জ্বলদর্চি

কুলো নামানো /ভাস্করব্রত পতি


পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব,  পর্ব -- ২৫

কুলো নামানো

ভাস্করব্রত পতি

'লক্ষ্মীছাড়া বছরের হয়ে গেল সায় / কুলোর বাতাস দিয়ে কর রে বিদায় ॥—ঈশ্বর গুপ্ত
বাঙালির লোক ঐতিহ্যে কুলো একটি অতি পরিচিত এবং অন্যতম কৃষিযন্ত্র। দৈনন্দিন পূজার্চনা সহ নানা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে কুলোর ব্যাবহার বহুলাংশে লক্ষ্য করা যায়। কোনো কিছুকে স্বাগত জানানো বা কারোর কাছে উপঢৌকন পৌঁছে দিতে এই কুলোই হয়ে ওঠে অন্যতম উপকরণ। তবে কখনো কখনো 'কুলোর বাতাস' হয়ে ওঠে বিদায়ের ঘন্টাধ্বনি। অলক্ষীকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদায় করার রেওয়াজ। ঈশ্বর গুপ্তের মতো 'একেই কি বলে সভ্যতা'তেও পাই 'কুলোর বাতাসের' অনুষঙ্গ -- 'তোর যেমন পোড়া কপাল, তাই হতভাগাকে রেখেছিস, আমি হলে এতদিনে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদায় কৰ্ত্তুম’।

যাঁরা ভাবেন 'কানে দিয়েছি তুলো, পিঠে বেঁধেছি কুলো', আমাদের ওসব জানার দরকার নেই। তাঁদের কাছে অনেক কিছুই অজানা থাকতে পারে। কখনো কখনো এই কুলোই সময়ে সময়ে হয়ে ওঠে 'ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো'। পরিবেশ বান্ধব এবং পরিবেশকেন্দ্রিক উপচারের ব্যবহৃত লৌকিক যন্ত্র। জলপাইগুড়ি এবং উত্তর দিনাজপুর জেলায় একটি বিশেষ লৌকিক উৎসব হল 'কুলো নামানো'। সেখানে এই কুলো প্রধান ভূমিকা নেয় বৃষ্টির কামনায় আয়োজিত উৎসবের অঙ্গ হিসেবে।

বৈশাখ জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড দাবদাহে ধরাতল যখন শুষ্ক হয়ে পড়ে তখন খেত খামার যেন জ্বলতে থাকে। পশু পাখিদেরও তখন লবেজান অবস্থা। এমতাবস্থায় এক ফোঁটা জলের জন্য চাতকের মতো তাকিয়ে থাকে সবাই। কিন্তু বৃষ্টির দেখা মেলেনা। এদিকে চাষের সময় আগতপ্রায়। তখন গ্রামবাংলার কৃষক পরিবারের মহিলারা চাষের জমিতে জলের তথা বৃষ্টির জন্য উদ্বেল হয়ে ওঠে। ছটপট করতে থাকে মনপ্রাণ। ঠিক এই সময় তাঁদের উৎসবে স্থান পায় 'কুলো নামানো'। তাঁদের বিশ্বাস গেরস্থের উঠোনে কুলো নামিয়ে রেখে প্রার্থনা করলে বৃষ্টি আসবেই। আর বৃষ্টি এলে চাষবাস হবে। ফসল ফলবে। মানুষ বাঁচবে।

উৎসবের শুরু হয় এভাবে। প্রথমে কোনো গেরস্থের উঠোনে একদল মহিলা আসে। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তির একটিই মেয়ে সেইসব মেয়েরাই এই উৎসবে অংশ নেয়। তাঁরা বাড়ির সামনে নিকোনো উঠোনে একটা কাঠের পিঁড়ির ওপর একটা কুলো নামিয়ে রাখে। ঐ কুলোর ওপর একটা পোড়া মাটির অথবা পেতলের ঘটির ঘটস্থাপন করা থাকে। জলপূর্ণ ঘটে থাকে আমসার। সেখানে কুলো নামানোর পর কুলোকে ঘিরে মেয়েদের পাশাপাশি মেয়েদের পেছনে ছেলেরাও নাচগান করে। এই গান আসলে দেবরাজ ইন্দ্রকে লক্ষ্য করেই করা হয়। তাঁর গুনগান করা হয়। আর এই ঘট রাখা কুলোতে রাখা থাকে ফুল, দূর্বা, ধানবীজ সহ নানা শষ্যবীজ।

এবার গেরস্থের বাড়ির সধবা কোনো মহিলা গলায় কাপড় জড়িয়ে একটি ঘটিতে করে জল নিয়ে এসে ঐ কুলোর সামনে মাটিতে রাখে। তখন নৃত্যগীত করা মহিলারা ঘটের থেকে জল নিয়ে ঐ উঠোনের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয় সকলের মঙ্গল কামনায়। আসলে বৃষ্টির কামনায়। বৃষ্টি হলে চাষ হবে। ফসল ফলবে। গেরস্থ বাঁচবে। ফের তাঁরা এ ঘট সহ কুলো উঠিয়ে নিয়ে পাশের গেরস্থের উঠোনে গিয়ে নামিয়ে রাখে। লোকসমাজে এই হারিয়ে যাওয়া উৎসবই 'কুলো নামানো' উৎসব।

উঠোনে কুলো নামিয়ে যে গান তাঁরা করেন সেরকম একটি গানের হদিস দিয়েছেন ছন্দা ঘোষাল। গানটি এরকম -- "হ্যাদে লো বুন মেঘারানী / হাত পা ধুইয়্যা ফ্যালাও পানি / ছোট ভুঁইতে চিনচিনানি / বড় ভুঁইতে হাঁটুপানি / মেঘারানীর ঘরখানি পাথরের মাঝে / হেই বৃষ্টি নামলো ঝাঁকে ঝাঁকে ঝাঁকে / কাল্যা মেঘ ধল্যা মেঘ বাড়ি আছনি / গোলায় আছে বীজ ধান বুনতে পারো নি / হ্যাদেরে কালামেঘ আস্য রে আস্য"।

গানটির ছত্রে ছত্রে কাল্যা মেঘকে আমন্ত্রন জানানোর প্রচেষ্টা। আমির খানের "লগান" সিনেমার সেই গানটি অনেকটাই এরকম -- "কালে মেঘা কালে মেঘা পানি তো বরষাও / বিজুরি কি তলবার নেহি বুঁদো কি বান চালাও / মেঘা ছায়ে বরখা লায়ে ...."। বৃষ্টির কামনায় ভূবন, ক্যাচরা, লখা, টিপু, গুরান, বাঘা, যশোদামনি, গৌরি, ঈশ্বর, দেব সিংদের কন্ঠে শোনা গিয়েছিল এ আর রহমানের এই গান। যা বহু প্রাচীন "কুলো নামানো" উৎসবের মাধ্যমে বৃষ্টির কামনায় গানের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে গিয়েছে।

দিন বদলের সাথে সাথে এ ধরনের প্রাচীন লৌকিক উৎসব আর গ্রামবাংলার দেখা যায়না। কিন্তু একটা সময় মানুষ অপারগ হয়েই এক ফোঁটা বৃষ্টির কামনায় দুয়ারে দুয়ারে কুলোয় করে জলভরা ঘট নিয়ে তা নামিয়ে রাখতো উঠোনে। তাঁদের বিশ্বাস এতে হয়তো মেঘারাণী সন্তুষ্ট হয়ে দ্রুত ধরাধামে নামিয়ে আনবে বৃষ্টির ধারা। হিন্দু মহিলাদের এই উৎসবের মতো মুসলিম মহিলারাও পালন করেন "কুলো ঘট ব্রত"। বাংলা প্রবাদের 'ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো' এই কুলো নয়। বৃষ্টির আনয়নে এই বাঁশের তৈরি কুলো গ্রামীন মহিলাদের বিশ্বাসের অন্যতম উপকরণ।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments