জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। তেইশ/শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। তেইশ

শুভঙ্কর দাস 

"যেন রসনায় মম
সত্যবাক্য ঝুলি উঠে খরখড়্গসম 
তোমার ইঙ্গিতে।যেন রাখি তব মান
তোমার বিচারাসনে লয়ে নিজ স্থান।
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।"


আপনি কি ইণ্ডিয়ান?

হ্যাঁ

ওহ্ অতি জঘন্য একটি দেশ, ততোধিক জঘন্য সেই দেশের আচার ও সংস্কার,এইভাবে মাথা উঁচু করে 'হ্যাঁ' বলতে লজ্জা করছে না!

না,মোটেই লজ্জা করছে না,বরং গর্ব হয়, এতোখানি স্বৈরাচারী ও অসভ্য শাসকের পায়ে দলেপিষে থেকেও নিজেদের ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে বিস্মৃত হইনি।

তাই? হোয়াট এ জোক!আমি শুনেছি, ইণ্ডিয়াতে কাজের ওপর মানুষের পরিচয় তৈরি হয়, এবং সে পরিচয় তাকে বংশপরম্পরায় বহন করতে হয়, এক পুরুষ মেথরের কাজ করে,তার বংশে আর কেউ ব্রাহ্মণ হতে পারে না,তারপর এই স্বাধীনযুগে আপনারা পরাধীনভাবে জীবনযাপন করতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। মাথা তুলে কোথাও দাঁড়ানো আপনারদের উচিত নয়।


মৃদু হাসলেন বীরেন,তারপর বলে উঠলেন,কী আর করা যাবে আপনার স্বজাতিগণ সেই মহৎ অত্যচারটি চালিয়ে যাচ্ছেন মিঃ ডালটন, যাতে আমরা মাথা তুলতে না পারি!

ডালটন লোকটি এবার উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন,সে তো আপনাদের কাপুরুষতা ও দুর্বলতার জন্য এ-ই অবস্থা, আমাদের দেখুন,কীভাবে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, শিক্ষা,শিল্পে এবং মানবিকতায়..

সে তো ঠিক,একটা নবীন জাতি তো অপর জাতিকে দেখে শিখে নেয় তাড়াতাড়ি, তাই তাদের তো এগিয়ে যাওয়া ধর্ম,পিতার চেয়ে পুত্র উন্নতি করলে সে কি লজ্জার! 

মানে? হোয়াট ডু ইউ মিন?

আইন মিন এমটি ভেসেল মেক দা সাউন্ড মাচ, একটু মন দিয়ে শুনুন,আমি যে দেশের মানুষ,তার সভ্যতা এতোখানি সুপ্রাচীন যে তার পাশে আপনার এই ইংল্যান্ডকে শিশু বললে কোনো অক্তুতি হয় না। যিশুর জন্মের সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে আমাদের দেশে মহাকাব্য রামায়ণ লেখা হয়ে গেছে। তখন হয়তো ইংল্যান্ড বলে কোনো দেশের অস্তিত্বই ছিল না।ছাড়ুন, ভারতবর্ষের কথা,সে অনেক মহান ব্যাপার,আমি শুধু বলব, আমার জেলার কথা।আমি মেদিনীপুর বলে একটি প্রভিডেন্স থেকে আসছি,তার একটি বন্দর আছে, তার নাম তাম্রলিপ্ত।সেই বন্দর এতোখানি উন্নত ও আধুনিক ছিল,যা দেখার জন্য সুদূর চিন থেকে ফা-হিয়েন এসেছিলেন এবং তিনি এখানে ৩০ টি পবিত্র বৌদ্ধপীঠ দর্শন করেন। এখানকার পড়াশোনা দেখে চমকিত হন এবং ফা-হিয়েনের ২০০ বছর পর আবার সেই চিন থেকে হিউয়েং সাং আসেন,এই তাম্রলিপ্ত বন্দরে। তখনও তার উন্নতি ও প্রতিপত্তি দেখে চমকিত হন।
সবচেয়ে বড় কথা,আপনার দেশের ব্যবসায়ী তো সমুদ্র ডিঙিয়ে এসেছিলেন আমাদের দেশে,সামান্য দারুচিনির কমদামে সংগ্রহের লোভে,এখন তাদের লোভ যদি রাক্ষুসে হয়,তাতে আমাদের কী দোষ বলতে পারেন!

ডালটন এর উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল
তার আগেই বীরেন বলে উঠলেন,আর আপনার দেশের মানুষের মানবিকতার কথা বলছিলেন না,তবে শুনুন, শুধু ধর্মের দিক থেকে ডিসেন্টার বলে একজন মহান সাহিত্যিককে এই দেশের মানুষ অবহেলা ও ঘৃণার চোখে দেখত, এখনও দেখে।এবং সেই সাহিত্যিককে বই লেখার জন্য প্রকাশ্যে একটা খোলা জায়গায় বড় থামের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়।এবং যারা দেখতে আসে তারা তামাশা-মজার ছলে ইট-পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে সেই এমনভাবে আহত করা হত,যে সে মারাই পড়ত।ভাগ্যিস ইনি মরেননি, তাই এইরকম অসাধারণ উপন্যাস আমরা পেয়েছি। 

হু ইজ হি? 

ড্যানিয়েল ডিফোর নাম শুনেছো মাই ব্রাদার, তাঁর জগতজোড়া বিখ্যাত উপন্যাসের নাম রবিসশন ক্রুশো।

ডালটন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

বীরেন তা দেখে ডালটনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,মাই ফ্রেন্ড,  সব দেশেই ভালো-মন্দ সবকিছু থাকে,তাই বলে সেই সব বিচার করে নিজেদের বন্ধুত্ব নষ্ট করার মানে হয়!
বিমল এসেই সব শুনেছিল।সে ডালটনের দিকে তাকিয়ে বলল,ভাইটি, এর নাম বীরেন শাসমল, একে চেনো না,এ যেমন মেদিনীপুরের রাজা,তেমনি পড়াশোনায় খোদ লন্ডনের মিডল টেম্পলের রাজা।তুমি ভাই ইংল্যান্ডে জন্মাাতে পারো,এ তোমার চাইতে বেশি ইংল্যান্ডকে চেনে,তাই এর সঙ্গে মুখ করতে এসো না!

তুই থামবি বিমল,হালকা রাগ দেখিয়ে বললেন বীরেন।

তুই রাগ দেখলে কী হবে? বাসার বাইরের চল,দ্যাখ কারা এসেছে তোকে নিতে!

কেন? কৌতূহলী হল বীরেন।

আরে ভুলে গেলি,সেই যে লন্ডন স্কোয়ারে যেতে হবে,সেই যে একজন বিখ্যাত আইরিশ নেতা বক্তব্য দিতে আসবে,তুই শুনবি বললি,রাতেই তো কথা হল ভুলে গেলি!

ওহ্ আচ্ছা,কিন্তু ওটা তো রবার্ট বলেছিল,সে কোথায়?

আরে আমি এখানেই অপেক্ষা করছি,বন্ধু, কাম অন, আর লেট করা যাবে না,চল, চল ভাই,দরজার কাছ থেকে একজন ইংরেজ যুবক মুখ বাড়িয়ে বলল।

বীরেন তাড়াতাড়ি পোশাক পরিবর্তন করে বেরিয়ে পড়ল।লন্ডনের বিকেলবেলা। হালকা তুষার তুলোর মতো ঝরে পড়ছে।পাইনগাছগুলো সেই তুলো মেখে দাঁড়িয়ে আছে,যেন একটু পরে ছদ্মবেশ প্রতিযোগিতা হবে,তার মেকাপ চলছে। এখানের একটি জিনিস বীরেনের খুব ভালো লাগে,প্রতিটি গাড়ি-ঘোড়া সুনির্দিষ্ট পথ ধরে চলে এবং শব্দহীনভাবে। তারপর বন্ধুদের সঙ্গে এক অনন্য অভিজ্ঞতা হবে ভেবে গাড়িতে চড়ে বসল।এই আইরিশ নেতা নিজের দেশের স্বাধীনতার জন্য একেবারে মাটিতে পা রেখে কাজ করেছেন,শুধু বক্তব্যবাজ নন, রীতিমতো পড়াশোনা ও মানুষের সঙ্গে মিশে দেশের স্বপ্ন সাকার করার কারিগর।সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার,যে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তাঁর যাবতীয় কাজকর্ম সেই ইংল্যান্ডের রাজধানীতে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ ঘটেছে। 
কিন্তু রবার্ট এসব শুনে চোখ টিপেছে বিমলের দিকে... 
একটি পরিচ্ছন্ন, উন্নত, বিলাসী অডিটোরিয়াম। ভেতরে ঢুকলে মন ভালো হয়ে যায়।কিন্তু মঞ্চে পর্দা লাগানো কেন? তারপরে কোনো মাইক্রোফোনের আয়োজন নেই, বক্তব্য কীভাবে দেবে?
এই প্রশ্ন মনে আসতে রবার্ট বলে উঠল,আসলে আইরিশ নেতাটি নিজেদের কাজকর্মের কিছু ফুটেজ দেখাবে,তাই এই ব্যবস্থা  আর তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেন না,দর্শকদের মধ্যে ঘুরেফিরে কথা বলেন।

ওহ্, বাহ্ তাহলে তো দারুণ মানুষ।

ব্যাস,কিছুক্ষণ অনুষ্ঠান শুরু হল।আর বীরেনের মাথায় আগুন জ্বলে গেল।

কোথায় সেই আইরিশ নেতা! কোথায় তার বক্তব্য? এতো সিনেমা শুরু হয়েছে, তার মানে এটি একটি সিনেমাহল।তাঁকে পেছনের দরজা দিয়ে এই জন্য ঢোকানো হয়েছে, তাঁকে পুরোপুরি ঠকানো হয়েছে, তাঁর বন্ধুরা মজা করার জন্য এ-ই প্লান করেছে।
পর্দায় তখন চলছে ইংরেজি কোনো রোমান্টিক মুভি।
ক্রোধে চোখ লাল হয়ে গেল বীরনের।
তিনি বুটের সশব্দে হল থেকে বেরিয়ে এলেন।
সেদিন রাতে বাসায় অন্নগ্রহণ করলেন না। এমন কি রাগ এতোখানি হল, বাসার বন্ধুদের এই ছলনার জন্য তিন-চারদিন কথা বললেন না।
একদিন সন্ধ্যাবেলা।
বিমল এলো বীরেনের ঘরের সামনে।সঙ্গে সঙ্গে বীরেন তাকে ঠেলতে ঠেলতে বাইরে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বিমল বলে উঠল,আচ্ছা, বন্ধু ভুল হয়ে গেছে,আমরা জাস্ট মজা করতে চেয়েছিলাম,তুই সারাক্ষণ পড়াশোনা করিস,কলেজে গিয়ে সেই পড়াশোনা, কখনো ক্যান্টিনে আসিস না,বাইরে ঘুরতে যাস না,পার্টি-ফার্টিতে তীব্র অনীহা,তাই রবার্ট-পিটার মিলে এই প্লান করেছে।এখন তো মাফ করে দে..

বীরেন ভেতর থেকে শুধু বলল,দেশে গিয়ে কথা হবে।

মানে,ওরে দেশে ফিরতে এখনও তিনবছর, তার মধ্যে বন্ধুদের মধ্যে কি এইসব থাকা ভালো,তার আগে তুই দরজাটা খোল,বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছি,অন্য বাসার ছেলেপুলে দাঁত বের দেখছে

না,কোনো কথা নয়, হাসুক, তোরা কী করে এমন করতে পারলি? এত বড় মিথ্যে,রবার্ট-পিটার না জানুক,তুই তো জানিস, আমি কীরকম, এক কথার মানুষ,একবার যা বলব,তাই করব,ভুলে গেলি,আমার মাকে..

সব মনে আছে,তুই দরজা খোল,এই দ্যাখ রবার্ট পর্যন্ত ভয়ে জড়োসড়ো, সে এতো অনুতপ্ত যে,বোধহয় ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে,তার আর ব্যারিস্টার হওয়া হল না!

মানে?  কী বলছিস? অবাক হল বীরেন। 

ঠিকই বলছি,দরজা খোল

বীরেন দরজা খুলল,সঙ্গে সঙ্গে বিমল,রবার্ট, পিটার আরও পাঁচ-ছয় যুবক ঘরে ঢুকল।সত্যি রবার্ট অনুতপ্ত। 
সে এসেই বীরেনের হাত চেপে বলে উঠল,আই অ্যাম ভেরি সরি ফ্রেন্ড, আমি কোনোদিন এরকম বিহেভিয়ার করব না,তুমি আমাকে এবারের মতো ক্ষমা করে দাও।

বীরেন মুখে কিছুই বললেন না।শুধু একটি ব্যাগ থেকে একটি কাগজ বের করে বিমলের হাতে দিল।বিমল বুঝতে পারল,এটি সেই প্রতিজ্ঞাপত্র, যা বীরেন দেশ ছাড়ার পূর্বে তার জননীর কাছে করেছিল।
সে পুরোটা পড়তে লাগল।
" পরমারধ্যতমা শ্রীযুক্তা জননী ঠাকুরানী, সংসার সুহৃদ জ্যেষ্ঠ পূজনীয় অগ্রজ ও জ্যেষ্ঠ ভগিনীগণ, পূজ্যবর আচার্য এবং গুরুজনগণ, শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুগণ,স্নেহাস্পদ কনিষ্ঠ ভ্রাতা-ভগিনী ও আত্মসুহৃদগণ... 

আপনারা যে সকল সদুপদেশ প্রদান করিলেন,তাহা আমি কদাচ বিস্মৃত হইব না।প্রবাসকালে সে সকল স্মরণ করিয়া স্বীয় কর্তব্য পালনে যত্নবান হইব।আপনিদিগের সমক্ষে সর্বসাক্ষী ভগবানের দিকে চিত্ত নিবেশিত করিয়া আমিও প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে...

সব পড়ার দরকার নেই, বিমল,তুই তিন নম্বরটা পড়, বলে উঠলেন বীরেন।

মোট নটি প্রতিজ্ঞার তিন নম্বর বিমল পড়তে শুরু করল,

"আমার চরিত্র সর্রতোভাবে নির্মল রাখিয়া যথাসাধ্য তাহার উন্নতির জন্য চেষ্টা করিব,চরিত্রবান,ধর্মনিষ্ঠ, ঈশ্বরবিশ্বাসী, সাধু ও সৎকর্মশীল ব্যক্তি ভিন্ন অপর কাহারও সহিত ঘনিষ্ঠতা রাখিব না এবং অসচ্চরিত্র, বিলাসী ও উচ্ছৃঙ্খল লোকের সহিত সংসর্গ করিব না।"

এইকথাগুলো ইংরেজিতে ট্রান্সলেশন করে শুনিয়ে দিল বিমল।
সত্যি তাই,যা যা প্রতিজ্ঞাপত্রে লেখা ছিল বীরেন সেইভাবে জীবনযাপন করেছিলেন।নিজের হাতে রান্না করে একেবারে ব্রহ্মচারীর মতো লন্ডনে কাটিয়েছেন।ক্লাসের অতি প্রিয় বন্ধুরা বীরেনকে রেস্তোরাঁয় নিয়ে যেতে পারেনি।কোনোদিন কোনো মেলা-অনুষ্ঠান, এমন কি কলেজ শট টুরে পর্যন্ত বীরেন যায়নি।
কিন্তু পড়াশোনার কাজে জাপান,ফ্রান্স,আমেরিকা গেছেন,অথচ সেই প্রতিজ্ঞাপত্র লঙ্ঘন করেননি! 
বীরেনের একটাই কথা,একবার আমি যা কথা দেব,সেই কথা রাখার জন্য আমার মাথা যদি কেটে ফেলা হয়,তাতেই আমি রাজি,কোনোদিন কথার খেলাপ করতে পারব না।

ডালটন পাশের ঘরে ছিল,সে এসে সব শুনে বীরেনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,দ্যাট ম্যান অ্যাজ এক্সট্রাঅডিনারী! 

এই কথা রাখা কী মারাত্মক সত্যি, তা বীরেন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে দেখিয়েছেন। প্রায় চার বছর পর বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফেরেন।এবং মেদিনীপুর এবং কলকাতা দুই জায়গায় প্র্যাকটিস শুরু করেন।অল্প দিনের মধ্যে ব্যারিস্টারিতে নাম করতে শুরু করেন। 
এই সময় মেদিনীপুর আদালতে কাজ করতে গিয়ে একটি ঘটনা ঘটে।
সেদিন আদালতের কাজ সেরে বীরেন বেরিয়েছেন,এমন সময় পারিবারিক আত্মীয় ও একান্ত সচিব ত্রৈলোক্য প্রধান এসে হাঁপাতে লাগল।
বলে উঠলেন, একটা কাণ্ড ঘটেছে বীরেনবাবু, সেই ঘটনার এবার একটা শেষমেস না করলে নয়।

কোন ঘটনা?

সেই যে কাশ্মীরী বিধবা ব্রাহ্মণীর ঘটনা

সে তো আমি মধ্যস্থ করে মিটিয়ে দিয়েছিলাম

কিন্তু সেই ব্রজমোহন তো ছাড়ছে না,সে এবার অন্য জিগির তুলেছে

কী?  

এই ওরা বেজাতের 

মানে?

মানে বাঙালি নয়, তাই এখানে থাকার অধিকার নেই, আরও কানভারি করেছে,এই বলে,এদের জন্য নাকি বঙ্গভঙ্গ হয়েছিল!

সেকি!  এতো মারাত্মক অন্যায়।অসহায় মানুষকে এইভাবে জোরজুলুম করছে

আরও আছে,এখানেই শেষ নয়

কী?

যেহেতু ওরা বাংলা কথা বলতে জানে না,কাশ্মীরী, তার ওপর মাথার ওপর কেউ নেই, তাই ব্রজমোহনের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে বিধবার সাড়ে দশবিঘা জায়গার ওপর 

বটে,এই ব্যাপার চলুন,এখুনি এগরা যাবো বলেই বীরেন হনহনিয়ে নিজস্ব গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন।

ঘটনাটি এই

লালা বলরাম নামে এক ব্যক্তি কাশ্মীর থেকে বঙ্গদেশে এসে উপস্থিত হন,কর্মসূত্রে।এখানে এসে তার ভাগ্যের চাকা খুলে যায়।তারপর পরিবারসহ এগরার কাছে জমিটমি কিনে বসবাস শুরু করেন।সারদামণি লালার যোগ্য সহধর্মিণী ছিলেন।বাঙালি পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।বাংলা কথা বলতে পারতেন না,তাই ইশারা-ইঙ্গিত করে কাজ চালাতেন। তাদের দুটি কন্যাসন্তান।লালা বলরাম মিশুকে লোক।অল্পদিনের মধ্যে আশেপাশের মানুষজনের সঙ্গে সৌহার্দ্য গড়ে তোলেন।কিন্তু সহসা একটি দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। 
ব্যাস,সেই সময় স্থানীয় মহাজন ব্রজমোহনের দৃষ্টি পড়ে সেই বাড়িটির ওপর।নানারকম ঝামেলা ও নিন্দামন্দ করে গৃহছাড়া করার চেষ্টা করতে থাকে।বিধবার অল্প টাকা ছাড়া পুঁজি ছিল না।কিন্তু সেই সময় আদালতে বীরেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ। এবং পরিত্রাতা হিসেবে বীরেন এই ঘটনায় উপস্থিত হন।তিনি ব্রজমোহনের বিষদাঁত ভাঙতে সক্ষম হন। এবং সেই পরিবারকে নিজের গ্রাম চণ্ডীভেটির পাশে ভবানীপুরে এনে বসত গড়ে দেন।
সবই ঠিকঠাক চলছিল।কিন্তু ব্রজমোহন দমবার পাত্র নয়, সে দূর থেকে কলকাঠি নেড়ে সেই গ্রামের কিছু লোককে টাকা দিয়ে কিনে ফেলল। তারা সেই বিধবা মহিলাকে বিপাকে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল।
এখন গুরুতর অভিযোগ, লালা বলরাম তিনকড়ি নামে কোনো এক চাল ব্যবসায়ীর কাছে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ করেছিল,তা শোধ করেনি,তার ফলে আসল-সুদসহ যা টাকা হয়েছে, তা পরিশোধ করতে এই বিধবা মহিলাকে পথে বসতে হবে।
তারপর আরও সমস্যা হচ্ছে, এইসনব যখন সালিশি প্রক্রিয়া চলছে,তখন এই বিধবার সপক্ষে কেউ দাঁড়ানো তো দূর,বলার লোক ছিল না,কারণ ভাষাগত একটা বাধা ছিল।
অশ্রুসজল কণ্ঠে মহিলা হিন্দিতে যা বলছে মোড়ল মহাশয় তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারছেন না।ফলে জটিলতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোটামুটি একটা শেষ পর্যায়ে উপস্থিত, অর্থাৎ বিধবা মহিলাকে উচ্ছেদ করার কাজ প্রায় হয়ে এসেছিল,এমন সময় বীরেন চিত্রনাট্যে প্রবেশ করলেন।

সারদামণির গৃহের সামনে বেশ কয়েকজন উপস্থিত। একপাশে তিনকড়ি ও তার লোকজন এই সালিশি সভার পর দখল নেবে ঘরবাড়ি, এইরকম একটা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দাঁড়িয়ে। অন্যপাশে সারদামণি মাথায় আঁচল দিয়ে মাথা নত করে সবকিছু বোঝার চেষ্টা করছেন এবং আঁচলের একপ্রান্ত থেকে তিনিও কিছু বলছেন,কিন্তু কজন তা বুঝবে বোঝা মুসকিল।তার দিকে গাঁয়ের দু-একটি মহিলা আছেন।
মাঝখানে বৃদ্ধ মোড়ল,মাদুরে বসে।তাঁর মুখ গোঁফ-দাঁড়ির জঙ্গল।এমন কি ভ্রূর চুল পর্যন্ত এমনভাবে ঝুলে আছে,তিনি জাগ্রত নাকি নিদ্রিত বোঝা মুসকিল।যখনই কিছু বলার জন্য গলাটা উঁচু করেন,এতবেশি কেশে ওঠেন,তাঁর কোনো কথাই পরিষ্কার শোনা যায় না।তাই একজন দোভাষীর কাজ করছে,সেই লোকটি অবশ্য মারাত্মক রকমের অনুকথক,অর্থাৎ মোড়ল মহাশয় যদি একটি বাক্য বলেন,তাহলে দোভাষী তাই দশটি বাক্যে বুঝিয়ে দেন।
আর তাতে তিনকড়ি মাঝেমধ্যে লাফিয়ে উঠছিল।
বীরেন প্রথমেই ঢুকে তিনকড়ির দিকে চেয়ে বলে উঠলেন,এখনও সালিশিসভার সিদ্ধান্ত শোনানো হয়নি,এতো উত্তেজনা কি ভালো? আপনি প্রমাণপত্রটি একবার দেখান,যে কাগজে লালা বলরাম সই করে আপনার কাছে টাকা ধার করেছিল।

বীরেনের উপস্থিতির সভায় তরঙ্গ খেলে গেল।বৃদ্ধ মোড়ল নড়েচড়ে বসলেন।এইরকম একটি গেঁয় সালিশিসভায় বিলেত-ফেরত ব্যারিস্টার এসে দাঁড়িয়েছে,এটাও তো বিরল ঘটনা।
তিনকড়ির বুক কাঁপতে লাগল।কিন্তু বাইরে সেকথা বুঝতে দিল না।সে চেঁচিয়ে বলল,ঐ তো কাগজ,তাতে সই আছে,টাকার পরিমাণও উল্লেখ আছে,আমি কি মিথ্যা বলছি, আমি হরিভক্ত,খুব শক্ত আমাকে ঠকানো...

সেই মোড়লের দোভাষীর হাতে একটি কাগজ ছিল।বীরেন সেটা দেখার জন্য নিল।।তিনি দেখা মাত্র বুঝলেন,এই কাগজ জাল এবং সইও জাল করা হয়েছে। 
তারপর বীরেন নতমুখ সারদামণির কাছে গিয়ে বললেন,আপনার স্বামী তো নিশ্চিত কোনো না কোনো দলিল রেখে গেছেন,সেটি একটু দেখব।

একথা শোনার পর সারদামণি মাথা নাড়লেন এবং ঘরের ভিতরের দিকে তাকিয়ে ডাকলেন, হেমু, হেমু

সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা হেমন্ত কুমারী  বেরিয়ে এলো।তাকে দেখে বীরেন পাশে দাঁড়ানো ত্রৈলোক্য প্রধানকে ইশারা করলেন,দলিলটি নিয়ে আসার জন্য। 
ত্রৈলোক্য এবং হেমন্তকুমারী ঘরের ভেতরে গেল।কিছুক্ষণ পরে একটি দলিল হাতে করে ত্রৈলোক্য এলেন।
বীরেন তার সঙ্গে তিনকড়ির কাগজ মিলিয়ে একেবারে নিশ্চিত হলেন,এটি জাল কাগজ।
এবার বীরেন মোড়লমশাইয়ের দিকে কঠিন কণ্ঠে বলে উঠলেন,এই কাগজটি জাল,এটি অবশ্য আমার অনুমান।তবুও আমি সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ল্যাবটেরিতে টেস্ট করতে পাঠাব,আপনার অনুমতি চাইছি?

কোথা? ল্যা-ল্যা- বো-- টা র, সেটা আবার কী জি- জি- নিস? অনেক কষ্টে বলে উঠলেন মোড়ল।

এখন এইভাবে অপরাধ ধরা চলছে,এবং আমার বিশ্বাস, এতেই সত্যিটা বেরিয়ে আসবে।আর এই কাগজ যদি জাল বেরোয়,তাহলে তিনকড়িবাবুর একজন অসহায় বিধবা মহিলাকে অকারণে বিরক্ত ও তাঁর সম্পত্তির ওপর অযথা দখলদারির জন্য তিন বছরের জেল এবং তিন হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে।
এবং যারা এখানে মিথ্যে সাক্ষী দেওয়ার জন্য তিনকড়িবাবুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে,তাদের জেল হয়তো হবে না,কিন্তু টাকা জরিমানা দিতেই হবে।

উপস্থিত কেউ কোনোদিন ল্যাবেটরি কী তাই নামই শোনেনি,তার ওপর শাস্তির বহর শুনে তিনকড়ির দিকের লোকজন সুড়সুড় করে পালাতে লাগল।
অবশ্য এই ল্যাবেটরিতে টেষ্ট সেভাবে ভারতবর্ষে চালু হয়নি,তবে বীরেন বিদেশে পড়ার সময় তা শুনেছে এবং দেখেছে। 

ত্রৈলোক্য মৃদুস্বরে বলে উঠলেন,অর্থাৎ তিনকড়ির কোনো কড়ি রক্ষা হবে না।

কিছুক্ষণ নীরবতা। 

তিনকড়ি কী করবে খুঁজে পেলো না। সে আরও একবার নিজেকে সত্যি বলে দাবি করার জন্য বলে উঠল,এতো গ্রামের সালিশি, এখানে ঐসব লাবটারি টেস্ট আসছে কেন? এতে তো মোড়লমশাইের অপমান।যা বিচার এখানে হবে।

তারপর তিনকড়ি ব্রজমোহনের শেখানো মোক্ষম ঘা-টা দিল।তারপর একটি কথা বুঝতে পারছি না,মোড়লমশাই, এই কেসে বীরেনবাবুর উদ্দেশ্যটা কী? তিনি ঐ বেধবার সম্পর্কে কী হন?  কোনো কি আত্মীয়?  সেসব তো পরিষ্কার নয়,কেন উনি ওদের হয়ে বলতে এসেছেন?  তা আগে সবার সামনে পরিষ্কার হোক.. 
বলেই চোখ টিপে তাকাল সেই মোড়লের দোভাষীর দিকে।


মোড়লমশাইের দোভাষী যেন এই প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিল,সেও মাথা ঝাঁকিয়ে সমর্থন করল।
সে আরও যোগ করল,এরা বাঙালি নয়, কাশ্মীরী,কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে,এদের এই গাঁয়ে বসবাসের কোনো অধিকার নেই,মোদের নিজস্ব আচার-ধারা আছে,তাতে এদের কিছুই মেলে না।তাই এদের যদি গাঁ থেকে বের করা হয়, তাতে কোনো ক্ষতি নেই। তার ওপর বীরেনবাবুর এই পরিবারের প্রতি এতখানি দরদ কীসের জন্য, তাও বুঝতে পারছি না!
এদিকে সারদামণি কতটা বুঝল কে জানে,তবে তিনিও কেমন অসহায় বোধ করলেন। আসলে তিনি বীরেনের মতো সম্মানী ও সৎ মানুষের জন্য চিন্তিত। 

বীরেনের এইবার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল।তিনি বলে উঠলেন,খুব পরিষ্কার, পরিষ্কার করা হচ্ছে, কে পরিষ্কার আর কে নোংরা আমি প্রমাণ করে ছাড়ব।
সই জাল করে মানুষকে হয়রানি, জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়ব...

এই বজ্রনাদী কণ্ঠস্বর শুনে তিনকড়ির হাড় পর্যন্ত শুকিয়ে গেল।সে ব্যাপারটা যে এমন হবে বুঝতে পারেনি।

তারপর যখন বীরেন চেঁচিয়ে বলে উঠল,কলকাতা নয়, এই মেদিনীপুর আদালতে টেস্ট করার আমি ব্যবস্থা,করব,যত পয়সা লাগুক, কোনটা দুধ আর কোনটা জল পরিষ্কার হয়ে যাবে। 

এই কথা শুনে তিনকড়ির সকল কড়ি মাটিতে গড়াগড়ি দিল।সে দৌড়ে গিয়ে মোড়লমশাইের পাশে পড়ল।ককিয়ে কেঁদে বলে উঠল,মোকে ক্ষমা করে দিন,মুই মিথ্যা বলছি। বীরেনবাবু সত্যি কইছে,ও কাগজ জাল।মোকে ব্রজমোহন এসব তৈয়ার করে দিছিল,মুই শুধু বলছিলি!

এইবার মোড়লমশাই যেন যুবকের শক্তি পেলেন,তিনি কম্পিত হাতে তিনকড়ির গালে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দেন।

তিনকড়ি তখন একবার সারদামণি, একবার বীরেনের, আবার দৌড়ে গিয়ে লালা বলরামের ছবির দিকে তাকিয়ে ক্ষমা চাইতে লাগল।


ব্যাস! সভার কাজ শেষ হয়ে গেল।
সকলে চলে যাচ্ছিল,একে একে... 

সেই বীরেন উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠলেন,আমি সকলের উদ্দেশ্য জানাচ্ছি,  আমি এই সারদাদেবীর কনিষ্ঠ কন্যা হেমন্তকুমারীকে বিবাহ করব,তাহলে তো আমার সঙ্গে এঁদের সম্পর্ক এবং গ্রামের বসবাসের অধিকার নিয়ে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।

সকলে শুনে চমকে গেল।এমন কি ত্রৈলোক্য প্রধান পর্যন্ত থ।
সারদামণি ঘোমটার আড়াল থেকে বীরেনকে দেখলেন এবং সত্যিকারের মানুষ কীরকম হয়, যেন কথাই ভাবতে লাগলেন।স্বামী গত হওয়ার পর যে পরিমাণ গাল-মন্দ  এবং নিপীড়ন সহ্য করেছিলেন,আজ তা যেন সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল।
বৃদ্ধ মোড়লমশাই এইবার উঠে দাঁড়ালেন। বীরেনের কাছে গেলেন। এবং এইরকম অসহায় এক বিধবার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নবীন আগুনে যুবকটিতে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন।


মোড়লমশাই তো কমদিন সালিশি করলেন না,কত রকমের ঘটনার রূপ-বেরূপ তিনি জীবনে দেখেছেন।শুধু শুধু তিনি পক্বকেশধারী হননি, তবুও তিনিও আলোড়িত হন।
এই বয়সেও কত অবাক করা ঘটনা তাঁকে দেখতে হচ্ছে।

প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা বলার,বীরেন কথা রেখেছিলেন। সারদাদেবীর কনিষ্ঠা কন্যা হেমন্তকুমারীর পাণিগ্রহণ করেন এবং স্ত্রীর বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি শিক্ষার জন্য লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হেমন্তকুমারীও স্বামীর মর্যাদা রাখেন,অল্পদিনের মধ্যেই বাংলা ভাষার প্রাথমিক জ্ঞান এবং নানারকম বুনন ও সেলাই শিখে নিয়ে সকলকে চমকে দেন।


ইংরেজ রাজসরকার বিরুদ্ধে গান্ধিজি যখন অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন,তখন তার এই উত্তাল আহ্বানে কংগ্রেসের অধিবেশনে যিনি প্রথম ব্যারিস্টারি ত্যাগ করার ঘোষণা করলেন,তিনি বীরেন অর্থাৎ  বীরেন্দ্রনাথ শাসমল।
রুপোর চামচ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেও,জমিদারের আদুরে সন্তান হয়েও তিনি গরীবের জীবনের মূল্য ও মর্যাদা দুই বুঝতেন।
ব্যারিস্টারি ছাড়াটা শুধু লোকদেখানো মঞ্চ কাঁপানো কথা ছিল না,তিনি এক কথার মানুষ ছিলেন।
নিজের গাড়ি ছেড়ে বাসে-ট্রামে যাতায়াত করতে লাগলেন এবং গ্রামে থাকলে গরুর গাড়ি অথবা পায়ে হেঁটে জনসংযোগ করতে লাগলেন।
প্রায় সকলেই যখন মহানগরকে আন্দোলনের জন্য বেছে নিলেন,তখন তিনি তাকালেন গ্রামের গরীব-দুঃখীদের দিকে।তিনি বোধহয় প্রথম ভারতীয়, যিনি বুঝেছিলেন,বাবুগিরি করে স্বাধীনতা লাভ করা সম্ভব নয়, আর কোনো আন্দোলনকে সার্থক করে তুলতে হলে আগে গ্রামকে জাগাতে হবে।
তার জন্য ধূলিধূসর মাটিকেই মঞ্চ করলেন।

মেদিনীপুরের কাঁথি সংলগ্ন একটি অঞ্চল। একটি খোলা মাঠে বিকেলবেলা লোকে লোকারন্য। এবং আরও লোকজন আসছে মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে। সকলকেই প্রায় গাঁয়ের চাষাভূষা মানুষজন। মহিলাও দলবেঁধে এসে উপস্থিত। অথচ সেখানে কোনো মেলা, যাত্রা অথবা কোনো পরবের আয়োজন নেই। 
সকলে মারাত্মক রকম উত্তেজিত এবং অবাক।
কারণ একজন বিলেত ফেরত ব্যারিস্টারি অদ্ভুত কান্ডকারাখানার আয়োজন করেছেন।
মাঠের মাঝখানে খড়-বিচালির স্তূপ।তার ওপর বিদেশি পোশাক ও জিনিসপত্র সকলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে।তার ফলে স্তূপটি ধীরে ধীরে বড় আকার নিচ্ছে। কেউ আবার নুনের প্যাকেটও ছুঁড়ে দিয়েছে। বীরেন্দ্রনাথ সেই সবকিছু কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করছেন।তিনি গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনকে বোঝাচ্ছেন,এইভাবে যদি আমরা বিদেশি জিনিস ধুলোয় ফেলতে পারি,তাহলে এই বৃটিশ সরকারও একদিন গুলোতে গড়াগড়ি দেবে।

এমন কথা আশেপাশের লোকজন বাপের জন্মে শোনেনি!এমন হওয়া সম্ভব?  বিলাতি জিনিসে বৃটিশ সরকারের  প্রাণ লুকিয়ে আছে?এতো সেই রূপকথার গল্পের মতো? রাক্ষসের প্রাণ লুকিয়ে আছে ভোমরার ভেতর... 

সেই কথাই বীরেন্দ্রনাথ বললেন,হ্যাঁ,একদম ঠিক,আমরা যত ওদের জিনিস না কিনব,ততই আমাদের শক্তি বাড়বে,ওদের শক্তি কমবে... আমরা আমাদের হাতের তৈরি জিনিস ব্যবহার করব।সবচেয়ে বেশি লাগে জামাকাপড়, সেই জিনিস আমরা চরকায় কাটব... খদ্দেরের জিনিস আমাদের পোশাক হবে।
বৃটিশ সরকারের জিনিস না কিনলে,ওরা টাকা রোজগার করতে পারবে না,ফলে ওদের সবকিছু বন্ধ হয়ে যাবে। 

এই কথা বলার ফলে বেশ একটা উল্লাস তৈরি হল। এমন করে কেউ কোনোদিন ভাবেনি! এতো দারুণ ব্যাপার।
একেই বলে হাতে না মেরে পাতে মারা।
সব প্রস্তুতি সারা।
এইবার সেই আশ্চর্য ঘটনা ঘটবে।একটি মশাল জ্বেলে বীরেন্দ্রনাথ তিনবার চক্কর দিলেন স্তূপাকার জিনিসপত্রের চারিপাশে। 
জনতা কৌতুহলে অস্থির। 
এবং ভয়েও কিছুটা।
কারণ দুজন ঘোড়ায় করে পুলিশ এসে উপস্থিত হয়েছে। তাদের দু'জনের হাতে রাইফেল। 

বীরেন্দ্রনাথ সেই ভয়টা লক্ষ্য করলেন।তিনি দেখলেন,এইভাবে পুড়িয়ে দিলে কাজের কাজ কিছুই হবে না।

তিনি সেই আগুন নিয়ে সেই স্তূপের ওপর দাঁড়ালেন,তারপর জনতার দিকে চিৎকার করে বললেন,কে আছো  তোমাদের মধ্যে আমার সঙ্গে এই পুণ্যকাজে এগিয়ে আসবে? 

জনতা চুপচাপ। 

কোনো ভয় নেই,এই কাজের মাধ্যমে আমরা অহিংস ভাবে সরকারকে বুঝিয়ে দিতে চাই,আমরাও মানুষ, আমাদের মানসম্মান আছে।
কেউ আছো? এগিয়ে এসো? এগিয়ে এসো!

সহসা সেই ভীড়ের মধ্যে থেকে একজন লোক বেরিয়ে এলো।বলিষ্ঠ, পাথরকাটা নাকমুখ,গায়ে অতি সাধারণ খদ্দেরের ফতুয়া,পা খালি,তাতে ধুলোর আস্তরণ। 

সেই লোকটি এগিয়ে গেলো।বীরেন্দ্রনাথ খুশি হলেন।তিনি স্তূপ থেকে নেমে এসে সেই লোকটিকে মালটি দিলেন।
তারপর নিজে আরও একটি মশাল জ্বালালেন।
বীরেন্দ্রনাথ এবং সেই লোকটি এগিয়ে গেলো।
দুজনেই আগুন ধরিয়ে দিল বৃটিশের তৈরি করা জিনিসপত্রে।
দাউ দাউদ করে আগুন জ্বলে উঠল।জনতা আবেগে ও উল্লাসে ফেটে পড়ল।
সেই পুলিশের ঘোড়া দুটি ধীর গতিতে চলে গেল।

বীরেন্দ্রনাথ আগুনের রূপ দেখতে দেখতে প্রশ্ন করলেন,কোথা থেকে আসছেন ভাই?

আমি সুতাহাটা থেকে,তবে আমাকে 'আপনি' বলার দরকার নেই।আমি অতি তুচ্ছ মানুষ... 

বীরেন্দ্রনাথ হাসলেন,তারপর বললেন,আচ্ছা,সে তো বুঝলাম,তা এই সুতাহাটা কি সেই হলদি নদীর তীরে? 

হ্যাঁ

অনেকটা রাস্তা, কীভাবে এলে?

আজ্ঞে,কিছুটা গরুর গাড়ি,তারপর হেঁটে 

বীরেন্দ্রনাথ মৃদু অবাক হলেন।

আমাকে তুমি চেনো?

যাঁকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র মেদিনীপুরের মুকুটহীন রাজা বলেন,তাঁকে চিনব না!

দেখে মনে হচ্ছে পড়াশোনা করা লোক, কী পড়ছ? 

আজ্ঞে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের লাস্ট ইয়ারের ছাত্র ছিলাম,পরীক্ষা দিতে মন চায়নি,কারণ দেশকে সেবা করতে চাই,তারপর আপনি তো বলেছেন,"যাঁরা দেশের জন্য অপরের সাহায্য সহানুভূতির আশার অপেক্ষা বলা করে আন্দোলনে কায়মনপ্রাণে যোগদান করতে ও আত্মাহুতি দিতে ইচ্ছুক,শুধু তারাই যেন আন্দোলনে যোগদান করেন।"

আমি আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত...

বীরেন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়ে গেলেন,এইরকম যুবক তো তিনি খুঁজছিলেন,তোমার নাম কী?

আজ্ঞে,কুমার 

কুমার? 

কুমারচন্দ্র জানা...


ক্রমশ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments