জ্বলদর্চি

'বল মেথড' : (এক ক্ষণজন্মা বিজ্ঞান-সাধিকা মিস অ্যালিস অগাস্টা বল-এর জীবনের অজানা কাহিনী)/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৬৫

পর্ব ― ৬৫

'বল মেথড' : 
(এক ক্ষণজন্মা বিজ্ঞান-সাধিকা মিস অ্যালিস অগাস্টা বল-এর জীবনের অজানা কাহিনী)

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসীদের একটি নামকরা দৈনিক নিউজ পেপার 'দ্য কালার্ড সিটিজেন' (The Colored Citizen)। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রো-আমেরিকানদের সুখ-দুঃখ প্রকাশের প্রথম দলিল ছিল পত্রিকাটি। এ হেন জনপ্রিয় নিউজ পেপারের ততোধিক জনপ্রিয় এডিটর ছিলেন জেমস প্রেসলি বল। তিনি একাধারে নিউজপেপার এডিটর, ফটোগ্রাফার আর আইনজীবী। তাঁর সুযোগ্য অর্ধাঙ্গিনী মিসেস লরা লুইস বলও পেশায় একজন চিত্র-সংগ্রাহক। বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে বংশ পরম্পরায় ফটোগ্রাফি বল-পরিবারের পেশা ও নেশা। সিনিয়র জেমস বল একজন নামজাদা ফটোগ্রাফার ছিলেন। ধাতব পাতের উপর ছবি প্রিন্টিং-এ সুনামের সঙ্গে দারুণ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তিনি। এ কাজে রীতিমতো এক্সপার্ট।

সিলভার প্লেটের উপর পারদবাষ্প আর আয়োডিন মৌল পদার্থের সক্রিয়তা কাজে লাগিয়ে সুন্দর ছবি প্রকাশ করতে সিদ্ধহস্ত। শুধু ফটোগ্রাফি নয়, জুনিয়র জেমস বল আর তাঁর স্ত্রী শ্রীমতি লরা বল 'আফ্রিকান-আমেরিকান কম্যুনিটি'-এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। কমিটির সম্মাননীয় সদস্য আর আইনজীবী হওয়ার সুবাদে কালো চামড়ার মানুষ বল-দম্পতির বার্থ-সার্টিফিকেটে জ্বলজ্বল করছিল 'শ্বেতাঙ্গ' লেখাটি। সেজন্য শ্বেতাঙ্গ সমাজে তাদের অবাধ যাতায়াত-মেলামেশা স্বীকৃত ছিল। এ হেন বল-দম্পতির চার-চারজন সন্তান-সন্ততি। দুজন ছেলে আর দুজন মেয়ে। দুজন ছেলের বড় উইলিয়াম ও মেজো রবার্ট। মেয়েদের মধ্যে বড় তথা সেজো অ্যালিস আর ছোট অ্যাডি।

মধ্যবিত্ত পরিবারটির বাস ওয়াশিংটনের সিটল-এ। চার ছেলেমেয়ের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী অবশ্য তৃতীয় জন ― কন্যা অ্যালিস বল। জন্ম ১৮৯২ সালের চব্বিশে জুলাই। বাল্যকাল থেকে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে তুখোড় সে। তাঁর মেধার রত্নখচিত দ্যুতি ক্রমশ ঝলমলিয়ে ওঠে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজের দোরগোড়ায়। যদিও বিংশ শতকের ভোর লগ্নে আমেরিকায় কালো চামড়ার মানুষের প্রতি এক তীব্র বিদ্বেষ, পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ তথা রেসিজম মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে আমেরিকার ভঙ্গুর সমাজে। শয়ে শয়ে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী রাস্তাঘাটে, বাসে-ট্রেনে, অফিস-আদালতে হেনস্থার স্বীকার। এ হেন জাতি-বিদ্বেষ মেধাবী কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে-ছোকরার শিক্ষালাভের পথে অন্তরায়। কিন্তু অ্যালিস-এর মেয়েবেলা বেশ স্বচ্ছন্দে কাটে। কারণ বাবা-মায়ের জন্মের প্রমাণপত্রে ওই 'শ্বেতাঙ্গ' শব্দবন্ধের উপস্থিতি। শ্বেতাঙ্গ সমাজে তার যাতায়াত সুনিশ্চিত করে। 

