জ্বলদর্চি

গ্ৰামের শহুরে রূপকথা /শেষ পর্ব /সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্ৰামের শহুরে রূপকথা

সুরশ্রী ঘোষ সাহা

শেষ পর্ব : সার্বিক উন্নয়ন 

সেই যে দীর্ঘদিনের অন্ধকার কাটিয়ে, লন্ঠন - গ্যাসবাতির দিন পেরিয়ে গ্ৰামজীবনে ইলেকট্রিক আলো এল, আসলে তা ছিল উন্নতির পথে এক পা বাড়ানো। প্রথমে পথে ঘাটে, তারপর একে একে বাড়িঘরে ঢুকে পড়ল কমলা- সাদা রশ্মি। সূর্যের আলো হারিয়ে যাবার পরে অমন আলোময় সন্ধ্যা-রাত পাওয়া ছিল তখন মানুষের স্বপ্নের অতীত এক বিষয়। 

 কখনো গুঁড়ো মাটি কখনো প্যাচপ্যাচে কাদামাটির পথ যে একদিন বাঁধানো রাস্তা হবে সেকথাও মানুষ তখন কল্পনা করেনি। কিন্তু গ্ৰামের উন্নতির দ্বিতীয় ধাপেই হল, মোরামের রাস্তা থেকে কালো পিচের রাস্তা। যার উপর দিয়ে প্রখর রোদের দিনে আগের মতন খালি পায়ে বহু দূর হেঁটে যাওয়া যায় না ঠিকই, কিন্তু গর্তহীন মসৃণ এই পথে চাকা খুব দ্রুত গড়িয়ে যায়। গরুর গাড়ির চাকার দিন পেরিয়ে ততদিনে টায়ার- টিউবের চাকা গড়ানোর দিনও এসে গিয়েছে উন্নতির হাত ধরে। 

 জীবনের নানা কাজের জন্য পুকুরের জল আর খাওয়ার জন্য ইঁদারার জলই ছিল তখন একমাত্র সম্বল। সেখান থেকে পথেঘাটে ও ঘরের মধ্যে বসল টিউবয়েল। প্রকৃতির ভাঁড়ারে যে কোনকিছুই অফুরন্ত নয়, প্রকৃতি তা থেকে থেকেই মনে করিয়ে দেয়। ভূগর্ভস্থ জলের ব্যাপারেও প্রকৃতি এক এক স্থানে শূন্য হাত দেখাতে থাকে মানুষজনকে। একটা সময় বহু জায়গায় টিউবওয়েলের হান্ডেলে চাপ দিলে উঠে আসে শুধু নির্জলা বুকফাটা শব্দ। সেই আগের মতন আর তার পেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে না তুমুল জলধারার স্রোত। ফাঁকা টিউবওয়েলের ক্যাঁচ-কোঁচ বুকচেরা শব্দ শুনতে বড় বেদনাদায়ক। তাই মানুষ মাটির গভীরতম ঘরবারান্দা থেকে জল তুলে আনার জন্য পাম্পের ব্যবস্থা করে। পাম্প চালিয়ে সাবমার্জড জল তুলে জমিয়ে রাখা শুরু হয় ট্যাঙ্কে। নতুন করে ট্যাপ কল খুললেই ঝরঝর ঝরনা ধারায় বয়ে আসে জল। 

 কুঁড়েঘর বা মাটির বাড়ি থেকে পাকা তিনতলা চারতলা বাড়ি ওঠে একের পর এক। অবস্থাপন্নদের একটা নয়, অনেকগুলো করে বাড়ি হয়। শুধু চাষের জমিই রোজগারের উপায় থাকে না। গ্ৰামের ছেলেরা লেখাপড়া শিখে দূরের শহরে পাড়ি দিতে শুরু করে নানা উপায়ে রোজগারের জন্য। শহরে ছড়িয়ে আছে অনেক চাকরি, অনেক রকমের ব্যবসা করার পথও সেখানে খোলা। একদিকে দিনমজুর লাগিয়ে নিজেদের কিংবা ভাগের জমিতে চাষ চলতে থাকে, পাশাপাশি নিজ শরীরে খেটে অন্যদিকে চলে ভিন্ন উপায়ে রোজগার।

 মাঠঘাটে প্রস্রাব পায়খানার দিনও ফুরায় একসময়। ঘরে ঘরে বসে স্যানিটারি পায়খানা। চৌবাচ্চা দেওয়া বাথরুম। বাচ্চাদের জন্য শাওয়ার কল। কাঠকয়লার উনুনের পাশাপাশি ঘরে আসে রান্নার গ্যাস। এবং সাথে সাথেই বদলে যায় বাসনকোসনের ধরনধারন। অ্যালুমিনিয়াম, সাদা কলাইয়ের থালা বাটির বাসন উঠে গিয়ে নতুনত্ব ফ্রাইং প্যান -প্রেসার কুকার আসে। কাঁসার মতন ভালো জিনিসের মর্মও হারাতে বসে মানুষ। কাঁসার থালা বাসনে খাওয়া খুবই স্বাস্থ্যকর, তবু গ্ৰামের মানুষও কাঁসা-পিতল ছেড়ে স্টিলে ভুললো। বাসনকোসনের পাশাপাশি খাওয়া দাওয়ার রীতিও বদলে গেলো সবচেয়ে বেশি। এখন তো শহরের মতন চাউ-ম্যাগি-পাস্তা-ব্রাউন ব্রেড চলছে মুড়ি রুটির পাশাপাশি। তবে নিজের চাষের জমির ধান - গম - ডাল খাওয়া কখনো গ্ৰামের মানুষ ছাড়বে না, এই রক্ষে। যতই উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে চাষের জমিতে ফসল ফলানো হোক, নিজেদের শরীরের ঘাম মিশে থাকা শস্যের স্বাদই যে আলাদা। 

 গ্রামের মানুষের জীবনধারায় এমনিভাবে নানাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে একের পর এক। বিদ্যুৎ আসার পরপরই এসেছে ঘরে ঘরে টিভি। বাড়ির মেয়ে-বৌদের টিভি সিরিয়ালে মগ্ন হওয়ার দিন হয়েছে।‌ মনে পড়ে, খুব হেসেছিলাম একবার একটা ঘটনা দেখে। গ্ৰামের সকল বড় বাড়িতেই তখন নতুন আসা টিভি চলতো সন্ধ্যা থেকে। এমনই একদিন হাঁটতে বেরিয়েছি আমি। দেখি কিনা, চারুদের ঘর থেকে খুব উত্তেজিত কথাবার্তা ও মহিলাদের উচ্চ কন্ঠ ভেসে আসছে। চারু আমার চিরপরিচিত বন্ধু। দাঁড়িয়ে পড়ে 'চারুউউউ' বলে হাঁক দিই। তৎক্ষণাৎ চারু বেরিয়ে আসে তাদের বাইরের ঘর থেকে। আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ওদের ঘরে। মেঝেতে মাদুর পাতা। সেখানেই আরো কিছু মেয়ে-বৌদের পাশে হাঁটু মুড়ে বসি। সকলে ডুবে আছে টিভি সিরিয়ালে। চারুও ঢুকে যায় ঐ সিরিয়ালের ঘোরে। বুঝতে পারি, অসময়ে ডেকে ফেলেছি চারুকে। ভ্যাবলার মতন এদিক ওদিক তাকিয়ে বসে থাকি। আমার তো সিরিয়াল-নেশা নেই, সবদিকে চোখ ঘুরলেও টিভিতে কিছুতেই তা আটকায় না। কয়েক মুহূর্ত কেটে যায় এইভাবে। হঠাৎ দেখি, চারুর বৌদি আবার শাপ-শাপান্ত শুরু করেছে টিভির দিকে তাকিয়েই। বাকিরাও সুর যোগ করে তাতে। বুঝতে পারি, ভিলেনকে দেওয়া হচ্ছে এত সকল অভিশাপ। গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে আসি চারুর ঘর থেকে। বাইরে বেরিয়ে দমকা হাওয়ার মতন পেট ফেটে উঠতে চায় হাসিতে। 

