জ্বলদর্চি

জ্বলদর্চি ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ৮৭

 ছোটোবেলা  বিশেষ সংখ্যা ৮৭


সম্পাদকীয়,

গর্ভধারিনী ছাড়াও, জন্মভূমিও আমাদের মা। নদীও মা।  গঙ্গাও আমাদের মা। তৃষ্ণা আন্টির উপন্যাসে জয়াবতী আর পুণ্যি দুই সই আবার একে অপরের সঙ্গে গঙ্গাজল পাতিয়েছে। সেটাও একটা প্রিয় সম্পর্ক। কল্যাণ আঙ্কেলের তোলা প্রচ্ছদের ছবিতে দেখো ছোটো ছোটো ছেলেগুলো কেমন  নদীতে নেমে খেলা করছে। বিশ্বনাথ জেঠু তাঁর ছড়ায় বলেছেন, মন যা চায় তাই কর। তবে কখনোই ভুতুর মতো কোর না। ভুতু কে? সেটা জানতে পড়তে হবে তপন জেঠুর গল্পটা। ভুতুর দুষ্টুমির শেষ নেই। কারণ ভুতু ছোটো।  ছোটোরা একটু আধটু দুষ্টুমি করে বইকি। ছোটোরা দুষ্টুমি করে, খেলা করে, গল্প শোনে। ছোটো হওয়ার মজাটাই আলাদা। তাই ভানুপ্রিয়া একটু বড় হয়েছে কি হয়নি আবার ছোটো হয়ে যেতে চায়। ছোটো হওয়ার আর একটা মজা সকলে গিফট দেয়। বিশেষ করে সান্টা ক্লস। যাবে নাকি সান্টা ক্লসের দেশে? সেখানে তো আমরা সকলে যেতে পারব না। তাই মলয় জেঠু সেখানে গিয়ে সান্টা ক্লসের ঠিকানা এনে দিয়েছেন। তোমরা সকলে সান্টাকে চিঠি লিখে গিফট চেয়ে নিও কেমন? আমিও চিঠি লিখব সান্টাকে। আমি কী চাইব? আমি বলব ছোটোবেলার ছোটোবন্ধুরা যেন সকলে মহান হয়। নদীর মতো মহান। মহান হবার কথায় মনে পড়ে গেল, এবারের ছোটোবেলায় পীযূষ আঙ্কেল এক মহান ব্যক্তিত্বের কথা লিখেছেন। তিনি কে জানো? তিনি প্রশান্ত চন্দ্র মহালনবিশ। তোমরা কিন্তু শ্রীজা আর সুদেষ্ণার আঁকা কেমন লাগল জানিও। - মৌসুমী ঘোষ।



ধারাবাহিক উপন্যাস 
জয়াবতীর  জয়যাত্রা
উনবিংশ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক

পাল্কিটা কোথায় গেল?
২৩

এ-ই তাহলে মা গঙ্গা! জয়াবতী যে মুখফোঁড়, তার অব্দি বাক্যি হরে গেল দেখে। যদিও সে বুঝতে পারল না একটা নদী, তা সে যত বড় আর যত সুন্দরই হোক, তাকে মা বলে ডাকার কী আছে? যাই বলো বাপু, দিনরাত মা মা করাটা বাঙ্গালির একটা মস্ত রোগ। নিজেরা কুটো নেড়ে দুখানা করবে না, কেবল সব মায়ের ওপর ছেড়ে দেওয়া। তার ওপর ছোট এতটুকুনি মেয়েকেও মা বলে ডাকবে, আবার তাকে বেঁধে পুড়িয়ে মারতেও যাবে! কেমন দুমুখো সাপ সব।জয়াবতী হাওয়ায় ওড়া আঁচল সামলাতে সামলাতে দেখল বাব্বা কী বড় নদীটা। এপার ওপার দেখা যায় না। তবে খুব চোখ চালিয়ে দেখলে বোঝা যায় ওপারে সবুজ সবুজ বনের রেখা, তার মধ্যে একটা খুব উঁচু মন্দিরের দেউল চোখে পড়ল জয়াবতীর। মন্দির যখন আছে, মানুষও থাকবে নিশ্চয়। সে সেনমশাইকে শুধোল ‘ও সেনমশাই, ওদিকেও কি মানুষের বাস আছে? মন্দিরের চুড়ো চোখে পড়চে দেকচি’ পুণ্যি অমনি পাশ থেকে বলল ‘মা গো মা, এত বড় একটা নদী, তার ওপারেও মানুষ থাকে? মানুষের বাস নেই এমন জায়গা পিথিমিতে আছে, হ্যাঁরে গঙ্গাজল?’

পুণ্যির কথা শুনে হাড়পিত্তি জ্বলে গেছিল প্রথমে। জয়াবতী খুব কড়া করে বলতে গেছল ‘কুয়োর ব্যাঙ কোতাকার! ওপারেও তোর মতো কুয়োর ব্যাঙ আছে নিশ্চয় অনেক, তারাও ভাবছে, এপারে মানুষ আছে নাকি?’ কিন্তু বলা হল না সেসব। পুণ্যির ওই যে শেষ ডাকটা- হ্যাঁ রে গঙ্গাজল, শুধু তাকে যে গলিয়ে দিল তাই নয়, সে যেন চমকে উঠল। আরে, তাদের সই পাতানো তো গঙ্গাজলের নামে, সেই কোন ছোটবেলায় গঙ্গাজল পাতিয়েছিল, আর সেই গঙ্গার সামনে তারা দুটিতে দাঁড়িয়ে আছে এখন। কী অপূর্ব এক অনুভূতিতে তার শরীর মন ভরে গেল। তার মনে হল তাদের দেশের মানুষ কিছুই না দেখে, না শুনে গোটা একটা জীবন কাটিয়ে দেয়। শুধু যে মেয়েমানুষরা এমন জীবন কাটায় তাই নয়, পুরুষরাই বা যায় কোতায়? তার পিতাঠাকুর সেই কোনকালে একবার কাশীধাম গেছিলেন, সেই জন্মের মুড়ি কর্মের যাওয়া তাঁর। মা যে মনে মনে শ্রীক্ষেত্র যাবার ইচ্ছে পুষে রেখেছেন, তা জানে জয়াবতী। শ্রীক্ষেত্রর প্রসাদে নাকি উঁচু জাত নিচু জাতের ভেদ নেই। সবাই সে প্রসাদ পায়। ভাবতেই খুব ভালো লাগল তার। তাছাড়া সে শুনেছে শ্রীক্ষেত্র ধামটি সমুদ্দুরের পাশে। সমুদ্দুর নাকি নদীর থেকেও অনেক অনেক বড়, এত বড় যে কল্পনাই করা যাবে না, আর তার জলের রঙ নীল, আর সে জল নদীর মতো মিঠেও নয়, নোনা। সেই কথা মনে হতেই জয়াবতী মনে মনে দুটো কথা ঝপ ঝপ করে ভেবে ফেলল-
এক- সে একবার মা কে শ্রীক্ষেত্র ধাম দেখাতে নিয়ে যাবে
দুই - তার নতুন কোন সই হলে তারা নীল সমুদ্দুর পাতাবে।



তার কারণ তার মনে হল সই পাতানোর মধ্যে আসলে মানুষের মনের সাধ ধরা থাকে।আর মানুষ যখন মন থেকে খুব জোর দিয়ে কিছু  চায়, সেটা তার হয়েই যায়। গঙ্গাজল পাতিয়েছিল বলেই না আজ ওরা দুই সইতে গঙ্গার সামনে দাঁড়াতে পারল। তেমনই যদি নীল সমুদ্দুর পাতায়, তবে একদিন না একদিন সে নিশ্চয়ই সমুদ্দুর দেখতে পাবে। কিন্তু মুশকিল হল, পুণ্যির সঙ্গে তো গঙ্গাজল পাতানোই হয়ে গেছে, আর ওই মেয়েটা, যাকে সে নাম দিয়েছে পেরজাপতি, এমন নির্জীব, তাকে কেবল বোন ভাবা যায়, তার সঙ্গে কিছুতেই সই পাতাবে না সে। কিন্তু তাহলে নীল সমুদ্দুর কবে আসবে তার জীবনে? হঠাৎ তার মনে হল  ওই যে সবুজ রেখার মতো বন আর মন্দিরের চুড়ো দেখা যাচ্ছে, তার না দেখা সই লুকিয়ে আছে ওই পারে কোথাও। খুব শিগগির দেখা হয়ে যাবে তার সঙ্গে।

সেনমশাই এগিয়ে এসে বললেন ‘ওপারের যে গাঁ-টা দেখা যাচ্ছে, তার নাম  কুঁকড়োহাটি’
কুঁকড়ো! মানে তো মুরগি! ‘তার মানে ওখানে কি মুরগির হাট বসে, ও সেনমশাই?’
সেনমশাই সপ্রশংস চোখে তাকান জয়াবতীর দিকে। এই মেয়েটা পুঁথি পড়তে একদম ভালো বাসে না, কিন্তু কী প্রখর বুদ্ধি! যদি দেশ, সমাজ অন্যরকম হত, তবে তিনি নিশ্চয় করে বলতে পারতেন এ মেয়ে মস্ত বড় হবে, বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু যে দেশে মেয়েকে আঁতুড়ঘর থেকে টেনে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হয়, ঘাটের মড়া বুড়োর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়, সে স্বামী মরলে তাকে চিতায় জ্বালানো হয় ধরে বেঁধে আর যদি নাও পোড়ানো হয়, দিনান্তে একমুঠো আলোচাল খাইয়ে আর নির্জলা একাদশী করিয়ে তাকে রোজ দগ্ধে দগ্ধে মারা হয়, সে দেশে এই মেয়ের কী ভবিষ্যৎ! এ কথা ভেবে বিষাদ ঘনায় কেমন। তবে সে বিষাদ গাঢ় হবার সময় পায় না।কারণ পেরজাপতি তখন বলে বসেছে
‘মুরগির হাট মানে ওদিকে মোচলমানের বাস নাকি সেনমশাই! কি ঘেন্নার কতা মাগো, তাহলে তো যত নৌকো আসছে ওদিক থেকে, সব মোচলমানের ছোঁয়া? মাগো! আমি কোথায় যাব গো। জাত ধম্মো কিচু রইল না কো’
সেই শুনেই  জয়াবতী বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর ওপর।
‘এত জাত ধম্মোর চিন্তা যখন, তোর আগুনে পুড়ে মরাই ভালো ছিল বুজলি পেরজাপতি। আগুন তো হিঁদু মোচলমান মানে না, সব একধার থেকে সাফ করে দেয়। বলি কোন শাস্তরে লেকা আছে যে মোচলমান ছোঁয়া নৌকো ছুঁলে জাত যাবে? লোকে বলে মা গঙ্গা নাকি সব পাপ নিয়ে নেন। তাহলে পাপ যদি  কিছু হয়, মা গঙ্গাই সে পাপ নিয়ে নেবেন, তোর আর জেঠামি করতে হবে না।তুইও যদি মোচলমানদের মতো কুঁকড়ো খেতিস, তবে তোর গায়ে জোর হত, যখন চিতেয় টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন ওদের দু ঘা দিয়ে পালাতে পারতিস’
পুণ্যি ভাবছিল, মাগো! ওর মুখে কি কিচুই আটকায় না? হিঁদুর ঘরে কুঁকড়ো!

সেনমশাই তখন ঘোড়া কোথায় রাখা হবে, পুরুত কোথায় এসব খোঁজ নিচ্ছিলেন বলে এদের কথা আর খেয়াল করলেন না। জয়াবতী তাঁর আর পানুর সঙ্গে ঘোড়ায় এসেছে জেদ করে, একটা পাল্কিতে পুণ্যি  আর পেরজাপতি আর বড়টায় মা, স্ত্রী আর মানোর মা -র আসার কথা। কিন্তু সেই পাল্কিটা এখনো পৌঁছল না কেন?
(ক্রমশ)


ভুতুর দুষ্টুমি

তপন রায়চৌধুরী

না, না,  ভুতুকে নিয়ে সত্যিই আর পারা যাচ্ছে না। ভয়ানক দুষ্টু হয়ে গেছে। কখন কী করে বসবে ও, কোনো ঠিক নেই। ইদানীং ব্যাপারটা যেন বেড়েই চলেছে। আর, সেই কারণেই ভুতুর মা, বাবা, দাদু, ঠাকুমা খুব চিন্তায় পড়ে গেছে যত দিন যাচ্ছে। ভুতুর এক দিদি আছে বটে, কিন্তু সেও যে খুব বড় ওর থেকে তা তো নয় যে কিছুটা শাসনে রাখতে পারবে ভুতুকে। মিমি সাত পূর্ণ করে সবেমাত্র আট-এ পড়েছে। আর, ভুতুর চার হবে কয়েকমাস বাদে।

ভুতুর দুষ্টুমির একটা নমুনা পেশ করলেই বোঝা যাবে, ও এখন কোন অবস্থায় আছে। কিছুদিন আগের কথা। মিমির আঁকাতে খুব মন। সেদিন ঘরে বসে কিছু একটা আঁকছিল একমনে। ভুতু কথা নেই বার্তা নেই দিদির ঘরে ঢুকে লাঠি দিয়ে দিদির পিঠে দিল এক বারি। আচমকা লাঠির বারি খেয়ে মিমি চমকে উঠে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল। বেগতিক বুঝে ভুতু সেই ঘর থেকে বেরিয়ে দিল এক ছুট। রান্নাঘর থেকে ঠাকুমা ‘কী হল’ ‘কী হল’ বলে ছুটে এল মিমির ঘরে। মিমি তখন কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘আমি আঁকছিলাম, ভাই আমাকে লাঠির বারি মেরেছে।‘
ভুতুর ঠাকুমা তখন মিমির কান্না থামাতে ব্যস্ত। মিমি থামল কিছুক্ষণ বাদে, তারপর ওর ঠাকুমা ‘কোথায় গেল ওটা, দাঁড়া দেখাচ্ছি’ বলতে বলতে এঘর ওঘর সেঘর খুঁজতে লাগল ভুতুকে। খুঁজে আর পায় না। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, দক্ষিণ দিকের ব্যাল্কনিতে রাখা ওয়াশিং মেশিনের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে ছিল ভুতু। ঠাকুমা দুঘা দিতে যাবে, ভুতু কিভাবে যেন কায়দা করে ঠাকুমাকে ডজ করে আবার অন্য ঘরে ছুট লাগালো। অবশ্য বেশি কায়দা করতে পারল না। দু-তিন ঘা খেতেই হল শেষ পর্যন্ত। শুরু হল ভুতুর কান্না। ওদিকে মিমির কান্না থেমে গেল কিছুক্ষণ বাদেই, সম্ভবত ভুতুর কান্নার আওয়াজ পেয়ে। ওর ঠাকুমা আবার মারধোর করে বেশিক্ষণ সেই মেজাজ ধরে রাখতে পারে না। ভুতুর চোখের জল দেখে তিনিও প্রায় মুহূর্তেই নরম হয়ে গিয়ে ভুতুকে আদর করতে থাকেন। পরিশ্রান্ত ভুতুকে জল খাওয়ানো হয় তখন।    এটা প্রায় প্রতিদিনকার ব্যাপার। 

অলোকের মানে ভুতুর বাবার এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে বহুদিন ধরে। সেই করোনার শুরুর সময় থেকেই। অলোক তার নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে অফিসের কাজকর্ম ম্যানেজ করে। ভুতুর এই দস্যিপনা সে নিশ্চয়ই শুনতে পায়, তবে খুব অসহ্য না হলে সে ঘরের বাইরে আসে না। ভুতু অবশ্য ওর বাবাকে খুব ভয় করে, তবে মাথার ক্যারাটা বেশি নড়াচড়া করলে ওর ওই ভয়ভাব খুব একটা থাকে না। ভুতুর মা ব্যাংকে চাকরি করে। সকাল ন’টায় বেরিয়ে যায় প্রত্যেকদিন, ফেরে সন্ধে সাতটা নাগাদ। ভুতুর দাদু সুজিতবাবু নির্ভেজাল শান্তশিষ্ট মানুষ, তিনি ভুতুকে একটু যেন এড়িয়েই চলেন। ফলে ভুতুকে সামলাতে প্রায় পুরো চাপটা এসে পড়ে ওর ঠাকুমার ঘাড়েই।

আবার, ভুতু বাড়িতে আছে অথচ একেবারে শুনশান, কোনো আওয়াজ নেই, সেটাও গভীর চিন্তার ব্যাপার। ভুতুর ঠাকুমা চিত্রাদেবী খুব সচেতন সে ব্যাপারে। এত শুনশান যখন, নিশ্চয়ই কিছু একটা কুকর্মে লিপ্ত আছে ভুতু। তেমনই একটা ঘটনা ঘটল একদিন। মিমি স্কুলে গেছে। ভুতুর মা তো অফিস চলে গেছে ন’টা নাগাদ। অলোকবাবু দরজা বন্ধ করে ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এ ব্যস্ত। সুজিতবাবু সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। চিত্রাদেবী রান্নাঘরে। বেশ নিস্তব্ধ বাড়িটা। চিত্রাদেবীর কেমন একটা সন্দেহ হল, এত চুপচাপ লাগছে কেন! ভুতু কী করছে? রান্নাঘর থেকে তিনি একবার উঁকি দিলেন বসার ঘরে। নাহ, ভুতুকে তো দেখা যাচ্ছে না। তিনি শোয়ার ঘরে গেলেন। দেখলেন, ভুতু একটা বড় পাউডারের কৌটো থেকে একগাদা পাউডার একটা বাটিতে ঢেলে তাতে জল দিয়ে সেই জলগোলা পাউডার নিজের মুখে মাখছে। সাদা ভুতের মত হয়ে গেছে মুখটা। চিত্রাদেবী ‘এ মা, কী করেছিস’ বলে ভুতুকে ধরে মারতে যাবেন, ভুতু এক ছুটে সোজা ঠাকুরঘরে ঢুকে গেল। ঘরময় পাউডার ছড়িয়ে আছে। চিত্রাদেবী তখন ভুতুর অপকর্ম পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মোটামুটি দশ মিনিট সময় লাগল সেসব করতে। তারপর যা হয়, ভুতুর পিঠে পড়ল কয়েক ঘা, শুরু হল ভুতুর কান্না, শেষমেষ যথারীতি চিত্রাদেবীর আদর এবং ভুতুর জল খাওয়া। 

কিন্তু দুদিন পরেই ভুতু যা কান্ডটি করল, তাতে সকলের বোধবুদ্ধি লোপ পেল একেবারে। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ চিত্রাদেবীর রান্নাবান্নার কাজ শেষ হয়েছে। পুত্রবধূ অফিস চলে গেছে, অলোকবাবুর ওয়ার্ক ফ্রম হোম, সুজিতবাবু বসার ঘরে বসে টিভি দেখছেন। মিমি স্কুলে। চিত্রাদেবী তখন আধঘণ্টার জন্য আবাসন চত্বরে নেমেছেন ভুতুকে নিয়ে। ঠিক ওই সময় ভুতুরই বয়সী অন্যান্য ফ্ল্যাটের কিছু কচিকাচারাও তাদের মা-ঠাকুমাদের সঙ্গে আবাসন চত্বরে চলে আসে। ভুতু সেইসময় ওদের সঙ্গে দৌড়োদৌড়ি, খেলাধূলা করে। সারাদিনের মধ্যে ওই সময়টুকুই চিত্রাদেবীর ফাঁকা সময়, আর, ভুতুও খেলাধূলা করার একটু সুযোগ পায়, ওর শিশুমন তৃপ্ত হয়। এরকমই চলে আসছে বেশ কিছুদিন ধরে। কিন্তু সেদিন ঘটল এক মহা বিপত্তি। ভুতু খেলছিল ওর বন্ধুদের সঙ্গে। চিত্রাদেবী ফ্ল্যাটের একজন ভদ্রমহিলার সঙ্গে গল্প করছিলেন, আর, মাঝে মাঝে নজর রাখছিলেন ভুতুকে। কিন্তু সেদিন তিনি বোধহয় গল্পে এমনই মশগুল ছিলেন যে ভুতুর দিকে খেয়াল ছিল না। ফ্ল্যাটের গ্রাউন্ড ফ্লোর এবং আবাসন চত্বরের মাঝে একটা লোহার দরজা থাকে। অন্যসময় সেটা তালাবন্ধ অবস্থায় থাকে। যেহেতু বিভিন্ন ফ্ল্যাটের বাচ্চারা এবং তাদের মা-ঠাকুমারা আবাসন চত্বরেই আছেন, ফলে সেই দরজা খোলাই ছিল, তালা দেওয়া ছিল না। ভুতুর মাথায় সেদিন বোধহয় ভূত চেপেছিল। খেলতে খেলতে ও হঠাৎ সেই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে সোজা লিফটে ঢুকে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বাটন টিপে দিল। বহুবার লিফট ব্যবহার করার সুবাদে ভুতু জেনে গিয়েছিল বোতাম টেপার ব্যাপারটা। এবার লিফট উঠল শুধুমাত্র ভুতুকে নিয়ে যেটা এ পর্যন্ত কোনোদিন হয়নি। এরপর ভুতুর খেলাধূলা শুরু হয়ে গেল লিফটের মধ্যে। সে একবার মজা করে ওপরে উঠছে, আবার নীচে নামছে। দোতলার কিংবা তিনতলার একজন বয়স্ক ভদ্রলোক তাঁর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে হঠাৎ খেয়াল করলেন, লিফটের মধ্যে শুধুমাত্র একজন বাচ্চা, উঠছে নামছে। তিনি দেখেই চিনতে পারলেন, এ তো অলোকের সেই দুষ্টু ছেলেটা। তিনি চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। সেই চেঁচামেচি চিত্রাদেবীর কানে গেল, তিনি হঠাৎ তাকিয়ে দেখেন আবাসন চত্বরে ভুতু নেই ওর বন্ধুদের মধ্যে। লিফটের দিকে তিনি ছুটে গিয়ে দেখেন, লিফট উঠছে নামছে। ভুতু মজা করে তার ভেতরে নাচানাচি করছে আর হাসছে বেশ চেঁচিয়ে। চিত্রাদেবী এবং তাঁর সঙ্গে যাঁরা ছিলেন তাঁরা বেশ দিশেহারা হয়ে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা ওপরে উঠছেন, আবার নামছেন, আর, ভুতুকে চেঁচিয়ে থামতে বলছেন বাইরে থেকে। কিন্তু ভুতুর ঠিকমত নাগাল পাচ্ছেন না তাঁরা। এইভাবে চলল কিছুক্ষণ। একসময় লিফট থামল ওপরে কোনো এক তলায়। চিত্রাদেবী এবং তাঁর সঙ্গের দুএকজন সিঁড়ি ভেঙে চারতলায় গিয়ে দেখেন, ভুতু লিফটের বাইরে খোলা একটা জায়গায় মহানন্দে জোড়া পায়ে নেচেই চলেছে আর হাসছে। চিত্রাদেবী তো ভয়ঙ্কর রেগেমেগে ভুতুকে বকাবকি শুরু করে দিলেন, কিছু চড়-চাপড় এসেও পড়ল ভুতুর ওপর। শুরু হল  ভুতুর কান্না।       

যথারীতি নিয়মমাফিক ভুতুকে জলের বোতল ধরিয়ে দেওয়া হল, ওকে বোঝানো চলল, আজ সাংঘাতিক কিছু একটা হতে পারত। চিত্রাদেবী বোঝাতে লাগলেন ভুতুকে। একটা সময়  বেশ সুন্দর হেসে চিত্রাদেবী ভুতুকে বললেন, 
‘আর এরকম কাজ কোনোদিন করবে না তো?’
বোতলে মুখ দিয়ে ভুতু জল খাচ্ছিল তখন। ঠাকুমার কথার উত্তরে সে বোতল থেকে মুখ না সরিয়ে মুচকি হেসে শুধু বলল,
‘উঁ?’




অজানার পথে
বিশ্বনাথ চৌধুরী

ঘরে বসে আর থেকোনা আকাশটাকে দেখো
হৈ হৈ করে বেরিয়ে এসো নতুন কিছু শেখো।

মন যা চায় তাই কর বহু দূরে চলে যাও
পিছনের কথা না যদি ভাব দেখবে কত কি পাও।

আকাশটা যে এত নীল দেখেছ কি এর আগে?
নতুন করে সূর্যটা যেন সবার মাঝে জাগে।

মাঠেতে শিশুরা খেলা করে দেখ কত মজা ক'রে
এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে শরীরটাকে গড়ে।

শহরের এই কোলাহল থেকে পালাও যদি তুমি
নতুন করে ভালো লেগে যাবে এই জন্মভূমি।

মুক্ত আকাশ, মুক্ত বাতাস, মিষ্টি পাখির ডাক
আনন্দটা আনুক ফিরে দুঃখটা চলে যাক।



ধারাবাহিক ভ্রমণ
সান্টাক্লসের আপন দেশে
মলয় সরকার
শেষ পর্ব

আমরা উঠে তৈরী হয়ে বেরোতে একটু বেলা হল। কিন্তু যেতে যেতে দেখি লোকবসতি সত্যিই কম এখানে। দিগন্ত পর্যন্ত ফাঁকা  রাস্তা চলেছে মাটির বুক চিরে। পাশে অল্প ঝোপ ঝাড় , কোথাও ছোট বয়ে চলা কোন নাম না জানা নদী। হঠাৎ দেখলাম বিশাল মোটা পাইপ লাইন চলেছে রাস্তার পাশে পাশে । ছেলে বুঝিয়ে দিল , এই সেই পৃথিবী বিখ্যাত তেলের পাইপ লাইন, যার নাম ট্রান্স আলাস্কা পাইপ লাইন। এর পাইপগুলোর ব্যাস চার ফুট, আর চলেছে প্রায় ১২৮৭ কিমি ধরে। বয়ে নিয়ে চলেছে ক্রুড পেট্রোলিয়াম বা খনিজ তেল। যার থেকে তৈরী হবে বহু কিছু দামী জিনিস। আর সেই জন্যেই এর আর এক নাম ’তরল সোনা’।আমেরিকার এই দেশটা রাশিয়ার থেকে কিনে নেওয়ার এটাও  একটা কারণ ছিল, এই তেলের খনির দখল নেওয়া। বেশিদিন হয় নি এটা, মাত্র ১৯৭৫-১৯৭৭ এ এটি তৈরী হয়। বললাম ছেলেকে, একবার নেমে ছুঁয়ে দেখে আসি এমন জিনিস।

নামলাম, কাছে গিয়ে দেখি, বেশ কয়েকটি জংলী খরগোশ , গায়ের রংটি ধূসর মত , খেলা করছে পাইপের নীচে। আমরা কাছে যেতেই, চমকে উঠে দৌড়ে পালাল, এই সব অহেতুক অবাঞ্ছিত লোকেদের জন্য। সত্যিই তো ওদের শান্তির রাজ্যে আমরা তো হঠাৎ মূর্তিমান এক উৎপাত।এই তেল কোন ক্রমে লিক করলে ঘটে যেতে পারে ভীষণ বিপর্যয়। তাই এর জন্য ভীষণ সতর্কতা নেওয়া হয়। এ ছাড়াও এর নানা রকম সতর্কতা আছে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শান্তমনে একটি পাহাড়ী গ্রাম্য মেয়ের মত একটি  ছোট্ট নদী। ধারে ধারে ফুটে রয়েছে অসংখ্য জংলী ফুল ।আমরা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে চারিদিকের দৃশ্য উপভোগ 
করে, আবার চললাম এগিয়ে। 
কিছু দূর যেতেই রাস্তায় চিহ্ন দেওয়া রয়েছে, আগে যাওয়া নিষেধ। এ কি রে বাবা! হঠাৎ এ বিপত্তি কেন? 
একটি পুলিশকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল আসল ব্যাপারটা। 
শুনলাম, আগে জঙ্গলে দাবানল লেগেছে। তোমরা কি জান ‘দাবানল’ ব্যাপারটা কি? 

যারা জানো, খুব ভাল কথা। যারা জান না তাদের জন্য বলি। এখানে এবং আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায়, অনেক ফাঁকা যায়গা আছে। ফলে জঙ্গলও আছে অনেক। আর তাতে আছে প্রচুর নানা ধরণের গাছ। তার ফলে পড়ে গাছের অনেক শুকনো পাতা। এছাড়া অনেক মরা শুকনো গাছও থাকে। এবার যখন, বিশেষ করে গরমের সময়, গাছে গাছে ঘষা লেগেই হোক, বা অন্য কোন কারণেই হোক, জঙ্গলে লাগে আগুন।
সেই আগুন শুকনো গাছ , ডালপালা, পাতা পেয়ে জ্বলে ওঠে তীব্র বেগে। তখন তাতে লাগে হাওয়া ।ফলে জঙ্গলে সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। এত আগুন নেভানোর মত মানুষের হাতে কিছুই থাকে না। পুড়ে শেষ হয়ে যায় বিস্তৃত জঙ্গলের বহুদূর পর্যন্ত। মারা যায় অনেক পশুপাখী। আগুন জ্বলতে থাকে অনেক দিন ধরে। বাতাসে মাইলের পর মাইল ভেসে যায় গাছ পাতা পোড়া ছাইএর অংশ। জঙ্গলের কাছে বাস করা মানুষও অনেক সময় মারা যায় । তাদের ঘরবাড়ী সমস্ত ছাই হয়ে যায়। যতক্ষণ না সে আগুন নিজে থাকে নেভে ততক্ষণ মানুষের প্রায় কিছু করার থাকে না। আর এই জঙ্গলগুলোর মধ্যে দিয়েই চলেছে বহু  রাস্তা। তাই সেই আগুনে জ্বলতে থাকা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তখন সমস্ত গাড়ীঘোড়ার চলাচল বন্ধ থাকে।

আমরা তখন বাধ্য হয়ে অন্য রাস্তা নিলাম।এবার গিয়ে হাজির হলাম এমন একটি জায়গায়, যা আমার অনেকদিনের স্বপ্ন। তা সার্থক হবে ভাবি নি। 

সামনেই দেখি দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই স্বপ্ন বিশাল এক মাথায় টুপি দিয়ে। সান্টা ক্লস। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে, সান্টা দাঁড়িয়ে আছে। এখানে যে মূর্তিটা আছে সেটি কিন্তু স্লেজগাড়ী চাপা বা পিঠে উপহারের ঝুলি নিয়ে নয়। এটি সান্টার দাঁড়ানো মূর্তি, দু’ হাতে কালো গ্লাভস পরা। মূর্তিটি আছে একটি তার দিয়ে ঘেরা সবুজ মাঠের মধ্যে। তার গায়ে হাত দেওয়া যায় না। একটু দূর থেকে দেখতে হয়। সান্টা এক হাতে ধরে আছে লম্বা একটা চিঠি আর সেই চিঠি পড়ছে সান্টা। তার অবশ্য একটা কারণ আছে। 


কারণটা বলি। তোমাদের মত যে সমস্ত ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সান্টার খুব ভক্ত, তারা তো তাকে খুব ভালবাসে। তাই তারা চিঠি লেখে, সান্টাকে। আর সারা পৃথিবীর যত ছোটদের লেখা চিঠি জমা হয় এসে এখানে সান্টার হাতে। তাকে সেগুলো খুলে পড়তে হয়। তাই এরকম ছবি। তোমরা হয়ত ভাবছ, এরকম আবার হয় না কি? সান্টাকে কি চিঠি লেখা যায় ? হ্যাঁ যায়।সত্যি বলছি। চিঠি যখন লেখা যায়, তার তো একটা ঠিকানা থাকতে হবে। নিশ্চয়ই আছে ঠিকানা। দিচ্ছি তোমাদের। তোমরাও চেষ্টা করে দেখতে পার  
কি হয়। আমি অবশ্য কখনও লিখি নি। তোমরা লিখে আমাকে জানাতে পারো। 
তার ঠিকানা হচ্ছে,
101, St. Nicholas Drive, North Pole AK 99705 (এটি ইংরাজীতে দিলাম, কারণ যারা সে চিঠি নিয়ে যাবে, তারা তো আর বাংলা পড়তে পারে না। কাজেই তাদের জন্য ঠিকানাটা ইংরাজীতেই দিলে ভাল)। তবে এখন আমেরিকান পোষ্টাল ডিপার্টমেন্ট বলেন, তাড়াতাড়ি চিঠি পৌঁছাতে গেলে, এই ঠিকানায় লিখলে ভাল। তা হল, 123 Elf Road , North Pole, 88888। অবশ্য অনেকে শুধু সান্টার নাম লিখে ছেড়ে দেয়। 
তবে বাস্তবে আমেরিকার পোষ্ট অফিসও এই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামায়। ১৯১২ সাল থেকে, পোষ্ট অফিসের কর্তাব্যক্তিরাও সত্যি সত্যি এই সব চিঠিগুলো নিয়ে ,সান্টার হয়ে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে ।তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা সান্টার অফিস আছে। অনেকে আবার সান্টার কাছে নানা জিনিস চায়। সেগুলো অনেক সময় পূরণ করার চেষ্টাও হয়।

এই জায়গাটি আমি যে এয়ারপোর্টে নেমেছিলাম, সেই এয়ারপোর্ট , অর্থাৎ ফেয়ারব্যাঙ্কস থেকে কাছেই। মাত্র ২০ কিমি দূরে। এখানে সান্টার মাথায় যে টুপি আছে, সেটা কিন্তু মোটেই , তোমরা যেমন দেখে অভ্যস্ত তেমন নয়। এটি একটু ‘ক্যাপ’ ধরণের। এই মূর্তিটা ৫০ ফুট উঁচু। বলা হয় এটি নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু সান্টার মূর্তি। এখানে সান্টার ঘর বলে যেটি বলা হয়, সেটি আসলে একটি ছোট পোষ্ট অফিসকে বাড়িয়ে সঙ্গে একটি বড় দোকান করা হয়েছে।যেটিতে বড়দিনে হরেক রকমের উপহার পাওয়া যায় । নানা ধরণের কেক, চকোলেট, রঙীন কার্ড, ফুল, সাজানোর জিনিস, ক্রীসমাস ট্রী ইত্যাদি নানা রকমের চোখ ধাঁধানো জিনিসপত্র। এটি খোলা থাকে সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত, রোজ সারাবছর, কেবল বিশেষ কয়েকটি দিন ছাড়া । তবে বিশেষ কারণ থাকলে আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় , কবে কবে বন্ধ থাকবে । 
সান্টার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নাম আছে, কোথাও তার নাম সেন্ট নিকোলাস(St. Nicholas), কোথাও সেন্ট নিক( St. Nick), বা ক্রিস ক্রিঙ্গল ( Kris Kringle), বা পেলজনিকেল (Pelznickel) 

সান্টার ঘরটি একটি বিশেষ ধরণের । এর দেওয়ালের রংটি ধবধবে সাদা, শুধু মাঝে কিছু লাল দাগ ছাড়া। এর গায়ে আঁকা আছে বেশ কিছু ম্যুরাল ছবি। 
এটি একটি  হাইওয়ের ধারে। যারা আলাস্কা ঘুরতে আসে তাদের কাছে এটি অবশ্য দ্রষ্টব্য।আমি আশা করব তোমরাও নিজের চোখে একবার সান্টাকে দেখে আসবে।
এখানে আছে আরও বহু দেখার জিনিস। আমরা পা বাড়ালাম পরের জায়গার উদ্দেশ্যে।
(শেষ)

আবার যদি পেতাম
 ফিরে সেই ছোটবেলা

ভানুপ্রিয়া মাহাত
নবম শ্রেণী
জওহর নবোদয় বিদ্যালয়
পশ্চিম মেদিনীপুর


আবার যদি পেতাম ফিরে 
সেই ছোটবেলা, 
আবার আমি খুব খেলতাম 
সারা দুপুরবেলা ।

মা আমায় ডাকতে যেত 
আবার কুলতলা ,
বলত ডেকে আয় খাবি আয়  
পরে খেলবি মেলা ।

বাবার সঙ্গে এক থালাতে 
একি খাবার খাওয়া , 
আবার যদি পেতাম ফিরে 
সেই ছোটবেলা ।

দাদুর কাছে রোজ রাত্রে 
নানান গল্প শুনে , 
মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ি 
তারা গুনে গুনে । 

পুকুর পাড়ের মাটি দিয়ে 
পুতুল গড়ার খেলা , 
আবার যদি পেতাম ফিরে 
সেই ছোটবেলা ।। 


স্মরণীয়
(প্রশান্ত চন্দ্র মহালনবিশ)
কলমে - পীযূষ প্রতিহার


১৮৯৩ সালের ২৯ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ। তাঁর পিতা ছিলেন প্রবোধ চন্দ্র মহলানবিশ ও মাতা নিরদবাসিনী দেবী। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বড়। প্রবোধ চন্দ্রের পিতা অর্থাৎ প্রশান্ত চন্দ্রের ঠাকুরদা ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের একজন পুরোধা। 

    প্রশান্ত চন্দ্রের প্রাথমিক পড়াশোনা ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলে। পরবর্তী কালে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে পদার্থ বিদ্যায় অনার্স সহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ১৯১২ সালে। এখানে তিনি আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন। মেঘনাদ সাহা ও সুভাষ চন্দ্র বসুর মতো ছাত্ররা ছিলেন তাঁর জুনিয়র। ১৯১৩ সালে পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ড যান এবং কিংস কলেজ, কেমব্রিজ থেকে পদার্থ বিজ্ঞানের ট্রাইপস(Tripos) পাস করেন। তারপর অল্প কিছুদিনের জন্য ভারতে আসেন এবং আবার ইংল্যান্ড ফিরে যান। এই সময় তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত 'বায়োমেট্রিকা' নামের একটি জার্নালে তাত্ত্বিক পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ খুঁজে পান এবং বিষয়টির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি মুগ্ধ হন এবং আবহাওয়া ও নৃবিজ্ঞানের সমস্যা গুলো বোঝার ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানের উপযোগিতা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেন। ১৯২২ সালে আবার ভারতে ফিরে আসেন ও প্রেসিডেন্সী কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি তিনি পরিসংখ্যান নিয়েও নিয়মিত কাজ করে গেছেন। প্রথমদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফলাফল, কলকাতার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের বিষয়ে নৃতাত্ত্বিক পরিমাপ এবং আবহাওয়া বিশ্লেষণের কাজ করেছিলেন। ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের মতো শিক্ষাবিদ তাঁকে এবিষয়ে উৎসাহ ও পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাঁর অনেক সহকর্মী পরিসংখ্যান নিয়ে পড়াশোনা করতে চাইলে প্রেসিডেন্সী কলেজে নিজের ঘরেই একটি পরিসংখ্যান পরীক্ষাগার স্থাপন করেন। ১৯৩১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর বরানগরে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট স্থাপন করেন, যেটি ১৯৩২ সালে রেজিস্ট্রেশন লাভ করে। তিনি বড় আকারের নমুনা জরিপ(Large scale sample survey) বিষয়ে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছিলেন। পাইলট জরিপের ধারণাটিও প্রশান্ত চন্দ্রেরই। ১৯৩৭-৪৪ সাল পর্যন্ত চা-পানের অভ্যাস, জনমত সমীক্ষা, ফসল এবং উদ্ভিদের রোগের মতো বিষয়গুলো নিয়ে সার্ভে করেছিলেন। পরিসংখ্যান বিষয়ে তাঁর প্রধান অবদান ছিল 'মহলানবিশ ডিস্ট্যান্স'(Mahalanobis distance) নামের একটি নতুন তত্ত্ব। প্রশান্ত চন্দ্রের মূল লক্ষ্য ছিল পরিসংখ্যানকে কাজে লাগিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত জনজীবন। নৃতত্ত্ব, ভাষা চর্চা, প্ল্যানিং, কৃষি, জাতীয় আয়, তথ্য প্রযুক্তি, কোয়ালিটি কন্ট্রোল, সমাজবিদ্যা, জেনেটিক্স,  নদী পরিকল্পনা, আবহাওয়া, উত্তরবঙ্গ ও উড়িষ্যার বন্যা নিয়েও গবেষণা করেছিলেন তিনি। তিনি কিছুদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেছিলেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন কাজ করেছিলেন তিনি। ১৯৩৮ সালে ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো রাশিবিজ্ঞানের কনফারেন্স আয়োজন করে বিজ্ঞান চেতনা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৫০ সালে ভারতে প্রথম ডিজিট্যাল কম্পিউটার আনবার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। 

    ১৯৪৭-৫১ সাল পর্যন্ত তিনি জাতিসংঘের সাব-কমিশনের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৫০ সালে তিনি জাতীয় নমুনা সমীক্ষা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং পরিসংখ্যান মূলক কাজকর্মের জন্য কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান সংস্থা গঠন করেছিলেন তিনি। ১৯৫৫ সালে তিনি ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হন। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ভারতে ভারি শিল্প বিকাশের জন্য যে কৌশল রচনা করেছিলেন তাতে শিল্পক্ষেত্রে উন্নয়ন তরান্বিত হয়েছিল। 

    ১৯৪৪ সালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওয়েলডেন মেমোরিয়াল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে দেবীপ্রসাদ সর্বাধিকারী স্বর্ণপদক ও ১৯৬৮ সালে শ্রীনিবাস রামানুজন স্ফর্ণপদক পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালে তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ দিয়ে সম্মানিত করে ভারত সরকার। আমৃত্যু তিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট এর সেক্রেটারি ও ডিরেক্টর। 
    ২৮ জুন ১৯৭২ এই মহান পরিসংখ্যানবিদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।


পাঠ প্রতিক্রিয়া
(ছোটোবেলা ৮৬ পড়ে দোলনচাঁপা তিওয়ারী যা লিখলেন) 

জ্বলদর্চি ছোটবেলা ৮৬ পাঠ-প্রতিক্রিয়া দেওয়ার আহ্বান জানানোর জন্য সম্পাদক মহাশয়া মৌসুমী দি কে (মৌসুমী ঘোষ ) আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

পত্রিকাটি পড়তে গিয়ে প্রথমেই চোখে পড়ে নিলাব্জ ঘোষের  তোলা ফটোগ্রাফিটি কি সুন্দর একটি নিখুঁত ফটোগ্রাফি।দুটি ফুল কেন দু দিকে মুখ করে আছে তা মৌসুমী দি সম্পাদকীয়তেই বলে দিয়েছেন ,খুব সুন্দর বিশ্লেষণ ওনার।
শুধু বিশ্ব পরিবেশ দিবসে কেন আমাদের প্রত্যেকটা দিনই প্রকৃতির  তথা পরিবেশের জন্য হওয়া উচিত। গাছ লাগানোর মাধ্যমে আমরা প্রকৃতির অনেকটা ক্ষত সারাতে পারি।

তারপর  দেখি একটি সুন্দর ধারাবাহিক  উপন্যাস তৃষ্ণা বসাকের লেখা "জয়াবতীর জয়যাত্রা" সেখানে ঠাম্মা কিভাবে ঘোড়ায় চড়তো আর বিয়ের পর তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।

তারপরেই অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র প্রিশ মিশ্র নজরুলের একটি সুন্দর ছবি এঁকেছে।
বোন  অনামিকা তেওয়ারী "নজরুলের প্রতি" কবিতাটি অসম্ভব সুন্দর লেখেছে। কি সুন্দর লাইন-"বিশ্ববীণায় বন্দিত হোক তোমার সকল  কর্ম"
সুদর্শন নন্দীর লেখা  "মীর দারোগায় বোধোদয়" একটি সুন্দর ভালোবাসা মিশ্রিত হাসির গল্প।
তারপর তো লেখক মলয় সরকারের হাত ধরে চলে গেলাম একেবারে সান্টা-ক্লজের দেশে, সেখানে রাত্রিকে দিন বলে ভ্রম হয়, কারণ সেখানে কখনো রাত হয়না।
গুরুসদয় দত্ত ব্রতচারী আন্দোলন সম্পর্কে অনেক কিছু তথ্য দিয়েছেন, যা আমাদের সৎ মানুষ ও দেশ প্রেমিক হতে শেখায়।

এবারের স্মরণীয় কলমে পীযূষ প্রতিহার মহাশয় সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে অনেক কিছু জানিয়েছেন তাঁর লেখা বাংলা ও ইংরেজি গ্রন্থ সম্পর্কেও আমাদের জানান। শুধু তাই নয় সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যে নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন এই তথ্যটি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।

পরিশেষে বলা যায় সম্পাদক মহাশয়ার (মৌসুমী ঘোষ) নিরলস প্রচেষ্টায় ছোটদের এই পত্রিকাটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নেবে।

আরও পড়ুন 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments