জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৮৬

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৮৬



সম্পাদকীয়,
‌প্রচ্ছদের ছবিটা দেখে তোমাদের এক বন্ধু আমাকে কি বলল জানো? সূর্যমুখী ফুল যদি কেবল সূর্যের দিকেই ফিরে থাকবে তবে নীলাব্জ আঙ্কেলের তোলা দুটো ফুল কেন দুদিকে তাকিয়ে? আমি বললাম, আরে বাবা ওদের তো আজ ঝগড়া হয়েছে। আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস, তাই তো একটু ঘুরু ঘুরু  যেতে চেয়েছিল পাশের বান্ধবী ফুলটি, কিন্তু বন্ধু ফুলটি তাতে রাজি নয়। কর্তব্য আগে। ফুলের একমাত্র কর্তব্য অন্যের তরে ফোটা। কোনো কারণেই তার ব্যত্যয় ঘটবে না। মলয় আঙ্কেলও বলেছেন তাঁর আলাস্কা ভ্রমণের গল্পে, আর যাই পাল্টাক প্রকৃতি নিজের রূপ নিয়েই বছরের পর বছর সেখানে একই ভাবে বিরাজ করছে। রাতের বেলাতেও দিনের মতো আলো সেখানে। অবাক হচ্ছ তো? অবাক তুমি হবে কেন? সোমরাজ আমাদের ড: স্ট্রেঞ্জের ছবি এঁকে পাঠিয়েছে। তাকে তো তোমরা সবাই জানো।  তবে তোমরা যেটা জানো না সেটা হল, আজকের দিনে সারা পৃথিবী ঝাঁপিয়ে পড়েছে ধরিত্রী বাঁচাও আন্দোলনে। নাহলেই কিন্তু প্রকৃতি মাঝে মাঝেই রুষ্ট হয়ে উঠবে। আরে আমাদের সচেতনতার অভাবের জন্যই সে ক্ষেপে ওঠে। তাই এসো গাছ লাগাই প্রকৃতিকে শান্ত রাখি। এবার একটা অন্য দিবসকে স্মরণ করে ছবি এঁকে পাঠিয়েছে তোমাদের বন্ধু প্রিশ। নজরুলের জন্মদিবস। আর অনামিকা আন্টি তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। এবারে পীযূষ আঙ্কেল সত্যেন্দ্র নাথ ঠাকুরের কথা বলেছেন।আর অলিভা দিদি ব্রতচারী আন্দোলনের কথা বলেছে।  সবার কথা পড়ে তোমাদের বোধোদয় হল কি? তবে বহুদিন বাদে মীরদারোগা আবার সুদর্শন জ্যেঠুর হাত ধরে ফিরে এসেছেন। তার কিন্তু এবার বোধোদয় হয়েছে। তোমরাও কিন্তু প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত হও। জল সংরক্ষণ করো, বায়ু দূষণ কমানোর চেষ্টা কর আর অন্তত প্রত্যেকে একটা করে ফুলের গাছ লাগাও আজকের দিনে। আমাকে ছবি পাঠাও তোমাদের গাছের। বন্ধু ফুলেদের দেখে সূর্যমুখীদুটিরও তখন ভারি আনন্দ হবে। ওরাও সবাই তখন ঝগড়া ভুলে গলা জড়াজড়ি করে সূর্য দাদুর গল্প শুনবে হা করে। ঠিক যেমন তৃষ্ণা আন্টির উপন্যাসে জয়াবতীরা ঠাম্মার বিয়ের গল্প শুনছে, সেই রকম আর কি।  --- মৌসুমী ঘোষ



ধারাবাহিক উপন্যাস
জয়াবতীর  জয়যাত্রা
অষ্টাদশ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক

মা দুগগা তো ঘরের মেয়ে
২২
তর্পণের যোগাড়যন্ত্র চলছে, ঠাকমা পুরুতমশাইকে নিয়ে যেতে বলেছেন সঙ্গে, ওখানে অচেনা জায়গায় পুরুত খুঁজতে গিয়ে লগ্ন পেরিয়ে যায় যদি। সে নাকি ভারি অনত্থ ব্যাপার হবে। সেই শুনে জয়াবতী অমনি ফোড়ন কাটে ‘কী যে বলো না ঠাকমা? জল চাইলে ফেরাতে নেই জানি, দেরিও করতে নেই, তবে একটা কথা তুমি বলো, সগগে তো আর পিথিমির মতো কাজ নেই, সেখানে কাউকে আমার পিতাঠাকুরের মতো টোল খুলেও পড়াতে হয় না, সেনমশাইয়ের মতো লোকের নাড়ি টিপে ওষুদ পালাও দিতে হয় না, কাছারি যাবার ঝামেলাও নেই, তাহলে দু দণ্ড সবুর করতেই পারেন তেনারা। লগ্ন আবার কী গা? মনের ভক্তি করে লোকে এই এত দূর  থেকে কষ্ট করে যাচ্ছে, তা কি তাঁরা বুঝতে পারছেন না? ওপর থেকে তো নিচের সবই দেখা যায়। এই যে তোমাদের ছাদে উঠি, সেখান থেকে তোমাদের এই সোনাটিকরি কেমন পোস্কের দেখা যায়, তাই না রে পেরজাপতি?’
পেরজাপতি সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় কাত করল। এত তাড়াতাড়ি ঘাড় নাড়াটা মোটেই পছন্দ হল না জয়াবতীর। সে ঝঙ্কার দিয়ে বলে উঠল ‘বুঝলে ঠাকমা, এর নাম পেরজাপতি মিছেই রাকলাম। কোথায় উড়বি ঘুরবি ফিরবি উড়বি, তা না দেকো কেমন নির্জীব হয়ে থাকে সারাক্ষণ। যেন জ্যান্ত মানুষই না’
পুণ্যি এককোণে বসে খলনুড়িতে মধু আর স্বর্ণভষ্ম দিয়ে কী একটা ওষুধ তয়ের করছিল, তার আর সহ্য হল না জয়াবতীর এত বক্তিমে। সে ক্ষেপে গিয়ে বলল ‘ তুই কি একটুখানির জন্যেও চুপ করতে পারিস নে, ও গঙ্গাজল? চিতের আগুনে পুড়ে মরছিল যে মেয়েটা, সোয়ামি যার মরে গেছে, সে নিজ্জীব থাকবে না তো কি ধেই ধেই করে নাচবে তোর মতো?’
'মরে যাই মরে যাই! ভারি আমার সোয়ামি রে। গেছে, গেছে আপদ গেছে। আশি বছরের বুড়ো একটা। পঞ্চাশ একশটা বিয়ে ছিল।  তাছাড়া  চিতার আগুনে তো পুড়তে হয়নি শেষ অব্দি, আমরা তো গিয়েই পড়লুম। তাই বলে কি মুখখানা তোলো হাঁড়ি করে থাকতে হবে? শাস্তরে কী লিকেছে জানিস তো, মরার আগে মরার চিন্তা করলে পাপ হয়’
পাপের কথায় পেরজাপতি শশব্যস্ত হয়ে উঠে বলে ‘ও জয়াদিদি, আমি এই তো হাসচি দেকো’
‘মনে থাকে যেন, সবসময় হাসবি, তা হ্যাঁ ঠাকমা, তোমরা পালকিতে যাবে না ঘোড়ায় চেপে, কিছু ঠিক করেছ?’
পুণ্যি আর থাকতে না পেরে বলে ‘মা গো মা, আমি কি মরে যাব বল তো ঠাকমা? কত করে মানা করলাম এইসব উতপটাং কথা বলতে নেই কো, ঠাকমা আর খুড়িমা নাকি ঘোড়ায় চাপবে। তোর নয় প্রাণের ভয় নেই, মেয়ে কবরেজ হবি বলে ক্ষেপে উটেচিস, আসলে কী জানো ঠাকমা ওর মনে হয় মাতাটা গরম হয়েচে, নইলে কেউ দিনরাত্তির ঘোড়া ঘোড়া করে’
ঠাকমা কিন্তু জয়ার কথায় মোটেই রাগেন না, তিনি উল্টে বলেন ‘ওরে জয়া, তোর সেনমশাইকে বল দিকিনি, তোতে আমাতে ঘোড়ায় চড়ে যাব। ছেলেবেলায় আমাদের বাড়ির উটোনে বাঁধা থাকত ছোট্ট একটা ঘোড়া। কত চড়তাম, তারপর একদিন ওঠ ছুঁড়ি তোর বে হয়ে গেল রে। ব্যস ঘোড়ায় চড়া বন্ধ হল।’
জয়াবতী আনন্দে লাফিয়ে উঠল। পেরজাপতি চোখ গোল গোল করে ঠাকমাকে দেখতে লাগল। পুণ্যি অবাক হয়ে দেখে। এই ঠাকমাও একদিন পাঁচ বছরের কচি মেয়েটি ছিল!
সে ঠাকমার গলা জড়িয়ে বলে ‘ও ঠাকমা, তোমার বিয়ের গপ্পো বলো না শুনি’
‘গপ্পো কিচুই নেই। একদিন সকালে উটে মার কাচে খেতে চাইলাম, অন্যদিন না চাইতেই মা খাওয়াবার জন্যে ব্যস্ত। আগের রাতের লুচি আর মেঠাই থাকে জলপানের, তারপর দুধ তো আছেই। সেদিন খিদেয় পেট জ্বলছে, মা দেখি খাবার দেবার নাম করে না। অভিমানে চোখ ফেটে জল আসছে, এক বিধবা পিসি ছিল, তার কাছে গিয়ে খেতে চাইতে সে তো অবাক হয়ে বলল ‘শোন মেয়ের কতা! যার বিয়ে তার হুঁশ নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই। বিয়ের দিন মেয়েমানুষ নুচি খাবে বলে কাঁদছে। কলিকাল কি সাধে বলেছে? ভোরবেলা যে দই চিঁড়ে খাইয়ে দেওয়া হল, সে তবে কীসের জন্যে? যা যা মেলা বকাস না ছুঁড়ি, দেকি আবার পিঁড়ে দুটো চিত্রি করা হল কিনা’
পুণ্যি সুযোগ পেয়ে একটু ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কেঁদে নিল। পেরজাপতি জয়াবতীর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাল। কাঁদবে কি কাঁদবে না বুঝতে পারছে না। কাঁদলেও কি পাপ হবে? দুজনের কাণ্ড দেখে হাড় জ্বলে গেল জ্যাবতীর। সে বলল ‘তা বলি ঠাকমা, ঘরে কি দুটো সন্দেশ কি মুড়ির মোয়াও লুকোনো ছিল না? দুটো চুপিচুপি মুখে পুরে দিলে কে আর দেকতে যেত বলো? এই যে ফি বছর মা দুগগা চার ছেলে মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি আসে, তাঁর খাওয়ার বহর দেকেছ? এই ফল, এই মেঠাই, এই অন্নভোগ, এই বৈকালী, চার ছেলেমেয়ের মা হয়ে যদি তিনি এত খেতে পারেন, তবে বিয়ের সময় ঝাড়া হাত পাটি যখন ছিলেন, তখন কিছু দাঁতে কাটেননি, এ আমায় বিশ্বাস করতে বলো?’
পুণ্যি তো পুণ্যি, ঠাকমাও অবাক হয়ে গেল জয়ার কথায়।

সেনখুড়িমা কাজ করতে করতে এসে বললেন ‘বাব্বা , এ মেয়ের মাথায় আসেও। মা দুগগার সঙ্গে কি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের তুলনা চলে? তিনি যে দেবী’
‘কেন চলবে না বল দিকি? উনি তো আমাদের ঘরের মেয়ে। যাবার বেলা পান্তাভাত খেতে দেয় দেকোনি? বরণের সময় পান সন্দেশ - এও তো ঘরের মেয়েকেই দেয়। মেলা বকাও তোমরা। এখন আমি একটা লতা খুঁজতে যাব। ভারি দেরি হয়ে গেল আমার’। ( ক্রমশ )



নজরুলের প্রতি
কলমে- অনামিকা তেওয়ারী

জৈষ্ঠ্য এলেই সুর ও ছন্দে গেঁথে নিয়ে এক মালা। 
প্রদীপ শিখায় নিই সাজিয়ে তোমার বরণ ডালা।। 

কলম তোমার স্বর্ণ আখরে ফলিয়েছে যত সোনা। 
অমূল্য সেই মণিমুক্তায়, তোমারেই করি বন্দনা।। 

প্রেম যমুনায় ডুবিয়েছো কবি, কত শ্রোতার হৃদয়। 
ধর্ম যেখানে কলুষিত, সেখানেই তোমার উদয়।। 

বিদ্রোহী তুমি উঠেছো গর্জে, মানুষের নীপিড়নে। 
কেঁপেছে বুক তবে থামেনি কলম, শোষকের কুশাসনে।। 

অভাব তোমার নিত্যসঙ্গী, নিয়তির পরিহাসে। 
হারিয়ে স্বজন, কেঁদেছো কবি করুণতম ভাষে।।

পরাধীনতার অতল গভীরে যখন ডুবছে নর-নারী। 
বজ্র লেখনী উঠেছে গর্জে, হুঁশিয়ার কান্ডারী।। 

সাম্যের গান গেয়েছো হে কবি, মানবতা তোমার ধর্ম। 
বিশ্ব বীণায় মন্দ্রিত হোক তোমার সকল কর্ম।।



মীরদারোগার বোধোদয়   

সুদর্শন নন্দী


বীরপুর থানার মীরদারোগা মানুষটির মনটি মাখনের মতো নরম। আর পাঁচটা থানার  বড়বাবু, মেজবাবু, ছোটবাবু ,পুলিশের মতো মেজাজ তার ধাতে নেই। তিনিও এই থানার বড়বাবু তবে সাবেকি ভাষায় সবাই তাকে দারোগাবাবু বলেই ডাকেন, আর এই ডাকই তার বেশ পছন্দের। একটা  নষ্টালজিয়ার সুগন্ধি রয়েছে এ ডাকে। তার ছেলেবেলা থেকে দারোগা নামটি গ্রামগঞ্জের মানুষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। ছেলেবেলার সে দৃশ্য টগবগ করে ফুটছে তার মনে। মনে আছে ছেলেবেলায় একবার এলাকার দারোগাবাবু জিপ নিয়ে গ্রামে ঢুকেছেন।  ভুঁড়িটি তার চলেছে আগে আগে। পিছনে লাঠি উঁচিয়ে  পুলিশ দুজন। গ্রামের সবাই ভয়ে তটস্থ। এক অদ্ভুত প্রাণী যেন প্রবেশ করেছে গ্রামে। তা  দারোগার এক পুলিশ জল  খাচ্ছিল। তখন তো আর বোতল কালচার গড়ে ওঠে নি। এক  গৃহস্থের ঘরে সেই জল খাওয়া দেখে ছোট্ট  মীর বিস্ময়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, বাবা পুলিশও জল খায় ?

সেসব কথা মনে পড়লে আজও হাসি পায় মনে। আর অদৃষ্টের কি লিখন। সেই চেয়ারে তিনিই আজ বিরাজমান। তবে সাবেকিয়ান ভাঙতে তিনি প্রথম থেকেই সচেষ্ট। পুলিশ,দারোগা মানে যে আর পাঁচটা মানুষের মতো  সেটা বোঝাতে হবে মানুষকে। কিন্তু সমস্যা হল  উপর মহল এতে মাঝে মাঝেই চটছে। শাসন ছাড়া মানুষের হুঁশ নাকি ফেরে না । দু ঘা পিঠে না পড়লে সোজা হয় না মানুষ । শুনতে পায় না কান না টানলে । ঢিলে দিলে ছিচকেমি থেকে  ফিচকেমি  বাড়ে। এই সাধারণ নিয়মগুলি মেনে না চললে থানা চালানো শিবেরও অসাধ্য।  অভিযোগ রয়েছে কিছু  মানুষেরও । দারোগাবাবুর নরম মনোভাবের  সুযোগে নাকি আধা শহর এই গ্রামের আইনশৃঙ্খলা একটু ঢিলেঢালা হয়েছে। বড় চুরি না হোক ছিঁচকে চোর তো  বেড়েছে। কে বলতে পারে আজকের ছিঁচকে কাল ডবল প্রমোশন পেয়ে ডাকাত হবে না?  সাহস বাড়লে ব্যাংও হাতিকে লাথি দেখায় । তাই অনেকে বলাবলিও  করেন যে  এহেন দারোগা এ যুগে পুরানো নোটের  মতোই অচল।  ফলও মাঝে মাঝে পাচ্ছেন না তিনি তা নয়।  তার সামনেই  হাজির এক মা ও মেয়ে । জানালা থেকে আলনায় রাখা এক দামী ফ্রক উধাও করেছে কেউ।   পড়ার ঘরেরে জানালার ধারে ছিল আলনা। কালই কালনা থেকে নতুন একটা ভাল ফ্রক  বাবা কিনে এনে দিয়েছে মেয়ে পুতুকে।  ভালো নাম তার প্রতিমা।ঘর ছেড়ে  একটু বাইরে বেরিয়েছে  সে,  অমনি জানলা দিয়ে  হাত বাড়িয়ে  কে সেই  ফ্রক ম্যাজিকের মতো ভ্যানিশ করেছে। এ ধরনের ছিঁচকে চুরি আগে ছিল না এ অঞ্চলে ।  চোরগুলো বোধ হয় বুঝেছে  যে  ধরা পড়লে  থানায় তার শাস্তি নেই তাই এতো বাড়বাড়ন্ত।

মায়ের  সাথে থানায় এসে পুতু মীরদারোগাকে  বললে সে ঘটনা। কিন্তু ওদের জন্য  চুরি থেকেও আরও বেশি অবাক অপেক্ষা করছিল থানায়। মীরদারোগা দুজনকে বসিয়ে বললেন- হ্যাঁ মা, ভুল তো তোমাদেরও ছিল। সাবধানে জিনিস না রাখলে শুধু চোরকে দোষ দিলে তো হবে না। বলি, মাছ খাও ঘরে?

দারোগা বাবুর প্রশ্ন শুনে মা মেয়ে অবাক। এর সাথে মাছ খাওয়া, মাংস খাওয়া , আমিষ নিরামিশের কি সম্পর্ক?

মা বললেন, হ্যাঁ খাই।  মীর দারোগা বললে, ভেরি গুড। এবার ধরুন বাড়িতে মাছ এনেছেন । সেটি জম্পেশ  রান্না করে কি খুলে রাখেন রান্নাঘরে? আর যদি ভুলে রেখেও দেন  তবে বিড়াল খেলে  বিড়ালকে মেরে কিছু লাভ হয় ?

মা মেয়ে দুজনেই  চুপ। দারোগার মুখে উল্টো কথা শুনে কিছু বলবেন তা  আর বলতে পারলেন না। কারণ তখনি দুকাপ চা তাদের সামনে দিয়ে গেল পাশের দোকানের ভুতু। ঢোক গিললেন পুতুর মা । রাগবেন না প্রশংসা করবেন গুলিয়ে ফেলছেন।  দারোগাবাবু বললেন ঠাণ্ডা  হয়ে যাবে খেয়ে নিন।  বিড়ালের সঙ্গে ছিঁচকে চোরের তুলনা শুনে মা বললেন- তবুও লাঠির ভয় না দেখালে বিড়াল তো বারবার ঢুকবে । তাই-

বাকি কথা বলার আগেই   এমন সময়  টেবিলের নিচ থেকে শব্দ এল-  ম্যাও।

বিড়াল নিয়ে আলোচনায় ম্যাও শব্দ আসায় মনের ভ্রম ভাবলেন মা।   কিন্তু  আবার সেই আওয়াজ- ম্যাও । শুনে এবার তাকালেন মা মেয়ে  টেবিলের নীচে। টেবিলের খুরোয় বাঁধা একটি হৃষ্টপুষ্ট বিড়াল। চোখ  ছানাবড়া হবার দশা ওদের । কারণ এ তো যা-তা সাধারণ আর পাঁচটা বিড়ালের মতো নয়। যেন বিয়ের আগের কনে এ।  কানে তার দুল, নাকে ছোট্ট ফুল । গলায় সোনালি চেন, জামায় রুপোলী পেন।  পাশে ঠেস বালিশ, নখে নেল পালিশ।

বিস্ময় কাটাতে  মীরদারোগা বাবু  বললেন – ওটা  আমার পুষি। ভালো নাম লুসি। খুব আদুরে।বলেই দারোগা বাবু  ডাকলেন  লু-সি ।

অমনি এক ঝাঁপে লুসি খুশি হয়ে টেবিলে। আঁতকে উঠলেন ওরা। দারোগাবাবু বললেন - কোন ভয় নেই। কিস্যু করবে না। ভেরি ওবিডিয়েন্ট ।  ঘরের মানুষ। আসলে মেয়েটার বিয়ে দেবার পর ঘরটা খালি হয়ে গিয়েছিল। তাই লুসিকে একপ্রকার দত্তক নেওয়ার মতো আর কি।  কেমন , দেখতে হিরোয়িন হিরোয়িন লাগছে না দিদি ? পুতু বললে, মা চলো। যা গেছে গেছে। এবার সাবধান হতে হবে । উনি তো বলেই দিলেন। 

ঠিক এ সময় অপেক্ষা করছিল আরেক বিস্ময়। থানার কাজের ছেলে নব  একটা প্যাকেট  বড়বাবুর হাতে দিয়ে বললে এই নিন লুসির ফ্রক। কলকাতা থেকে আনতে দিয়েছিলেন স্বপনকে। সে এনে আমার হাতে দিয়ে বললে দারোগাবাবুকে দিস, লুসির জন্য কিনতে পাঠয়েছিল। 

বাহ, বাহ। দে প্যকেটটা লুসিকে কাল ভালো করে সাজাব। কাল হ্যাপি বার্থ ডে বলে কথা। বলেই প্যাকেটটি মীরদারোগা ছিঁড়েছেন অমনি পুতু চিৎকার করে উঠল – এইতো স্যার এটাই তো আমার চুরি যাওয়া ফ্রক।

মীরদারোগা বললেন, কোথাও ভুল হচ্ছে মেয়ে। এটা আমার এক পরিচিতকে কাল কলকাতা থেকে কিনতে দিয়েছিলাম। সে কিনে এই নব-র হাতে পাঠিয়েছে।

এমন সময় বিড়ালের গলা থেকে বের হল- ম্যাও। 

এই দেখ লুসির আমার খুব পছন্দ। ও সায় দিয়েছে। মীরদারোগা একগাল হেসে  বললেন।

তখনই দারোগার হাত থেকে পুতু ফ্রকটি নিয়ে মাকে সে দেখালে  একটু  ঢিলে  ছিল বলে ফ্রকের নীচটা নিজে হাতে কালো সুতো দিয়ে  সে  সেলাই করেছিল।  

মাথা চুলকোলেন মীরদারোগা। স্বপন তো একাজ বহু আগে ছেড়েছে। নিজে পয়সা দিয়ে ব্যবসায় নামিয়েছেন। তার মানে আমার দেওয়া টাকা ও পকেটে ঢুকিয়ে এটি  পুতুদের ঘর থেকে ঝেড়ে দেয় নি তো ও?

ঠিক এমন সময় দেখলেন কজন লোক কাকে ধরে নিয়ে আসছে থানায়। তিনি আগে লুসিকে নামালেন নীচে। লোকগুলো দারোগাবাবুর টেবিলে এসে চেঁচাতে লাগল। স্যার কতদিন ধৃতরাষ্ট্র হয়ে থাকবেন ? এই যে আপনার পেয়ারের স্বপন , গুড বয়। মোটা একজন অভিযোগকারী বললেন- আজ আমার পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়েছে ।

মীরদারোগা  ভাবলেন তবে তার আশঙ্কাই বোধ হয় ঠিক । হঠাৎ হয়ে গেলেন তিনি অন্য মানুষ। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন- ও শুধু আপনাদের পকেট কাটেনি, কেটেছে আমারও। কেটেছে আমার মান সম্মান! উপকারের দক্ষিণা দিয়েছে আমায়। আমারই দেওয়া লুসির জামার টাকা মেরে চুরি করা একটা জামা দিয়ে গেছে। কি লজ্জার কথা। ছিঃ ।

বলেই  এক খাবলে স্বপনের চুলের মুঠি  ধরে কনস্টেবল সাগরকে বললেন- একে লকারে ঢোকা। কাল চালান করব। ঘানি না টানলে ওর শিক্ষা হবে না।

 এবার মীরদারোগা নিজেই বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন-শেষ বয়সে এসে আজ বুঝলুম মানুষকে  অন্ধ হয়ে বিশ্বাস করতে নেই, বাজিয়ে নিতে হয় মাঝে মাঝে।   দুধকলা দিয়ে সাপ পুষে আমাকেও ছোবল মারল? বলে ফ্রকটা পুতুকে দিয়ে দিলেন।  মুখ ঢেকে লকারে ঢুকল স্বপন। দারোগাবাবু বললেন , আপনারা এবার সবাই আসুন।  ওর কেস হিস্ট্রিটা তৈরি করি।

ডিউটি শেষে দারোগাবাবু  বাড়ি ফিরলেন। মন ভালো নেই। সঙ্গে লুসি।  জীবনে এক নতুন শিক্ষা পেলেন। ঘর ঢুকতেই স্ত্রী বললেন- আমার  থেকে লুসির কদর দেখছি বেশি। তুমি থানার বড়বাবু হয়েও আমি   একটা গামছা পর্যন্ত পেলাম না গিফট, আর লুসির বার্থ ডে-তে গিফট ফ্রক দিয়ে গেছে একটি মেয়ে। পুতু না কি নাম বলল। এই মাত্র গেল সে।

ফ্রক দেখে  মীরদারোগার কথা বের হল না। তার মানে ওরাও আমার লুসিকে এতো ভালোবাসে? বিষাদের মধ্যেও স্বাদ পেলেন ভালবাসার। এমন সময় শব্দ এল-ম্যাও।

মীরদারোগা লুসিকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।


ধারাবাহিক ভ্রমণ
সান্টাক্লসের আপন দেশে
পর্ব ২
মলয় সরকার


আগে কিছুটা বলে নিই এদের দেশের কথা।  
.
১৭০০ সালে মানুষ এটাকে প্রথম খুঁজে পেলেও ১৭৪১ সালে রাশিয়া এটার সম্বন্ধে আগ্রহী হয়ে ওঠে।  তারপর থেকে এটা অনেকটাই রাশিয়ার দখলে ছিল। শেষে আমেরিকা ১৮৬৭ সালে নামমাত্র মূল্যে এই দেশটি কিনে নেয় রাশিয়ার কাছ থেকে। .১৮৯০ সালে বহু মানুষ সারা পৃথিবী থেকে এখানে কি পাওয়া যায় তাই খুঁজতে আসে।সেই সময়টাকে বলে “গোল্ড রাশে’র সময়। তার পর  দুটি বিশ্বযুদ্ধের অনেক ওঠাপড়ার ভিতর দিয়ে গিয়ে  ১৯৫৯ সালেএটি প্রথম আমেরিকার হাতে পুরোপুরি আসে এবং আমেরিকাও এর দিকে মন দেয়।ধীরে ধীরে এটি সভ্য জগতের আলোয় আসে। আজ সেখানে কি নেই ?

 এটি আমেরিকার একটি প্রদেশ হয়ে গেছে, এবং অন্যান্য অন্য প্রদেশের মতই সব আছে এখানে। তবে সব পাল্টালেও প্রকৃতিকে তো অত সহজে বদলানো যায় না। সেটার বৈচিত্র্যই অন্য রকম। সেটারই একটা ছবি তুলে ধরব তোমাদের কাছে, যে আমি কি দেখে এলাম।
তোমরা হয়ত পরে পড়াশোনা করে বা নিজেরা এখানে এসে কখনও নিজের চোখে দেখে যেতে পারবে, তোমাদের ছেলেবেলার বন্ধু সান্টাকে।

আমরা ক্যালিফোর্ণিয়া থেকে  আলাস্কা এয়ার ওয়েজ এর এরোপ্লেনে চেপে গিয়ে পৌঁছালাম, এর একটি বড় এয়ারপোর্ট ফেয়ার ব্যাঙ্কসএ। যখন নামলাম, দুপুর রোদ।, বেশ চড়া। ভাড়ার গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে দেখি, চারধারে লোক খুব কম। বেশ ফাঁকা ফাঁকা। কি ব্যাপার , শহরে এত কম লোক কেন? আশ্চর্য লাগল। অফিস টফিস, দোকানও সব বন্ধ।
ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার, আজ ছুটী না কি? 
ও কিছু না বলে মুচকি হেসে  বলল, ঘড়িটা দেখ। দেখলাম। দেখে চোখ কপালে। সময় এখন রাত বারোটা। প্রথমে খেয়াল করি নি । ভাবছিলাম, দিন বোধ হয়। সত্যিই তো রাত বারোটায় মানুষ কি অফিস করবে? না, বাজার স্কুল যাবে? কিন্তু, এত চড়া রোদ!!!  ভুল দেখছি না তো? 
ছেলে বলল, আমরা এসেছি এখানের দিনের সময়। এখন ২৪ ঘণ্টাই দিনের সময়। 
তাইতো , এটা তো উত্তর মেরুতে।যদিও আসল ভৌগোলিক উত্তর মেরু এখান থেকে প্রায় ২৮০০ কি মি বা ১৭৪০ মাইল দূর।  এই ব্যাপারটা বইয়ে পড়েছিলাম, যে ছ’মাস দিন ছ’মাস রাত এখানে। তার এখন দিনের সময়। ২৪ ঘন্টা দিন যে কি জিনিস, এই প্রথম জানলাম। যখন ২৪ ঘন্টা রাতের সময় তখন সব সময়ই অন্ধকার।আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এখানে। সঙ্গে চারিদিকে বরফের রাজ্য। কিছুই ঘোরা বেড়ানো সম্ভব নয় তখন।।এখানে তাপমাত্রা মোটামুটি , গরমের সময় ৭ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড থেকে ২৪ ডিগ্রী, এবং ঠাণ্ডার সময় -৭ ডিগ্রী থেকে -২৩ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড।কাজেই শীতের সময় কত ঠাণ্ডা বুঝতেই পারছ।  

এখানে এসেই প্রথম ধাক্কা খেলাম। ধাক্কা খেলাম, না বলে বলতে হবে প্রথম মজার অভিজ্ঞতা হল। হোটেলে যখন ঢুকলাম, তখন রাত দেড়টা। 
বলে না দিলে বোঝা মুস্কিল, দিন না রাত। যাই হোক, হোটেলে খেয়ে দেয়ে শুতে রাত আড়াইটা। কিন্তু ঘুম আসে না। জানালা দিয়ে রোদের আলো আসছে। আর এমন দিনের (রোদের) বেলা ঘুমানো অভ্যেস নেই। ঘুম আসে রাতের বেলা, যখন চার পাশে নামে ছমছমে অন্ধকার। কিন্তু সে অন্ধকার তো এখানে কখনই হবে না। কি করি! জানালার পর্দা ভাল করে টেনে দিলাম, আলো নিভালাম। তাও অল্প আলোর রেখা যেন কোথা দিয়ে চুরি করে ঢুকছে, দুষ্টু মেয়ের মত। চোখ বন্ধ করে ভাবতে চেষ্টা করলাম, এটা রাত, এটা রাত। মন ঘুমাও এখন। কিন্তু বললে হবে কি ! ঠিক চোখ খুলে যাচ্ছে, দেখি দিন এখন। শেষে ভাবলাম, ধুত্তোরি যা হয় হোক। পারি না আর। শেষে দেখি রাত সাড়ে তিনটের সময় একটু রোদ কমে আমাদের বিকালের মত একটু মরা আলোময় বিকালের মত হল।তার পর আস্তে আস্তে আবার ভোর হওয়ার জন্য আলো বাড়তে লাগল। শেষে এই লুকোচুরি খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে কখন যে চোখটা একটু বুজে এসেছিল জানি না। যখন উঠলাম, তখন ঘড়িতে বেলা আটটা। (ক্রমশ)


গুরুসদয় দত্ত ও ব্রতচারী আন্দোলনের তাৎপর্য 

অলিভা বিশ্বাস 
দ্বিতীয় বর্ষ, চতুর্থ সেমিস্টার, হাবড়া শ্রীচৈতন‍্য কলেজ, উত্তর  চব্বিশ পরগনা


 ব্রতচারী নামটা শুনলেই যেন আমাদের নাম সিঁটকে ওঠে ।আর যে পাশ্চাত্য দেশের অনুকরণ করতে গিয়ে নিজেদের সংস্কৃতিকে ছোট করে ফেলছি সে সম্বন্ধে আমাদের কোনো ধারনাই নেই কিন্তু দেখতে পাওয়া যায় সেই পাশ্চাত্য দেশের মনীষী তথা ইংল্যান্ডের বিখ্যাত মনীষী ও কবি লরেন্স বিনয় স্বীকার করেছেন- বর্তমান যুগের সমগ্র পৃথিবীতে বিশেষ করে পাশ্চাত্য দেশে আমাদের জীবনের সমগ্রতাটি যেন হারিয়ে ফেলেছি; আমরা জীবনধারার সত্যরূপ কে সম্পূর্ণভাবে হারাতে বসেছি। ব্রতচারী সংচেষ্টার উদ্দেশ্য-মনের এই সমগ্রতা এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির এই লুপ্ত  সংযোগ পুনঃস্থাপন করিয়ে দেওয়া যা একান্ত দরকার। 

বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সকলের মুখে মুখে শোনা যায় ন্যাশনালিজম অর্থাৎ দেশপ্রেমের সংকীর্ণতা ছেড়ে দিয়ে একেবারে বিশ্বমানব প্রেমের ভরপুর হয়ে উঠলেই পৃথিবীতে শান্তি ফিরে আসবে। নির্দিষ্ট জায়গা দখলের উদ্দেশ্যে, নিজের আধিপত্য বাড়ানো উদ্দেশ্য যুদ্ধ হবে না। কিন্তু বর্তমানে তো দেখা যাচ্ছে ন্যাশনাল ইজম এর ফলে অন্য দেশের মানবে প্রতি হিংসা এবং অন্য দেশকে গ্রাস করার লোভ উপজাত হয়ে বর্তমান জগতে আরও বেশি পরিমাণে অশান্তি ও সংগ্রাম এর সৃষ্টি করছে, তাই এই পৃথিবীতে ব্রতচারীর একটি আদর্শ কথা মনে পড়ে যায় সেটি হল যে সকল মূলীভূত সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত একমাত্র তাতে করে বর্তমান জগতে উপরোক্ত সমস্যাগুলো সমাধান সম্ভব। জড়পদার্থ আর জীবিত প্রাণীতে এই তফাৎ যে জড়পদার্থ ইচ্ছা শক্তি দ্বারা অন্তরে ও বাহিরকে অর্থাৎ মনের ও শরীরের ছন্দ শক্তিতে চালনা করতে পারে সম্বন্ধিত অনিয়ন্ত্রিত করতে পারে না কিন্তু একটি জীব তার মনকে এবং শরীরকে ছন্দ দ্বারা চালিত ও সমন্বিত করতে পারে। 

এই অধঃপতিত বাঙালি জাতির মনে আবারও ছন্দ শক্তি একান্ত প্রয়োজনীয়তাও শক্তিমত্তার উপলব্ধি আমাদের ফিরিয়ে আনবার সাধনা করতে হবে যাতে করে আবার আমরা তার শরীর ও মনের ছন্নছাড়া ভাব দূর করে তাকে আবার স্বচ্ছন্দ ও সুষ্ঠু এবং অন্তরে ও বাহিরে পূর্ণ স্বাস্থ‍্যবান করে তুলতে পারি। তাই পৃথিবীর সকল দেশের মানুষকে হতে হবে স্বচ্ছন্দ তাহলেই মানুষ তার স্বভাব এর সাধনা করতে পারবে তাহলেই সে মানুষ হিসেবে স্বস্থ হতে সমর্থ হবে শরীর ও মনের স্বাস্থ্য লাভ করতে পারবে। ব্রতচারী চায় প্রত্যেক বাঙালি কে করতে পূর্ণ বাঙালি ও পূর্ণ  মানুষ; তার ভিতরে জাগিয়ে দিতে বাংলার স্বভাব ধারার প্রবাহের গৌরব বোধ তাকে বোঝাতে চায় যে বাংলা স্বচ্ছন্দ ও স্বভাবের ধারাকে অতিক্রম করে অর্থাৎ পূর্ণ বাঙালি না হয়ে অন্য মানুষ হওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। বতচারী তে একটি অন্যতম কবিতা রয়েছে যা আমাকে ভীষণভাবে টানে সেটি হল চির ধন্য সুজলা ভূমি বাংলার/জয় জয় সোনার বাংলা!/জয় জয় ভাষার বাংলার/জয় জয় আশার বাংলার/সর্ষের শিল্পের শখ্যর ঐক্যের জ্ঞানের  মহা প্রানের বাংলার! আমরা বাঙালি বাংলাভূমি আমাদের মাতৃভূমি বাংলা শক্তি দ্বারা আমাদের মধ্যে অভিব্যক্ত আমরা বাংলার ছন্দ ধারা মূর্ত প্রকাশ এই দেশাত্মবোধ প্রতিদিনের অজস্র মুখবন্ততার মধ্যে আমাদের অন্তরের সঞ্চারিত করে দিতে হবে। দুঃখের বিষয় আজ সঞ্চারিত নেই বলেই হয়তো রাজনৈতিক নেতাদেরকে আমারা আমাদের মাতৃভূমি কে নিয়ে ছেলে খেলা করতে দিচ্ছি নীরবতা সহিত। স্বদেশ প্রেম কে ব্রতচারী এক নতুন সংজ্ঞার উপর উপস্থাপিত করতে চায় যাতে করে এক দেশের মানুষের মনে অন্য দেশের মানুষের প্রতিহিংসার দেশের স্বভাব নির্বাচন করে তার স্থানে এনে দেয় পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা অনুরাগ ও সহযোগিতা এবং স্থাপনের আগ্রহ। 

আমাদের সংস্কৃত এক অর্থে আমাদের আত্মা যা আমরা আজ হারাতে বসেছি এখন একান্তভাবেই প্রয়োজন যে সাধনার দ্বারা আমরা বাংলার স্বরূপ  চিনতে পারব এবং বাঙালির আত্মাকে করতে পারব আত্মস্থ ও স্বচ্ছন্দ এরই পথ দেখায় ব্রতচারী। প্রতি দেশের মানুষই চায় নিজের জীবনের সফলতা আনতে ।কিন্তু তা করতে গিয়ে নিজের আত্ম পরিচয়  ও সংস্কৃত ভাবধারাকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করে তা কখনোই সম্ভব নয়। আত্মানং বিদ্ধি যার অর্থ প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় স্থাপন করা। যা শুধু সংস্কৃতে বলা হয় তেমনটা নয় প্রায় সমস্ত ভাষার উল্লেখ রয়েছে যেমন সাধারণত আমরা বলে থাকি know yourself, কিন্তু আমরা বহু মানুষই জানিনা সংস্কৃত ভাষায় তথা বাংলা অতীতে বহু আগেই এ আদেশ ঘোষিত হয়েছিল। ব্রতচারীর পঞ্চব্রত যথা জ্ঞান, শ্রম, সত্য, ঐক্য এবং আনন্দ। এগুলি শুধু ব্রতচারী নয়  আমাদের যুবসমাজেরও ব্রত হওয়া জরুরী। ব্রতচারী প্রগতি বিরুদ্ধে নই বাঙালি বিজ্ঞানী শিল্পে এবং আধুনিক যুগের সকল কলাবিদ্যা পৃথিবীর সঙ্গে তাল রেখে এগিয়ে যেতে হবে কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে সখ্য ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। 

এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ স্ত্রী-পুরুষ ও বয়স নির্বিশেষে দেশের মানুষের মধ্যে একটা বৈশ্বিক নাগরিকত্ব জাতীয় চেতনা প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের সকলকে ব্রতচারী আন্দোলনের অংশীদার হওয়া বর্তমান পরিস্থিতে একান্তই জরুরী হয়ে পড়েছে। আমার মতে শুধু মুখের কথায় বতচারী আন্দোলনে অংশীদার  হব। এটা যথেষ্ট নয় তার উদ্দেশ্য,  গুরুত্ব সম্পর্কে আত্মস্থ করে তাকে নিজের জীবনে প্রতিফলিত করতে পারলে একটি প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠা সম্ভব। ব্রতচারী ছাড়া সাধারণ মানুষের জীবন অসম্পূর্ণ ছিল এবং আজীবন থাকবে। আমাদেরকে একটা সৎ মানুষ হতে শেখায় এই ব্রতচারী এবং একটা সুস্থসবল দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ব্রতচারী। তাই এক কথায় বলা যায় বিজ্ঞান ছাড়া যেমন একটি উন্নত দেশ গঠিত হতে পারে না ঠিক তেমনি ব্রতচারী ছাড়া একটি সুস্থ সবল দেশ তথা দেশের নাগরিক গঠিত হওয়া সম্ভব নয় । কারণ মানুষের মনের একাগ্রতা দেশাত্মবোধ ও সকলের প্রতি সহানুভূতি গঠিত না হলে একটি সুস্থ সবল দেশ গঠিত হতে পারে না । তাই আমার মতে আমাদের সকলকে ব্রতচারী প্রতি সম্মান করা দরকার এবং গুরুসদয় দত্তের প্রদর্শিত পথে এগিয়ে ব্রতচারী আন্দোলনের অংশীদার হয়ে ব্রতচারীকে জীবিত রাখা আমাদের কর্তব্য।


স্মরণীয়
(সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর)
কলমে - পীযূষ প্রতিহার

১৮৪২ সালের ১জুন কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। তিনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র, রবীন্দ্রনাথের দাদা। মায়ের নাম সারদা দেবী। বাড়িতেই প্রাথমিক পাঠ এবং বাংলা, ইংরেজি ও সংস্কৃত শিক্ষা হয়েছিল তার। ১৮৫৭ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষা শুরু হলে ঐ বছরই হিন্দু স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েছেন। ১৮৬১সালে কেশবচন্দ্রের সঙ্গে কৃষ্ণনগরে ব্রহ্মধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন। ১৮৬২ সালে লণ্ডন যান এবং ১৮৬৪ সালে প্রথম ভারতীয় হিসেবে আই সি এস হয়ে দেশে ফিরে আসেন। এরপর প্রথম চাকুরী সূত্রে বোম্বাই(বর্তমান মুম্বাই) গমন করেন। ১৮৬৫ তে আমেদাবাদ শহরের এসিস্ট্যান্ট কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ পান। ১৮৯৭ সালে চাকুরী থেকে অবসর নেন ও কলকাতা ফিরে আসেন। সরকারি চাকরিতে থাকাকালীন দেশবাসীর মনে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করতে ১২৭৩ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংক্রান্তির (১২ এপ্রিল ১৮৬৭) দিন কলকাতার বেলগাছিয়ায় 'হিন্দুমেলা'র প্রবর্তন করেন। এই মেলা উপলক্ষে 'মিলে সবে ভারত সন্তান' গানটি রচনা করেন ও প্রশংসা অর্জন করেন। ১৯০০ ও ১৯০১ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি হন। ১৯০৬ এ আদি ব্রহ্মসমাজের আচার্য ও ১৯০৭ এ দ্বিজেন্দ্রলাল ঠাকুরের সঙ্গে ব্রহ্মসমাজের আচার্য ও সভাপতি মনোনীত হন। তিনি সাহিত্য রচনায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। মোট নয়টি বাংলা গ্রন্থ ও তিনটি ইংরেজি গ্রন্থ রচনা করেন। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলো হল- বোম্বাই চিত্র (১৮৮৮), বৌদ্ধধর্ম (১৯০১), এছাড়াও নাটক সুশীলা-বীর সিংহ (১৮৬৭) , স্ত্রী স্বাধীনতা, ভারতবর্ষীয় ইংরেজ(১৯০৮) , আমার বাল্যকথা ও আমার বোম্বাই প্রবাস(১৯১৫), Raja Rammohan Ray, The Autobiography of Maharshi Devendranath Tagore ইত্যাদি। এছাড়াও অনুবাদ সাহিত্যও তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। অনুবাদ করেছেন বালগঙ্গাধর তিলকের গীতারহস্য , তুকারামের অভঙ্গ কবিতাবলী ও মেঘদূত(১৮৮৪)। তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন ১৮৫৯-৬০, ১৯০৯-১০ এবং শেষ পর্যায়ে ১৯১৮-২৩ পর্যন্ত। তিনি স্ত্রী স্বাধীনতা নিয়ে খুব সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলতেন। তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীকে তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার আদর্শ শেখাতে ও মুক্ত চিন্তার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে বিলেতে পাঠিয়েছিলেন। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার বড় অংশের মহিলাদের পর্দাপ্রথা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পথ দেখিয়েছিলেন। 

   সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৩ সালের ৯ জানুয়ারি কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।


পাঠ প্রতিক্রিয়া
(ছোটোবেলা ৮৫ পড়ে কবি বিশ্বনাথ চৌধুরী যা লিখলেন)

জ্বলদর্চি ছোটোবেলা  সংখ্যা ৮৫ 
পড়লাম। প্রথমেই রূপণ আর্যের তোলা এক
অসাধারণ চিত্র অসম্ভব ভালো লাগল। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি শিশু আর ব্যাক গ্রাউন্ডে বৃক্ষরাশি। আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে
শিশুটি স্বাধীনভাবে। প্রতিবারের মতো আমাদের প্রিয় গুণী লেখিকা ও সম্পাদিকা
মৌসুমী ঘোষের ভূমিকা পড়ে সংখ্যাটিতে কী
কী আমরা পেতে চলেছি তার সামগ্রিক ধারণা
পেয়ে গেলাম। সায়নীর সাগর দেখার স্বপ্ন ছন্দে খুব সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস ওনার ছড়ায়। ক্লাস
নাইনের অ্যানুয়াল পরীক্ষায় বাংলায় পঁচিশ
পাওয়া জয়ন্তী মন্ডল স্বপ্নে সুকুমার মাস্টারের
কাছে ব্যাকরণ শিখে পরের বছর মাধ্যমিকে
বাংলায় একশোতে ছিয়ানব্বই নম্বর পেয়ে বাংলায় প্রথম হওয়ার যে গল্প লিখেছেন সেটা
সত্যি খুব ভালো লাগল। মাথায় কোনো ছড়ার
লাইন না এলেও প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে
মুগ্ধ হয়ে অবশেষে সুন্দর একটা ছড়া লিখে
ফেলেছে ছোট্ট মামনি অনামিতা। প্রতিবারের
মতো তৃষ্ণা বসাকের ধারাবাহিক উপন্যাস
" জয়াবতীর জয়যাত্রা " আমাদের মুগ্ধ করেছে। সান্টাক্লসের দেশ আলাস্কা ভ্রমণের
যে বর্ণনা আমরা মলয় সরকারের ধারাবাহিক
ভ্রমণ প্রথম পর্বে পেলাম তা অনবদ্য। আগামী পর্বগুলোর পড়ার অপেক্ষায় রইলাম। রামকিঙ্কর বেইজকে স্মরণ করে পীযুষ প্রতিহারের লেখা থেকে শিল্পীর সম্বন্ধে আমরা অনেক কিছু জানতে পারলাম। অষ্টম শ্রেণীর
স্নেহা দাস ময়ূরের যে সুন্দর ছবি আমাদের
উপহার দিয়েছে তার জন্য সে যথেষ্ট প্রশংসার
দাবি করতেই পারে। সর্বোপরি মৌসুমী ঘোষের
সুন্দর সম্পাদনায় দিন দিন পত্রিকাটির সুনাম
বাড়ছে।

আরও পড়ুন 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments