জ্বলদর্চি

নিউ বটব্যাল অপেরা /শ্রীজিৎ জানা

নিউ বটব্যাল অপেরা

শ্রীজিৎ জানা



বিকেলের আড্ডা কদিন নিরামিষ যাচ্ছে। তা প্রায় এক সপ্তাহ তো হবেই। মানে আড্ডার যিনি মধ্যমণি সেই ওয়ান এন্ড ওনলি বটুদা গো- ওয়েন্ট- গন। কোন কিছু না বলেই বটুদা হঠাৎ ফুড়ুৎ হোয়ে যায় এভাবেই। আবার ঠিক ধুমকেতুর মতো চোঁচা মেরে হাজির হয় বটতলায়। এমন মতিগতি নিয়ে কিছু বল্লেই বটুদার জবাব,
--বটু বটব্যালের মতিগতি দেবা ন জানন্তি,তোরা তো সব লেডিকেনি রে!!
বটুদার আদব -বেয়াদব আমাদের ধাতে সয়ে গ্যাছে। কিন্তু যা কিছুতেই সয় না তা হল বিকেলের বটতলার আড্ডায় বটুদার গরহাজির। 
শিবেন বাড়িতে বেশ কয়েকবার চক্কর মেরেছে। প্রত্যেক বারের মতো বাড়ির সদস্যরা ওই একই উত্তর ঝুলিয়ে দিয়েছে মুখের সামনে,
--ওর খবর তোমরা ছাড়া এ তল্লাটে কারুর জানার তো  কথা নয়। দ্যাখো নতুন কি মহানকর্মে ব্রতী হয়েছে।
কিন্তু একটা বিষয়ে বটুদার কড়া নির্দেশ আছে আড্ডা নিয়ে। সে থাকুক বা না থাকুক বটতলাকে বটুবাহিনী শূন্য করা যাবে না। তার বাক্য আমাদের কাছে বেদবাক্য সমান। এতদিনেও সেকথা অমান্য করিনি আমরা।

আজও আড্ডার রুল মাফিক শিবেন হাজির হয়েছে আগেই। সাথে আমি। কথা হচ্ছিল গাঁয়ের শিবতলার গাজন মেলা নিয়ে। হঠাৎ প্রদীপের জিনের মতো ভুস্ করে হাজির গ্রেট বটুদা। তার চলন ভঙ্গিমায় নবাবী আদব। চাহুনিতে রাজপুতানা জ্যোতি। বচনে সম্রাটের মতো স্বরক্ষেপন,
--বাত্তামিজের দল্। সম্মুখে দন্ডায়মান নটসম্রাট বিপিন বটব্যাল। উঠিয়া তাহাকে সেলাম ঠোকো জলদি। নইলে নটসম্রাটকে ইনকার করার গুনহাতে গর্দান যাবে এখুনি!
পুতুলনাচের পুতুলের মতো বাঁই করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সত্যিই বটুদা হাজির। শিবেন তড়াক করে লাফিয়ে বলে উঠে,
---- জয় বটুদা কী জয়!
উত্তেজনা আমিও ধরে রাখতে না পেরে শিবেনের সঙ্গে গলা মেলাই,
---জয় বটুদা কী জয়!
কিন্তু দেখলাম আমাদের জয়ধ্বনিতে বটুদা ততটা খুশি নয়। আমাদের দু'জোড়া চোখ কারণ খুঁজতে  বটুদার দিকে ত্যাড়া ভাবে পড়ল। একইসাথে শিবেনের জোরালো জিজ্ঞাসা,
----বটুদা এমন জয়ধ্বনিতে তুমি কী খুশি নও?
----খুশি বাট্ তোরা কোথাও যেন একটা ভুল কচ্চিস।
সমস্বরে বলে উঠি,
----মানে!
----মানে হোলো তোদের বটুদা আর পাঁচজনের মতো আলুনিমার্কা নয়।  সে হোলো নটসম্রাট! জয়ধ্বনি দিতে হলে ওই উপাধিসহ নামের জয়ধ্বনি দে। তবে না।
---নটসম্রাট উপাধি তুমি কবে পেলে বটুদা? কারা দিলো এই সম্মান?
----ওহে শিবচন্দর সেই ইতিহাস বল্লে রাখালদাস বাঁড়ুজ্জে অব্দি চমকে যাবেন তুমি তো লেডিকেনি।
----বারবার লেডিকেনি বোলছো মানে নিশ্চই এনেছো এই সুবোধ বালকদিগের তরে।
কথাটা শেষ করেই শিবেন বটুদার দিকে চেয়ে বলে,
---দেখলে তো বটুদা ক্যামন তোমার মতো যাত্রার স্টাইলে বল্লাম।

এবার আমি কথার মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ি,
---তুই থাম শিবেন।   তোমার উপাধি লাভের গল্পটা শুনাও বটুদা। এত্তবড় খেতাব!আর তর সইছে না।
শিবেন গতিক বুঝে আমার তালেই তাল ঠুকে বলে,
---কতদিন তোমার মুখে গল্প শুনিনি বটুদা। একটা জম্পেস করে গল্প শোনাও দেখি।
শিবেনের কথায় ছেদ পড়বার আগেই ধমকে উঠে বটুদা,
---ওরে সাইবেরিয়ান ভল্লুক যেটা শুনবি সেটা গাঁজাখুরি গপ্প নয়। তোদের বটুদার জীবনের এক গোল্ডেন পেজ!
  তারপর বটুদার জীবনের সত্যি কাহিনী আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে যারপরনাই আমোদ ছড়াল মনে।
বটুদা একবার যাত্রাদল গড়ে তার গাঁয়ে। নাম রাখে নিউ বটব্যাল অপেরা। শুধু বটব্যাল অপেরা নামটা কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছিল। তার উপর বাংলা নামটার আগে  গোরাদের একটা শব্দ বসিয়ে দিলে নাকি  মারাত্মক  জোর আসে। তাই বটব্যালের গর্দানে নিউ শব্দের অবস্থান। উদ্দেশ্য গাঁয়ের প্রতিভা আবিষ্কার। রচনা ও নির্দেশনা বিপিন বটব্যাল। নায়কের ভূমিকায়ও বটুদা নিজেই। একমাস ধরে চলে যাত্রার মহড়া। সেবার গাজনের মেলায় নিউ বটব্যাল অপেরার শুভ মহরৎ হওয়ার কথা। স্থির হয় কলকাতা থেকে কোনো ফিমেল আর্টিস্ট আনা হবে না। গাঁয়েরই ভূপতি মালাকারকে অনেকেই মেযেমুখো বলে রাগায়। বটুদা তাকেই বেছে নেয় বেগম চরিত্রে। ঐতিহাসিক পালার জন্য পোশাকআশাক ভাড়া করে আনার কথা হয় মালিদা থেকে। তলাপার্টি রেডি। অল ইন্ডিয়া ডেকোরেটরের আলো,ঝালর,সিনসিনারি বুক করা হয়ে গ্যাছে। কিন্তু সমস্যা হোলো অম্বিকাচরণের তখনো পার্ট মুখস্থ হয়নি। কুশীলবদের অধিকাংশ নিরক্ষর। কিন্তু অসম্ভব শ্রুতিধর। শুনে শুনেই পার্ট কণ্ঠস্থ করেছে তারা। বটুদার কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখে অম্বিকাচরণ জানায়,
--চিন্তা নেই ভায়া ও আমি মেকাপ দিয়ে দুবখন।
অম্বিকাচরণের কথায় সামান্য ভরসা পেলেও আরো গুরুতর  এক ফ্যাসাদ বটুদাকে বিচলিত করে তুলেছে।
সন্ধে হলেই গগন সাঁপুইয়ের ঢুকুঢুকু চাই। পইপই করে নিষেধ করেছে বটুদা,
---ওই দিনটুকু ফাঁক দিস রে গগন।
---ওটা না খেলে আমার যে পা কাঁপবে বটব্যল দা
---বটব্যল না বটব্যাল। এখনই ততলে যেও না ভাইটি।

হরেক ঝক্কি সামলে সেবার গাজনের মেলায় অনুষ্ঠিত হোলো নিউ বটব্যাল অপেরার ঐতিহাসিক যাত্রাপালা।চারিদিকে চরম উত্তেজনা। মেলার মাঠে লোক থিকথিক করছে। গাঁয়ের দল যাত্রা করবে বলে কথা। গলার স্বর গম্ভীর করে, মাঝে মাঝে কাঁপিয়ে মাইকে ঘোষণা করছে মেলা কমিটির ঘোষক সত্যেন মাল। ঢঙ করে ঘন্টা বাজতেই তলাপার্টির দল পেঁ-পোঁ-ঝনঝন-ডিস শব্দে মিউজিক শুরু করে দিয়েছে। যাত্রা শুরু সাড়ম্বরে। দুটি দৃশ্য শেষে প্রবেশ গগন সাঁপুইয়ের। বেশ কিছুক্ষণ তাকে গ্রিনরুমে পাওয়া যাচ্ছিল না। সেই নিয়ে চিন্তা সকলেরই ছিল। আর হলও তাই। গগনের সংলাপ ছিল,"নারী নারী তুমি ভবশঙ্করী তোমার লাঞ্ছনা আর সহ্য হচ্ছে না"! সেই সংলাপ গগনের কিছুক্ষণ অদৃশ্য থাকার দৌলতে হোলো,
---নাড়ী নাড়ী ভবের শঙ্কড়ী তোমাড় লাল ছ্যানা আমাড় আড় সহ্য হচ্ছে নি।
বলেই চিৎপটাং। চারিদিকে তুমুল হল্লাহাসির কলরোল। স্টেজ অন্ধকার করে গগনকে দ্রুত আনা হয় সাজঘরে। যাত্রা চলতে থাকে আপন তালে। মাঝে মাঝে মাইকের ক্যাঁ-কোঁ ব্যাগড়ামি।কারো কারো স্বর ভয়ে পৌঁছায় না মাইক্রোফোন অব্দি। কেউ ডাঁয়ে যায় তো কেউ বাঁয়ে। স্টেজময় এক হুলুস্থুল কান্ড। কিন্তু সেরার সেরা কান্ড ঘটে শেষে। অন্তিম দৃশ্য হোলো যুদ্ধের দৃশ্য। আর সেই দৃশ্যের একদিকে অম্বিকাচরণ, অন্যদিকে বিপিন বটব্যাল। অম্বিকাচরণের হাতে থাকবে তলোয়ার আর বটুদার হাতে বন্দুক। ডায়লগ বলে বন্দুক তাক করলেই স্টেজের পুব দিকে সুপারি পটকা ফাটাবে মাধব সামন্ত। অম্নি অম্বিকাচরণ লুটিয়ে পড়বে মাটিতে।প্ল্যান মাফিক বন্দুক তাক করে বটুদা বলে উঠে,
---আজই তোর জীবনের শেষ দিন রে অত্যাচারী নবাব। এই নে তোর পাওনা।
কিন্তু একি কোন পটকার শব্দ নেই। অম্বিকাচরণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চোখ নাচিয়ে বটুদাকে জিগ্যেস করে এখন কী করবে। বটুদা ম্যানেজ করে পরিস্থিতি। করতালিতে ফেটে পড়ে চারিদিক।

এটুকুর পরেই শিবেন লাফিয়ে উঠে,
--তাতেই তুমি নটসম্রাট উপাধি পেলে? ব্যাপারখানা যেন ক্যামন…!
---চুপ রহো বুড়বক। লাস্ট ফিনিশিংটা যে দিলুম কীভাবে সেটা কি জানো শিবেনচন্দর?
আমি হাসি চেপে বলি,
---কীভাবে বটুদা।
কিছুটা শান্ত হয়ে বলে,
---দেখলুম সুপারি পটকা ফাটছে না। কী করা যায়। অম্বিকাচরণের মুখ শুকনোপরা দেখাচ্ছে। অম্নি মগজে বিদ্যুৎ খেলে গেল। ডায়লগ দিলুম পাল্টে। বললুম,
---আমার হাতে বন্দুক আর তোমার হাতে তলোয়ার। এ তো অন্যায় সমর। যাও আজ থেকে তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। এটাই তোমার শাস্তি।
 আর তাতেই বাজিমাত। মেলা কমিটি আমার হাতে তুলে দিল নটসম্রাটের মেডেল।
শিবেন তখনো পিছু ছাড়ে না। বলে,
--কিন্তু পটকাটা ফাটলো না কেন?
কথাটা শুনেই অগ্নিশর্মা হয়ে বটুদা তেড়ে উঠে,
---না ফেটে ভালোই করেছে। ওটা গচ্ছিত আছে স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ। ভবছি তোর মাথায় ফাটাবো। ব্যাটা বাত্তামিজ।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments