জ্বলদর্চি

খর্জুর বীথির ধারে- ২/মলয় সরকার

খর্জুর বীথির ধারে

মলয় সরকার

(২য় পর্ব )দ্বিতীয় পর্ব


রিয়াধ বেশ ফর্সা, লম্বা, চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা, শক্ত পোক্ত অথচ ভদ্র গোছের চেহারার মানুষ।ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরাজী বলে, তবে বেশ বোঝা যায়। নিজেই কথা বলে। অর্থাৎ, কথা বলতে যে খুব অসুবিধা হবে না, তা বুঝলাম।

গাড়িতে উঠেই সে কথা বলতে বলতে চলল, আজ প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, আপনারাও ক্লান্ত। আজ হোটেলে বিশ্রাম করুন। কাল সকাল থেকে আমাদের যাত্রা আরম্ভ।

প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে এমন সময় গাড়ী গিয়ে থামল আম্মান ম্যারিওট হোটেলের সামনে। এই সব পাঁচতারা হোটেলের উপর আমি খুব বিরক্ত। এদের কেতা কানুন, রঙ ঢং , টিপস এসব বেশি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে অনেক অসুবিধা হয়, যা আমি এর আগে অনেক বড় বড় জায়গায় অনেকবার পেয়েছি। সে জন্য আমার নিজের মনে হয়, এর থেকে কম মানের তিন তারা হোটেল ভাল। 

যাই হোক, রিয়াধ নামার সময় হাতে একটা মোবাইল ফোন ধরিয়ে বলল, আপনারা যতদিন এখানে থাকবেন, এই ফোনে আমাকে যোগাযোগ করে নেবেন। কাল সকাল ঠিক ন’টার সময় আসব।নীচে থাকব। আপনারা রেডি হয়ে নেবেন।
অন্যান্য জায়গায় আমাকে নতুন জায়গার নতুন সিম নিতে হয়, এখানে সে ঝামেলাটা আর রইল না।

ও চলে গেল। 
আমরা ঢুকতে গিয়ে দেখি হোটেলের গেটের মুখে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। প্রথম দর্শনে চমকে ও থমকে গেলাম। এটা কি রকম ব্যাপার, সিকিউরিটির গেটের পাশে আগুন কেন? খেয়াল করে দেখি, ওটি সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য। আগুনটি বোধ হয় গ্যাসে চলছে, বদ্ধ জায়গায়, অনেকটা আমাদের রাজঘাটে গান্ধী সমাধিতে যেমন আছে তেমন।

যাই হোক, প্রাথমিক টেবিলের কাজকর্ম সেরে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিলাম। 

আমরা তৈরী পরদিন সকালে।  ঠিক সময়ে দেখি, রিয়াধও হাজির, ফোনে জানাল। আমাদের এক মুখ হেসে তাজা গোলাপের মত ‘ফ্রেস’ স্বাগত জানিয়ে গাড়িতে তুলল রিয়াধ।  উঠেই বলে দিল, গাড়িতে প্রচুর জলের বোতল আছে, যত খুশী জল খাবেন।আর একটা কথা, আমার গাড়িতে ওয়াইফাই আছে।আপনারা যেখানে খুশী ফোন করতে পারবেন।

 আমাদের এই সব ব্যবস্থা গুলো খুব ভাল লাগল। সত্যি কথা বলতে , আমি এর আগে একটা গাড়ীতেও ‘ওয়াইফাই’ দেখি নি । বাড়িতে দেখেছি। অনেক পরে আমাদের দেশে ট্রেনে, বা বাসেও হয়েছে শুনেছি।
যাক, খুব ভাল হল। আজকের গন্তব্য, মাউন্ট নেবো। মাঝে পড়বে মাডাবা, এ ছাড়া আছে Shobak Castle ইত্যাদি।

চলেছি রাস্তা দিয়ে।মাঝে ধূ ধূ মরুভূমির মত রাস্তা।মরুভূমির বুক চিরে একেবারে পরিপাটি চুলের মাঝে সুন্দর কাটা সিঁথির মত পথ দিয়ে চলেছি।সমস্ত বাড়ী, যা দেখা যাচ্ছে, কোন বিশেষ রঙ নেই।কেমন সাদাটে ধূসর রঙের পাথর দিয়ে তৈরী, আর বাড়ী গুলোর কোন বৈচিত্র্য নেই। শুধু একেবারে চৌকো বাক্সের মত পরপর সাজানো রয়েছে।ইউরোপের বাড়িগুলোর একটা সৌন্দর্য্য আছে, অনেক জায়গাতেই। হয় প্রাচীনত্বের ছাপ, নয়ত আকৃতি বা রঙের কিছু বিশেষত্ব। এখানে তা নয়, ঘরেরও কোন রঙ নেই সব একই রঙ, এর গঠনেরও কোন বৈচিত্র্য নেই।অনেক ফাঁকা ফাঁকা জায়গা। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ধূ ধূ ফাঁকা।

জর্ডন খুব ছোট জায়গা। মানচিত্রে অনেক ছোট। কিন্তু তার গুরুত্বটা অনেক বেশী। এখানে সেই তুলনায় লোকসংখ্যাও যে খুব বেশি তা নয়, মাত্র ১১৫ জন এক বর্গ কি মি তে। 

রায়েধ বেশ কথা বলে। চুপচাপ থাকা ওর স্বভাব  নয়। ও প্রথমেই বলে নিল, আপনাকে ‘স্যর’ বলব কিন্তু মিসেস কে ‘সিস্টার’ বলব। আমি বললাম, বল, আপত্তি কি।  ও বলল,না- আসলে আমার একটাই দিদি ছিল, যাকে আমি খুব ভাল বাসতাম। কিন্তু সে দিদি ছোটবেলায় মারা গিয়েছিল। এজন্য আমার সিস্টারের প্রতি একটা আলাদা দুর্বলতা মাখা ভালবাসা আছে। আমার, মিসেসকে দেখে ‘সিস্টার’ ডাকতে ইচ্ছা হয়েছে। 

শুনে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। আমি ভাবছিলাম, এক ভগ্নীহারার গোপন মনোবেদনার কথা। মানুষের অন্তরতম কোণের কথা তো আমরা জানতে পাই না। সেখানে কত দুঃখ, কত গোপন ব্যথা জমা হয়ে থাকে, যা একটু টোকা দিলেই বেরিয়ে আসে, আমরা নিজেরাই জানি না। আজ  সুদূর বিদেশে এসে এক ভিন্ন ভাষা ভাষী , ভিন্ন ধর্মী মানুষ, সব ভুলে শুধু তার অন্তরের দুর্বলতম স্থানটিকে প্রাধান্য দিয়ে  আমাদের আপন করে নিচ্ছে যা তার দৈনন্দিন রুজি রোজগারের  থেকে অনেক দূরে।এবং সেটি প্রথম পরিচতির মুখেই।আমাদের মধ্যে ও কি দেখেছে জানি না। আমিও তো বেরিয়েছি এই মানুষের মনের গুপ্তধনের সন্ধানে।এই সমস্ত পরশপাথরই তো আমার সঞ্চয়।
এই সমস্ত টুকরো ছবিগুলোই জমা হয়ে থাকে মনের কোণে।আসলে, মন একটা বড় চালুনী। যেটি ধরে রাখবার সেটি ঠিক রেখে দেয় আবার কত বড় বড় অপ্রয়োজনীয় কথা ঝেড়ে ফেলে দেয়।

এগোচ্ছিলাম Madaba Al Gharbi Street দিয়ে । যেতে যেতে এক জায়গায় দেখলাম , দূরে অনেক ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। আর একটা ছোট পাহাড় কাটা হচ্ছে। সেই পাহাড়ের পাথরের টুকরো নিয়ে যাচ্ছে ট্রাকের পর ট্রাক। পাথর গুলির রঙ ঐ সাদাটে ধূসর রঙের। আমি সেদিকে রায়েধের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। ও বলল, ওগুলো ফসফেট ফার্টিলাইজার।

 আমি বইতে ব্যাপারটা পড়েছিলাম। দেখি নি কখনও।সেটাও দেখলাম আশ্চর্য হয়ে।এখানকার মাটি পাথরে আছে ফসফেট । সেই ফসফেট সার হিসাবে প্রচণ্ড কাজে লাগে। সেগুলিই চলে যাচ্ছে, ফ্যাক্টরী হয়ে নানা দেশে। এখানে এই ফসফেটের বড় বড় ফ্যাক্টরী আছে ।সেটি এই দেশের এক বিশাল বড় রপ্তানী যোগ্য সামগ্রী। হিসাব করে দেখা গেছে, দেশের মাটির প্রায় ৬০ ভাগ ফসফেটে তৈরী। কাজেই এরা দেশের মাটি পাথরই বিক্রী করছে।একটা ব্যাপার! এত সার এখানে, অথচ এখানে এত মরুভূমি। সৃষ্টিকর্তার কি অদ্ভূত লীলা। যত দেখি আর ভাবি,আশ্চর্য হই।

অনেকে আগে মাদাবা যায়, পরে নেবোতে। আমরা আগে গেলাম মাউন্ট নেবো। পাহাড়ে ওঠার সময় দেখি শুকনো লাল রঙের এক পাথরের পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে ঘুরে ঘুরে ওঠার রাস্তাটি বেশ সুন্দর লাগল। অনেকটা আমাদের দেশের জুলুক যাওয়ার রাস্তার পাহাড়ের মত।এখানে আগে খুব ভিড় হত না, কিন্তু সম্প্রতি খুব পর্যটকরা যাচ্ছেন। জায়গাটি অনেকটা পরিত্যক্ত জায়গার মত বেশ কিছুটা জনহীন। এটি একটি পাহাড়ের উপরে। প্রায় ৭০০ মিটার উঁচু পাহাড়ের উপরে এই জায়গা । এটি আবারিম পর্বতমালার একটি অংশ।দূর থেকে এটি একটি শুকনো বৃক্ষহীন উঁচু পাথরের ঢিবির মত লাগে। আসলে, ২০০০ খ্রীষ্টাব্দে পোপ জন পল  এটি পরিদর্শন করার পর থেকে মাদাবার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। পরে ২০০৯ সালে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টও এখানে আসেন। এখানে দ্রষ্টব্য যে অনেক আছে তা নয় , তবে এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ যে,  ইহুদী ধর্মগুরু মোজেস  জীবনের শেষ দিনগুলোতে এখানেই থাকতেন এবং এখান থেকেই দূরের খ্রীষ্টিয়ানদের ঈপ্সিত পূণ্যভূমি জেরুজালেমের দিকে দেখিয়েছিলেন। কিন্তু জীবদ্দশায় তিনি সেখানে যেতে পারেন নি। তিনি এখানেই মারা যান।বলা হয় তাঁর সমাধি আছে এখানেই। তবে সঠিক সমাধির জায়গা কোথায় আছে সেটি সঠিক জানা যায় নি। বাইবেলে এবং ইতিহাসে মোজেসের অনেক অলৌকিক ক্ষমতার কথা বলা আছে।

এখানে আছে একটি চার্চ। যেটি বাইজান্টাইন যুগ থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।এই চার্চটি ১৯৩৮ সালে মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করা হয়। চার্চটি চতুর্থ শতাব্দীতে তৈরী হয়েছিল। এটি ১৯৮৪ সালে  বেশ কিছু সংস্কার করা হয়।পরে ২০০৭ সালে এটি সম্পূর্ণ ভাবে তৈরী করা হয়। এই চার্চে রয়েছে সেই যুগের বেশ কিছু বাইজান্টাইন ধরণের মোজাইকের  কাজ। তবে চার্চটি যে খুব একটা বিশাল দর্শনীয়, এমন নয়। ভিতরে কিছু মোজাইকের কাজ ও ছবিও রয়েছে। খুব বেশি সাজানো গোছানোও নয়।এই অঞ্চল যে মোজাইকের কাজের জন্য প্রাচীন যুগ থেকেই বিখ্যাত ছিল তা বোঝাই যায়। এখানে ঢোকার মুখে একটি বেশ বড় পাথর দাঁড় করানো রয়েছে যার গায়ে এখানকার সম্বন্ধে খোদাই রয়েছে। চার্চের দেওয়ালে , মেঝেতেও মোজাইকের কাজ রয়েছে।যীশুখৃষ্টের ক্রুশের দ্যোতক একটি জড়ানো সর্পস্তম্ভও রয়েছে। এটি নাকি ইটালিয়ান শিল্পী গিওভানি ফান্তোনি (Giovanni Fantoni) তৈরী করেছিলেন।

আমাদের এখানে ছেড়ে দিয়ে রায়েধ বলেছিল, আপনারা দেখুন, আমি গাড়িতে আছি। হয়ে গেলে চলে আসবেন। আমি বুঝলাম, ও কেমন গাইড! আসলে এই সব সাধারণ অশিক্ষিত মানুষগুলোর তো এত ইতিহাসের জ্ঞান নেই।সব জানি ভাবটা যতটা, আসলে ততটা নয়। যাক গে’ মানুষটা ভাল মনে হচ্ছে, এটাই ভাল। 

এখান থেকে দূরে দেখা যাচ্ছে জেরুজালেম। পাহাড়ের মাথা থেকে দূরে চারিদিকের দৃশ্য বেশ সুন্দর। ডেড সী ও এখান থেকে দেখা যায়।

এখানে একটি পাথর রয়েছে, যেটি এক পাথরে তৈরী একটি বিরাট চাকার মত। এটি নাকি কোনও এক সময় এখানে চার্চের দরজা হিসাবে ব্যবহৃত হত। কিন্তু কি করে যে তা হত, আমার সন্দেহ রয়েই গেল।বুলবুল বলল, এটাতে কোন ফুটোও নেই , কব্জা লাগানোর জায়গা নেই, এটা দরজা কি করে হতে পারে? তাছাড়া পাথরটা এতই বড় মোটা আর ভারী, যে দরজা হিসাবে ব্যবহার করাও মুস্কিল।আমি বললাম, তাই তো ভাবছি। তবে ইতিহাস সব সময়েই, কিছু অনুমান, কিছু সত্যি, কিছু উদ্দেশ্যমূলক ভাবনা, এসব দিয়েই হয়। আজ যা বলা হচ্ছে তাকেই মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
তবে একটা কথা ঠিক যে, একটা পাথর থেকে নিটোল এত বড় গোল চাকার আকৃতিতে তৈরীর পিছনে যথেষ্ট দক্ষতা নিশ্চয়ই আছে। এরকম এর একটি পাথর আমি দেখেছিলাম অবশ্য, তুরস্কের মাটির নীচের পাথর কাটা শহর কায়মাকলি তে । সেখানে যে কি করে গোলাকৃতি পাথরটা লাগানো আছে, যা একটা দরজার কাজ করছে, তা আজও বিজ্ঞানীরা বোঝেন নি।

এর পরে চলুন যাব পরের পর্বে–

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

2 Comments

  1. ভাগ্যিস tag করেন নইলে এতো সুন্দর লেখা পড়াই হ'ত না । --অলোক ।

    ReplyDelete
  2. অসাধারণ বর্ণনা। ভালো লাগছে পড়তে
    পরের বর্ণার অপেক্ষায় থাকলাম।

    ReplyDelete