অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান
দিলীপ মহান্তী
১৩.
অশোক মহান্তীর ‘কুমারী গর্ভ’ কবিতায় আমরা মহাভারতের সেইসব নারীদের পাচ্ছি যাঁরা অপমানিত হয়েছেন, বঞ্চিত হয়েছেন আবার প্রতিবাদে জ্বলে উঠেছেন। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর এঁরা রুখে দাঁড়িয়েছেন। এই গর্জে ওঠাকে কবিতায় স্বাগত জানানো হয়েছে। তাঁরা বুঝতে পেরেছেন তাঁরা অন্তেবাসী। একালের ভাষায় অপর। তাঁদের ওপর সমাজের আধিপত্যবাদীরা যাবতীয় বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেন। তাঁরা বুঝতে পারেন শোষণ-পীড়নের এই কৌশল। মহাভারতের সেইসব নারীদের পাশে এনে বসিয়েছেন একালের এক প্রান্তিক নারীকে। যার ফলে কবিতাটি অন্য মাত্রা পেয়েছে। নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়েছে। প্রথমে আসি দ্রৌপদীর কথায়। নারীকে সম্পদ ভেবেই তো যুধিষ্ঠির পাশাখেলায় দ্রৌপদীকে বাজি রেখেছিলেন। আর সেই সম্পদকে অধিকার করতে চেয়েছিলেন দুর্যোধন। সমাজে নারীর স্থান, ধর্ম ও স্বাধীনতা নিয়ে মহাভারতে অনেক কথা আছে।
মহাভারতে আছে স্বামীর শুশ্রূষাই নারীর ধর্ম আর এই ধর্ম পালন করলেই তার স্বর্গলাভ হবে। মনুও বলেছেন- স্বামী দুশ্চরিত্র, কামুক, গুণহীন হলেও স্বাধ্বী স্ত্রী তাঁকে দেবজ্ঞানে সেবা করবেন । আরও বলেছেন নারীকে দিনরাত পরাধীন রাখবে পুরুষ। মহাভারতেও আছে নারী কোনো দিনও স্বাধীনতা পাওয়ার যোগ্য নয়। সে বালিকা বয়সে বাবার অধীনে থাকবে, যৌবনে থাকবে স্বামীর অধীনে আর বার্ধক্যে থাকবে পুত্রের অধীনে।
দ্রৌপদী যখন প্রাতিকামীর মুখে শুনলেন পাশা খেলায় যুধিষ্ঠির তাঁকে পণ রেখেছিলেন এবং তিনি হেরে গেছেন আর দুর্যোধন তাঁকে সভাতে ডেকেছেন। সেজন্যই তিনি দ্রৌপদীকে নিয়ে যেতে এসেছেন। তখন দ্রৌপদী যে কথা জিগ্যেস করলেন তা যেমন মহাভারতে গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সমাজে নারীর স্থান, তার অধিকার, তার প্রতিবাদ ইত্যাদি দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। দ্রৌপদী বললেন:
‘যাহ প্রাতিকামী, গিয়া জিজ্ঞাস রাজারে।
প্রথমে আপনা কিম্বা হারিলেন মোরে।।
হারিয়া থাকেন যদি প্রথমে আপনা।
তবে গিয়া জিজ্ঞাসিহ সভাসদজনা।।‘
এই প্রথম দ্রৌপদী পুরুষসমাজকে প্রশ্ন করছেন। এর আগে সবকিছু মেনে নিয়েছেন। পুরুষদের হাতে ব্যবহৃত হয়েছেন। সেদিনের সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সবকিছু মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। আজ তিনি জানতে চান কোন অধিকারে যুধিষ্ঠির তাঁকে বাজি রেখেছেন। এ প্রশ্ন দ্রৌপদীর একার নয়, পৃথিবীর সনস্ত নারীর হয়ে তিনি প্রশ্ন করছেন পুরুষতন্ত্রকে, পুরুষ সমাজকে। এখানে নারী পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হল। দ্রৌপদীর এই প্রশ্নের উত্তর সেদিনের হস্তিনাপুরীর কৌরবদের ভরা সভায় ছিল না। বড় বড় রথী মহারথী জ্ঞানীগুণীজন বয়োজ্যেষ্ঠরা যখন একেবারে চুপ তখন শুধু একজন পুরুষ প্রতিবাদ করলেন। তিনি বিকর্ণ:
‘আগে নরপতি আপনাকে হারিয়াছে।
কৃষ্ণার উপর তার কি প্রভুত্ব আছে।।
বিশেষে সমান কৃষ্ণা এ-পঞ্চজনার।
একা ধর্ম্মনৃপতির নাহি অধিকার।।’
দ্রৌপদীর গহন গোপন মনের খবর অশোক মহান্তী অন্য একটি কবিতায় তুলে ধরেছেন। যেখানে নারী স্বাধীনতার এক দিগন্ত রচিত হয়েছে। দ্রৌপদীর প্রেমিকা হৃদয়ের গোপন অন্তঃপুরের কথা যেমন আছে তেমনি তাঁর তেজস্বিনী রূপটিও জ্বলে উঠেছে:
‘যুদ্ধের আমি যতটুকু জানি, যুদ্ধ হয়েছে প্রাণে
কুরুক্ষেত্র মাঠ শুধু নয়, কুরুক্ষেত্র মানে
নারীর শরীর-ইতরতা-লোভ-কবিতালেখার কালি
ভাঙা হাড়, ভাঙা অস্ত্রের গুঁড়ো, মাঠময় চতুরালি
নারীর শরীর- পুরুষের লোভ- প্রাসাদ- হর্ম্যচূড়া
সিংহাসনের নিচে, আরো নিচে, যেখানে খড়ের নুড়া
দিনরাত জ্বলে শরীরে শরীর, রক্তে কণিকাময়
এক শরীরের ভেতরে শরীর, শরীরের মহাভয়
দম্ভ-দন্ড মানুষী-মুন্ড কোদন্ড টংকার
বিজয়ীর হাসি, বিজিতের ক্ষোভ, অনাবৃত অনুদার
জ্যা-এর মুক্তি, কালোযুক্তির সীমা নেই, সেইখানে
কুরুক্ষেত্র বুকে বসে থাকে, কুরুক্ষেত্র টানে
আমি কর্ণের মানসী কিম্বা কৃষ্ণের সহচরী
সেটা কথা নয়, আসল কথা যা, তা হলো আমিও নারী
আমার ভেতরে আদিম জলজ, প্রাণের প্রবহমান
সুখে-দুঃখে আছি পুরুষের পাশে, তবু রূঢ় ব্যবধান
আমাকে ডেকেছে পুরুষের চোখ, আদিম-কামনা যত
আমাকে ডেকেছে স্বেচ্ছাচারের ভেতরে মর্মাহত
আমাকে ডেকেছে কূট-বিনিময়, দাসপ্রথা বরাবর
আমাকে দাবার ঘুঁটি বানিয়েছে আমারই স্বয়ম্বর
হাজার শুশুক চোখ মেলেছিল, যবে আমি বিবসনা
এমনকি সেই অন্ধরাজারও চোখ ফোটে ষোল আনা
আমাকে বাড়তি ছুঁতে চেয়েছিল অমোঘ দুঃশাসন
সেই থেকে এই মৃত্যুযুদ্ধ, সামাজিক মহারণ
কর্ণ, তোমাকে ভালোবাসি, তবু, ভালোবাসা মানে ঘৃণা
তোমার পুরুষ-হৃদয়ে কখনো বাজেনি সপ্তবীণা
একটি মাত্র মৃত্যু আমাকে করে গেছে অপরাধী
কর্ণ, সে তুমি বুঝবে না আর, কেন আমি আজও কাঁদি
পার্থ, পার্থ, তুমি অনর্থ, ভীরু ও নপুংসক
স্ত্রী-র সম্মান বাঁচাতে পারোনি, এতবড় প্রতারক
জ্যা-মুক্ত তীর ভেদ করেছিলে,যখনই পাপের চোখ
তুমি কি দ্যাখোনি, সে-রক্তে লেখা মহাভারতের শ্লোক
আমার এ-যুদ্ধে কোনো দায় নেই, ভারতবর্ষ জনে
যে বোঝে না সেও ভালো করে বোঝে লক্ষভেদের মানে’
( কৃষ্ণা: ঘাস রঙয়ের আকাশ )
‘কুমারী গর্ভ’ কবিতায় শকুন্তলার প্রসঙ্গও এসেছে। তাঁর প্রতিও কম অন্যায় হয়নি। শেষ পর্যন্ত শকুন্তলার প্রতিবাদী ও বিদ্রোহিনী রূপটি চাপা থাকে না। শকুন্তলা দুষ্মন্তকে বলছেন:
‘আমার দেখহ শক্তি আপন নয়নে।
এখনি যাইতে পারি যথা ইচ্ছা মনে।।
কুরূপ মনুষ্য রাজা নিন্দে সর্বলোকে।