 এই বিশ্ব জগতসভায় যখন মুঠোফোন এল, গ্ৰামপথে ঢুকতেও তা দেরি করেনি বেশি। মুঠোফোনের কল্যাণে ইন্টারনেটের ব্যবহারও শুরু হল। ঘরে ঘরে ওয়াইফাই বসে দেশ-বিদেশের সাথে সংযোগ রক্ষা হচ্ছে এখন দিনরাত। বিরাট কাজে দিয়েছে এই যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি। 

 গ্রামের সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে উপজেলা, উপজেলার সঙ্গে জেলার সংযোগ সড়ক তৈরি হয়েছে। গ্ৰামকে বিশ্বের দরবারে ছড়িয়ে পড়তে যা বিপুলভাবে সাহায্য করেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে গ্রামে উৎপাদিত ফসল সহজেই শহরে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে গ্ৰামের মানুষের শহরে আসার হারও বেড়ে গিয়েছে। স্কুল - কলেজ - ইউনিভার্সিটি - ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ কী ডাক্তারি শিখতেও হরবখত গ্ৰাম থেকে শহরে ছুটে আসছে মানুষ। দেশের গ্রামাঞ্চল বিদ্যুচ্চালিত অটো-রিকশা ও সিএনজি চালিত অটো-রিকশায় ছেয়ে গেছে। শুধু এসব চালিয়েই অনেকে ভালো উপার্জনও করছেন। অন্যদিকে গ্ৰামে  এনজিওর তৎপরতা এবং রেমিট্যান্সের ব্যাপক প্রভাব তো আছেই। 

 তবে আগেকার গ্ৰামের মতন আর সেই নিভৃত বা বিচ্ছিন্ন গ্রাম নেই। প্রাণচাঞ্চল্য এসেছে। ছোটবেলায় গ্ৰামের বাড়িতে দেখতাম সন্ধ্যা সাতটা মানেই যেন কত রাত। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার তোড়জোড় চলত। এখন আমাদের শহুরে কালচারের মতন রাত বারোটাতেও বাড়ির সব আলো জ্বলতে থাকে। অতিমারি আসার পর বিদেশে শুনেছি শহর ছেড়ে বহু মানুষ গ্ৰামে গিয়ে বাড়ি বানিয়ে থাকছে। শহুরে দূষিত বাতাস ফুসফুসকে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে, তাই শুদ্ধ বাতাসের সন্ধানেই গ্ৰামমুখী হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। আমাদের এখানেও গ্ৰামে বেড়েছে মানুষের চলাচল। এমনকি কলকাতার কাছাকাছি নিউটাউন আরবান এরিয়া গড়ে তুলেছেন সরকার। ক'দিনের জন্য ঘুরতে যাওয়ার স্থান হিসেবেও এদিক ওদিক সাজানো গোছানো গ্ৰাম্য পরিবেশ গড়ে তোলা হচ্ছে। 

 নকল গ্ৰাম নয়, আসল গ্ৰাম নিজেদের রূপ বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেঁচে থাকুক এই স্বপ্ন দেখি। এত উন্নতির পরে আজও গ্রামের প্রধান সমস্যা মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অভাব। এইসবের পাশাপাশি গ্রামীণ রাজনীতির কুটিলতা তো চিরকালই আছে। তাই বুকে পাহাড় সমান আশা রাখি, এইসকল অসুবিধা দূর করে গ্ৰাম চিরকাল হাসতে থাকুক, প্রাণখোলা চিরনবীন এক গ্ৰাম্য হাসি।

ছবি: লেখিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments