জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব - ২৬
উই ছাতু
সূর্যকান্ত মাহাতো
এ যেন হিমালয়ের ঠিক ক্ষুদ্র রূপ। আছে হিমালয়ের মতোই উঁচু উঁচু শৃঙ্গ। তবে হিমালয়ের মতো শক্ত ও ভরাট নয়। একেবারে নরম। আদুরে। অনেকটা আবার ঝুরঝুরেও। আছে অজস্র চোরা কুঠুরি। বায়ু চলাচলের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অসংখ্য রন্ধ্র পথ। কারণ ওখানে একজন রাজা থাকেন। একজন রাণীও থাকেন। আর থাকেন তাদের হাজারো সৈন্য সামন্ত। কাঠ, মাটি, শুকনো পাতাকে মুখের লালা রসে ভিজিয়ে ভিজিয়ে হিমালয় সদৃশ এই রাজ্য ও রাজপ্রাসাদ ওরা গড়ে তোলে।
কিংবা এক টুকরো দুবাইয়ের বাড়িগুলোর সঙ্গেও তুলনা করা যেতে পারে। সেখানকার সুউচ্চ ইমারতগুলো যেমন আকাশে মুখ তুলে থাকে, জঙ্গলমহলে শাল গাছের পাদদেশেও তেমনি সেগুলো মুখ তুলে আছে। গগনচুম্বী ইমারতগুলোর মতোই আকাশ পানে তাকিয়ে আছে। দুবাইয়ের বাড়িগুলোকে মানুষ আধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে গড়ে তুলেছে। কিন্তু জঙ্গলমহলের গম্বুজাকার এই বাড়িগুলো কেবলমাত্র মুখের লালা রস মিশিয়ে মাটিকে কাদামাটি বানিয়ে নির্মিত হয়েছে। তফাত কেবল এটুকুই।
ঠিক ধরেছেন। উইপোকা ও উই ঢিবির কথাই এতক্ষণ বলছিলাম। উইপোকা। ওরা অন্ধ। ওরা চোখে দেখতে পায় না। সূর্যের আলো তো ওরা একেবারেই সহ্য করতে পারে না। তাই এমন আলোহীন বদ্ধ বাড়ি বানায়। সেখানে খোলা জানালা নেই। বরং ভিতরের কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের জন্য অজস্র বায়ুপথ আছে। সে কারণেই এমন বদ্ধ বাড়িতে ওরা সহজেই বসবাস করতে পারে। জঙ্গলমহলে এই উইপোকার বাসা বা উইপোকার ঢিবিগুলোকে অনেকে "টিলা" বলেও ডাকে। অনেকটা লাল তামাটে রঙের হয় এই টিলাগুলো।
যদি ধরেই নিই হিমালয়, তাহলে তার পর্বত শৃঙ্গের শ্বেত শুভ্র বরফের দৃশ্য প্রথমেই চোখে পড়ে। সেখানে সূর্যের আলো পড়ে সেই শুভ্র বরফের হীরক দ্যুতি যেন বহুলাংশে বেড়ে যায়। জঙ্গলমহলে বর্ষার শুরুতে কিছু কিছু উইঢিবিগুলোও তেমনি। শৃঙ্গভাগটা শ্বেতশুভ্র হয়ে ওঠে। সকালের নরম আলোয় তখন তার শোভা অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে উঠে। অনেকসময় শরীরের অন্য অংশেও যেভাবে গজিয়ে উঠে, দেখে মনে হবে সাদা সাদা বরফের গুচ্ছ যেন লেপ্টে আছে। তবে বরফ নয় ওগুলো হল "উই ছাতু"।
আবার যদি দুবাইয়ের গগনচুম্বী বাড়ি গুলোর মতো মনে করা হয় তাহলেও বেশ মিল পাই। সে বাড়িগুলোর মাথায় যেমন অজস্র সাদা সাদা টুনি বাল্ব জ্বলে ওঠে। জঙ্গলমহলের উইঢিবিগুলোও ঠিক তেমন। অজস্র প্রস্ফুটিত উই ছাতুর দ্যুতি সেই টুনি বাল্বকেও হার মানায়। সকালের নরম আলো মেখে অসাধারণ শোভা বৃদ্ধি করে।
হ্যাঁ "উইছাতু"-র কথাই বলছি। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম-Termitomyces microcarpus(টারমিটমাইসিস মাইক্রোকারপাস)। একে উই ছাতু বাদেও আরও অন্যান্য কএকরি নামে ডাকা হয়। যেমন "টিলা ছাতু", "মেকা ছাতু" বলেও ডাকা হয়। উইয়ের বাসাকে এখানকার মানুষ "মেকা" বলেও ডাকে। শুধু তাই নয় অনেকে একে ছোট বালি ছাতু বলেও ডাকে। আসলে বালির উপর হলেও তার নিচে উইপোকার বাসার কোনও না কোনও একটা বাসা থাকেবেই। তবেই এই ধরনের ছাতুগুলো তৈরি হয়।
উইয়ের ঢিবিগুলোতে কীভাবে এই ছাতু গড়ে ওঠে? আসলে কয়েক হাজার উইপোকা এই ঢিবিগুলোতে বসবাস করে। তাদের বিষ্ঠা এই ঢিবিগুলোর গায়ে জমতে থাকে। এরপর বর্ষায় বৃষ্টির জল পেলেই তখন ছাতু তৈরি হওয়ার একটা উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে ওঠে। বিষ্ঠা, জল ও মাটির সংমিশ্রণে গজিয়ে ওঠে এই ছাতুগুলো। প্রথমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শ্বেত শুভ্র ছাতুর ডিম তৈরি হয়। এরপর সেই ডিমগুলো একটু একটু করে বাড়তে থাকে। আসলে এগুলো ডিম নয়। ছাতুগুলোর একেবারে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়। তারপর বাড়তে বাড়তে একসময় কড়ি হয়ে ফুটে ওঠে। কড়ির সময় মাথাটা দেখতে অনেকটা টুপির মতো হয়। তবে এই ডিম থেকে কড়ি হয়ে ফুটতে একদিনের বেশি সময় লাগে না। ডিমগুলো দেখলে মনে হবে যেন হাজারো মুক্তোর বিন্দু কোন এক দেওয়ালে থরে থরে সুসজ্জিত ভাবে বসানো আছে।
ডিমগুলো ক্রমশ বড় হতে থাকে। একটু একটু করে গজিয়ে ওঠে একটা শিক বা ডাঁটা বা দন্ড। তখন অনেকটা আলপিনের মতো দেখায়। মাথাটা পিনের আকার থেকে ধীরে ধীরে গোল হয়ে বড় হতে শুরু করে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন উই এর ঢিবিগুলোতে ছাতুগুলো পিনের মত গাথা হয়ে হয়ে আছে। এদের শরীর খুবই নরম হয়। একটু চাপেই ভেঙে পড়ে। নয় তো পিষে যায়। ফোটা অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকে না। খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়।
আরও সহজ ভাবে বললে বলা যায়, এর আকার হল একটি ছাতার একেবারে ক্ষুদ্রতম রূপ। উপর ভাগটা বেশ মসৃণ হয়। তবে ভেতরের অংশটা দারুণ। মেয়েদের শাড়ির ভাঁজ করা কুচির মতো অসংখ্য খাঁজ কাটা কাটা। ফোটা অংশটা আবার অনেক সময় পাপড়ির মতো স্তবকেও অনেক সময় ভাগ হয়ে যায়।
এবার আসি এই ছাতুর স্বাদের কথায়। এর স্বাদের কথা বলার আগে একটা প্রচলিত প্রবাদের কথা বরং শোনা যাক----
মাছের মধ্যে রুই
শাকের মধ্যে পুই
এবং ছাতুর মধ্যে উই
প্রচলিত এই প্রবাদের কথা থেকে সহজেই আন্দাজ করা যায় যে উই ছাতুর স্বাদ ঠিক কেমন হতে পারে। রুই মাছ ও পুঁইশাক যেমন স্বাদে ও গন্ধে অসাধারণ খেতে। ঠিক তেমনি এই ছাতু। স্বাদে একেবারে অতুলনীয়। আসলে ছাতুর এই স্বাদের আসল রহস্যটা লুকিয়ে আছে তার রন্ধন প্রণালীর উপর। অন্যান্য ছাতুর মতো একটু পিচ্ছিল ভাব তো একটা আছেই। সেটা বরং এই ছাতুর স্বাদকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
এই ছাতু তুলে বা কুড়িয়ে এনে প্রথাগতভাবে রান্না করা যায় না। ছাতুর ডাঁটার মাটি লেগে থাকা অংশটা ভালো করে হাতের দুই আঙুলে কেটে দিতে হয়। ছাতুগুলোর আকার খুবই ছোট হওয়ায় পরিষ্কার করে বাছতে দীর্ঘ সময় লাগে। তাই অনেক বেশি ধৈর্য নিয়ে একাজ করতে হয়। ছাতু এত বেশি নরম যে স্বাভাবিক ভাবে রান্না করতে গেলে এর অস্তিত্বই তেমন একটা থাকে না। এ ছাতু রান্নার সর্বশ্রেষ্ঠ দুটি পদ্ধতি হল "বাটিপোড়া" এবং "পাতাপোড়া"। এই দুটো রান্নাতেই গুঁড়ো মশলা নয়, বরং গোটা মশলা ব্যবহার করা হয়। গোটা জিরে, গোটা হলুদ, কাঁচা লঙ্কা ভালো করে শিলে বেঁটে সরষের তেল মাখিয়ে "বাটিপোড়া" করে খেলে এর স্বাদ অসম্ভব রকমের বৃদ্ধি পায়। ঠিক একইভাবে মশলা মাখিয়ে "পাতাপোড়া" করে খেলেও এর স্বাদ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। শালপাতার মতো যেকোনও পাতায় পোড়ালে সেই পাতার একটা সুন্দর ফ্লেভার ছাতুর সঙ্গে মিশে যায়। তখন তো এর স্বাদ আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
এবার এর পুষ্টি গুণের কথা একটু বলা যাক। এই ছাতু যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিগুণেও ভরপুর। এই ধরনের ছাতুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিজ্জ প্রোটিন। সাধারণত নিরামিষভোজীদের কাছে যা খুবই উপকারী। সেইসঙ্গে খনিজ পদার্থ ও একাধিক ভিটামিন তো আছেই। আছে ক্যালসিয়াম সহ অন্যান্য খাদ্য গুণাগুণ।
এই ছাতু কুড়িয়ে এনে বেশিক্ষণ রাখা যায় না। তাই বাজারে এই ছাতু সহজে বিক্রী করতে দেখা যায় না।
এই ছাতু কেবল মানুষেই খায় না। যাদের কারণে এই ছাতুর জন্ম সেই উই পোকাদেরও অত্যন্ত প্রিয় খাবার। সব ছাতু কুড়ানো সম্ভব নয়। তাই অবশিষ্ট ছাতুগুলো তখন ওদেরই প্রাপ্য। এছাড়াও যেগুলো মানুষের চোখের আড়ালে রয়ে যায় সেগুলো তো পুরোটাই ওদের।
এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। লক্ষ্মীর মায়ের সেবার খুব অভিমান হয়েছিল। ওর নিজের মরদের সঙ্গে। তরকারি নিয়ে খুব খোঁটা দিচ্ছিল স্বামী। কিন্তু লক্ষ্মীর মা পাবেই বা কোথায়? তাকে যা এনে দিবে, সে তো তাই রান্না করে খাওয়াবে! কিন্তু কে শোনে সে কথা। তাই লক্ষ্মীর মায়ের সেদিন থেকে খুব অভিমান হয়েছিল। একদিন পর স্বামী মাংস কিনে এনে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু লক্ষ্মীর মা পাত্তা দেয়নি। মাংস ওভাবেই পড়েছিল। স্বামী কয়েকটা খারাপ খারাপ কথা বলে তখন বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল।
এদিকে তারপর থেকেই লক্ষ্মীর মায়ের একটু একটু করে অনুশোচনা হতে লাগল। ভাবল, এতটা বাড়াবাড়ি না করলেও হত। বেচারা খাবে বলে কত শখ করে মাংস কিনে এনেছিল! একমাত্র তার জন্যই খেতে পেল না। সেদিন রাত্রিতে লক্ষ্মীর মায়ের আদর মাখা হাতটাও এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়েছিল ওর স্বামী। কী আর করবে! একবুক কষ্ট নিয়েই পাশ ফিরে শুয়েছিল লক্ষ্মীর মা।
পরদিন সকালে ছাগলের দড়ি আনতে গিয়েই চোখে পড়েছিল টিলা ভর্তি ছাতু। এমন দৃশ্য দেখেই খুশিতে নেচে উঠল। যত্ন করে তুলে এনেছিল বাড়িতে। তুলতে তুলতে ভাবছিল, উই ছাতুর "বাটিপোড়া" পেলে তার স্বামীর আর কোনও রাগ অভিমান থাকবে না। কারণ ও যে এই ছাতু খেতে ভীষণই ভালোবাসে।
হলও তাই। উই ছাতুর তরকারি পেয়ে স্বামীর সব মান অভিমান কেটে গেল।
উই ছাতুর এই মরসুমে জঙ্গলমহলের প্রতিটি পরিবারেই এমন কত খুশি ও আবেগ যে ছড়িয়ে থাকে তা বলে বোঝানো যাবে না। সেটাই বা কম কী!
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
0 Comments