যতক্ষণ দর্পণেতে মুখ নাহি দেখে।।
হেন মিথ্যাবাদী তুমি হইলে নিশ্চয়।
তোমার নিকটে থাকা উচিত না হয়।।’
এক শক্তিশালী রাজাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা শকুন্তলার ছিল। তাঁকে মিথ্যাবাদী বলার ক্ষমতা দেখিয়েছেন এবং মিথ্যা কথা বলার জন্য তাঁকে সহস্রবছর নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে একথাও বলেছেন। দুষ্মন্তের সমস্ত ঐশ্বর্য, সম্মান, প্রতিপত্তি, বীরত্বকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে জ্বলে উঠলেন নিজস্ব চারিত্রিক বিভায়। এই প্রতিবাদী রূপ সে যুগে বিরল।
গান্ধারীর মধ্যেও এই প্রতিবাদ আছে। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে যখন বাবা-মা বিয়ে ঠিক করলেন তখন থেকেই গান্ধারী কাপড়ে চোখ বাঁধলেন। এই ঘটনার মধ্যেই নিহিত আছে অভিমান থেকে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ। তিনিও ধর্মের জয় চেয়েছিলেন। দুর্যোধন যখন গান্ধারীর কাছে যুদ্ধ জয়ের জন্য আশীর্বাদ নিতে গিয়েছিলেন তখন গান্ধারী বলেছিলেন-যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ। সেই গান্ধারী যখন জানলেন পাণ্ডবরা অনেক অধর্মের যুদ্ধে কৌরবদের অনেক বীরকে হত্যা করে জয়লাভ করেছেন আর এর মূল চক্রী শ্রীকৃষ্ণ, তখন তিনি শ্রীকৃষ্ণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন:
‘ওহে কৃষ্ণ জনার্দ্দন দৈবকী-কুমার।
তোমা হতে হৈল মোর বংশের সংহার।।
অনর্থের মূল তুমি দেব নারায়ণ।
কর্ম্মভোগ বলি কর দোষ বিদূরণ।।
শুন কৃষ্ণ, আজি শাপ দিব হে তোমারে।
তবে পুত্রশোক মোর ঘুচিবে অন্তরে।।
অলঙ্ঘ্য আমার বাক্য, না হবে লঙ্ঘন।
জ্ঞাতিগণ তব কৃষ্ণ হইবে নিধন।।
পুত্রগণ-শোকে আমি যত পাই তাপ।
এরূপ যন্ত্রণা পাবে,দিনু অভিশাপ।।
মোর বধূ যেই-মত করিছে ক্রন্দন।
এই মত কান্দিবেক তব বধূগণ।।
তুমি যেন ভেদ কৈলে কুরু-পাণ্ডবেতে।
যদুবংশ তথা হবে, আমার শাপেতে।।
কৌরবের বংশ হৈল যেমন সংহার।
শুন কৃষ্ণ, এই মত হইবে তোমার।।‘
এই অভিশাপে একদিক যেমন আছে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহী মানসিকতা তেমনি আছে আ্ত্মবিশ্বাস ও তেজ। নারী শুধু অন্তঃপুরে থাকার সামগ্রী নয়, পুরুষের চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে জানে তার ভুল ও অন্যায় মনে করিয়ে দিতে জানে। নিজের অধিকার বুঝে নিতে জানে। ‘কুমারী গর্ভ’ কবিতায় নারীর এই ভাষা ফুটে উঠেছে।
'আবহ সকাল' থেকে শুরু করে '৪৮ বছরের স্বীকারোক্তি' পর্যন্ত কবিতা গ্রন্থে এবং সারা রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা অজস্র ছোটো পত্রিকায় তিনি বহু প্রথম শ্রেণীর প্রেমের কবিতা লিখেছেন। সব উল্লেখ করা সম্ভব নয়, তবে এই মুহূর্তে কয়েকটি মনে পড়ছে - হিম, মাটি, জড়, প্রেম, সম্পর্ক, পায়েল, ঘ্রাণ, ঘুমহীন, সৌন্দর্য দর্শন, পিপাসা, অনির্মিত, আনন্দ, জন্মভূমি, স্রোতটান, শরীর, দেহ, মৃত্যু সংলাপ প্রভৃতি। তাঁর সম্পাদিত ' মহাকাল' পত্রিকায় লিখেছিলেন ' জলের কবিতা' নামের এক অসামান্য দীর্ঘ প্রেমের কবিতা। কৌতূহলী পাঠকের কবিতাটি পড়া জরুরি।
তাঁর অনেক প্রেমের কবিতা তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে। দীর্ঘ ২২ বছরের মিলিত জীবনে তাঁরা একসঙ্গেই থেকেছেন অধিকাংশ সময়। জীবিকার সূত্রে বৌদিকে দু'তিনবার ট্রেনিংয়ের জন্য বাইরে যেতে হয়েছে। সেই সময় টুকুতে তাঁদের দাম্পত্যের গভীরতা বোঝা যায়। মান, অভিমান, বিরহ,যন্ত্রণা, বেদনা, বিষাদ কখনো বা অবিশ্বাসও ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন মুহূর্তকে কেন্দ্র করে। এক্ষেত্রেও কোনো ব্যতিক্রম না ঘটিয়েই জীবন উঠে আসে কবিতায়। বেশ কিছু কবিতায় সেই ট্রেনিং সেন্টারের অনুষঙ্গ। যেমন, শরীর, রাত্রি বন্দনা, বসন্তের চিঠি, ঘুমহীন, জড়িত আড়াল, দ্বিতীয় সঙ্কেত, নক্ষত্র প্রভৃতি। একটি লেখাতে বৌদি জানাচ্ছেন : অভিমান উনার বেশিক্ষণ থাকে না, একটু ভালোবাসলে শিশুর মতো মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলে তক্ষুনি যেন প্রেমের অবতার। তবে কখনোই আমাকে কাছছাড়া করতে চাইতেন না। আমিও বাপের বাড়ি বা কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়ি সে কারণে কখনোই যেতাম না। আমাদের দুজনের মিলিত ২২বছরের জীবনে হয়তো বাপের বাড়ি গেছি চার থেকে পাঁচ বার। তাও আবার দুজনে একসাথে গেছি মনে হয় দুই থেকে তিন বার। আমি বাপের বাড়ির সবার থেকে বড়দিদি। বাবা অসময়ে দেহ রাখার ফলে ভাই বোনদের প্রতি টানটা আমার একটু বেশিই ছিল। কিন্তু উনি চাইতেন আমার মন প্রাণ যেন উনাতেই মগ্ন থাকে। এটাকে প্রভুত্ব বলে কিনা জানি না এবিষয়ে উনার ডাইরিতে পড়েছি, " স্ত্রীর কাছে সর্ব সমর্পণের প্রত্যাশা যদি প্রভুত্ব হয় তবে সেই প্রভুত্বই পত্নীপ্রেম।" ( এ কোন প্রেমিক, যে ছেড়ে যায় : সাধনা মহান্তী, মনন, ডিসেম্বর ২০০৩)।
‘কবিজায়া’ কবিতায় অশোক মহান্তী লিখেছেন:
‘বিগত কুড়ি বছরে প্রতিদিন তুমি জীবনের পাশে
একজন কবিকে পেয়েছো।
তাঁর চুল-চোখ –চুম্বন এবং ভালোবাসা পেয়েছো।
তুমি বলেছিলে, ‘কবিতা-ছাড়া আর কিছুই চাই না জীবনে’
সে ছিল এক আবেগ-প্লাবিত বসন্তের দিন।
তারপর, গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ ও হেমন্ত কেটে গেছে –
মাঠের ধানগাছগুলি উঠে এসেছে ঘরে,
ঘর থেকে বাইরে যাবার সমস্ত পথটাই এখন
জনশূন্য একা।
ঠিক এমন দিনেই, ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে
তুমি দেখলে – শীতে ঝরে যাচ্ছে বনের পাতা,
হাওয়ায় উড়িয়ে নিচ্ছে পথের ধুলো,
কেউ হাঁক দিয়ে যাচ্ছে, কোথায় যেন অন্তরালে!
কবিতা ডাকছে না!’
বেশ কিছু কবিতায় আত্মদহন লক্ষ্য করার মতো। পুরুষ সমাজের প্রতিনিধি হয়ে তিনি যেন আয়নার সামনে দাঁড়াচ্ছেন। বার বার ক্ষতবিক্ষত হয়ে আগুনের সামনে যাওয়ায় তাঁর চরিত্রের একটি বিশেষ দিককে ফুটিয়ে তুলছে।। নুলো হাত, পঙ্গু হাত, কলুষিত হাত, কালো হাত - ধ্বজা, পাথর পূজা, স্তব্ধতায়, প্রভৃতি কবিতায় উঠে আসছে। কোনো এক কর্মের জন্য অনুশোচনা আছে। গ্লানি আছে। পাপ পুণ্যের কথা, ন্যায় অন্যায়ের কথা উঠে আসার অর্থ তিনি সৎ এবং গভীর ভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাসী।
রবীন্দ্রনাথের অনেক গান - যেমন প্রেম ও পূজা পর্যায়ের অনেক গানকে আলাদা করা যায় না তেমনি অশোক মহান্তীর প্রেম ও মৃত্যু বোধের কবিতা কোথাও কোথাও এক বিন্দুতে মিলে যায়। আলাদা করা খুবই কষ্টের। আমরা বুঝতে পারিনা প্রেমের হাত ধরে আমরা মৃত্যুর কিনারায় পৌঁছে যাই। জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মুহূর্ত ছবি কখন নিজের অজান্তে জীবনের সীমা ছাড়িয়ে অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে যেতে চায়। হয়তো সীমা ছেড়ে অসীমের দিকে। আর এই পুরো কাজটি সম্পন্ন হয় শব্দের অলৌকিক জাদুতে :
' তোমার স্তনের সাদা অংশ থেকে সারারাত ঝরেছে শিশির
আমি হিমে ডুবে গেছি, ডুবে গেছে সমস্ত শরীর
নীল বর্ণমালা। প্রাচীন সমুদ্র থেকে জল
প্রাচীন আগুন থেকে যথেষ্ট উত্তাপ এসে পুড়িয়েছে
স্নায়ুতন্ত্রীশিরা, তারপর সারারাত কেবলই মৃত্যুর দ্রুত পদশব্দ শুনি।
আমাকে জাগিয়ে দিয়ে গেছে কেউ।
কেউ একজন রুক্ষ মরুপ্রান্তরের বুকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
অত্যন্ত গম্ভীর কোনো কথা বলে গেছে।
কী কথা, কে শোনে সেই কথা?
মন্থর বাতাসে গান, হাওয়ায় হাওয়ায় কাঁপে
সুধাময় ঝাউয়ের মঞ্জরী, শালবন, মহানিম থেকে ঝরে
হলুদ পাতারা সারে সার।
ঝরাপাতা দু'পায়ে মাড়িয়ে পার হই
উলঙ্গ মাঠের কাছে সন্ধ্যা থামে, রাত্রি ও প্রভাত থামে
থেমে যায় হৃদয় স্পন্দন আমাদের।
অনেক দূরের বন, অনেক দূরের নদী, অনেক দূরের যে আকাশ, সেইখানে
ক্রমাগত বর্ষা নামে। বর্ষা এসে ডুবিয়েছে মানুষের শিল্পকলা
প্রাণীর মস্তক, আর সব চূড়াও গম্বুজ, যারা এতকাল স্থির হয়েছিলো।
আমি ডুবিনি বর্ষায়, আমি আগুনে পুড়িনি, শুধু হিমে
জড়াতে জড়াতে এক অপার রহস্যে ভেসে গেছি।
(হিম : অতিবর্তী জাগো)
অনেক নারীর সংস্পর্শে আসার কালে তাঁর সহানুভূতিশীল নরম ভেজা মনের স্পর্শ পাই। তিনি অনুভব করেন সেইসব নারী হৃদয়ের বজ্রগর্ভ মেঘকে। তাঁর হৃদয়ের এক শুভবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। যা থেকে তাঁর উপলব্ধির জগৎটি বলিষ্ঠ হয়েছে। নারীবাদের এক বিশেষ হাওয়া বয় কবিতায়। তাই ইতিহাস থেকে উঠে আসা চরিত্র জাহানারার কথা তিনি সম সময়ের প্রেক্ষিতে বিনির্মাণ করেন :
' রাজধানী থেকে দূরে, আগ্রায়, পাথর ভাঙছে, যেসব
ক্রীতদাস
বহুবর্ষকাল তাদের বিছানার পাশে কোনো নারী নেই,
তাদের উৎসবে, ব্যসনে, শ্রমক্ষেত্রে, এমনকি বিশ্রামের ভেতরেও
কোনো নারী নেই,
যেমন, তোমার শয়নকক্ষে খোজা- ছাড়া আর কোনো পুরুষ দেখনি তুমি
কোনদিন। '
( জাহানারা : ঘাস রঙয়ের আকাশ)
ভাবেন কাদম্বরী দেবীর কথা। যে কাদম্বরী দেবী না থাকলে হয়তো এই রবীন্দ্রনাথকে আমরা পেতাম না। সোজা কথায় তিনি বলেন :
' তোমার মতো বৌদি ঘরে থাকলে, আমরাও
রবীন্দ্রনাথ হতে পারতাম।
আমরা যে অনেকেই রবীন্দ্রনাথ হতে পারিনি, তার কারণ
আমাদের ঘরে মহর্ষির মতো পিতা নেই,
তোমার মতো বৌদি নেই,
তা নাহলে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির চেয়ে
ঢের ভালো আমাদের রোঁয়া- ওঠা গ্রাম।'
( কাদম্বরী দেবী : ঘাস রঙয়ের আকাশ)
তাঁর উপলব্ধির জগৎ থেকে উঠে আসে এমন আশ্চর্য কবিতাও। যেখানে ফুটে ওঠে সনাতন বাংলা। যে কবিতা আমাদের শেকড় ধরে নাড়া দেয়:
‘যে-মেয়ে চুলের বিজ্ঞাপন দেয়, সেও কেন
শরীর দেখায় বুঝতে পারিনা।
শৈশবে রাণু মাসিমাকে দেখেছি, নদীর বালিতে বসে
চুলে জবা পাতা মাখছে,
তারপর, ধুয়ে দিলেই সেই মেঘবরণ চুল।
যৌবনে অবশ্য রাণু মাসিমার সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা হয়নি।
এখন যুবক আমি। রাণু মাসিমা কী জানি প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে গেছে হয়তো।
তার মুখে মাণিকমালা কাঞ্চনমালার গল্প শুনেছি,
ভাদুরাণী-টুসুরাণী আর মা-জগদ্ধাত্রীর গল্প শুনেছি,
আর শুনতে-শুনতে সেই মেঘবরণ চুলের কথা এসে পড়েছে বারবর।
শৈশবেই যে-চুলের সঙ্গে ভালোবাসা আমাদের
তাতে মেঘের মায়া, জলের কাজল, আর পদ্মপুকুরের ঘ্রাণ।
সেই চুলে আকাশ ভেঙ্গে পড়তো, বাতাস পথ হারিয়ে ফেলতো
আর পূজা-পার্বণে চুল খুলে দিলেই, মেয়েরা হয়ে উঠতেন মা-লক্ষ্মী।
এখন, হেয়ার-ডাই কোম্পানীর বিজ্ঞাপনে
নিখুঁত জ্যামিতির মতো চুল
আকাশ পেরিয়ে
আমাদের টিভির পর্দায়
লাফিয়ে উঠছে ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতো,
আমাদের চিবিয়ে খাচ্ছে সারারাত।
(বিজ্ঞাপনের চুল: ঘাস রঙয়ের আকাশ )
( ক্রমশ )
0 Comments