অ্যালিস-এর ঠাকুর্দা সিনিয়র জেমস বল তখন খুব অসুস্থ। আর্থ্রাইটিস-এর সমস্যায় কাবু। ঠাণ্ডা বাড়লে আর্থ্রাইটিস-এর প্রকোপ বাড়ে। অসহনীয় লাগে তখন। সেটা ১৯০৩ সালের ঘটনা। অ্যালিস-এর বাবা-মা স্থির করল― সিটল ছেড়ে হনুলুলু পাড়ি দেবে পুরো ফ্যামিলি। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। সেবছর শীত পড়ার আগেই গোটা পরিবার আরও দক্ষিণে পাড়ি দিল। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে হনুলুলু'র আবহাওয়া অধিকতর গরম। পরিবেশের উষ্ণতা হয়তোবা খানিক স্বস্তি এনে দেবে বৃদ্ধ মানুষটিকে। আশায় মরে চাষা! শেষমেশ হনুলুলু পাড়ি দেয় তারা। তাদের সে আশায় অবশ্য গুড়েবালি! হনুলুলু আসার অল্প ক'দিন পর বৃদ্ধের অকস্মাৎ দেহাবসান ঘটে। ছোট্ট অ্যালিস তখন বারো বছরের কিশোরী। 
         
এ হেন শোক সন্তপ্ত পরিবারটি বয়োজ্যেষ্ঠের মৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাদের সমস্ত পরিশ্রম-পরিকল্পনা পণ্ডশ্রম হয়ে যায়। ১৯০৪ সালে সারা বছর হনুলুলু'তে অতিবাহিত করে তারা। শোক ভুলে পুনরায় ১৯০৫-এ সিটল-এ ফিরে আসে পুরো ফ্যামিলি। পুরনো জায়গায় ফিরে এসে কিশোরী অ্যালিস-এর ব্যস্ততা বহুগুণ বেড়ে গেল। স্থানীয় সিটল হাইস্কুলে ভর্তি করা হল তাকে। পড়াশুনায় সে বরাবরই অত্যন্ত ভালো। প্রিয় বিষয় অবশ্যই বিজ্ঞান। মাধ্যমিক সে-স্কুলে বিজ্ঞানের বিষয়গুলিতে নজরকাড়া ফলাফল তাঁর। সায়েন্সে হামেশাই টপ গ্রেড সুনিশ্চিত করে সে। ১৯১০ সালের ঘটনা। সেবছর সিটল হাইস্কুল থেকে ভালো গ্রেড সমেত গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি পায়। রসায়ন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। কেমিস্ট্রি নিয়ে উচ্চতর পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া মনস্থির করে সে। এর অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি ডাবল গ্র্যাজুয়েশন। ১৯১২ সালে ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রিতে ব্যাচেলরস ডিগ্রি এবং ১৯১৪ সালে ফার্মাসি বিজ্ঞানে ডাবল ব্যাচেলরস ডিগ্রি তাঁর সাফল্যের মুকুটে যুক্ত হল। দ্বৈত-গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর তাঁর গন্তব্য ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি। লক্ষ্য ফার্মাসিতে উচ্চ ডিগ্রি লাভ। সেজন্য ওয়াশিংটন পাড়ি দিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মাসি বিভাগে পরামর্শদাতা তথা গাইড ড. উইলিয়াম ডেন-এর সংস্পর্শে আসেন। ড. ডেন-এর সঙ্গে ফার্মাসি বিষয়ে একটি দশ পাতার আর্টিকেল প্রকাশ পায় আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি পরিচালিত জার্নালে। জার্নালে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ছিল― ইথার দ্রবণে বেনজোইলেশন (Benzoylation in Ether Solution)। সেসময় আমেরিকার ওই নামকরা জার্নালে এক কৃষ্ণাঙ্গ নারীর প্রবন্ধ প্রকাশের ঘটনা রীতিমত ঈর্ষণীয়। বেশ গর্বেরও বটে! যদিও আর্টিকেল ছাপার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি তাঁর বিজয় রথের ঘোড়া। কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায় সম্বল করে উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে তাঁর গবেষণায়। 

সেজন্য গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিটের পর তাঁর কাছে উচ্চ শিক্ষার দ্বার হাট করে খুলে গেল আকস্মিক। গ্র্যাজুয়েটে ভালো রেজাল্টের সুবাদে মিলে গেল একগুচ্ছ স্কলারশিপ। বেশ কিছু কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির দারুণ অফার এল।  শেষমেশ তাঁর পছন্দের দুটি প্রতিষ্ঠান বার্কলেতে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি আর হাওয়াই কলেজ (অধুনা হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়)-এর অফার গ্রহণীয় মনে হল তাঁর। দিনের শেষে হাওয়াই কলেজ বেছে নেওয়া তাঁর প্রথম পছন্দ। রসায়নের মাস্টার ডিগ্রিতে অনায়াসে ভর্তির অভাবনীয় সুযোগ পেয়ে গেল হাওয়াই কলেজে। কাভা প্ল্যান্ট স্পেসিসের রাসায়নিক গুণাগুণ সংবলিত গবেষণায় ঠাসা ছিল তাঁর মাস্টার ডিগ্রির থিসিস। এ হেন থিসিসের সৌজন্যে হাওয়াই কলেজ থেকে মিলল এম. এসসি. (M. Sc.) ডিগ্রি। সেটা ১৯১৫ সাল। এর আগে কোনও মহিলা হাওয়াই কলেজ থেকে এম. এসসি. (M. Sc.) হয়নি। ১৯১৫ সালে হাওয়াই কলেজের প্রথম গ্র্যাজুয়েট নারী তথা প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা তিনি।
         
কেমিস্ট্রিতে এম. এসসি. (M. Sc.) ডিগ্রি লাভের অব্যাহতি পরে হাওয়াই কলেজের রসায়ন বিভাগে প্রথম আফ্রো-আমেরিকান 'রিসার্চ কেমিস্ট ও ইনট্রাক্টর' হিসাবে কাজে যোগ দিলেন তিনি। কাভা গাছের রাসায়নিক সক্রিয়তা নিয়ে নতুন করে তাঁর পথচলা শুরু। এসময় হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের কালিহি হাসপাতালের ডাক্তার মিস্টার হ্যারি হলম্যান সদ্য যৌবন উত্তীর্ণ কুমারী অ্যালিস-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ড. হলম্যান একজন উপযুক্ত সহকারী খুঁজছিলেন, যে তাকে কুষ্ঠ রোগ নিরাময় গবেষণায় সাহায্য করবে। 

কুষ্ঠ রুগীরা কি সমাজে দুচোখের বিষ? বিংশ শতাব্দীর প্রথম দু"দশক পর্যন্ত অন্তত তেমনটাই মনে করা হত। কারণ কুষ্ঠ আক্রান্ত মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত। কোনও চিকিৎসা নেই। আবিষ্কার হয়নি ওষুধ। সেজন্য সমাজ-সংসার থেকে, পরিবার-পরিজন থেকে দূরে একান্তে মৃত্যুর দিন গোনা ছাড়া অন্য গত্যন্তর নেই তাদের। চিকিৎসার ন্যূনতম পরিসেবা অমিল। কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত মানুষজনকে সেসময় হাওয়াই-এর মোলোকাই দ্বীপপুঞ্জে স্থানান্তরিত করে দেওয়া হত। এ হেন দ্বীপান্তর মৃত্যু পরোয়ানার নামান্তর মাত্র! কুষ্ঠ রুগীতে যেন মোলোকাই দ্বীপপুঞ্জে উপচে পড়ছে। দীর্ঘ সাতশ বছর ধরে চালমুগরা তেল দিয়ে কুষ্ঠ রোগ প্রতিকারের চেষ্টা চলছে বটে। তবে তা লোকের মন ভোলানো ব্যাপার স্যাপার বই অন্য কিছু নয়। কারণ রোগ নিরাময়ের প্রাচীন এই পদ্ধতিটি একেবারে ফলপ্রসূ নয়। ফলে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে রুগীর মৃত্যু অবধারিত। 
            
কুমারী অ্যালিস-এর তখন নামমাত্র বয়স। সদ্য তেইশ পেরনো তরতাজা এক তরুণী। তিনি একটা টেকনিক আবিষ্কার করে বসলেন। বিভিন্ন জৈব কিংবা অজৈব অ্যাসিড থেকে প্রস্তুত করলেন 'এস্টার' নামক এক রাসায়নিক যৌগ পদার্থ। এস্টার জাতীয় সরলীকৃত ওই যৌগ পদার্থকে সহজেই মানব শরীরে প্রবেশ করানো যায়। আর, একবার এ হেন এস্টার মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে কুষ্ঠ রুগীর শরীরে অনেক অসাধ্য সাধন ঘটে। অভূতপূর্ব শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। রোগ থেকে, নিশ্চিত মৃত্যুর ছোবল থেকে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে কুষ্ঠ রুগী। হাতে গরম ফল মিলল ওষুধের প্রয়োগে। এ যেন সোনার চাঁদ হাতে পাওয়ার সামিল! অভাবনীয় সাফল্য। অথচ নিয়তির কী পরিহাস! সাফল্যের এ বিশাল ঈর্ষণীয় খতিয়ান প্রবন্ধ আকারে কোনও জার্নালে প্রকাশ পেল না। গবেষণা লব্ধ দস্তাবেজগুলি আবিষ্কারকের গোপন খাতায় বন্দি হয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে পড়ে রইল বহুদিন।

কি এমন ঘটল যে আর্টিকেল আকারে প্রকাশ পেল না তাঁর গবেষণা? নিয়তির চরম অভিশাপ নেমে এল কুমারী অ্যালিস-এর উপর। অভিশপ্ত সে-দিনটা ছিল ৩১ ডিসেম্বর ১৯১৬ সাল। সেবার ডিসেম্বরের হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় মৃত্যুলোকে পাড়ি জমান তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র চব্বিশ বছর। ক'দিন আগে রিসার্চের সময় হঠাৎ অসুস্থ বোধ করেন তিনি। শরীর এত খারাপ হল যে নিরুপায় হয়ে কয়েক মাসের জন্য অসুস্থ শরীরে অ্যালিস দেশবাড়ি সিটল-এ চলে আসেন নিজের চিকিৎসার প্রয়োজনে। তারপর আর তাঁর ফেরা হল না নিজ কর্মক্ষেত্রে। অকালে ঝরে গেল তাঁর প্রাণের স্পন্দন। চোখে নেমে এল চিরঘুম। অথচ, আজও তাঁর মৃত্যুর কারণ পুরো রহস্যে মোড়া। কেউ বলেন ― গবেষণায় ব্যবহৃত বিষাক্ত ক্লোরিন বাষ্প তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী। আবার কারও মতে ― টিউবারকিউলোসিস-এ আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। পুরোটাই ধোঁয়াশা! তাঁর মৃত্যুর সঠিক কারণ আজও অজ্ঞাত। যেমন অজ্ঞাত থেকে গেল শেষ সময়ে করা তাঁর গবেষণার রেজাল্ট। ছাপার অক্ষরে প্রকাশের আলো দেখল না তাঁর আর্টিকেল।

ইতিমধ্যে, ১৯২০ সালে একটা মজার ঘটনা ঘটল। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো অবাক করা সে-ঘটনা! আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নালে ফলাও করে ছাপা হল হাওয়াই-এ কর্মরত এক ফিজিসিয়ানের রিপোর্ট। রিপোর্টে প্রকাশ― মিরাকল! হাওয়াই-এর কালিহি হাসপাতাল থেকে ৭৮ জন কুষ্ঠ রুগী সম্পূর্ণ সুস্থ শরীরে বাড়ি ফিরে গেছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষকগণ ভালো মতো পরীক্ষা নিরীক্ষার পর অভিমত প্রকাশ করে বলেছেন― তাদের শরীরে কুষ্ঠ রোগের লেশমাত্র উপসর্গ আর নেই। এ যে অভাবনীয় খবর! অবিশ্বাস্য ব্যাপার! 

ইতিপূর্বে, ১৯১৯ সালে হাওয়াই কলেজের ডিন রসায়নবিদ ড. আর্থার এল. ডিন একটি আর্টিকেল প্রকাশ করলেন। শুধু প্রবন্ধ ছাপিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না তিনি। স্বল্পায়ু অ্যালিস-এর দেখানো পথে অধিক পরিমাণে এস্টার উৎপাদনে উৎসাহী হয়ে পড়লেন। এভাবে উৎপাদিত এস্টার কুষ্ঠ রুগীর শরীরে প্রয়োগ করলেন। তারপর যা ঘটল, তা এক কথায় মিরাকল! নজরকাড়া ফল মিলল। ধীরে ধীরে সুস্থ হতে শুরু করল কুষ্ঠ আক্রান্ত লোকজন। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে তারা সবাই বাড়ি ফিরে গেল। সবাই ধন্য ধন্য করল অধ্যাপক ড. আর্থার ডিন-এর এ হেন আবিষ্কারে। আরও এক ধাপ এগিয়ে অধ্যাপক ড. আর্থার ডিন এস্টার উৎপাদনের পদ্ধতিটির নাম রাখলেন 'দ্য ডিন মেথড'। তিনি নিজে পুরো কৃতিত্ব নিয়ে গেলেন। আর্টিকেলের ছত্রে ছত্রে কেবল তাঁর নিজের গুণগান; কোথাও কুমারী অ্যালিস-এর নাম পর্যন্ত উল্লেখ নেই! সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ ছন্দপতন ঘটল ১৯২২ সালের দোরগোড়ায় এসে। কী ব্যাপার! কী ঘটেছিল সেবছর? 
            
ক্ষণজন্মা অ্যালিস-এর মৃত্যুর পর ছয় বছর অতিক্রান্ত। নিস্তরঙ্গ ইথার তরঙ্গে হঠাৎ ঢেউ উঠল! ১৯২২-এ হাটে হাঁড়ি ভাঙলেন মিস্টার হলোম্যান। অ্যালিস-এর একসময়ের সহকর্মী ছিলেন মি. হলোম্যান। এস্টার নিস্কাশনে দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজ করেছিলেন তিনি এবং অ্যালিস। সেই কাজের সূত্রে তরুণী অ্যালিস-এর গবেষণার নাড়িনক্ষত্র তাঁর নখদর্পণে। বিভিন্ন জৈব ও অজৈব অ্যাসিড থেকে কীভাবে এস্টার উৎপাদন করেছিলেন অ্যালিস, সবকিছু তাঁর জানা।  হুবুহু সেই একই প্রক্রিয়া ব্যবহার করে অধ্যাপক ড. আর্থার ডিনও এস্টার তৈরি করলেন আর আর্টিকেল প্রকাশ করে তাঁর নাম দিয়ে দিলেন দ্য ডিন মেথড। প্রকৃত উদ্ভাবক রয়ে গেল লোকচক্ষুর আড়ালে। ঢাক ঢোল পিটিয়ে নাম-যশ নিয়ে গেল অন্য কেউ। আসল সত্য-রহস্য রইল পর্দার আড়ালে। এ অসম্ভব! বিবেকের দংশনে আক্রান্ত মি. হলোম্যান। তিনি কোনও মতে মানতে পারছেন না এ অন্যায়। তাঁর দৃঢ় সংকল্প― এস্টার নিষ্কাশনে অ্যালিস-এর কৃতিত্ব জনসমক্ষে তুলে ধরবেন তিনি। অ্যালিসকে পুরো কৃতিত্ব দিয়ে ছাপলেন একখানা আর্টিকেল। ১৯২২ সালে। সে-প্রবন্ধে অ্যালিস-এর উদ্ভাবিত কুষ্ঠ নিরাময় টেকনিকের নাম রাখলেন 'বল মেথড' (Ball Method)। পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা সকল অন্ধকার-ছলচাতুরি নিমেষে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। দিনের আলোয় স্পষ্ট প্রতিভাত হল আসল সত্য ঘটনা। গোটা বিশ্ব জানল কুষ্ঠ নিরাময়ে একজন কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীর ত্যাগ, নিষ্ঠা, অধ্যবসায় আর লড়াই-এর গল্প ও ফলাফল। 

ডিন মেথড আর বল মেথড-এর মধ্যে চুলচেরা তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে ড. হলোম্যান সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন ডিন মেথড। স্বীকৃতি পেল 'বল মেথড'। ড. হলোম্যান তাঁর আর্টিকেলে ডিন মেথডকে তুলোধুনো করে স্পষ্ট লিখলেন― 
'I can't see that there is any improvement whatsoever over the original technique as worked out by Miss Ball. The original method will allow any physician in any asylum for lepers in the world, with a little study, to isolate and use the ethyl esters of chaulmoogra fatty acids in treating his cases, while the complicated distillation in vacuo will require very delicate, and not always obtainable, apparatus.'

কুষ্ঠ রোগ নিরাময়ে ড. অ্যালিস বল-এর কৃতিত্ব আজকে সর্বজন স্বীকৃত। গোটা বিশ্বের মানুষ তাঁর অবদান নতমস্তকে স্মরণ করে। প্রতি চার বছর অন্তর ২৯শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে "অ্যালিস বল ডে" (Alice Ball Day) হিসাবে পালিত হয়। আগের দিন, অর্থাৎ ২৮শে ফেব্রুয়ারি দিনটি হাওয়াই ইউনিভার্সিটি তাদের ক্যাম্পাসে প্রতি বছর আলাদাভাবে "Alice Agusta Ball Day" পালন করে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments