জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-২৫/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ২৫

পরের বছর আর ‘হিলাল’ প্রকাশিত হল না। এদিকে আমার মাথায় লেখার ভূত যে সাওয়ার হয়েছে, সে আর কিছুতেই নামছে না। মেদিনীপুর শহরের কোথায় কী পত্রিকা প্রকাশিত হয়, তা আমার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। তখন খবরের কাগজে বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনের তরফ থেকে লেখা চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হত। একদিন বকুল খবরের কাগজ হাতে করে নিয়ে এসে দেখিয়ে বলে, মা তুমি লেখার জায়গা পাচ্ছনা? এই দ্যাখ, আনন্দবাজারে লেখা চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে! তুমি এদের লেখা পাঠাতে পার।

        আমি তিনটি পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে তার জবাবও পেলাম। বলা হয়েছে, আপনার লেখা মনোনিত হয়েছে। আমাদের পত্রিকার সদস্য হওয়ার জন্য এই পরিমাণ টাকা পাঠাতে হবে। আমি টাকাও পাঠিয়ে দিলাম। পত্রিকা হাতে পেয়ে দেখলাম, বেশিরভাগই হাবিজাবি লেখা। সদস্য চাঁদা দিয়ে লেখা পাঠাতে ইচ্ছে করল না, তাই থেমে গেলাম। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সোনার তরী’ নামে একটি পত্রিকা থেকে সেই বছরই অক্টোবর মাসে একটি আমন্ত্রণ পত্র পেলাম মহাজাতি সদনে সোনার তরীর বার্ষিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠের জন্য। ব্যপারটা আমার কাছে স্বপ্নের মত মনে হল! কলকাতার কোন অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা পাঠের আমন্ত্রণ পাব! এ আমি ভাবতেও পারছি না। সাহস করে একদিন সম্পাদককে ফোন করলাম।  কথা বলে ভদ্রলোককে ভালই মনে হল। তারপর মাঝে মাঝে কথা হত। ১৯৯৭ এর জানুয়ারিতে ভদ্রলোকের একটি চিঠি পেলাম। তাতে উনি লিখেছেন, ‘আপনার সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে, আপনার বাংলাতে বেশ পাণ্ডিত্য রয়েছে’। ‘পাণ্ডিত্য’ শব্দটা  পড়ে আমি হাসব না কাঁদব? ভেবে পেলাম না ।

              ইতিমধ্যে একদিন ব্যোমকেশ বাবুর বাড়ি গিয়ে আলাপ করে এসেছি। কথায় কথায় জেনেছি ওনার সঙ্গে মেজকাকার পরিচয় ছিল। কাকার লেখা একটি কাব্যগ্রন্থ বের করে আমাকে দেখালেন। কাকার বন্ধু তো কাকাই হন। তাই উনিও আমার কাকা হয়ে গেলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় মেজকাকাকে কথাটা জানাতে পারলাম না। কাকা ১৯৯২ সালে মারা গেছেন। ব্যোমকেশকাকা আমাকে মেয়ের মত স্নেহ করেন। মাঝে মাঝে রিক্সা নিয়ে চলে আসেন এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা নানা বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করেন। বুকে পেসমেকার বসানো থাকায় ফোনে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারতেন না।

              উনি একদিন আমাকে ওনার দুটি ইচ্ছের কথা জানান। প্রথমটি হল,  মৃত্যুর পর ওনার দেহ দাহ না করে যেন বাড়ির পাশে বাগানে সমাধি দেওয়া হয়  এবং সঙ্গে দেওয়া হয় তাঁর লেখার সরঞ্জাম। আর দ্বিতীয় ইচ্ছেটি হল ওনার পারলৌকিক কাজের দিন হিন্দু ধর্মের রীতি-রেওয়াজের সঙ্গে সেইদিন যেন কোরান ও বাইবেল পাঠেরও ব্যবস্থা করা হয়। কিন্ত তাঁর এই ইচ্ছের কথা বাড়ির কাউকে জানিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাননি। রাতে উনি একা ঘুমিয়ে ছিলেন। কাকিমা মেয়েরবাড়ি বা অন্য কোথাও গিয়ে  ছিলেন। সে রাতেই ঘুমের মধ্যে হার্টফেল হয়ে মারা জান। তখন ল্যান্ডফোন ছিল। বড়ছেলে ফোন করেছিলেন। কিন্তু ফোন বিকল  থাকায় আমাকে জানাতে পারেননি। পরদিন আবার ফোন করে আমাকে জানালে, আমি জিজ্ঞেস করি সৎকার করলেন কী ভাবে? কাকার তো অন্যরকম ইচ্ছে ছিল! উনি বললেন, বাবা তো আমাদের কিছু বলে যান নি। বাবার এক বন্ধু বলাতে, বাবার ইচ্ছের কথা জেনেছি। কিন্তু সমাধি দেওয়ার ব্যাপারটাতে কেই রাজি না হওয়াতে বাবাকে দাহই করা হয়েছে। তবে বাবার দ্বিতীয় ইচ্ছেটির বিষয়ে  পুরোহিতদের সঙ্গে আলোচনা করেছি, ওনারা বলেছেন, দিনে শ্রাদ্ধের কাজ মিটে গেলে রাতে কোরান বাইবেল পাঠে কোনো আপত্তি নেই। আমি আমন্ত্রিত ছিলাম। কোরান বাইবেল পাঠের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ব্যোমকেশকাকা কাজি নজরুলের অনুরাগী ছিলেন। তাঁর লেখা কবিতার মধ্যে কাজি নজরুলের লেখার ছাপ রয়েছে।

              
  এরপর সবকিছু অতি দ্রুত ঘটতে লাগল। সোনার তরী পত্রিকার শারদ সংখ্যার জন্য একটি কবিতা পাঠালাম। সম্পাদক এবার আর সদস্য চাঁদা দেবার কথা বললেন না। পরে জেনেছি ওনার একটি মানবতাবাদী(পি,ফোর) সংগঠন আছে, এই সংগঠন থেকে সমস্ত অন্যায়ের বিরুধে প্রতিবাদ জানানো ও সমাধান খোঁজা হয়। তখন আমার বাইরের জগৎ সম্বন্ধে তেমন কোনও ধারণাই ছিলনা। টোপ,  ফাঁদ, এসবের কেছুই বুঝতাম না। আমাকে এই সংগঠনের সদস্য হতে বললে, আমি এই ভেবে রাজি হলাম, সেইসময় রাজ্যে মুসলিম মহিলাদের সমস্যা নিয়ে বলার মত কোনো জায়গা ছিল না। কোথাও কোন আলোচনা হত না। কোন পত্র-পত্রিকায়  লেখাও হত না। তখন বুঝলাম আমাদের কথা আমাদেরই বলতে হবে, এবং তারজন্য একটা মঞ্চ চাই। সেই মুহূর্তে এই মঞ্চটিকে বেছে নেওয়া ছাড়া আর অন্য কোনও পথ ছিল না।

            ১৯৯৭ এর ১৬ নভেম্বর আমার ছোটবোন ছবির প্রথম সন্তান নাতাশার (রানি) জন্ম হল মামাবাড়িতেই। এই সময় বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। খবর পেয়ে যেতে চাইলাম। খান সাহেব কী একটা কারণে আমাকে কয়েকদিন পরে যেতে বললেন। বাবলি বকুল দুজনেই তখন কলকাতায়। খান সাহেব খড়গপুরের কাছে বদলি হয়ে এসেছেন। ২৫ নভেম্বর আমার আর ২৬ নভেম্বর বাবলির জন্মদিন। ঠিক তার পরের দিন বিকেলে খবর পেলাম বাবার অবস্থা খুবই খারাপ। ওনার ফিরতে দেরি হবে, তাই আমি ছোটমাসিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পরলাম। আমাকে যে খবর দিতে এসেছিল সে বলেছিল গড়বেতায় লোক থাকবে, আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। কারণ তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিল, বিশেষকরে রাতের দিকে। বাস থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। হঠাৎ মাঙ্কিক্যাপ পরা এক ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এই সময় তুমি এখানে? এই এলাকায় অনেকে আমাকে চেনেন, আমি তাঁর দিকে ভাল করে না তাকিয়ে উত্তর দিলাম, বাবা খুব অসুস্থ, মঙ্গলাপোতা যাব। এখানে লোক থাকার  কথা ছিল, কিন্তু কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। ভদ্রলোক বললেন, তুমি আমাকে চিনতে পারছনা? আমি শুকুর। আমরা একই স্কুলে পড়াশোনা করেছি। তাছাড়া বাম নেতা শুকুর তপনকে সারা পশ্চিমবঙ্গ একডাকে সবাই চেনে। টুপি খুলতে আমি চিনতে পারলাম। ও আমাকে আশ্বস্ত করে বলল, ভেবনা, আমাদের অনেকগুলো বাইক আছে। তোমাদের বাড়িতে পৌঁছে দেব। সেই সময় রাজনৈতিক হানাহানি তুঙ্গে। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ওদের বাইকে যাওয়ার সময় গুলিতে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু তখন তো ওসব চিন্তা মাথাতেই আসেনি।

         এভাবে বাড়ি পৌঁছে দেখলাম আমার চিরদুঃখী বাবা চিরসান্তির দেশে পাড়ি দেয়েছেন। বাবার দেহ সাদা কাপড়ে ঢেকে তাবুতে (শব বহনকারী খাটিয়া) শোয়ানো আছে। বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলাম। বাবার সাথে শেষ দেখাটা হল না, ঠিক আমার মায়ের যেমন হয়নি। পরদিন সব মিটে গেলে সেইদিনই বাড়ি ফিরে আসতে  হল। ওনার অফিস আছে। তাছাড়া বাড়িতে কেউ নেই। ফিরে এসে খুব মনখারাপ করতে লাগল। কয়েকদিন পরে শাশুড়িমায়ের খোঁজ খবর নিতে শ্বশুরবাড়ি গেলাম। ওনার সময় হয়না বলে আমি মাঝে মাঝে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শাশুড়িমায়ের খবর নিয়ে আসি। শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে আমার তেমন একটা আপ্ততা গড়ে ওঠেনি। জেনারেশন গ্যাপটা খুব বেশিই ছিল। তাছাড়া আমার শ্বশুরবাড়ি আর বাপের বাড়ির শিক্ষা, সংস্কৃতি, আদবকায়দা ইত্যাদির মধ্যে অনেকখানি ফারাক ছিল। আমাদের প্রগতিশীল পরিবার। তাই দুজনের মানসিকতা ও জীবনযাত্রার মধ্যেও বেশ পার্থক্য ছিল। বড়ছেলের জন্মের পর শাশুড়িমা কোনোদিন রঙ্গিন সাড়ি পরেননি, আমি পোশাকের(সাড়ি)বিসষয়ে খুবই সচেতন। উনি খুব প্রয়োজন ছাড়া  গ্রামের বাইরে বের হতেন না। আমি দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াতে ভালবাসি। উনি পুঁথি পড়ে ফতিমা বিবির দুঃখে কেঁদে বুক ভাসাতেন। আশাপূর্ণা দেবীর সুবর্ণলতা পড়ে আমার দুচোখে প্রতিবাদের আগুন জ্বলত। উনি পরাধীনতার মধ্যে থেকে নিরাপত্যা বোধ করতেন। আমি স্বাধীনতা আর সেচ্ছাচারিতার মাঝখানের সীমারেখা নির্ধারণের চেষ্টা করতাম। উনি ছিলেন ত্যাগের প্রতিমূর্তি। আমি আর  পাঁচজনের মত সাধারণ। আমার চাওয়াপাওয়াও  সেই রকম।   

 মেদিনীপুরে বাড়ি করার পর শত অনুনয়-বিনয়ে, রাগে অভিমানেও শাশুড়িমাকে আমাদের কাছে ৩/৪ দিনের বেশি নিয়ে এসে রাখা যায়নি। ভেবে পেতাম না  যখন ছেলের কাছে  মখমলের নরম বিছানায় শুয়ে আরামে দিন কাটাতে পারতেন, তখন স্বামী- শ্বশুরের ভিটেতে ধূলিশয্যায় শুয়ে কোন অপার্থিব সুখে তিনি তৃপ্তি বোধ করেন? তাঁর জায়গায় নিজেকে বসিয়ে বহুবার এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছুতেই এই সহজ সরল মানুষটির সুখদুঃখের হিসেব মেলাতে পারিনি।

                                ক্রমশ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments