জ্বলদর্চি

শিক্ষক যখন পিঁপড়ে.. /নিশান চ্যাটার্জী


জীবনের গভীরে বিজ্ঞান- ৬

শিক্ষক যখন পিঁপড়ে..

নিশান চ্যাটার্জী

বর্তমান সমাজে সবথেকে বড়ো সমস্যা হচ্ছে,জনবিস্ফোরন একথা আমরা কমবেশি সকলেই মানি। কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলাফল সর্বগ্রাসী এবং যার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় খাদ্য ও বাসস্থানের অভাব। এছাড়াও এর ব্যপক প্রভাব পড়ে নতুন প্রজন্মের ওপরেও। এক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের নিরাপত্তা জনিত এমনকি আইনশৃঙ্খলার সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এই একই সমস্যা আমরা লক্ষ্য করি পিঁপড়েদের ক্ষেত্রেও।

 কিন্তু বহু যুগ ধরে তারা এই সমস্যার সাথে মোকাবিলা করে আসছে। বিশেষ জীবনধারা তাদের এই কাজে সাহায্য করেছে। পিঁপড়েদের  সেই জীবনধারা সম্পর্কে আলোকপাত করাই হলো আজকের আলোচনার প্রধান বিষয়।  আনুমানিক প্রায় তিন কোটি বছর আগে অলিগোসিন যুগের সময়কালের কিছু জীবাশ্ম থেকে পিঁপড়ের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।   ব্যক্তবীজী উদ্ভিদের থেকে নিঃসৃত আঠালো পদার্থের সাথে পিঁপড়েরা আটকে এই জীবাশ্ম গঠন হয়েছে বলে মনে করা হয়।

 ১৯৬৭ সালে আবিষ্কৃত এইরকম একটি জীবাশ্ম থেকে গবেষণার মাধ্যমে জানা যায় যে এদের বিশেষ অভিযোজন ক্ষমতার মাধ্যমে পৃথিবীর স্থলভাগের প্রায় সর্বত্র এরা ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীদের মত অনুযায়ী বিবর্তনের পথে পিঁপড়ের আবির্ভাব ঘটেছিল পাখাওয়ালা বোলতা জাতীয় পতঙ্গ থেকে। তাই বৈজ্ঞানিক শ্রেনীবিন্যাসে এদেরকে মৌমাছি, ভীমরুল প্রভৃতিদের সঙ্গে একই দলে রাখা হয় ( বর্গ হাইমেনোপটেরা)। জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মতে ভারতে প্রায় ৫০০টি পিঁপড়ের প্রজাতি রয়েছে। আর আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে প্রায় ১৩০টি প্রজাতি। যা জনবিস্ফোরনের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আ্যমাজনের বর্ষা অরণ্যে প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ৭০লক্ষ পিঁপড়ে বসবাস করে। আইভোরি কোস্টের প্রতি হেক্টর জমিতে গড়ে প্রায় কয়েক কোটি পিঁপড়ের বাস। এই বিপুল সংখ্যক উপস্থিতির কারণ হল এরা অরণ্যের মৃত্তিকার ভৌত ও রাসায়নিক চরিত্র সংরক্ষণ করে।  উদ্ভিদের বংশবিস্তারে এদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এরা মাটিতে নাইট্রোজেন সহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপাদান যুক্ত করে। এদের খাদ্য সংগ্রহের পদ্ধতি থেকে মনে হতে পারে এরা দেখতে পায়। 

কিন্তু বিজ্ঞানী হোলডোবলার ও উইলসন তাদের একটি বিখ্যাত বই-"The Ants" এ উল্লেখ করেছেন পিঁপড়েরা দেখতে পায় এমন কোনো নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বর্তমানে জানা গেছে  এরা বিশেষ প্রক্রিয়ায় ফেরোমন নিঃসরণ করে যা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, কেমিক্যাল ম্যাসেঞ্জারের কাজ করে।  এরা সব কাজেই পারস্পরিক সহযোগিতা দেখায়। খাদ্য যতো সামান্য হোক সকলে ভাগ করে খায়।  পিঁপড়েরা একফোঁটা প্রোটিনের অপচয় করে না। কিছু প্রজাতির পিঁপড়ে প্রোটিন জাতীয় খাবারকে পুনর্ব্যবহার করে থাকে। ফলে খাদ্যের চাহিদা কম হয়। ফলস্বরূপ পরিবেশের ওপর চাপ কম পড়ে।

 পিঁপড়েরা বিষাক্ত পদার্থ সহজে চিনে নিতে পারে। পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেছে কপার সালফেটে ডোবানো মৃত পিঁপড়ের দেহ অন্যরা কখনও খাদ্য হিসেবে সংগ্রহ করে বাসায় নিয়ে যায় না। এদের ভেজাল মেশানো খাদ্য থেকে ক্ষতিকর উপাদানকে আলাদা করে নিয়ে খাদ্য সংগ্রহের স্বভাব রয়েছে। এদের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলি এদের বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে সাহায্য করে ও সেই সঙ্গে খাদ্যের জোগান বজায় রাখতেও সাহায্য করে। এদের কাছে দিন ও রাতের কোনো পার্থক্য নেই। তাই এরা প্রয়োজনে যখন খুশি কাজ করতে পারে আবার কাজের ধরন অনুযায়ী কর্মীর সংখ্যা বাড়িয়ে বা কমিয়ে নিতে সক্ষম। পিঁপড়েদের আলোচিত এই সকল গুণ গুলো তাদের কোশে অবস্থিত জিন দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। এদের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য সমূহই এদের জীবনে জনবিস্ফোরনের খারাপ দিক গুলোকে রুখে দিতে সাহায্য করছে। মানুষের সাথে এদের জীবন ধারণের পার্থক্য হলো এরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে, অর্থাৎ অপচয় করে না। এরা প্রকৃত সমাজবদ্ধ তাই নিজেদের মধ্যে লড়াই-হানাহানি করেনা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে  সব কাজ সম্পন্ন করে। অপচয় রোধ করে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার এই শিক্ষা যদি মানুষ গ্রহণ করতে পারে তাহলে জনবিস্ফোরনের মতো একটি জ্বলন্ত সমস্যার সমাধান মানুষও করতে পারে। কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে মানুষের সমস্যা, পিঁপড়েদের তুলনায় অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী এবং সংকটজনক, যার জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত অপচয়ই প্রধান কারণ, যা আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ এখনো বুঝে উঠতে চাইছে না। তাই এক্ষেত্রে আকারে ছোট এই প্রাণীগুলো কিন্তু আমাদের তুলনায় বেশি শিক্ষিতের পরিচয় দেয়।।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments