জ্বলদর্চি

অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান-১৫/দিলীপ মহান্তী

অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান

দিলীপ মহান্তী

অন্তিম পর্ব 

‘অশোক মহান্তীর শ্রেষ্ঠ কবিতা’ গ্রন্থের ভূমিকায় সম্পাদক সৌমেন সাউ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন যা অশোক মহান্তীর কবিতা ভুবনে প্রবেশ করার বিশেষ দিক নির্দেশক হতে পারে। যদিও গ্রন্থটি কয়েক দিন আগে প্রকাশিত হয়েছে তবুও এই কাজ খুবই জরুরি ছিল। সম্পাদক বলেছেন: ' এক গভীর নির্জনতার ভেতর মৃদু ও মর্মভেদী উচ্চারণে গড়ে ওঠে তাঁর কবিতার সুঠাম অবয়ব। যা জীবনকে ছুঁয়ে থেকেও জীবনকে নিয়ে যায় অন্য কোথাও। সমস্ত কথার শেষে শব্দ যেখানে এসে থামে সেখান থেকে এক শেষ হীন যাত্রার আয়োজন শেষ করে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন কবি। তাঁর কবিতাকে দুচোখ ভরে দেখতে দেখতে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বিভোর হয়ে স্বপ্ন দেখা যায়। স্বপ্ন ছড়িয়ে দেওয়ার বিস্তৃত প্রান্তর খুঁজে পাওয়া যায়। আর তখন খুব কাছের মানুষ হিসেবে গা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন মানুষ অশোক মহান্তী। তাঁর কবিতা আবহমান জীবনের কবিতা। তাঁর কবিতা সুখ- দুঃখ- বিশ্বাস- বিশ্বাসভঙ্গ- বিস্ময়- বিস্তার ও বিষণ্ণতায় সংপৃক্ত।

   কবিতার জন্য আমৃত্যু রক্তক্ষরণ করেছেন কবি। বৈভব তাঁর খুব কাছে থাকা সত্ত্বেও তাঁকে তিনি গ্রহণ করেননি। অভিমান আছে কিন্তু কোথাও কোনো খেদ নেই। যা পেয়েছেন তা গ্রহণ করেছেন। যা পাননি তা তাঁর নয় বলে ভেতর থেকে আরও ভেতরের দিকে চলে গেছেন। নিজেকে গুটিয়ে আবারও ছড়িয়ে দেওয়ার অভিনব কৌশলটি বরাবর তাঁর বেশ করায়ত্ত থেকেছে। তিনি তাঁর সমগ্র সত্তা দিয়ে একটি নিজস্ব পথ খনন করতে চেয়েছেন অহরহ।...


   জন্ম- মৃত্যু- জীবন তাঁর কবিতায় ঘুরে ঘুরে দরজা বন্ধ করেছে, খুলেছে। এক মুহূর্ত কোথাও থামা নেই তাদের। নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে আলাদা করে দেখার চোখই হল ভালোবাসার চোখ। আবেগ, স্মৃতি, গোপন বেদনা ও একাকিত্বের সঙ্গে অভিজ্ঞতালব্ধ সুখ তাঁর কবিতায় শুধু রহস‍্যগহনতার ভেতর শেষ হয়নি, মুহূর্ত উন্মোচনের সঙ্গে এক অনিঃশেষ আবেগ চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। তিনি প্রকৃতির অসীম সৌন্দর্য ও অন্তহীন বিস্তারের ভেতর জীবনের বিচিত্ররূপ প্রত‍্যক্ষ করেছেন এবং অতি সহজ, সরল ও অকপট উচ্চারণে আমাদের অন্তর্গত আমিটিকে লাল-হলুদে রাঙিয়ে তুলেছেন। যা বিনাশী হয়েও অবিনাশী। নশ্বর হয়েও অবিনশ্বর। আর এখানেই তাঁর সার্থকতা। গোটা বিশ্বই তাঁর স্বদেশ। তিনি সবকিছু তুচ্ছ করে শুধু শিশুর সারল‍্য নিয়ে নিখাদ কবিতার দিকে বারবার ফিরতে চেয়েছেন। তাঁর সর্বগ্রাসী ব‍্যাপকতা ও বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সমকালীন কবিদের সঙ্গে মেলে না। জীবনের চারপাশে যা কিছু দেখা যায়, তা তিনি খুঁটিয়ে দেখেছেন, যা কিছু দেখা যায় না, তাও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন বলেই  তিনি এত স্বতন্ত্র।
   এই বিশ্ব- প্রকৃতির রূপ- রস- গন্ধের ভেতর তিনি খুঁজে পেয়েছেন একপ্রকার মুক্তির স্বাদ। তাঁর বেঁচে থাকার প্রবল আকুতি ও বিস্ময় সকলের সমীহ আদায় করে নিয়েছে। যুথবদ্ধ কাব্য-আন্দোলন থেকে সর্বক্ষণ দূরে থেকেছেন। তবে তাঁর  মননে ও অনুধ‍্যানে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ভাবীকালের ভাবনা যা ছাপিয়ে ওঠে সমকালীন বৈশিষ্ট্যকে। সত্যিই তিনি এক বিরল সময়ের বিরল কবি, এক পরম বিস্ময়। তাঁর কাব্য দৃষ্টি চিরশাশ্বত, আনন্দাশ্রয়ী এবং মাঙ্গলিক। প্রাকৃতিক রহস্য ও জাগতিক রহস‍্যের মুখোমুখি তাঁর জীবনরহস্য-সন্ধানী দুটি উজ্জ্বল বিস্ময়ভরা চোখের সম্মুখে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। তখন অনেক ক্লান্তি, সংশয়, ক্ষয়, না-পাওয়া ও পেয়ে হারানোর মধ্যে কেন জানি না নিজের মতো করে একেবারে নতুন করে এই বিশ্বসংসারকে ভালোবাসার সাধ জাগে।' – এই কথাগুলি একশো ভাগ সত্যি। আর এই কথাগুলি জেনে অশোক মহান্তীর কবিতা পড়লে বুকের ভেতরে দপ্ করে আলো জ্বলে ওঠে:

   ‘আজকাল, সবাই সবাইকে খুব ধোঁকা দিচ্ছে।

   এ-ওকে বলেই যাচ্ছে, সাবাস্ – সাবাস্
   আমি একা, ঘুরপথে হাঁটি।

   ঘুরে-ঘুরে যেখানে দাঁড়াই, সেখানে বয়স, স্রোত, কালোঘূর্ণি
   মধ্যবিত্ত জীবন-যাপন, সেখানে অস্থিরচিত্ত
   আরও একজন কেউ থাকে।

   তাকে কী বোঝাবো? তাকে কীভাবে বোঝাবো, কোনো
   অর্থ নেই যশ-প্রতিষ্ঠার, কোনো ধারা নেই, কীভাবে দাঁড়াতে হয়
   কোনখানে, কার কাছে গিয়ে।

   ভেতরে আগুন জ্বলছে। ধোঁয়া আসছে চোখ ভেদ করে
   এবার হাওয়ায় লুটোপুটি।

   আকাশের টুঁটি
   দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলেছি হে ধ্বংস করো মুঠি

   পারো যদি আমাকে ভেজাও।

   যত ভিজি, তত ঝরি, ঝরে ঝরে পড়েছি ধুলায়।
      ( প্রতিষ্ঠা: মাটির মন )


  একথা বলাও অত্যন্ত জরুরি যে, অনেক দিন ধরে বয়ে চলা অন‍্যায়ের ধারাবাহিকতায়, বহু অকবির চেষ্টায় বহু ধান্দাবাজের অপচেষ্টায় ও অশুভ ষড়যন্ত্রে বাংলা সাহিত্যে এক অদ্ভুত প্রতিষ্ঠান- কেন্দ্রিকতা তৈরি হয়েছে। বলা যেতে পারে কলকাতা-কেন্দ্রিকতা তৈরি হয়েছে। সেই সমস্ত ধূর্ত কবিদের মাথায় তেল দেওয়াই অদীক্ষিত পাঠকদের একমাত্র কাজ। সেই বৃত্তের বাইরের অনেক গভীর উচ্চারণ-  অনেক প্রকৃত কবি আড়ালে থেকে যান শুধু সেই বৃত্ত থেকে দূরে থাকার কারণে বা সেই পথে পা না দেওয়ার অনিচ্ছায়। যাবতীয় ভন্ডামি, যাবতীয় বাচালতা, যাবতীয় অগভীরতাকে সঙ্গী করে একদল কবি প্রচুর হাততালি পাচ্ছেন সময়ের এই মুষল পর্বে। যেখানে যাবতীয় প্রলোভনকে অস্বীকার করে অশোক মহান্তীর মতো প্রকৃত কবি প্রচারের আলোর বাইরে অন্ধকারে বসে কবিতা রচনার মগ্ন তপস্যায় রত ছিলেন। সেটাই ছিল তাঁর কাছে স্বর্গ। তিনি কখনো মাথা নিচু করেন নি। আত্মসম্মান নষ্ট হতে দেননি। তিনি শুধু শব্দের তপস্যার মাধ্যমে দেখতে চাইছিলেন গূঢ় গভীর জীবনকে, জীবনের বিস্তারকে। কবিতার ঈশ্বরকে। গাইতে চাইছিলেন ঈশ্বরের গান। আর অন্ধকার সরাতে চেয়েছেন শব্দের প্রদীপ জ্বেলে। বহু মমতায় আর বেদনায় তিনি নীরবে এই শিল্পচর্চা করেছেন। বেঁচে থাকার মুহূর্তে সময় তার মূল্য দেয়নি। পরিশীলিত রুচির এই কবি ঈষৎ ভেজা কন্ঠ স্বরে তাঁর অবস্থান জানিয়েছেন। জীবিকার প্রতি সৎ থেকে ছড়িয়েছেন অতৃপ্তির বিষাদ ও আলোর প্রত‍্যাশা :
 
১.   'দিন যায়। কবিতা লেখা হয় না।
        জীবিকার পাশে এক অত‍্যল্প আলোয়, মাছি ওড়ে, বর্ষাকাল ওড়ে।
        আমি দেখি টিভির পর্দায় ভাসে শ‍্যামলকান্তির মুখ
        শঙ্খ ঘোষ, নীরেনের মুখ, আর হাজার মাইল দূরে কোনো এক
        পাহাড় ডিঙিয়ে আশা আলো।

   এই আলো কার মুখে পড়েছিলো? যেদিন বসন্ত এসে বনে
   ফুটিয়ে দিয়েছে ফুল,ঝরাপাতাগুলি সব উড়ন্ত হাওয়ায়
   বন থেকে কিছু দূরে শুকনো নদীর তট বেয়ে বেয়ে
   ধুলো ও বাতাসে মাখামাখি। তারপর এগোতে এগোতে
   সেই কাঁচের জানালা, নীল পাখি, সেই মাটির মূর্তির মত
   সুঠাম দাঁড়িয়ে থাকা কালো চুল।

   বেণীটি পিঠের থেকে আরো নিচে কোমর অবধি
   যেন মাধ্যাকর্ষণের টানে টানে প্রান্তরের ঘাস ছুঁয়ে থেমে যায়।

   সেদিনের সেই চোখ আজ মৃত মাছের মতন, নাকি
   পাহাড় ডিঙিয়ে আসা অফুরন্ত আলো, ভাবতে ভাবতে
   পনেরো বছর আমি তার দিকে তাকিয়ে রয়েছি।
   পাশেই জীবিকা, কুঁজ, রক্তমাখা কাপড়-চোপড়, আর পরিশ্রমী
   মানুষের হাতে সোনার শিমুলগাছ,
   হায় কবি, কোথায় তাকাবে?

   দিন যায়। কবিতা-লেখার দিন, জ্বরে পুড়ে আরোগ্যের দিন
   তবু কবিতা আসেনা কিছুতেই।'
            ( নষ্ট দিন: মাটির মন)

২.  ' আমার নিজের কবিতা সম্পর্কে কিছু বলুন আপনারা।
   
    আপনারা, যাঁরা কবিতা পড়েন, কবিতা লেখেন, কবিতা ভালোবাসেন, আর ৮০ বছরেও
    যাঁরা কবিতার জন্য চেতনার রক্তবমন করে যাচ্ছেন আমি তাঁদের মুখ থেকে শুনতে চাই
    কবিতা কি, কবিতা কেন, কাদের জন্যই বা কবিতা লেখা হয়।

    আপনারা খুব উদার না হলে অন্যের প্রশংসা করতে পারবেন না জানি।
    অন্ততঃ এও জেনেছি আপনাদের মধ্যে কেউ সেরকম উদার নেই। একজন পরে,
    সে আমার চেয়ে এবং আপনাদের চেয়েও ছোটো এক তরুণ কবি।

    আর নিজেকেই নিজে আমি প্রশংসা করি। আমার কবিতার পাঠক আমি নিজেই।

    এই জগৎ কি আর কোনো জগতের জন্য অপেক্ষা করে? এই আকাশের পরেও কি
    আর কোনো আকাশের অস্তিত্ব আছে মনে হয়? ফুল যা ফুটে উঠবার ছিলো
    তা ফুটে উঠলেই গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে বহুদূর বহুদূর থেকে ছুটে আসে
    গন্ধলোভী অলি, গন্ধোভোজী বাতাস, আর পোকার আক্রমণ।

    প্রতিটি কবিতার বই প্রকাশের আগেই আমি বুঝে নিয়েছি কী তার ভবিষ্যৎ
    কী তার আগাগোড়া, কী তার ছন্দ, স্পন্দন, অথবা চাতুর্য।
    আর বুঝে নিয়েছি এই গঙ্গাহৃদি বাংলায়,এই জম্বুদ্বীপে,এই সর্বংসহায়।
    কারা কোথায় কবিতা লিখতেন,কী রয়ে গেছে সেই কবিতার সত্যে,আজও,নিরবধিকাল

    কতদিন সময় লাগে একটি কবিতার পুরোনো হয়ে যেতে?
    একটি কবিতার চির নতুন হয়ে ওঠার জন্য কতবার জন্মগ্রহণ করতে হয় একজন কবিকে?
    বারবার পড়ার পরও আমি নিজে আমার কবিতার রহস্য বুঝিনা
    শুধু মিলিয়ে নিতে চেয়েছি অন্যদের সঙ্গে, অনেক কবিতা ও অকবিতার সঙ্গে।

         আজ যদি আপনারা চিৎকার করে ওঠেন কী জানি সন্দেহ জাগবে হয়তো
         আর যদি নীরব থেকে যান, ভাববো, এসবই গভীর ঈর্ষা ও চক্রান্ত আপনাদের
         বলুন, কী করবেন এরকম অবস্থায়?

         আর, আমিই বা কী করতে পারি একটি কবিতা লেখা হয়ে যাওয়ার পর?
                ( সমালোচক : মাটির মন)

     একথা তো ঠিক তাঁর কবিতা পড়ে সেই সময়কার সমালোচকরা অর্থাৎ ক্ষমতাশালীরা বেশিরভাগই নীরব ছিলেন। সেটাকে আমরা তাঁর কথা মতো ঈর্ষা বা ষড়যন্ত্র বলেই ধরে নেবো। একদল শহুরে মানুষ তাঁকে উপেক্ষা করেছেন। ভয় পেয়েছিলেন তাঁর ক্ষমতায়। তাই তাঁকে বসিয়ে দেওয়া বা থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টার পদ্ধতিই উপেক্ষা। সেটা তিনি জানতেন। তাই বার বার অভিমান করেছেন আর নীরবে কবিতা লিখেছেন। কবিতার মাধ্যমে আগুন ছড়িয়েছেন : 

    ' আমার কবিতা যদি আপনার না ভালো লাগে কী করার আছে'
     এই কথা বলে সেই চক্ষুষ্মান চলে গেল অন্ধের সমাজে
     যে- তারা আগুন চেনে, জল চেনে, টক- মিষ্টি ফল
     এবং চিনেছে শীত, হেমন্ত ও গ্রীষ্ম ঋতু, শীতরাতে গরম কম্বল

     অক্ষর চেনেনা শুধু, অক্ষরের শব্দ চেনে, অক্ষর আলাপ
     তাদের সম্মুখে বসে সে এখন আগুনের পরিবর্তে লিখে রাখে সাপ
     অন্ধীর আঁতুড়- ঘরে জাতকের নামপত্রে লিখে রেখে পলাশলোচন
     এবার সে ফিরে আসে, বস্তু জগতের কাছে, সেই তার নন্দন কানন। 
            ( প্রতীক : মাটির মন )

'কবিতীর্থ' পত্রিকার সম্পাদক উৎপল ভট্টাচার্য অশোক মহান্তীকে একটি চিঠিতে লিখেছেন : 
স্বজনেষু, 
আপনার কবিতা পেয়েছি। কবিতাগুলো ভালো লেগেছে। বেশ কিছুকাল ধরে অনেক উৎকৃষ্ট কবিতা লিখে চলেছেন আপনি। কিন্তু সেই মতন প্রচার কিংবা প্রসার দেখছি না এটাই আক্ষেপ। অথচ কবিতার জগতে যে কত কিছু ঘটছে। সবই দেখছি। আমার তো কোনও সামর্থ্য নেই। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই।
যাক সুযোগ পেলে পরে কোনও সংখ্যাতে কবিতাগুলো ছাপার ইচ্ছে রইলো। যা আমার ক্ষমতা ও সামর্থ্যের মধ্যে। ...
                                                                                প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানবেন
                                                                                       উৎপল ভট্টাচার্য

        তিনি অমরত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু সমকাল তাঁকে উপেক্ষা করেছিল, যদিও কলকাতার কিছু গুণমুগ্ধ পাঠক তাঁর ছিল। যাঁরা সেই সময় বিখ্যাত। তাঁরা জানতেন অশোক তাঁদের কাছে যাবেন না, তাই তাঁরাই বার বার ছুটে আসতেন ঝাড়গ্রামে -  অশোকের টানে। শিবনারায়ণ রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়, কালীকৃষ্ণ গুহ, রণজিৎ দাশ প্রমুখ আরো অনেকে। নামের তালিকা অনেক লম্বা হবে। ২.৪.৯৮ সালে লেখা রণজিৎ দাশের একটি চিঠি গুরুত্বপূর্ণ : 
প্রিয় অশোক
আপনার নতুন কবিতার বইটি পেয়েছি। বইটি খুবই ভালো লেগেছে। অনুভূতি এবং সহানুভূতির যুগল গভীরতা সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে বেশ কিছু কবিতায়, যারা মনকে ছুঁয়ে গেছে। বিশেষভাবে চমৎকৃত হয়েছি আপনার ' কুরুক্ষেত্রের শ্বেতপত্র' কবিতাগুচ্ছ পড়ে। এত ভালো ছন্দ এবং কাব‍্যভাষা আপনার আয়ত্তে, আপনি এই আঙ্গিকে কেন আরও বেশি লেখেন না ভেবে অবাক হয়েছি। এই লেখাগুলি অবশ্য এই বইতে বেমানান হয়েছে। এই সিরিজে আরো বেশ কিছু কবিতা নিয়ে একটি স্বতন্ত্র কাব‍্যগ্রন্থ হলে খুব ভালো হয়।
মাঝে মাঝেই আমার ঝাড়গ্রাম যাবার ইচ্ছা হয়। কিন্তু আপনি ব‍্যস্ত মানুষ এই ভেবে পিছিয়ে যাই। তবে আপনার এই বইটি সেলিব্রেট করতে আমাকে ঝাড়গ্রাম যেতেই হবে।...
আপনার স্ত্রী এবং পুত্রকে আমার প্রীতি। আপনি ভালোবাসা জানবেন।
                                                                                  রণজিৎ দাশ

    আমাদের মনে আছে ব্লেকের কথা, উইলিয়াম কার্লোজ উইলিয়ামের কথা, গীয়ম আপোলেনীয়ারের কথা, সেজার ভালেখার কথা, জীবনানন্দ দাশের কথা - যাঁরা সমকালের কোলাহলে চাপা পড়ে গিয়েছিলেন কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম যা়ঁদের নতুনভাবে আবিষ্কার করেছিল, মাথায় তুলে নেচেছিল। এখনো নাচছে। অশোক মহান্তীর ক্ষেত্রে একথা সমান প্রযোজ্য। সেই কাজ শুরু হয়ে গেছে।
তিনি নিজেও তা জানতেন। এজন্যই অমরত্বের প্রত‍্যাশী ছিলেন। লিখেছিলেন : 

  'তা থেকে অনেক সোজা, সরাসরি যাও তার কাছে
   বুকের হীরক জলে যেখানে পাথরে আলো নাচে, 
   প্রশ্ন করো : সে কি চায়? যশ- অর্থ - ক্ষমতা - প্রতাপ
   প্রাণের প্রকৃত শান্তি - অমরত্ব - বৌদ্ধিক সংলাপ - 

   কুড়ি বছরের পর, মন বলে আশ্চর্য উচ্ছ্বাসে
   সমস্ত মৃতের মুখ কবিতায় ঘন হয়ে আসে।'
          ( কবিতার কুড়ি বছর : ঘাস রঙয়ের আকাশ)

 অমরত্ব চেয়েছেন বলেই কীটস অনুসরণে লিখেছেন : 
   একজন শুয়েছে এখানে
   জলে যার নাম লেখা ছিলো
   একজন ঘুমায় এখানে
   ঘুম যাকে অমরত্ব দিলো।
         ( কবি কীটস : ঘাস রঙয়ের আকাশ)

এজন্যই তাঁর মৃত্যুর পরের কবিতা তিনি মৃত্যুর অনেক আগেই লিখেছেন : 
   গলায় নক্ষত্রের মালা পরে দাঁড়িয়ে আছি।
   পায়ের নূপুর এই ঘাস।

   আর জলস্রোত ছিন্নভিন্ন ভেসে যাচ্ছে হাওয়ায় হাওয়ায়
   আমি তাকে ডাক দিচ্ছি।

   বস্তুত মৃত্যুর পরে এই হবে আমার কবিতা।
         ( মৃত্যুর পরের কবিতা : মাটির মন)
                 ( সমাপ্ত )

ঋণ স্বীকার: যাঁদের উৎসাহ, সহযোগিতা, ভালোবাসা, নিরন্তর তাগাদা ছাড়া এই লেখা কখনোই লিখতে পারতাম না, তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কেউ সব সময় পাশে থেকে উৎসাহ দিয়েছেন, কেউ বার বার মনে করিয়ে সঠিক সময়ে লিখিয়ে নিয়েছেন। কেউ কবির কোনো কবিতা পাঠিয়ে সাহায্য করেছেন, কেউ পাঠিয়েছেন তাঁর কিছু দুষ্প্রাপ্য ছবি। এঁরা সবাই আমার অত্যন্ত কাছের মানুষ: শম্পা মহান্তী, নির্মাণ মহান্তী, উত্তম মহান্তী, গৌতম মহান্তী, স্বস্তিকা মহান্তী, দয়াময় বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রিয়ব্রত গোস্বামী এবং ঋত্বিক ত্রিপাঠী।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments