জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-২৭ /সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-২৭

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়


ব্যাটন রুজ, লুইজিয়ানা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

...ইয়ে কাঁহা আ গয়ে হাম...

ভয়! এ বড় ভীষণ জিনিস। সমাজ যে মেয়েকে চোখ রাঙিয়ে ঘরে ঢোকানোর চেষ্টা করল, সে মেয়ে বেরিয়ে এল বাঁধন ছিঁড়ে। আর যার জন্য পুরো দুনিয়াটাই মুক্তমঞ্চ, সেই পুরুষ কিনা নিজের ছায়াতেই বন্দি হয়ে রইল।

প্রেমে আর সমর্পণে যতখানি বেপরোয়া হতে পেরেছেন একশো বছরের পুরনো নারী, কতটা সঙ্গোপনে সরেছেন শতাব্দী প্রাচীন পুরুষ।

এবার এক বেপরোয়া নারীর মনের কথা...জলে ডুবে মানুষ যেমন অন্ধভাবে মাটি আঁকড়ে থাকে-সে কিছুতেই ছাড়তে চায় না। ঠিক সেইরকম আমি জানতাম ভালোভাবে যে, আমাকে নিয়ে বাইরের মানুষের অনেক চিন্তা। অনেক আগ্রহ। কিন্তু আমার কোন টেনশন নেই। অবশ্য এটা আমার নিজস্ব মানসিকতার কারণ।

আমি ভাবি মাঝে মাঝে ভবিষ্যৎ? সে আবার কি?

এতগুলো বসন্তকে যখন টপকে টপকে পেড়িয়ে এলাম তখন তো পড়াশুনাও করেছি। আর এখন তো নিজে চাকরি করি, কেন পরাধীনতার মধ্যে যাবো। ঠাকুর মা কে খুঁটি করেছি তখন থেকেই। একদিন আমারও চোখে বারিধারা ছিল, কাঁধে ছিল মেঘ। অথচ কী মন্ত্রবলে সেইসব একেবারে তুড়ি মেরে ঝেড়ে ফেলেছি এই অভিবাসে এসে।

সেদিন বৃটিশ এয়ারওয়েজ প্লেনটা কিন্তু স্বনিয়মেই ছুটছিল নিজের পথে । প্লেনের জানালার বাইরে দিয়ে দ্রুত পেছনে সরে যাছিল গাছপালা, পুকুর-নালা, মেঠোপথের পথিক, আকাশে আনাগোনা মেঘের ঝাঁক, কিছু কিছু ঝাঁ চকচকে উড়ন্ত স্মৃতি। এমন আরও কত কিছু পিছলে যাচ্ছিল পেছনে । প্লেনটা সবাইকে ছাপিয়ে এগিয়ে চলেছিল সামনের দিকে । প্লেন ছুঁলো নিউ ইয়র্কের মাটি। বাইরে তখন সন্ধ্যে শুরু হয়েছে।

নিউ ইয়র্কে জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে নেমেই গ্রীন কার্ড হাতে পেলাম। তারপর সেখান থেকে ডোমেস্টিক ফ্লাইট সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন্সএ লুইজিয়ানার রাজধানী ব্যাটনরুজ -এ এসে নামলাম। সাথে ছিল মেজদিদিয়া আর ন'দাদা। আমি অবাক হয়ে দেখছি চারিপাশ। কোথাও কোনো জড় পদার্থের চিহ্ন নেই। ঝকঝক তকতক করছে চারিদিক। এয়ারপোর্টে গাড়ি করে নিতে এসেছিল ছোদ্দা আর সেজদা। বসে পড়লাম তাতে। ক্লান্তি বলে কিছুই ছিল না তখন। তখনও জানি না আমার কি ভবিষ্যৎ?

গাড়িতে বসেই ন'দাদা বলল, “এই একটা দেশ-যেখানে সবাই ছুটছে আপন খেয়ালে। কে তুই -কি তোর অতীত-নিয়ে এরা বসে থাকে না, বুঝলি শিমুল। এনজয় ইয়োর লাইফ হোয়াটএভার ইউ ওয়ান্ট। নোবডি উইল ডিসটার্ব ইউ। রাস্তায় পয়সা পড়ে আছে-তোকে কুড়িয়ে নিতে জানতে হবে। কান আর চোখ একেবারে খোলা রাখতে হবে, ব্যাস! কোথায় তোর সেই রংচটা জীবন আর কোথায় তোর আলোময় নতুন জীবনের হাতছানি। এত ভালো মেয়ে তুই-পড়াশুনা কর-যা পড়তে চাইবি-আমি পড়াব তোকে। তবে পুরানো-কে বস্তাচাপা দিয়ে পথের দুপাশে জানলা দিয়ে এখুনি ফেলে দে ।”
ছোদ্দা যথারীতি “ এ ভাই! আমরা কিন্তু সব ঝাউগ্রাম থেকে আউচি, তাই নারে ? এখানে কিন্তু 'হিলিক হিলিক' শব্দ শুনতে পাবেক লাই। তবে কিছু সাঁ সাঁ মোটরগাড়ি শব্দ ছাড়া চলে বটেক। হুই হুথা ম্যাকডোনাল্ট, পাশে দেখতিছিস উটা হল বার্গার কিং। সানডুইচ, হাস ব্রাউন সব খাতি ইচ্ছে করলে... খাতি পারবি। আর সব পরে চিনাব, বুইলি ভাই।

মোক্ষম খিদে পাইচে বটেক। ক্যাট ফিশ সড়ষে দিয়ে রান্নার পর ভাবতি হবেক ইটা ইলিশ মাছ খাঁইচু। বাসমতি রাইস, পোস্ত-বিউলির ডাল, আর সড়ষে ইলিশ—হা হা হা বুঝতেই পারবেক লাই যে, আম্রিকায় আছি। আমাদের দোকান আহে বুইলি কিছু - হিউস্টনে প্যাটেল ব্রাদার্স বলে দোকান আহে- সেখান থেকে সব আসে, এ ভাইইই... হাস দে তো যরা?” হেসে ফেললাম সবাই।

ন'দাদা আর সেজদাদা বলল ছোদ্দাকে, “তুই হলি গিয়ে এক্কেবারে পাক্কা কলকাতার ছেলে। ভাত -মাছের গল্প ছাড়া আর কি কোনো গল্প নেই?” ওই তো গাড়ি চালাচ্ছিল আর সবাইকে হাসাবার চেষ্টা করছিল।

দেখতে দেখতে বাড়ি পৌঁছে গেলাম হুউউশ করে। বাড়ি দেখে তো অবাক। বাইরেটা আমেরিকার আচ্ছাদন হলেও ভেতরে পাক্কা বাঙালি বাড়ির আবহাওয়া। বাড়ির মানুষজন-রা, দেওয়াল, সিলিং দরজা-জানলা সব একসাথে - “হাই” বলে উঠল। টেবিলে গিফট রাখা ছিল। সেগুলো খুললাম। 'ওয়েলকাম শিমুল' লেখা কেক কাটলাম। তারপর ফ্রেশ হয়ে বড় টেবিলে সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়ার ধুম। হঠাৎ খুব ভালো লাগা্র রেশ মনে পড়শ বুলিয়ে দিল। খাওয়ার শেষে আইস্ক্রিমের একটা বেশ বড় আকারের ব্যারেল-এর মধ্যে থেকে সবাই বাটি করে আইস্ক্রিম নিল-ঘুম এল না কারুর চোখে। রাতে পৌঁচেছিলাম তাই জেট ল্যাক শুরু হল। গল্প হল হরেক রকম। “সাড়ে চুয়াত্তর” সিনেমা দেখা হল সবাই মিলে। ভোর হচ্ছে তাই দুই চোখে ঘুমেরা আরামে বাসা বাঁধল।

তারপর ধীরে ধীরে সবার ছুটির দিনে শুরু হল ন'দাদার কত কষ্টের করা বাবার আর মা-এর নামের বাড়ি “প্রাণ কটেজ আর নির্মলা ডুপ্লেক্স” দেখতে যাওয়া। সব ভাড়াটে আছে ওসব বাড়ি গুলোতে।

এখনকার মত ব্যটনরুজ তখন এত রমরমা হয় নি । আমি বলছি ১৯৮৯ সালের কথা। ছোট্ট শহর ব্যটনরুজে তখন হাতে গোণা গুটি কয়েক বাঙালী। আমি অবশ্য তার আগে ১৯৮৭ সালে এসে ছয় মাসের জন্য ঘুরে গেছি। এই ন'দাদাই সবাইকে এখানে এনেছে। ন'দাদার একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল, “বেঙ্গল ইমপোর্টস”। তুমি দেখেছো তো। দাদারা তো সবাই শিবপুর বি ই কলেজের। তুমি জানোই।

এখানে আসার পর মদ আর মেয়েমানুষের ভিড়ে না মিশে এই ইন্ডিয়ান দোকান করেছিল। কাজের শেষে সেটা চালাতো ন'দা আর পংকজ ধবলদেব দা।

“পংকজ ধবলদেবদা তো ঝাড়্গ্রাম রাজবাড়ির ছেলে, তাই না?” পলাশ প্রশ্ন করল।

“আগে বলেছি তো ওনার কথা। খুব খুউব ভালো মানুষ ছিল পংকজ দা। ওনার বৌ বিলাসপুরের রাজকন্যা কিরণ ভাবী। হ্যাঁ! অ-বাঙ্গালি ছিল, তবে ব্যটনরুজে এসে দিদিয়া আর বাড়ির সবার জন্য পরিষ্কার বাংলা শিখে গেছে। খুব সুন্দর দেখতে ছিল। এখন ওরা থাকে নিউ জার্সি তে। তারপর অন্য দাদারা, বৌদিরা, দিদিয়া আসলে তারাও সবাই মিলে চালাত সেই দোকান। কিরণ ভাবী তো থাকতই।

-“এখন তো বন্ধ করে দিয়েছে ন'দা, তাই না?”

-হ্যাঁ! বয়স হয়ে গেছে তো সবার। কাজেই বিক্রি করে দিয়েছে সেই দোকান। ভাইপো ভাইঝিরাও যে যার কাজে ব্যস্ত অন্য শহরে। আমি অবশ্য কোনোদিন বসি নি ওই দোকানে। তবে সাজাতাম মাঝে মাঝে। আমার হাতের তৈরী কুরুশের সব ব্যাগ, সেন্টার পিস, কোটি, পুতুল সব বিক্রি হয়েছে খুব।

-কারা কিনত শিমুল? তুমি দেশ থেকে শিখে এসেছিলে, তাই না?

-হ্যাঁ! আমি কলকাতায় থাকাকালিন ভবানীপুরের টিনা মাসীমার কাছে শিখেছিলাম। আমেরিকানরা , রেড আমেরিকানরা খুব পছন্দ করেছিল সেই সব জিনিস। তারপর 'সোয়াগম্যান' নামে এক সুপারস্টোর-এর ম্যানেজার এসে ন'দাদার কাছ থেকে বাকি সব কিনে নিয়েছিল। বলেছিল, “এত সুন্দর জিনিসগুলোতে ইন্ডিয়ান মশলার গন্ধ থাকলে, কেউ নেবে না।”

ছোট ভাই-এর আমেরিকান বৌ কিছু হাতের কাজ ওদের চাকরির জায়গা ডেরিডারের শো কেসে রাখল। ওখানেও সব বিক্রি হয়ে গেল।

আমি রান্নাও শিখিয়েছি বাড়িতে -দাদারা বুদ্ধি করে দুপুরে আমাকে ব্যস্ত রাখবার ব্যবস্থা করে ফেলল। না হলে কোনোদিনও জড়তা কাটত না। বাড়িতেই আমাদের কিচেনে ইন্ডিয়ান রান্নার ক্লাস শুরু করলাম-সাদা ভাত, সড়ষে দিয়ে ক্যাট ফিশ ফিলে, বেগুন ভাজা এইরকম সোজা রান্না দিয়ে শেখাতে শুরু করলাম। ১১ জন এসেছিল শিখতে। হাউসওয়াইফ যারা তারাই এসেছিল শিখতে। তাদের স্বামীরা কেউ কেউ ইন্ডিয়া গেছিল তখন তারা রান্নার স্বাদ পায়, দোকানে বিজ্ঞাপন দেখে তাদের বৌদের রান্না শেখার জন্য পাঠায় । এখানে সব কিছুর ইভালুয়েশন দেয়-ওরা কি সুন্দর ভাবে লিখে দিল। ভাত থেকে পোলাও, বিরিয়ানি কিভাবে শর্টকাটে করা যায় শিখল। পেট পুরে তৃপ্তি করে খেত। আমার তখন খুব ভালো লাগত, সেই সময় যেন অন্য জগতে বাস করতাম । প্রতি সপ্তাহে একদিন করে শেখাতাম। অল্প করে রান্না করে নিয়ে আসতে বলতাম-যেটা শেখাতাম। দুটো সিটিং করিয়েছিলাম। এখানেও যে হাউস ওয়াইফ আছে-বিশ্বাস করবে না অনেকে।

তারপর ন'দাদা আমাকে প্রাইভেট কলেজ 'ব্যাটনরুজ স্কুল অফ কম্পিউটার'-এ কম্পিউটার একাউন্টিং নিয়ে পড়বার জন্য ভর্তি করে দিল। আমি বিশ্বাস করি... শিক্ষা, বুদ্ধি, বিদ্যা, জ্ঞান, উন্নতি-যা কিছু, সব সুখের জন্য । যেমন করেই দেখো না কেন, নিজের সুখ বাড়ানো ছাড়া আর কিছুই নয়।

আগে আসলে হয়ত অনেক কিছু করতে পারতাম কিন্তু আমাকে এখানে আসতে না দেওয়ার জন্য ওরা কেস করল যে, ওদের না জানিয়ে আমাকে ওরা নিয়ে আসছে এদেশে। তাই আবার সব মিটিয়ে একেবারে পাকাপাকিভাবে এদেশে এসে পৌঁছালাম। আর পিছুটান রইল না।

 চারিদিকে ঝাঁ চকচকে আবহাওয়া। মনটাও বেশ ঝরঝরে লাগছিল তখন।

'ব্যটনরুজ স্কুল অফ কম্পিউটার' -এ পড়বার সময় আলাপ হল নানা দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে।

আমেরিকান মেয়ে শীলা লেন আমার খুব ভাল বান্ধবী হয়েছিল । নদা অফিসে যাওয়ার সময় আমাকে কলেজে নামিয়ে দিত আবার অফিস ছুটির পরে আমাকে বাড়ি নিয়ে যেত।  তারপর শীলা নদাকে বলেছিল, "আমি শিমুলকে বাড়িতে ড্রপ করে দেব।" কারণ, আমাকে অপেক্ষা করতে হত নদার জন্য প্রায় দেড় ঘণ্টা। 

ওখানে আবার একটা ইরানিয়ান ছেলে 'ফ্র্যাঙ্ক পাওনে' আমার পেছনে লাগে।  সে শীলাকে আমার সাথে আলাপ করিয়ে দিতে বলে। ব্রেকে একদিন কলেজ ক্যানটিনে  আমরা স্ন্যাক্স খাচ্ছি। সেই ছেলেটা যার নাম ফ্র্যাঙ্ক পাওনে এসে টেবিলে ঠিক আমার সামনে বসে পড়ল।

জিজ্ঞেস করে, “আর ইউ এনগেজড, শিমুল?”

“ইয়েস!” ছোট্ট উত্তর আমার।

“হোয়ার ইজ ইয়োর ফিয়ান্সে নাও?”

“ইন্ডিয়া।” আবার ছোট্ট উত্তর আমার।

“ওহ মাই গড! হি ইজ দেয়ার, এন্ড ইউ আর ওয়েটিং ফর ইয়োর ফিয়ান্সে হিয়ার? এনজয় ইয়োর লাইফ! ওকে!”

ওয়ান মোর কোশ্চেনঃ “সাপোজড ইয়োর ফিয়ান্সে ডায়েড। হোয়াট ইউ উইল ডু দেন?”

“উইল বি উইডো দেন”। বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলাম। এগুলো বলছি কারণ, আমার খুব অদ্ভুত লেগেছিল তখন।

“হোয়াই? হোয়াই সো শিমুল?” অবাক হয়েছে যেন এমনভাবে প্রশ্ন করল।

“দ্যাটস দি ইন্ডিয়ান কালচার”। ফ্র্যাঙ্ক তখন হা হা করে প্রাণখুলে হাসতে লাগল। আমার খুব বিরক্ত লাগছিল তখন। কিছু বলতে পারছিলাম না তো। ভাগ্যিস ক্লাশ শুরু হয়ে গেল, তাই উঠে পড়লাম আমরা।

কলকাতা থেকে সেজ'দা গিয়ে বৌদি, বাচ্চাদের নিয়ে হুড়মুড় করে এসে পড়ল। বাড়ি জমজমাট। এবার আমার ওপরে ভার পড়ল বাচ্চাদের পড়াশুনা দেখাবার। খুব ভালো লাগতে লাগল তখন।

সবাই বলে স্যাক্রিফাইস করেছি। ওদের জানাই গীতায় আছে, “স্যাক্রিফাইস না করলে জীবনে হ্যাপিনেস আসে না।” 

একটু অন্য কথায় যাই... আমার এই জীবন গড়ে তোলার জন্য যেটা রঙ্গীন আর আবশ্যিক ...

ব্যাটনরুজ স্কুল অফ কম্প্যিউটার কলেজে ভালো রেজাল্ট করে কাজ পেলাম 'ডিপার্টমেন্ট অফ এনভাইরনমেন্টাল কোয়ালিটিতে' ডাটা এন্ট্রিস্ট হিসেবে। ভালো লাগল না কাজ। সব সময় কম্প্যিউটারে কাজের জন্য, আমার হাতের নার্ভের প্রবলেম শুরু হল। কিন্তু জীবনকে থামতে দিলাম না। মনে মনে জীবনকে বললাম, “ চলো ইয়ার, আগে বঢ়কে দেখে...”

(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments