জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৮৮

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৮৮


সম্পাদকীয়,
আচ্ছা, তোমরা জানো কি রাজিয়া সুলতানা কে ছিলেন?  আচ্ছা এবার বলো টাইগার হিল কোথায় অবস্থিত? মহিষমর্দিনীর নাম শোনোনি? বাংলার বাঘ কে তো চেনো? টাইগার হিল কোথায় সেটাতো গল্পে গৌতম জেঠু নাহয় বলে দিলেন, কিন্তু শ্যামদেশ? হুঁ হুঁ বাবা,  পারবে কি করে এসব পারতে গেলে স্কুলে যেতে হয়। আর তোমরাতো কোভিডের পর থেকেই স্কুল ছুটির জন্য বাড়িতে বসে।  রাজিয়া সুলতানা দিল্লীর রানী ছিলেন। তিনি হাতি ঘোড়া চড়তেন।  কে বলল? কেন তৃষ্ণা আন্টি। মহিষমর্দিনী রূপে মা দুর্গার পুজো কবে হয় জানো? জৈষ্ঠ মাসে। তার কথা ছড়ায় লিখেছে প্রবাহনীল। আর বাংলার বাঘের কথা সবার জানা সত্ত্বেও আরো অজানা কথা জেনে নিও পীযূষ আঙ্কেলের লেখায়। কোভিড আর গুগুল তোমাদের এই জানার অভ্যাসটা নষ্ট করে দিচ্ছে। কোভিডের কান্ডকারখানার তো শেষ নেই। সে নিয়ে লিখেছেন সুনৃতা আন্টি। সবই হল কিন্তু শ্যামদেশ? শ্যামদেশের বেড়ানোর গল্প শুনতে এবারের ছোটোবেলা সমুদ্র পাড়ি দিল। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে চলো আমরা সবাই চলে যাই নতুন দেশের গল্প শুনতে জয়তী আন্টির সঙ্গে।   এদিকে আমাদের গ্রাম বাংলা শহর জঙ্গল পাহাড় জুড়ে বর্ষা এসে গেল। বর্ষার সবুজ বনানীর ছবি ঋপণ আঙ্কেল পাঠিয়েছে।  ছোটো বন্ধুরা ছবি এঁকেছে দেখ অবশ্যই। স্কুল খুললেই কিন্তু পরীক্ষা তাই তার আগে জেনে নাও সব প্রশ্নের উত্তর ছোটোবেলা পড়ে। --- মৌসুমী ঘোষ।


ধারাবাহিক উপন্যাস
জয়াবতীর  জয়যাত্রা
বিংশ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক

মেধো ডাকাত!
   
২৪
প্রথমে কথা ছিল তিনটে পালকিতে মেয়েরা আসবে আর সেনমশাই ঘোড়ায়। কিন্তু জয়াবতীর এক কথা, সে কবরেজি শিখছে, দুদিন পরেই পুরো কবরেজ হবে, পালকিতে গেলে তার নাকি মান থাকে না।তাহলে বাড়ি থেকে এত দূরে বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে থেকে, এত কষ্ট করে কবরেজি শেখা নাকি তার বেরথা যাবে। এমন পাকা পাকা কথা শুনে ঠাকমা, খুড়িমা তো বটেই, অমন যে জাঁদরেল সেনমশাই, তিনি অব্দি বাক্যিহারা। মেয়ের কথা শোনো! পালকি চড়লে নাকি তেনার মান যাবে। এত ঘাড়বেঁকা যে তাকে বোঝানোই গেল না, মেয়েমানুষ  এতখানি পথ সবার বুকের ওপর দিয়ে ঘোড়ায় চলে গেলে লোকে কী বলবে?
‘লোকে আবার কী বলবে? সারাবছর শূল পিত্ত কফে ভুগে কবরেজের দোরে এসে দাঁড়াতে হয় যাদের, তাদের আবার কথা! তবে শোন বলি খুড়িমা’
পুণ্যি ভাবল নির্ঘাত আবার কোন কথা বানিয়ে বলে শাস্ত্রের নামে চালাবে জয়াবতী। পুণ্যির মরা সোয়ামীর তর্পণের কথা নিজে সে মুখ ফুটে বলতে পারেনি লজ্জায়, সে কথা ঠাকমার মাধ্যমে সেনমশাইয়ের কানে পৌঁছে দিয়েছে এই দস্যি  মেয়ে জয়াবতীই। সেই ইস্তক পুণ্যি জয়ার কথায় আর আগের মতো ফঁস করে উঠতে পারেনা। পুণ্যিকে এবং খুড়িমা, ঠাকমা –সব্বাইকে অবাক করে দিয়ে জয়াবতী বলল ‘তোমরা বুঝি কেউ রাজিয়া সুলতানার নাম শোনোনি?’ রাজিয়া সুলতানা? সবাই সবার মুখ চায়।
‘দিল্লি বলে একটা জায়গা আছে, তা নিশ্চয় জানো?’
এতেও সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।
শুধু পেরজাপতি ফস করে বলে ওঠে ‘মোচলমান পাড়া গো ঠাকমা ওইসব দিল্লি মিল্লি’
জয়াবতী কটমট করে তাকায় তার দিকে। তারপর বলে ‘রাজিয়া সুলতানা ছিল দিল্লির রানি, দিল্লি কেন গোটা দেশেরই রানি। তা তিনি হাতি ঘোড়া কী না চড়েছেন বলো?’
এই অঞ্চলে ঘোড়া দেখলেও, হাতি কেউ দেখেনি কখনো। মনসাপোতার জমিদার বোসদের হাতি বাঁধা থাকত সিংহ দুয়ারে, শোনা কথা, তবে দেখেনি কেউ। কিন্তু বোস গিন্নি, তাঁকে সবাই বড় রানিমা বলত, তাঁকে দেখেছে খুড়িমা কালী মন্দিরে। এই বড় বড় চোখ, টানা নথ, আলতা রাঙা পা, নীলাম্বরী শাড়ি, পালকি থেকে যখন নামতেন, সবাই হাঁ করে দেখত, ভাবত দেবী দুর্গাই বুঝি নেমে এসেছেন মর্তে। রানি হবে এইরকম সবাই জানে। সেখানে ঘোড়ায়, হাতিতে চেপে রানি আসছে, ভাবতেই পিলে চমকে গেল সবার।
খুড়িমা হাসি চেপে বলল ‘তাহলে আমাদের এখন থেকে বলতে হবে রানি জয়াবতী, কেমন? ওরে সবাই মিলে বল জয় জয়াবতীর জয়।’
প্যাংলা পানু কোথায় ছিল কে জানে, ছুটে এসে বলল ‘জয় রানি জয়াবতীর জয়’
জয়াবতী অমনি তার মাথায় একটা চাঁটি মেরে বলল ‘ভাগ, আমি রানি হলে তোকে সেপাইও রাখা যাবে না, যা চেহারা। যাই হোক, আমি বলতে চাইছি, যে দেশে রানিরা ঘোড়ায় চড়ে, প্রজারাও চড়তে পারে’
‘মেয়েমানুষ আবার প্রজা !’
পেরজাপতি ছাড়া আর কে বলবে এমন?
কেন নয়? পুরুষমানুষ খায়, দায়, ঘুমোয়, কাজ করে, আমরাও করি। আর যা খাজনা দেওয়া হয়, তাতে মেয়েমানুষেরও অংশ আছে, যাক অত শক্ত কথা শুনে তোর লাভ নেই’
এমন কোমর বেঁধে তর্ক করল জয়াবতী যে সবাই বুঝে গেল সে ঘোড়ায় চড়েই যাবে। আর কোন দিকে আঁটতে না পেরে পুণ্যি একটা জামাই ঠকানো প্রশ্ন তুলল।
‘তুই ঘোড়ায় চড়লে শাড়ি পরবি কী করে? তর্পণ তো শাড়ি ছাড়া হবেই না’
‘কোন শাস্তরে লেখা আছে যে তর্পণ শাড়ি ছাড়া হবে না? মোচলমানদের শবে বরাত বলে একটা পরব আছে, জানিস তো? সেও এইরকম অনেকটা। চোদ্দ গুষ্টিকে জল দেওয়ার মতো। তারা কি সবসময় শাড়ি পরছে নাকি? তাছাড়া আমি খামোখা তর্পণ করতে যাব কোন দুকখে? আমার বাবা মা’ বলেই নিজেকে সামলে নিল জয়াবতী। নিজের বাপমাকে নিয়ে এমন কথা বলে নাকি কেউ?
পুণ্যি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল এই দেখে  যে গঙ্গাজল নিজেকে সামলে নিল। এত বকলে তো খারাপ কথাই বেরোবে মুখ দিয়ে। কিন্তু ওর মুখের কাছে দাঁড়ায় কার সাধ্যি। কিন্তু এ তো বড় আচ্চজ্জের কথা যে পুণ্যি সারাক্ষন দুলে দুলে পুঁথি মুখস্থ করে, সে কিছুই জানে না বাইরের খবর। কিন্তু পড়ার নামে সাপবাঘ হলেও জয়াবতী কত খবর রাখে দেশের। রাজিয়া সুলতানা, শবে বরাত! বাবা। ধন্যি মেয়ে যাহোক।
 
ধন্যি মেয়ে যে জয়াবতী , সে কথা সেনমশাইও স্বীকার করেন মনে মনে। তিনি এমনিতে গম্ভীর মানুষ, প্রয়োজনের বেশি কথা বলেন না, একমাত্র নিজের মা ছাড়া আর কেউ সাহস করে কথা বলে না তাঁর সঙ্গে। কিন্তু জয়াবতী অন্য ধাতু দিয়ে গড়া। সে মেয়েমহলে রাজিয়া সুলতানা দিয়ে যে গল্প ফেঁদেছিল, সেই গল্প দিব্যি বুক বাজিয়ে সেনমশাইয়ের কাছে গিয়ে শুনিয়ে এল। কোন ভয় ডর নেই। ভেতরে ভেতরে পুণ্যির মতোই প্রচণ্ড অবাক হলেন তিনি। একটা অনুচ্ছেদ মুখস্থ করতে দিলে অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমা গড়িয়ে যায়, তবু সে পাঠ দিয়ে উঠতে পারে না যে মেয়ে, সে এত সংবাদ জানে কোথা থেকে? আর মিথ্যা নয়, নির্ভুল তথ্য। তাহলে কি এ মেয়ে শ্রুতিধর, কানে যা আসছে, তাই সে আত্মস্থ করে নিচ্ছে, শুধু তাই না, সঠিক স্থানে প্রয়োগও করছে। দুর্গা পূজা আসন্ন, জয়ার পিতা দুর্গাগতি নিশ্চয় কন্যা দুটিকে নিয়ে যেতে চলনদার পাঠাবেন। সেনমশাই স্থির করলেন দুর্গাগতিকে একটি পত্র লিখবেন, এই কন্যাকে হঠকারিতা করে যেকোন পাত্রে দান করা যাবে না। দান? কন্যা কি বস্তু যে দান করা যায়? নাহ, সারাজীবন চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে থেকেছেন, সমাজের এই অন্ধকার দিকগুলো তাঁর চোখেই পড়েনি। তাছাড়া, সব কি পুথি পড়ে হয়? চোখে দেখতে হয়, বুক দিয়ে অনুভব করতে হয়। তিনি তাঁর পিতার একমাত্র সন্তান, পানুও তাঁর একটিমাত্র পুত্র। কন্যা এ বংশে হয় না। তাই কন্যাকে বড় করার পর পরের হাতে তুলে দেবার যে বেদনা তা তো তিনি বুকের মধ্যে কখনো অনুভব করেন নি। তাঁর হঠাৎ একটি আগমনী গান মনে পড়ল, প্রতি বছর এইসময় পাগল ঠাকুর দরজায় দরজায় এমন গান গেয়ে বেড়ায়। তার একটি গান মনে পড়ল এখন।
‘এবার আমার উমা এলে উমাকে আর পাঠাব না’
যাদের মেয়ে পরের ঘর করতে চলে যায়, তারাই এ ব্যথা অনুভব করতে পারে। কিন্তু, কিন্তু তাঁর মেয়ে না থাকুক, মা আছেন, স্ত্রী আছেন, মার বিয়ে হয়েছিল পাঁচ বছর বয়সে। আর স্ত্রী যখন আসে, তখন সে সাত বছরের বালিকা। কত খেলেছেন একসঙ্গে। সে মাঝে মাঝেই পুকুরপাড়ে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত। বিরক্ত হতেন তিনি। মেয়েগুলো কেন যে এমন ছিঁচকাঁদুনে হয়! আজ হঠাৎ মনে হল, সেই কান্না আসলে ফেলে আসা বাপ মা ভাই বোনের জন্যে, তাঁকে তো নিজের লোকজন ছেড়ে অন্য কারো ঘর করতে হয়নি। নাহ, কোথাও একটা বড় ভুল থেকে যাচ্ছে।এই সমাজ, দেশ, কাল, রাষ্ট্র যেভাবে চলছে, তার মধ্যে গড়ায় গলদ থেকে গেছে।
নিজের চিন্তার মধ্যে তলিয়ে গেছিলেন সেনমশাই, জয়াবতী  বলল ‘ও সেনমশাই বলি কি, ওদের আর ঘোড়ায় চড়ে কাজ নেই কো। যা ভীতু সব। ওরা সব পালকিতে যাক। আমি আপনি আর পানু ঘোড়ায় যাই’
মেয়ের কথা শুনে আরো আশ্চর্য হয়ে গেলেন সেনমশাই। অনুমতি নেবার ধারই ধারে না এ। যেন এ কথাটা স্থির হয়েই আছে, এইভাবে বলছে।এমন তার আত্মবিশ্বাস যে এতে রাজি হওয়া ছাড়া তাঁর আর উপায়ই নেই। তবু তিনি শেষ চেষ্টা করে দেখলেন।
‘ঘোড়ায় যেতে তো আপত্তি নেই, কিন্তু ফেরার সময় তো সন্ধে লেগে যাবে মা, আর তিনশূন্যির জঙ্গল পড়বে রাস্তায়, সেখানে তো মেধো ডাকাতের আস্তানা, পালকিতে মেয়েমানুষ লুকিয়ে থাকলে তবু একরকম। ঘোড়ায় বসা দেখলে...’ কথাটা অর্ধেক রেখে এমনভাবে শিউরে উঠলেন যে ভয়ের একটা শিহরণ শ্রোতার শরীরে চারিয়ে পড়াই প্রত্যাশিত। কিন্তু কোথায় কী। এ মেয়ে তো মেধো ডাকাতের নাম শুনে আহ্লাদে আটখানা। ‘সত্যি সেনমশাই? মেধো ডাকাত! কত নাম শুনেচি ছোটবেলায়।একবার দেখতে পেলে চক্ষু সার্থক হয়’ পানু এতক্ষণ এই ঘরে ছিল জয়াবতী  খেয়াল করেনি। ওর কথা শেষ না হতে হতে সে চিৎকার করতে করতে ঝড়ের বেগে  বেরিয়ে গেল ‘ও ঠাকমা, মেয়ের কথা শুনলে! মেধো ডাকাতকে দেখতে পেলে নাকি চক্ষু সার্থক হয়!’
জয়াবতী  সেই শুনে রাগ রাগ গলায় বলল ‘পানু যেন ঘোড়ায় না যায় সেনমশাই, অমন লাগানো ভাঙ্গানো লোক আমি দুটি দেকিনি। ওর থেকে মেধো ডাকাত হাজার গুণে ভালো’।
(ক্রমশ)



কোভিডকালের  কান্ডকথা
সুনৃতা মাইতি


পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে নেমেই এ ব্লকের প্রবেশ দরজার আড়ালে  চুপচাপ দাঁড়িয়ে পরলো গেনু। এখন রাত দেড়টা তো হবেই। তিন , চার ও পাঁচ তলায়  কয়েকটি  লাইট বন্ধ হয়নি এখনও । আবাসিকরা অনেকেই ভুলে যান ঠিক সময়ে বাতি বন্ধ করতে। প্যাসেজগুলো তাই এখনও অল্পবিস্তর আলোকিত । রাতের দারোয়ান পান্তুকাকু আবাসন প্রাঙ্গনের চারিদিক ঘুরে ঘুরে হুইসল দিচ্ছেন । পান্তুকাকু ছোটখাটো পেটানো চেহারার মানুষ । খানিক ভুলো স্বভাবের। তবে কাজে ফাঁকি  দেন না। খাটতে পারেন খুব। আবাসনের মধ্যেই তাদের জন্য নির্দিষ্ট একটি ছোট্ট ঘরে থাকেন। সেনগুপ্ত কাকু  তার দেশের বাড়ি থেকে পান্তুকাকুকে নিয়ে এসেছেন।  লকডাউনের মধ্যে রাতের জন্য নাকি একটু বিশ্বাসী দারোয়ান দরকার ছিল এই আবাসনের জন্য । তাই সন্ধ্যা ছটা থেকে ডিউটিতে জয়েন করেন পান্তুকাকু। 


রাত বাজে আড়াইটে। থকথকে অন্ধকার বাইরে। একটা দুটো রাতকাবারি  আলো এখনও জ্বলছে বাইরেটায়। সেখানে অন্ধকারের জমাটিয়া ভাব কেটে খানিক পাতলা হয়ে গেছে। নাঃ, অস্বাভাবিক কিছু  তো নেই বাইরে! আকাশটা থমথমে গম্ভীর হয়ে আছে। আচ্ছা! , বুলটিদের ফ্ল্যাটেই এই ব্যাপারটা ঘটছে কেন?  বুলটিদের বাড়িতে  মা আর মেয়ে দুজনেই আছে সম্প্রতি । বুলটির বাবাকে প্রথম লকডাউনের আগেই অফিস থেকে পাটনায় বদলি করা হয়েছিল। করোনাকালীন পরিস্থিতিতে তিনিও খুব একটা ঘনঘন কলকাতায় আসতে পারছেন না। কিন্তু ঘটনাটার পিছনে যেই কলকাঠি নেড়ে থাকুক, তার উদ্দেশ্যটা আসলে কী? যাকে অপরাধ বিজ্ঞানের ভাষায় বলে "মোটিফ" । ভাবতে ভাবতে গেনু পান্তুকাকুর গতিবিধির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিল। নাহ্, তেমন কিছু  অসংলগ্ন ব্যাপার তো চোখে পড়ছেনা।


    ২

  কি যে কোভিড কাল এল! এখন দুমাথা এক করে জল্পনা করাটাও মুশকিলের বিষয়। দূরত্ববিধি না মানলেই নয়। রোববারের সকালটা এমন নিরুত্তাপ আগে ছিলনা। রোববার মানেই যাবতীয় কঠোর  বিষয় থেকে ছুটি। তাই গেনুদের আবাসনের ক্ষুদেরা সবাই কলরব করত  উঠোন জুড়ে। দেখে মনে হতো যেন চাঁদের হাট বসেছে। এখন  লকডাউনে সবাই ঘরের মধ্যে ঢুকে গেছে। বাচ্চাদের বাইরে যাওয়া  মানা। আবাসন প্রাঙ্গন নিস্তব্ধ। বি ব্লকের চারতলার একটি জানলার ধার থেকে  জয়াকাকিমার পাখি পুষ্যি রিওর  ডাক মাঝেমধ্যে ওই নিস্তব্ধতা চিড়ে দিচ্ছে । হালদার কাকুর জার্মান শেপার্ড জগাইও করুন মুখে ব্যাল্কনিতে বসে আছে। হালদারকাকু সবে কোভিড  জ্বর থেকে সেরে উঠেছেন। শরীর দূর্বল , তাই জগাই এর নিত্য ভ্রমণ বন্ধ। জগাই এর একটি  ভাই আছে। ওর নাম মাধাই। মাধাই উল্টোডাঙায় হালদারকাকুর ছোট ভাইয়ের বাড়িতে থাকে। তবে নীচের কম্পাউন্ডে গেনুদের সবার প্রিয় মিষ্টি  বেড়াল কাজু সমাজদার  জয়সবাল গাঙ্গুলী  আলম দত্ত বসু মন্ডল  ল্যাজ উঁচিয়ে মাস্ক পরা গাঙ্গুলীবাবুর সাথে ক্যাটওয়াক যুক্ত মর্নিং ওয়াক করছে। কাজুর নামের পাশের টাইটেলটা তার লেজের চাইতেও  বিঘৎ খানেক বড়। হবেনাই বা কেন! কাজুকে সবাই যে নিজেদের পরিবারের একজন মনে করে।  কাজুর একটা ভাই ছিল। কিশমিশ। কিশমিশ অল্প বয়সেই বখে গিয়ে বাউন্ডুলেপনায় হাতে খড়ি দিয়েছে। কাজু ভালো মেয়ে। কথাটথা শোনে। বুদ্ধিও প্রচন্ড ।  ফুল ক্রিম দুধ ছাড়া ভাত খায়না।  খুব সৌন্দর্য সচেতন মেয়ে  কাজু। বুচঁকি লক্ষ্য করে দেখেছে সে সকালে উঠেই গা চেটে চেটে নিজের গ্রুমিং করে। ওকে একটা কার্ডবোর্ডের ঘর বানিয়ে সুন্দর করে বালিশ টালিশ দিয়ে সাজিয়ে  দেওয়া হয়েছে। এখন গাঙ্গুলীবাবু যতটুকু  হাঁটছেন কাজুও ততটুকু যাচ্ছে। তিনি দিক পরিবর্তন করলে কাজুও তেমনটি করছে। গেনুদের আবাসনটা খুব একটা বড় ধরনের নয়। দুটোই ব্লক  সাকুল্যে। তবে সব রকমের সুযোগ সুবিধা আছে। গ্যারেজগুলো ছেড়েও অনেকটা ফাঁকা জায়গা আছে নীচে । সমাজদার বাবুর গ্যারেজের ধার ঘেঁষে একটি দেওয়ালে পুরো আবাসনের পাওয়ার সারকিট প্যানেল বসানো। সেখানে প্রয়োজন মতো আবাসনের প্রতিটি জায়গার ইলেকট্রিক  পাওয়ার ফ্লো নিয়ন্ত্রিত করা যায়। ছয়তলার ছাদে কমিউনিটি হল আর ঠাকুরের মন্দির। আবাসনের উঠোনের পাশ দিয়ে  অনেক রকমের গাছ গাছালি আছে। শীতকালে মরসুমি ফুলও লাগানো হয়। উত্তর দিকে বড় গেট। 


রোববার  সকালটাতে এখন গেনু, পটকাই, বুলটি, বুঁচকি আর অন্তুরা  অনলাইন মিটে আড্ডা দেয় , দাবা কিংবা অন্তাক্ষরী খেলে।  তবে আজকের আড্ডাটা খুব সিরিয়াস বিষয় নিয়ে। হয়েছে কি বুলটিদের বাড়িতে গত তিনদিন ধরে রাত একটা  বাজলেই কারেন্ট চলে যাচ্ছে । ফিরছে ভোর ছটায়। ইলেকট্রিশিয়ানকে ডাকা হয়েছিল। তিনি কিছু  বুঝতেই পারছেন না। বুলটিদের বাড়ির বিদ্যুতের লাইনে কোনও গন্ডগোল নেই।  কিন্তু  এমন আজব আর ভুতুড়ে ব্যাপার নিয়ে বুলটি খুবই চিন্তিত। বুলটির প্রাণের বন্ধু  বুঁচকি একটা নীল রংয়ের জামা পরেছে। মাথায় মিকি মাউস ক্লিপ। কম্পুতে গুগল মিটের জানলায় বসে সে বিজ্ঞের মতো মুখ করে  মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললো...


“আর বলিস না রে..চারিদিকে শুধু  খারাপ খবর। মা তো একটুও বেরোতে দেননা।  কাজুটাকেও একটু  লক্ষ্য  রাখতে পারছিনা। সে পর্যন্ত বখে যাচ্ছে ! সেদিন দেখি কিছু  বিগড়ে যাওয়া  বেড়ালের সাথে বহাল তবিয়তে আড্ডা দিচ্ছে। কিশমিশটাও দেখি আজকাল বোনের কানে মন্তর দিতে নিয়মিত আসছে। পই পই করে ওকে বলেছি ," কাজুরে তুই যার তার সাথে মিশিস না"। কে শোনে কার কথা! সেদিন নাকি  ভোম্বলদের আবাসনের নারকেল গাছে উঠে কাকের ডিম চুরি করে খাচ্ছিল। কি খারাপ কথা! সেদিন জানলা দিয়ে ডেকে বল্লাম.." হ্যাঁ রে কাজু ...তোর কি খাওয়ার অভাব! কেবল হাবিজাবি খাওয়ার দিকে মন। তোর মনুষ্যত্ব বোধ কোথায় গেল রে! অবলা  বাচ্চাগুলোকে খেয়ে ফেললি! "

“শুনে কাজু কি বললো রে?” পটকাই মিচকি হেসে জিজ্ঞাসা করে।

“কি আর বলবে! অনুতাপ হয়েছে হবে। মাথা নীচু করে বললো, "মিউ"।

পটকাই এর ফিচেল হাসিটা মুখ থেকে কিছুতেই মিলিয়ে যাচ্ছে না। সে সবজান্তা গামছাওয়ালার মত টিপ্পনী কাটল...


" বিড়ালের কি ভাবে মনুষ্যত্ব থাকবে শুনি! ওটা তো মার্জারত্ব হবে। মনুষ্যত্ব আর মার্জারত্বকে মার্জ করানোটা খুবই শক্ত রে বুঁচকি..."

“তোর আর সে চিন্তা করতে হবেনা বাপু। তুমি নিজের চড়কায় তেল দাও। শুনলাম তুই নাকি সেদিন অনলাইন ক্লাস করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলি! " বলতে বলতে বুলটি পটকাই এর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল।

পটকাই মাথার ওপর দুহাত জোড়া করে তাতে ভর রেখে কম্পিউটারের সামনে আয়েস করে বসেছে। বলল...

“আরে,পিটি ক্লাস হচ্ছিল। অডিও শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম! মা তো রেগে কাঁই ; খালি গজগজ করছিলেন। অবশেষে  বাবা বিরক্ত  হয়ে হোম আপিস থেকে মাথা তুলে বললেন,

"গজগজানি থামাও তো। বেশ করেছে । অনলাইন পিটি ক্লাসে একটু ঘুমিয়ে নিয়েছে। তুমি এবার ওর সাঁতার ক্লাসটাও অনলাইন হয় না কি দেখে ভর্তি করে দাও।"

"তোরা না আসল কথা থেকে বার বার সরে যাস। কেবল আলতু ফালতু আলোচনা !" বুলটি ঠোঁট ফুলিয়ে বলে।


 "এদিকে তিনদিন ধরে আমাদের যা অবস্থা!  ফ্যান না চললে  গুমোট লাগেনা ! তার ওপর অন্ধকারে জানলা দিয়ে শুধু  ছায়ার আনাগোনা দেখতে পাইথন । কি ভয়ানক পরিস্থিতি ! তোরা কিছু  একটা কর গেনু। 

“ তুই এ ব্যাপারে   কাকুকে ফোন করে কিছু   বলেছিস?”

গেনু চিন্তিত মুখে বলে।

বুলটি মাথা নাড়াল। হ্যাঁ বাচক।

“বাবাই তো ইলেকট্রিশিয়ান পকাই কাকুকে ডাকলেন । ডেকে কোনও  লাভ হলোনা। পকাই কাকু পান চিবোতে চিবোতে বললেন, " রাতে ঘুমের মধ্যে অনেক কিছু  ভুলভাল মনে হয়। আপনাদের ফেজে লাইন গেছিল বোধহয়।"

 “  ওরকম রিদম মেনে কারেন্ট  যেতেই পারেনা । তাছাড়া কাল রাতে আমি সরেজমিনে দেখেছি সব জায়গায় লাইট আছে। তাহলে শুধু  বুলটিদের বাড়িতেই ছিলনা ওইসময় কারেন্ট । তাই তো রে বুলটি?” গেনু বলে।

অন্তু মানে অন্তরা এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনছিল। সে তার ঠাম্মার বিশেষ ঘনিষ্ঠ । বাবা ও মা উভয়ে কাজে ব্যস্ত থাকেন বলে দিনের অধিকাংশ সময় সে ঠাম্মার সাথেই কাটায়। অতএব ঠাম্মার অমাবস্যা , পুর্নিমা , একাদশী , অম্বুবাচি সহ আধিভৌতিক এবং আধিদৈবিক সমস্ত জ্ঞান সে এই বারো বছর বয়সেই  করায়ত্ত করেছে। ভূত  , ভূতাঙ্গ এবং ভূতান্তের বিষয়েও তার প্রবল উৎসাহ। 

“লোড শেডিং না। একটা নির্দিষ্ট সময়ে আলো থাকছে না। তার মানে আমি নিশ্চিত যে তেঁনারা এতে জড়িত। হ্যাঁ রে বুলটি,তুই কি জানলার পাশ থেকে কোনও ডাক শুনতে পাস? যেমন খোনা গলায় “বুলটি...বুলটি...বুলটি....”। বুঝলি,এটা নিশির ডাক হতে পারে। ঠিক ওই সময়ে নিশি তোকে ডাকছে না তো! আর নিশির ডাকে আলো নিভে যাচ্ছে ।

বুলটির অবস্থা এমনিতেই কঠিন থেকে তরল হয়ে আছে কদিন ধরে। অন্তুর এহেন বক্তব্যে তার অবস্থা গ্যাসীয় হবার উপক্রম হলো। 

     ৩

 বড়দের কয়েকজনের কানেও খবরটা পৌঁছে গেছে দেখা গেল।  গেনুর বাবা কৌশিক দত্তবাবু বুলটির বাবার সাথে কথা বলেছেন। তবে সবাইকে ব্যাপারটা জানানো হয়নি। এ নিয়ে কনফারেন্স কল হয়েছিল বিল্ডিং কমিটির মাথাদের কজনের মধ্যে ।গেনু স্পষ্ট  শুনেছে হালদার কাকু বলছিলেন ...

“মোটিফ - টোটিফ তো একটা কিছু  আছে দাদা।  আচ্ছা কোনও অসাধু চক্রের এতে হাত- ফাত নেই তো! হলে খুবই মুশকিল! সবার নিরাপত্তার প্রশ্ন। তবে পোশ্নটা হচ্ছে কি ভাবে আলো নিভে যাচ্ছে কিংবা নিভিয়ে দেওয়া হচ্ছে ? “

“আমার বাপু ওই দিনের নতুন দারোয়ানটিকে সুবিধের মনে হয়না। আর পান্তু তো আমাদের নিজেদের লোক। ওকে নিয়ে ভাবার কিছু  নেই “ সেনগুপ্ত কাকু বলেছেন। 

 দিনের দারোয়ান নিতাই প্রামানিককে কদিন হলো একটি মাঝারি মানের সিকিউরিটি এজেন্সি থেকে আবাসনের দিনের ডিউটিতে পাঠানো হয়েছে । দীর্ঘদেহি বলিষ্ঠ  নিতাই প্রামানিক  দারোয়ানদের জন্য বরাদ্দ নির্দিষ্ট ঘরেই থাকেন।  ঠিকুজি কুষ্ঠি ঘেঁটেই সিকিউরিটি  এজেন্সি নাকি লোক পাঠায় । তবে বলা যায়না কিছু । কার মনে যে কি আছে! সন্দেহ কাটাতে পাশের পাড়ার নামজাদা ইলেকট্রিশিয়ান হরেন সাঁপুইকে ডাকা হয়েছিল। হরেনও বুলটিদের লাইনে গোলমেলে কিছু  খুঁজে পাননি। বিল্ডিং কমিটির সেক্রেটারি গাঙ্গুলীবাবু সিসিটিভি ফুটেজ চেক করলেন। এমনিতেই এখন কোভিডের কারণে  লোকজনের আনাগোনা কম আবাসন চত্বরে । খুব জরুরী না হলে বাইরের লোক ঢুকতে দেওয়া  হয়না। সিসিটিভিতে সন্দেহজনক কিছু  পাওয়া যায় নি । তবে সিসিটিভি চেক করবার সময় নাকি নিতাই প্রামানিক একটা কেমনধারা মুখ করে গাঙ্গুলীবাবুর দিকে তাকিয়েছিলেন। এটা সবাই লক্ষ্য করেছে।  তাই সন্দেহের তীরটা খানিক তার দিকেই গিয়ে বিঁধবার তক্কে আছে। ঠিক হয়েছে আজ রাত্রিটা সবাই সতর্ক থাকবে।সামনের দিকে ফ্ল্যাট আছে যাদের তারা ব্যাল্কনিতে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য রাখবে।

রাত বাজে একটা। বাবার সাথে ব্যাল্কনিতে বসে ছিল গেনু। এটাই মোক্ষম সময়। দেখা যাক কি হয়! হঠাৎ  দারোয়ানদ্বয়ের ঘর থেকে একটা সুদীর্ঘ ছায়াকে গুটিগুটি পায়ে আবাসনের ভিতরপানে এগিয়ে আসতে দেখা গেল । আরে! এতো দিনের দারোয়ান নিতাই প্রামানিক ! যাচ্ছে কোথায় এত রাতে! ব্যাপারটা তো খুব একটা সুবিধার নয়। কৌশিকবাবু সেনগুপ্ত বাবুকে ফোনে মেসেজ দিয়ে দিলেন। এদিকে দরকার হলে জগাইকে নিয়ে নীচে নামবে হালদার কাকুর ছোট ছেলে।  ওর কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ আছে। আসছেন বাকিরাও। 


 নীচে নেমে কৌশিকবাবুরা সবাই হাঁ হয়ে গেলেন । সমাজদার বাবুর গ্যারেজের সামনে নিতাই প্রামাণিক তার বিশাল চেহারা নিয়ে পান্তুকাকুকে জাপটে ধরে চেল্লাচ্ছেন...

“ধরসি...ধরসি...হেরে ধরসি। হ্যাঁ রে ব্যাটা দুইশ একের মেইনফ্রেম  সুইচ নিভাইতেসস ক্যান! “ 

ছোটখাটো চেহারার পান্তুকাকু সড়াৎ করে ওই বিপুল জাপটানি থেকে বেড়িয়ে সেনগুপ্ত কাকুর শরণাপন্ন হলেন...


“ ও দাদা! আমি কি দোষ করিচি? তোমরাই তো আমাকে আলো নিভাতে কয়েচ রাত্তিরবেলা। সিঁড়ির লাইট বন্দ কত্তি ভুলে যায় অনেকে। তাই এই প্যানেলের এই সুইচটা অফ কত্তি কয়েচ যে! তাতে সিঁড়ির সব লাইট অফ হয়ে যাবে। রাত এগটা বাজলেই আমি নিত্যি ও সুইচ অফ করি তো। সন্দেবেলায় অন করি।“ বলেই নির্দিষ্ট একটি সুইচের দিকে ইশারা করে পান্তু।

“তবে রে ব্যাটা ! হেই ডানদিকের কোণের দুই নম্বর মিটারটাতে সিঁড়ির সুইচ আসে। আর বামদিকের কোণার দুই নম্বর মিটারটা তো ফ্ল্যাট নম্বর দুইশ একের । তুমি কি ডাইন বাইম গুলাইয়া খাইস? লোকের ঘরের বাতির লাইন অফ করো ক্যান মিসামিসি!" এতটা বলেই  কৌশিক দত্তবাবুর দিকে তাকিয়ে নিতাই প্রামানিক লজ্জা লজ্জা মুখে বলে উঠলেন...


 “চিল্লামিল্লিতে দাদাগো ঘুমের দফারফা হইল বুঝি! কি করুম দাদা, আইজকাইল সকাল ছয়টায় ডিউটিতে জয়েন কইরাই  দেখি সিঁড়ির আলো নিভানো হয় নাই। এদিকে দুইশ একের মেইন সুইচ নীচে নামানো। রোজ ছয়টায় ঠিক করি এইসব। কি হয় বোঝতে তক্কে তক্কে ছিলাম। আইজ হাইতে  নাইতে কার্যকারণ  ধরতে পাইছি।“


গেনু বাবার পিছে পিছে চুপি চুপি এসেছিল। এখন সিঁড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে বিড়বিড় করে উঠল...


“ কি কান্ড! একে কি উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে বলা যায়! সিঁড়ির লাইটের জায়গায় বুলটিদের লাইট! তাই ভাবি, রাত্তিরবেলা সিঁড়ির সব কটা লাইট বন্ধ হয়না কেন! আমাদের আবাসনে বিদ্যুতের অপচয় তো হয়না।“

এদিকে সমর সমাজদার, কৌশিক দত্ত , জাহাঙ্গীর আলম , জগন জয়সবাল এবং সুবীর মন্ডলেরা অকুস্হলে পৌঁছে হাঁ হয়ে তখনও দাঁড়িয়ে। মাস্কের আড়াল থাকায় সেটা  অবশ্য বোঝা দুষ্কর। এত হট্টরোলে কাজু  সমাজদার  জয়সবাল গাঙ্গুলী  আলম দত্ত বসু মন্ডলের  ঘুম ভেঙে গেছে।  কার্ডবোর্ডের ঘর থেকে বেড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে সে বলে উঠল,”ম্যাও..”


এই ম্যাও এর ভাবার্থটা বুঁচকির পক্ষেই একমাত্র বোঝা সম্ভব । গেনু ভাবছিল। তার জোর হাসি পাচ্ছে।  বুঁচকিকে  কালই জিজ্ঞাসা করতে হবে মিউ আর ম্যাও এর মধ্যে পার্থক্যটা কি!



আমি মিসি রাজু আর শয়তান ইয়োটাকু

গৌতম বাড়ই


স্কুলের ছুটি পড়তেই আমরা বারবার আমাদের এই পাহাড়ি গ্রামটাতেই ফিরে আসতাম। বাবার অফিস থেকে আগেভাগে  ছুটি যোগাড় করতে হত আর বাবা আমাদের নিয়েই ফিরতেন সেই পাহাড় যেখানে শেষ হয় সমতলের বাড়িতে কদিনের ছুটি কাটিয়ে। গরমকালে মজাটা বেশি হত । নিচে গরম অথচ একটু উপরে পাহাড়ে চড়লেই পুরো শীতকালের আমেজ।

আমি আর মিসি সঙ্গে রাজু এই তিনজনে মিলে বেজায় মজা করি যখনই ছুটিতে আসি এই বাড়িতে। তবে সেবারে অন্য একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিল এখানে। এরপর বলছি সেবারের ঘটনাটি। মিসি আমার বোন। কাকার মেয়ে। রাজুও কাকার ছেলে প্রায় আমার মতন বয়স।

বাঘ পাহাড়ের নিচে আপার জনসন হাট্টা বলে একটি পাহাড়ি বস্তি বা গ্রাম আছে তার উপরে ধুপি গাছের জঙ্গল। বড়রা বলে ওদিকে যেতে নেই । ভাল্লু আছে। চিতা আছে। খতরা বিল্লি আছে। ভূত- প্রেত শয়তান ও আছে। আরও ওপরে ঘন পাইনের জঙ্গল। বাঘ পাহাড় বললে তোমরা বুঝবে না। যদি বলি টাইগার হিল। সবাই এককথায় চেঁচাবে--- "চিনি তো বেশ ভালো মতন "। বাঘ পাহাড়ের মাথায় দাঁড়ালে  ভোর বেলায় যে সানরাইজ হয় অমন সুন্দর দৃশ্য নাকি পৃথিবীতে খুব একটা দেখা যায় না। গল্পটা কিন্তু বাঘপাহাড়ের নয় তার আশপাশের এক পাহাড়ের। 

পাহাড়ি বাঁশ মাঝখানটা কেটে ওপর থেকে ঝর্ণার জলের পরিষ্কার ধারা তা বেয়ে নেমে আসে  নিচে। আমরা সেই জলে স্নান করি। আমাদের যত কৌতূহল ওপরের ঐ নিরিবিলি ঝিঁঝিঁ ডাকা জঙ্গল। মাঝে মাঝে মাঝরাত্তিরে কখনও অদ্ভূত চিৎকার ভেসে আসে ওপরের জঙ্গল থেকে। মা বলে-- পাহাড়ি চিতার ডাক। জঙ্গলী জানোয়ারের ডাক। আজ আমি মিসি আর রাজু বড়দের চোখকে আড়াল করে লুকিয়ে চুরিয়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে  এক-পা দু-পা করে পাহাড়ের বেশ কিছুটা ওপরে জঙ্গলের পথে ঢুকেছি। নিচে আমাদের আপার জনসন হাট্টার বড় স্কুলবাড়িটা দেখা যাচ্ছে। আমাদের বাড়িটিও নজরে পড়ল। একটু খানি।  বাবা বলেন আমরা নাকি লেপচা জাতি। আমাদের কয়েক পুরুষের বাস এখানে। সকালবেলা হলে কী হবে! হঠাৎ করে পাহাড়ের ঐ জঙ্গলে রাতের মতন অন্ধকার নেমে এল। আমরা তিন ভাই-বোন একজন আর একজনকে শক্ত করে চেপে ধরে এক জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছি। মেঘেরা চোখ মুখ ভিজিয়ে চলে যাচ্ছে। মেঘের ধোঁয়ায় ভরা। অবশ্য নিচে আমাদের বাড়িতেও এরকম ভাবে মেঘ এসে হঠাৎ হঠাৎ করে দরজা জানালা দিয়ে ঢোকে। আরও নিচের দিকে সোনাদা বাজার আর টয়ট্রেনের  রেলস্টেশন হয়ত তখন স্পষ্ট। আমি এইসব দেখে স্কুল ম্যাগাজিনেও একটা কবিতা লিখেছিলাম। তার দুটো লাইন বলছি---

মেঘের বাড়ি দেশে
রোজ মেঘ পরীরা আসে।


আমরা ভাবছি কী করব!  ওদের মধ্যে আমি বড়। মিসি আমাকে বড়াভাইয়া বলে ডাকে । কয়েক মাসের বড় হওয়াতে রাজু আমাকে নাম ধরেই ডাকে। দুই ভাই দুই বন্ধু যেন। মিসি ক্লাস ওয়ান আর আমরা থ্রি- তে পড়ি।  ওরা তাই জিগ্গেস করছে, বিশেষ করে মিসি-- বড়াভাইয়া কী করব? আমার ভয় লাগছে। ভয়টা আরও বাড়িয়ে দিল বিকট গলা করে ঐ অন্ধকারে কেউ যেন আমাদের কে বলছে --- এই বাচ্চালোক তোরা এই জঙ্গলে কেন এসেছিস?

আমরা আমতা আমতা করছি। অন্ধকারের মধ্যে ঐ পাহাড়ি জঙ্গলে আমাদের সোনাদার বৌদ্ধগুম্ফায় যে রকম তারা আঁকা লাল লাল লালচে আলোর লন্ঠন বাতি থাকে, তা নিয়ে জাপানিজ বা চায়নিজ এক অদ্ভূত ভূতুড়ে বুড়ো আমাদের নাকের ডগায় হাজির। আমাদের বুকে কাঁপুনি তুলে ঐ অন্ধকার নিস্তব্ধ জঙ্গলে হা হা করে হাসিতে ফেটে পড়ল। আমি সাহস করে বললাম - তুমি কে? কোথায় থাকো?

সেই বুড়োর ঝুলে পড়া গালে সাদা দাঁতের পাটি স্পষ্ট। চেঁচিয়ে উঠলো--- আমি ইয়োটাকু। এই পাহাড় টপকে আর একটা পাহাড় চট্টকপুরা ঐ জঙ্গলে গুহার মধ্যে থাকি। আমার বয়েস আছে পাক্কা এক হাজার বছর।

আমি তো ওনাকে বয়স জিগ্গেস করিনি। তবে? আমি আবার আরও একটু সাহস নিয়ে বললাম--- তো আমাদের ভয় দেখাচ্ছেন কেন? আমরা খুব ভালো ছেলে- মেয়ে।

ইয়োটাকু আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল । পিঠের ঝোলা থেকে একটি বড় লাঠি বের করে আমাদের বলল- এ হল আমার  যাদুলাঠি। তোদের এই তিনবিচ্ছুকে ইঁদুর বানিয়ে দেব। ভাল্লো না ছাই! সব জানা আছে। তোরা বদমাশ আছিস। তোদের কৌতূহল বেশি।

ইয়োটাকুর চেহারাটা আরও হিংস্র হয়ে উঠছে। অন্ধকারও অনেকটা কেটেছে। মেঘের ওড়াউড়ি আর নেই।বাবা আর কাকার গলা শোনা যাচ্ছে আমাদের নাম ধরে ডাকছে। আরও আলোয় ভরে গেল জঙ্গল। পাহাড়ের যাদু এটাই। এই আলো আর এই অন্ধকার।  ইয়োটাকু ভ্যানিশ। সে জায়গায় বাবা-কাকা আর  ধমক-ধামক চলতে থাকল আমাদেরকে। কান মলাও খেয়েছিলাম সামান্য। তবুও বাবা আর কাকা এসে যাওয়াতে কী শান্তি। মন থেকে ভয় কেটে গেল। যা ভয়ানক ঘটনা ঘটতে চলেছিল। মিসিকে খুব করে বকল কাকা--- এই মেয়েটা ডাকু হয়েছে আর বাবা আমাকে বকল-- এই বড়টা যত নষ্টের গোড়া।


নিচে বাড়িতে এসে দেখলাম সবাই চিন্তিত মুখে বসে । পরে শুনেছিলাম আমরা ঐ ইয়োটাকু নামে এক তিব্বতী শয়তান প্রেত বুড়োর পাল্লায় পড়েছিলাম। যে বুড়োটার সমাধি রয়েছে ঐ একদম উঁচু পাহাড়ের জঙ্গলে এক গুহায় আজ থেকে একহাজার বছরের বেশি পুরানো  ঐ সমাধি।

বড়রা কেন না করে ছোটদের সেই থেকে বুঝেছিলাম। ওরা আমাদের থেকে অনেক বেশি জানে  আর সেই না শুনলেও যে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয় তাও জেনেছিলাম নির্জন জঙ্গলে ঢুকে।

ধারাবাহিক ভ্রমণ
আলো-অন্ধকারে শ্যামদেশ

জয়তী রায


আজ এমন দেশের কথা লিখতে যাচ্ছি, যার সঙ্গে আমার সম্পর্ক তেইশ বছরের। 
দেশটার নাম থাইল্যান্ড। বাংলায় বলে, শ্যামদেশ। আবার বলা হয়, ল্যান্ড অফ স্মাইল। সত্যিই তাই,  প্রথম দর্শনে আপন করে নেয় এই দেশ। এত সুন্দর ব্যবহার প্রতিটি মানুষের। বলার অপেক্ষা রাখে না। শুরু করি তবে। 

  
 চিন্তার সেতুপথ ... বিষয়টি এখনকার যুগে অবাস্তব ভাবা হয়, তার কারণ আমরা শুধুমাত্র জড় জগৎ নিয়ে নিজেদের ব্যস্ত রাখি। জড় জগৎ  ইন্দ্রিয়ের প্রাথমিক শর্ত পূরণ করে। তার প্রয়োজন আছে বইকি। কিন্তু পুরো চব্বিশঘণ্টা যদি বস্তুগত মোহে ডুবে থাকি তবে ধীরে ধীরে আমাদের অন্যান্য শক্তি লোপ পেতে থাকে। 
চিন্তনের সেতুপথ তেমনি একটি বিলুপ্ত প্রায় শক্তি। আমাদের জীবনযাত্রা স্কুলে ফাস্ট হতে শেখায়, নিজের কর্মজীবন কি করে উন্নত হবে শেখায়, ফেসবুকে পোস্ট দিতে শেখায়, সারাক্ষন অপরলোক কি কি করছে সে সবে ব্যস্ত রাখে, কিন্তু শেখায় না নিজের অনুভূতির দুয়ার আরো উন্মুক্ত আরো সুন্দর কি করে হবে? 
   অনুভূতি কিন্তু ঈশ্বর। 

আজান শুনি যখন কিংবা কোনো মন্ত্র অথবা কবিতা রাতের গভীরে এসরাজ যদি বেজে ওঠে অনুভূতির দুয়ার খুলে প্রবেশ করে অলৌকিক দুনিয়ার বাতাস। ভিতরে প্রত্যেকে বহন করছি এক শক্তি। সঠিক ব্যবহার করলে মনের এনার্জির বাতাবরণ এমন উন্নত হয়, যে কারণে বহু কিছু বুঝে নিতে পারে মানুষ। কারো মনের কথা ভাব বুঝে যাওয়া, কোনো ঘটনা ঘটার পূর্বাভাষ ইত্যাদি এমন কিছু অজানা ব্যাপার নয়। জড় আমির ভিতর হতে নিজেকে সরিয়ে নিজেকে দেখলে , মৌন থাকলে বোঝা যায় , যা দেখছি প্রতিদিন অথবা যেগুলি ছাড়া জীবন চলবে না মনে হচ্ছে , সেগুলি অভিনীত হচ্ছে মাত্র! বেশ পরিকল্পনা করে সাজিয়ে রাখা চিত্রনাট্য। আমরা সেই নাটকের কুশী - লব। তখন যেটুকু কাজের জন্য দরকার সেটুকু এনার্জি খরচ করে বাকি যদি অর্জন করি প্রতিদিন, তবে নিজেই বুঝতে পারব চারিদিকে এমন কিছু সৃষ্টি হচ্ছে যা ছোট আমির ভিতর হতে বড় আমির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। চিন্তন শক্তিমান হচ্ছে। তুচ্ছ আমির মান, অভিমান, অভিযোগ হল জঞ্জাল। ভাবের ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখে। সেগুলো সরিয়ে দিলে অধিকারী হওয়া যায় প্রখর অনুভূতির। দিনের কতটা সময় অভিমান করছি বসে বসে , একবার সেই হিসেব করেছি কখনো? 
  শক্তিমান চিন্তন ঘটিয়ে দিতে পারে এমন অনেক কিছু , যাকে আপাত দৃষ্টিতে অলৌকিক মনে হয়।
 আজ এইটুকুই বলি। পরে কখনো সুযোগ থাকলে বলব।

  
 ব্রহ্মা মন্দির উৎপত্তির ইতিহাস চমকপ্রদ। 
      
  মন্দিরে যেটা চোখে পড়ে, সেটা হল হলুদ রঙের প্রাচুর্য। থাইল্যান্ড যেহেতু বৌদ্ধধর্মের প্রাধান্য স্বীকার করে, তাই গেরুয়া বা হলুদ রঙ অথবা সোনালী রঙের প্রভাব সব জায়গায়। দেখে মনে হয়, এই রঙ ওদের কাছে খুব পবিত্র। মূলত এরা ধর্মপ্রাণ জাতি। ভগবান এবং ভূত দুটোই বিশ্বাস করে। স্বাধীন জাত। সহজ দর্শনে বিশ্বাস করে। যাই হোক, 

 একটা ছোট্ট জায়গায় চড়া রঙের  জরির পোশাক পরে সাত আট মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মাথায় মুকুট আছে। চুড়ি হার দুল সবই আছে। মুখে সাদা মেকাপ। কাজল। 
   নাচের ওখানে গিয়ে নিজের নাম দিতে হয়। মেয়েগুলির অপটু জিভ উচ্চারণ করে  হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রার্থনা করে।

  
     এখানে মন্দির নির্মাণ করার পরিকল্পনা ছিল না। হচ্ছিল হোটেল।  ব্যাংককে ঝেঁপে টুরিস্ট আসছে। বড় বড় কোম্পানি তাল মিলিয়ে হোটেল খুলতে শুরু করেছে।  জমজম এলাকা। ঠিক এইখানে হোটেল খোলার তোড়জোড় শুরু হল। ফাইভ স্টার হোটেল। পাশেই  গ্র্যান্ড হায়াত। ১৯৫৬ সালের কথা। সরকার হোটেল খোলার কাজ শুরু করল। মুশকিল হল, যতবার শুরু হচ্ছে, ততবার কিছু না কিছু ভেঙ্গে যাচ্ছে। কর্মচারীদের শরীর খারাপ হতে শুরু করল। দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার সময় নিয়ে মাটি পরীক্ষা করছে, বিদেশ থেকে এক্সপার্ট নিয়ে আসা হল... সকলের ভুরু কুঁচকে রইল। নাহ্। সমাধান হচ্ছে না কিছুতেই, সে এক মহা অশান্তি। কোটি কোটি টাকার ব্যাপার... সবচেয়ে বড় কথা কারণটাই বুঝতে পারছেনা লোক। হোটেলের জন্য মার্বেল আনা হচ্ছিল জাহাজ করে। ইতালি থেকে। সে জাহাজ ডুবে গেল। তখন ঘটল অলৌকিক ঘটনা। হঠাৎ করে একদিন এক হিন্দুসাধু কোথা থেকে এসে উপস্থিত। তিনি কিছু অদ্ভুত কথা বললেন। 

  সাধু বলে কি, এই জায়গায় ভূত আছে। স্পিরিট আছে। সেই অপশক্তি চাইছে না, লোকজন আসুক। এখানে হোটেল হোক। উনি বিধান দিলেন যে,  ব্রহ্মামূর্তি স্থাপন করা হোক। প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হোক। এই দেবতার শক্তি না কি সাংঘাতিক। তবে , আর ভয় থাকবে না। সাধুর কথানুযায়ী চলে, পুজো, প্রাণ প্রতিষ্ঠা সব ই হল।  হোটেলও খুলে গেল। কোনো ঝামেলা হল না। আবার মার্বেল এলো । কোনো বিপদ হল না।  কিছুই হল না।  
ব্যাংককের শহরের উপর অবস্থিত ব্রহ্মা দেবতা  সকলের বড্ড সহায়। পাশেই সূর্য দেবতার মন্দির। মানুষজন বড্ড বিশ্বাস করে।  ভালো হোক সকলের। হে ব্রহ্মাদেব। প্রণাম নিও। 
করোনা মুক্ত হোক পৃথিবী। (ক্রমশ)

মহিষমর্দিনী
প্রবাহনীল দাস

অষ্টম শ্রেণী, বিদ্যাসাগর শিশু নিকেতন
পশ্চিম মেদিনীপুর

অনেক বছর আগে,
কালনা ঘাটে একটি কাঠের টুকরো এসে লাগে।
রানাঘাটের রাই,
স্বপ্নে তাকে দেখতে পেলেন এক বড় ব্যবসায়ী।
মা যে দশভূজা,
কামনা তার, গঙ্গাঘাটে হোক না নিত্য পূজা।
স্বপ্নাদেশে যেমন
মূর্তি দেবী দেখিয়ে দিলেন, গড়ল কুমোর তেমন।
বাদলা শ্রাবণ মাসে,
রাখি ঝুলন পূর্ণিমাতে মৃন্ময়ী সে আসে।
একশো বছর পার,
মহিষমর্দিনীর পূজা অপার মহিমার।
ঘন্টা কাঁসির সুর,
বিশ্বাসেতে শান্তি মেলে, তর্কে বহুদূর।
পড়ল কাঠি ঢাকে,
এই পুজোতে কালনাবাসির আবেগ মিশে থাকে।



স্মরণীয়
(স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়)
কলমে - পীযূষ প্রতিহার
  
 ১৮৬৪ সালের ২৯শে জুন হরতাল আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতার বৌবাজারের মলঙ্গা লেনের ভাড়াবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল হুগলী জেলার জিরাট বলাগড় গ্রামে। তাঁর পিতা ছিলেন বিখ্যাত ডাক্তার গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও মা ছিলেন জগত্তারিনী দেবী। তিনি ভবানীপুরের চক্রবেড়িয়ার শিশু বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। বাল্যকালে একবার ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল তাঁর এবং বিদ্যাসাগরের দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। ১৮৭৯ সালে মাত্র পনেরো বছর বয়সে কলকাতার সাউথ সুবার্বণ স্কুল থেকে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে এন্ট্রান্স পাস করেন ও বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৮০ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। সেখানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও নরেন্দ্র নাথ দত্তের সাহচর্য লাভ করেন তিনি। ১৮৮২ তে এফ এ পাশ করেন তৃতীয় স্থান অধিকার করে, ১৮৮৪ তে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে বি এ পাশ করেন ও ১৮৮৫ তে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে গণিতে এম এ ( তখনও এম এসসি চালু হয়নি) পাশ করেন। ১৮৮৬ তে আবারও এম এ করেন পদার্থ বিজ্ঞানে এবং ছিয়ানব্বই শতাংশ নম্বর অর্জন করেন। ঐ বছরেই প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন (নগদ দশ হাজার টাকা) এবং আইন পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক লাভ করেন। ভারতে শিক্ষিত অধ্যাপককে ইংল্যান্ডে শিক্ষিত সমমানের অধ্যাপকের সমান মর্যাদা না দেওয়ায় ব্রিটিশ ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রস্তাবিত শিক্ষা বিভাগের চাকরি প্রত্যাখ্যান করে কলকাতা হাইকোর্ট আইন ব্যবসায় যোগ দেন। ওকালতিতে অসাধারণ পসার লাভ করেন। ১৮৮৯ তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৮৯৪ তে তিনি ডক্টর অব ল' ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কিছুদিন রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৮৯৮-১৯০৪ সাল পর্যন্ত কলকাতা কর্পোরেশনের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৮৯৯-০৪ পর্যন্ত বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য ও ১৯০৩-০৪ পর্যন্ত ভারতীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯০৪ সালে রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন। একই সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন ১৯০৬ সালে ও টানা চারবার দু'বছর মেয়াদী এই পদে ছিলেন (১৯০৬-১৪)।১৯০৮ সালে তিনি ক্যালকাটা ম্যাথেমেটিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।  ১৯২১ সালে আবার পঞ্চম বারের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন। উপাচার্য থাকাকালীন কয়েকটি অসাধারণ কাজ করেন, যেমন - বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ক্লাস চালু, বিজ্ঞান ও আইন কলেজ স্থাপন, স্কুল ও কলেজে বাংলা পঠনপাঠন চালু, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় স্নাতকোত্তর ক্লাস প্রবর্তন, দ্বারভাঙ্গা সৌধ নির্মাণ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসন প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি। 'সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে হস্তক্ষেপ করবে'- এরকম একটি শর্ত মানতে না পেরে ষষ্ঠবারের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে চাননি। গভর্নর লর্ড লিটন(১৯২৩-২৪) বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্বশাসন খর্ব করতে চাইলে তিনি অসীম তেজস্বীতার সঙ্গে রাজশক্তির বিরুদ্ধে বাদানুবাদে অবতীর্ণ হন ও সারা বাংলায় 'বাংলার বাঘ' বিশেষণে ভূষিত হন। 

     জীবনকালে তিনি তিনবার এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি, ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। গণিতের উপর বিভিন্ন বক্তৃতার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল 'জিওমেট্রি অব কনিক্স'(১৮৯৩) ও 'ল অব পারপিটুইটিজ'(১৮৯৮) নামের দুটি বই। অন্য একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ 'জাতীয় সাহিত্য' রচনা করেছিলেন তিনি। ইংরেজি, ফরাসি, রুশ, পালি ও বাংলা ভাষায় অসাধারণ দক্ষতা ছিল তাঁর। গনিতের ক্যালকুলাস শাখায় ও জ্যামিতিতে তাঁর ছিল দারুণ প্রতিভা। অসাধারণ বাগ্মী, তেজস্বী, দেশভক্ত ও পন্ডিত এই মানুষটিকে ব্রিটিশ সরকার 'সি.এস.আই.' ও 'নাইট' উপাধি প্রদান করেছিল। নবদ্বীপের পন্ডিত সমাজ থেকে 'সরস্বতী', পূর্ববঙ্গের সুধীসমাজ থেকে 'শাস্ত্রবাচস্পতি' ও সিংহলের মহাবোধি সোসাইটি থেকে 'সম্বুদ্ধাগমচক্রবর্তী' উপাধি লাভ করেন তিনি। ১৯২৩ সালে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং পুনরায় ওকালতি শুরু করেন তিনি। তৎকালীন প্রসিদ্ধ 'ডুমরাঁয় মোকদ্দমা' পরিচালনার জন্য পাটনা গমন করেন ও পাকস্থলীর পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৯২৪ সালের ২৫ শে মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।


পাঠপ্রতিক্রিয়া
( জ্বলদর্চি ছোটোবেলা ৮৭ পড়ে চেন্নাইবাসী গল্পকার বাসবদত্তা কদম যা লিখলেন) 

জ্বলদর্চি ৮৭ পড়তে গিয়ে প্রথমেই কল্যাণ সাহার তোলা প্রচ্ছদের নদী, নৌকা আর তীরের কয়েকজনে চোখ আটকায়। নদী দেখেই মনে হলো এইখানেই বুঝি সেন মশাই তার পরিবার, জয়াবতী, পুণ্যি আর পেরজাপতি কে নিয়ে গেছেন! তৃষ্ণা বসাকের 'জয়াবতীর জয়যাত্রা' য় আমরাও যে তার সঙ্গী। তপন রায়চৌধুরীর 'ভুতুর দুষ্টুমি' তে ভুতুকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। সে সারাসময় মোবাইল না ঘেঁটে যে অভিনব দুষ্টুমির প্ল্যান বানায়! ক্রেডিট তাকে দিতেই হবে। এরপর বিশ্বনাথ চৌধুরীর 'অজানার পথে'  পড়ে বেশ ভালো লাগলো। সত্যিই ছোটরা ঘরে আর না বসে বাইরে বেরিয়ে একটু হুটোপাটি করুক। এরপর মলয় সরকারের 'সান্টাক্লজের আপন দেশে' উরিবাবা সান্টাক্লজ কে চিঠিও লেখা যায়। তার বাড়িতেও যাওয়া যায়! আমি তো যাবই। সে যত ঠান্ডাই হোক না কেন। দুটোর জায়গায় তিনটে সোয়েটার পড়বো। এরপর ছোট্ট ভানুপ্রিয়া বলে নাকি আবার ছোট হতে চায়। দাঁড়াও বাপু আমাদের লাইন আগে। তুমি তো সদ্য ছোটবেলা পেরিয়ে এলে। এরপর পীযূষ প্রতিহার মহাশয়ের স্মরণীয় বিভাগে জানলাম প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ এর কথা। প্রতিবারের এই বিভাগ ছোটদের মনে অনেক বড় ছাপ রেখে যাচ্ছে আমাদের স্মরণীয় ব্যক্তিদের নিয়ে। সুদেষ্ণা গিরি আর শ্রীজা মাইতির আঁকা খুব সুন্দর হয়েছে।  মৌসুমীর সম্পাদকীয় এত ভালো তাকে নিয়ে কি মন্তব্য করব জানি না। সবশেষে বলি জ্বলদর্চি এগিয়ে চলুক রাস্তা আলো করে।

আরও পড়ুন 
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments