জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—ব্রাজিল/হনুমানের লেজের পুনর্জন্ম /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—ব্রাজিল

হনুমানের লেজের পুনর্জন্ম

চিন্ময় দাশ

হনুমান আর খরগোশ। একই বনে থাকে দুজনে। তা থেকেই একটু ভাবসাবও হয়েছে দুজনের। 
হোল কী, একবার দুজনে একটা চুক্তি করল, তাদের এলাকায় যত প্রজাপতি আছে, হনুমান তাদের মেরে ফেলবে। আর, যত সাপ আছে, তাদের সাবাড় করবে খরগোশ। 

একদিন গাছের তলায় শুয়ে একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছে খরগোশ। হনুমানের চোখে পড়ে গেল সেটা। খরগোশের কান তো একটু লম্বা। হনুমান চুপিসারে গিয়ে, দিল কানটা ধরে টেনে। খরগোশ ছিটকে উঠে পড়তেই, হনুমান বলল- ভুল হয়ে গেছে, বন্ধু। তোমার কান এমন বেখাপ্পা, আমি ভাবলাম প্রজাপতি। 

খরগোশ কিছু বলল না। তক্কে তক্কে রইল, কী ভাবে বদলা নেওয়া যায়। … … আরমার সাথে খরগোশের গভীর বন্ধুত্ব। গায়ে শক্তিও খুব। পরামর্শ করল দুজনে মিলে।
বেশ কয়েক দিন তক্কে তক্কে থেকে, মওকা জুটে গেল। গাছতলায় শুয়ে ঘুমোচ্ছিল হনুমান। বন্ধুকে নিয়ে চুপিসারে হাজির হয়ে গেল খরগোশ। দুজনে একটা ভারি পাথর গড়িয়ে এনে, দিল হনুমানের লেজের উপর চপিয়ে। 

আর যায় কোথায়? হনুমান চমকে উঠে, দিয়েছে এক হ্যাঁচকা টান। তাতে লেজটাই ছিঁড়ে গেল বেচারার।
আড়ালে বসে খরগোশের কাণ্ডকারখানা দেখছিল একটা বুনোবেড়াল। সে এক লাফে এসে লেজটা তুলে নিয়েই সরে পড়ল। হনুমান ভয়াণক রেগে চেঁচামেচি করতে লাগল তাতে।

খরগোশ গলা নরম করে বলল—ভুল হয়ে গেছে, ভাই। আমি ভেবেছিলা সাপ। ওটা যে তোমার লেজ, বুঝতেই পারিনিগো। তাছাড়া, ভুল তো হয়েই থাকে, ভাই। তুমি যেমন আমার কানকে প্রজাপতি বলে ভুল করেছিলে সেদিন।
এসব বাজে কথায় কান দিয়ে হবেটা কী হনুমানের? অতো সময়ও নাই তার হাতে। মাথায় একটাই ভাবনা,  নিজের লেজটা। লেজ ছাড়া বাঁচা যায় নাকি? মুখ দেখাবে কী করে সকলের কাছে। যেভাবেই হোক, লেজটা ফেরত পেতে হবে তাকে। বিড়ালের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল হনুমান।

খানিক দূর গিয়েই, পেয়েও গেল বিড়ালকে। কাকুতি মিনতি করে বলল— বেড়ালমাসি, বেড়ালমাসি! দয়া করে আমার লেজটা আমাকে ফেরত দাও। 
--দিয়ে তো দেবই। অমন বেখাপ্পা একটা জিনিষ নিয়ে আমি করবটাই বা কী? বেড়াল দেমাক দেখিয়ে বলল—আগে আমাকে খানিকটা দুধ এনে দে। তাহলে পেয়ে যাবি। 
--হনুমান বলল—দুধ আমি কোথায় পাবো?
বেড়াল বলল—দুধের অভাব কী? গরুকে গিয়ে বল। পেয়ে যাবি।
হনুমান গরুকে গিয়ে বলল— বেড়ালটা ভারি দুষ্টু। আমার লেজ নিয়ে নিয়েছে। খানিকটা দুধ দাও দয়া করে, দুধ পেলে বেড়াল আমার লেজ ফেরত দেবে। 
গরু বলল—দিতে পারি। আমাকে এক আঁটি ঘাস এনে দাও।
হনুমান বলল— যাচ্চলে, ঘাস আমি পাবো কোথায়? 
গরু বলল— কেন গো? চাষিকে গিয়ে বলো। পেয়ে যাবে।
চাষির কাছে গিয়ে হাজির হোল হনুমান। বলল— বেড়াল আমার লেজ নিয়ে নিয়েছে। এক আঁটি ঘাস দাও আমাকে দয়া করে। ঘাস পেলে, গরু দুধ দেবে। দুধ পেলে বেড়াল আমার লেজ ফেরত দেবে।
 চাষি বলল— ঘাস আমি দিতে পারি তোমাকে। দেবোও। আগে আমাকে খানিকটা বৃষ্টি এনে দাও।
হনুমান তো নিজেই পড়ল আকাশ থেকে—বৃষ্টি? সে আমি পাবো কোথায়?
মেঘ ভারি দয়ালু। তাকে গিয়ে বলো। পেয়ে যাবে।
মেঘের কাছে হনুমান বলল- বেড়াল আমার লেজ নিয়ে নিয়েছে। তুমি আমাকে কিছু বৃষ্টি দাও। বৃষ্টি পেলে, চাষি ঘাস দেবে। ঘাস পেলে গরু দুধ দেবে। দুধ পেলে তবেই আমার লেজ ফেরত দেবে বেড়াল। 
মেঘ বলল-- দিতে পারি বৃষ্টি। কিছুটা কুয়াসা এনে দাও আমাকে। 
হনুমান বলল— কী যে বলো, তার নাই ঠিক। কুয়াসা আমি পাবো কোথায়? 
--কুয়াসা পেতে আবার ঝামেলা কোথায়? কোন একটা নদীকে গিয়ে বলো। ঠিক পেয়ে যাবে।
নদী এমন কিছু দূরের পথ নয়। কাছেই ছিল একটা নদী। নদীর কাছে পৌঁছে গেল হনুমান। বলল—হতভাগি বেড়াল আমার লেজ নিয়ে নিয়েছে। তুমি দয়া করে খানিকটা কুয়াসা দাও আমাকে। কুয়াসা পেলে, মেঘ বৃষ্টি দেবে। বৃষ্টি পেলে চাষি ঘাস দেবে। ঘাস পেলে গরু দুধ দেবে। আর, দুধ পেলে, তবেই বেড়াল আমার লেজ আমাকে ফেরত দেবে।

হনুমানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত জরীপ করে, নদী বলল— যত সব অবাক কাণ্ড! কুয়াসা দিয়ে তুমি কী করবে? আর একবার বুঝিয়ে বলো তো, শুনি। 
হনুমান বলল-- আমার লেজ কেটে গিয়েছিল। সেটা  বেড়ালটা নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। কুয়াসা পেলে মেঘ বৃষ্টি দেবে। বৃষ্টি পেলে, চাষি ঘাস দেবে। ঘাস পেলে, গরু দুধ দেবে। দুধ পেলে, তবেই না বেড়াল লেজ ফেরত দেবে আমাকে!ীবার বুঝতে পেরেছ নিশ্চয়। তুমি কিছুটা কুয়াসা দাও, দয়া করে।
নদী বলল—একটু নয় হে। অনেক কুয়াসা দেব তোমাকে। কিন্তু আমার অবস্থা দেখছো তো? শুকিয়ে মরে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে। তুমি একটা ঝর্ণা এনে দাও। কুয়াসা পেয়ে যাবে।  
--কী জ্বালায় পড়লাম বলো তো? ঝর্ণা আমি পাবো কোথায়?    
নদী হেসে বলল— কেন? পাবে কোথায় মানে? সারা জীবন এমাথা ওমাথা লাফিয়ে বেড়াচ্ছো। ঝর্ণা কোথায় পাওয়া যাবে, সেটা জানো না? হাঁদা কোথাকার। ঐ যে দূরে পাহাড়গুলো দেখছো। ওখানে যাও। উঁচু পাহাড়গুলোর ভেতর গিয়ে দ্যাখো। ওখানেই পেয়ে যাবে। 

কতক্ষণ লাফিয়ে লাফিয়ে পাহাড়গুলোর কাছে হাজির হোল হনুমান। বেশি সময় লাগল না। পেয়েও গেল একটা ঝর্ণাকে। হাঁফাতে হাঁফাতেই বলল— সারা দিন ছোটা ছুটি করে হয়রান হয়ে গেলাম। 
ঝর্ণা বলল— অতো ছোটাছুটি কিসের জন্য গো? আর, এতো উঁচুতে এলেই বা কেন? 
হনুমান সব খুলে বলল তাকে—দুঃখের কথা কী আর বলব? নিজের বন্ধুই সর্বনাশটা করেছে যা করবার। তার জন্যই লেজটা কাটা পড়েছে আমার। এখন লেজ না হলে, আমি মুখ দেখাই কী করে, তুমিই বলো? 
ঝর্ণা বলল— সে নয় বুঝলাম। ঠিক কথাই বলেছ। কিন্তু আমি তোমাকে লেজ দেব কোথা থেকে?
--নাগো, না। তোমাকে লেজ দিতে বলিনি আমি। হনুমান কাতর গলায় বলল—দয়া করে তুমি কেবল চলো আমার সাথে। তোমাকে পেলে, নদী কুয়াসা দেবে আমাকে। কুয়াসা পেলে মেঘ বৃষ্টি দেবে। বৃষ্টি পেলে চাষি ঘাস দেবে বলেছে। ঘাস পেলে গরু দুধ দেবে। দুধ পেলে, তবেই আমার লেজ ফেরত দেবে বেড়াল। আমার অবস্থাটা বুঝে, একটু দয়া করো আমাকে। চলো আমার সাথে। 
শুনে আলোয় ঝলমল করে উঠল ঝর্ণার মুখ। খুশিতে ডগমগ হয়ে বলল—বাঁচালে, বন্ধু। সেই কতো কাল ধরে, বন্দী হয়ে আছি এই ধুমসো ধুমসো পাহাড়গুলোর ভেতর। এখানে দম আটকে আসে আমার। নিয়ে চলো আমাকে। একটু মুক্তি পাই তাহলে। 

ঝর্ণা ভারি খুশি। তার চেয়ে বেশি খুশি হনুমান। যাক বাবা, এতক্ষণে একটা ফয়সালা হোল। 
ঝর্ণাকে নিয়ে নদীর কাছে হাজির হোল হনুমান। নদী খুশি হোল ঝর্ণাকে পেয়ে। এবার তির-তির করে স্রোত বইবে তার শুকনো বুকে। সেই জলে খেলা করবে রঙিন মাছেরা। 
নদী অনেক কুয়াসা দিয়ে দিল হনুমানকে। হনুমান হাজির হোল মেঘের কাছে। কুয়াসা পেয়ে মেঘ বৃষ্টি দিল হনুমানকে। চাষি বৃষ্টি পেয়ে খুশি। হনুমানকে এক বোঝা ঘাস এনে ধরিয়ে দিল
আহা। মকমকে সবুজ ঘাস। তাও আবার পুরো এক আঁটি। তখন গরুর আনন্দ দেখে কে? হাসি মুখে দুধ দিয়ে দিল গরু। 

দুধ নিয়ে, নাচতে নাচতে বেড়ালের কাছে গিয়ে হাজির হোল হনুমান। দুধ দেখে আনন্দ ধরে না বেড়ালের। চোখ দুটো চকচক করে উঠল তার। 
হনুমানকে কিছু বলতে হোল না। বেড়ালই বলে উঠল—দ্যাখ গিয়ে, ঐদিকে উঠোনের এক কোণে পড়ে আছে তোর জিনিষটা। নিয়ে, দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে।
শুনে আঁতে ঘা লাগল হনুমানের। তবে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আবার কিছু উটকো ফ্যাকড়া বার করে ফেলে যদি। কাজ হাসিল হয়েছে। বিবাদ না বাড়িয়ে, সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

সত্যি সত্যি উঠোনের এক কোনে হতচ্ছেদ্দা করে ফেলে রেখেছিল লেজটাকে। ঝেড়ে-পুছে সেটা তুলে নিল হনুমান। ফেরার আগে, লম্বা করে একটা প্রণাম ঠুকে গেল বেড়ালকে— পেন্নাম হইগো, মাসি। চললাম। 
কথাগুলো কানে ঢুকল কি ঢুকল না বেড়ালের, ঠিক বোঝা গেল না। সে তখন চুকচুক করে দুধ খাওয়ায় মশগুল হয়ে আছে। বেড়াল ভালো জানে, খাওয়ার সময় অন্য কোন দিকে মন দিতে নাই।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments