জ্বলদর্চি

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় পর্ব - ১১/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় 
পর্ব - ১১                                

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী    

গওহরের বোম্বে যাওয়ার দুটি উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমতঃ জীবনের সবথেকে মধুর সম্পর্কের মানুষটির সাথে এখানের দিনগুলি কাটিয়েছিলেন সেই স্মৃতিকে পুনরায় জারিত করা এবং দ্বিতীয়তঃ হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের বিখ্যাত শিল্পীদের সান্নিধ্য পাওয়া। বোম্বেতে থাকার সময়ে গওহরের একটি অনুষ্ঠানে গান শোনার সুযোগ ঘটে মহীশূরের ছোট রাজকুমার কান্তিবর নরসিংহরাজ ওয়াদেইয়ারে। গওহরের গান এত ভাল লেগেছিল ছোট কুমারের যে তিনি তার দাদা মহীশূরের রাজা নলওয়াদি কৃষ্ণরাজ ওয়াদেইয়ারের কাছে সুপারিশ করলেন গওহরজানের মতো একজন বিখ্যাত শিল্পীর বোম্বেতে এক শেঠের আতিথ্য গ্রহণ করে থাকা অশোভনীয়। তাঁর প্রাপ্য সম্মান হবে মহীশূরের রাজদরবারের সভা গায়িকা। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই মহীশূরের রাজার দেওয়ান স্যার মির্জা ইসমাইলের কাছ থেকে গওহরজান একটি টেলিগ্রাম পেলেন যাতে বলা হয়েছিল যে মহারাজ তাঁকে রাজদরবারের সভা গায়িকা হিসেবে নিযুক্ত করতে অত্যন্ত আগ্রহী। এই টেলিগ্রাম পাওয়ার পরে গওহর সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি মহীশূরে যাবেন, কারণ মহীশূরের বর্তমান মহারাজের পিতা প্রয়াত চামরাজা ওয়াদেইয়ারের সময়ে তিনি মহীশূরের রাজদরবারে সংগীত পরিবেশন করে উষ্ণ আতিথ্য পেয়েছিলেন। সেই সময়ের সুখস্মৃতি তাঁর অন্তরে জেগে উঠল। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বোম্বের বাসস্থান ছেড়ে তিনি তাঁর জীবনের শেষ ঠিকানাতে যেয়ে পৌঁছালেন। 
                                                              
গওহরের মহীশূরের যাবার বিভিন্ন কারণ ছিল। তখনকার দিনে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় শত বৎসর পূর্বে মহীশূরের হিন্দুরাজারা যেভাবে সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং সঙ্গীতের বিকাশে যেভাবে তারা দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের মহারাজা বা নবাবদের রাজত্বে সেরকম কোথাও বিকশিত হয় নি। বীণা বাজানোর নতুন ধরনের রীতি ' মাইসোর বাণী বা শৈলী'র  প্রবর্তন মহীশূরের রাজ দরবারেই হয়েছিল। দক্ষিণ ভারতীয় সংগীতের বিভিন্ন দিকপালেরা যেমন -  বীণা শেষান্না, বীণা শামান্না, বীণা সুবান্না, বিদারাম কৃষ্ণাপ্পা, বাসুদেবাচার্য, সদাশিবা রাও, ডঃ মুথাইয়া ভগবতার, বীণা ভেঙ্কটগিরি আপ্পা প্রমুখেরা বিভিন্ন সময়ে মহীশূরের রাজদরবার আলোকিত করেছিলেন। মহারাজা নলওয়াদির রাজত্বকালে সংগীতের বিকাশ ও আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রেও প্রভূত বিকাশ ঘটেছিল। হিন্দুস্তানী, কর্ণাটকী ও পাশ্চাত্য সংগীতের মেলবন্ধন, ব্যাপকভাবে বাদ্যযন্ত্র ও অর্কেষ্ট্রার ব্যবহার, বিভিন্ন সময়ে সংগীত সম্পর্কিত আলোচনা ও বিতর্ক সভা, বিভিন্ন শিল্পীদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার ফলে নতুন নতুন রাগের সৃষ্টি মহীশূরের রাজাদের উৎসাহ দানের ফলেই ঘটেছিল। এছাড়াও ভারতের মধ্যে সর্বপ্রথম প্রাসাদপ্রাঙ্গণে মাইক্রোফোন লাগিয়ে রাজদরবারের অনুষ্ঠান যাতে সাধারণ মানুষ উপভোগ করতে পারেন তার ব্যবস্থা হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে উত্তর ভারতীয় হিন্দুস্তানী সংগীত গায়কেরা যেমন উস্তাদ ফৈয়াজ খান, উস্তাদ আব্দুল করিম খান, বিখ্যাত সেতার বাদক আফতাব বরকত উল্লা খান সেখানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন এবং তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগ্নী সরলা দেবী চৌধুরানী দু'বৎসর মহীশূরে থাকাকালীন কর্ণাটকী সংগীত ও বীণা বাদনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুবাদে বিশ্বকবিকে সেইসব গান গেয়েছিলেন সেই সব গান গেয়ে শুনিয়ে ছিলেন। সেই সব গান শুনে কবিগুরু এত প্রভাবিত হয়েছিলেন যে তিনি কর্ণাটকী সুরে গানও রচনা করেছিলেন যা রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রচলিত গায়কী রীতি থেকে নতুন ধারার সৃষ্টি করেছিল যাকে ভাঙ্গা গান বলা হত।                                     

এইরকম এক সাঙ্গীতিক পরিমণ্ডলে গওহরজান মহীশূরে এসে পৌঁছালেন। তাঁর সাথে মহীশূর রাজদরবারের পক্ষ থেকে যে চুক্তিপত্র করা হয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল তাঁর থাকার জন্য 'দিলখুশ কটেজ'-এ তিনি বিনা ভাড়ায় থাকতে পারবেন, মাসিক ৫০০ টাকা বেতন পাবেন, রাজপরিবারের কারো জন্মদিন, দশেরা উৎসব এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে তাঁর মহীশূরে থাকা বাধ্যতামূলক এবং রাজদরবারের অনুমতি সাপেক্ষে অন্য সময় তিনি মহীশূরের বাইরে অনুষ্ঠান করতে যেতে পারবেন। যে দিলখুশ কটেজে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল সেটি ললিতা মহল প্রাসাদে যাবার পথে পাহাড় দিয়ে ঘেরা একটি নিরিবিলি শান্ত পরিবেশের মাঝে একটি কটেজ যেখানে তাঁর সঙ্গীত চর্চা করার এক আদর্শ পরিবেশ ছিল। অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য যে গওহরজান একদিন তার গান রেকর্ডিং বা সংগীতানুষ্ঠানের জন্য এক থেকে তিন হাজার টাকা পারিশ্রমিক পেতেন সেই গওহরজানকে মহীশূরের রাজদরবারে মাসিক পাঁচশো টাকা বেতনে চুক্তিবদ্ধ হতে হলো।

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। গওহরের বিভিন্ন গুণ থাকা সত্ত্বেও নিজের শিল্পীসত্তার প্রতি তার খুব অহংকার ছিল এবং তার বিলাসবহুল জীবনযাত্রা প্রদর্শনের জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করতেন। জীবনের সোনালী দিনগুলিতে এই গওহরজান তাঁর বিলাসবহুল জীবন যাত্রা ও অতি তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিসের পিছনে এক সময় কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতেন। শোনা যায় তাঁর পোষা বিড়ালের বিয়েতে তিনি বারোশো টাকা খরচ করেছিলেন, আবার সেই বিড়ালের যখন বাচ্চা হয়েছিল সেই সময়ে কলকাতা শহরে যে পার্টি দিয়েছিলেন তাতে খরচ করেছিলেন কুড়ি হাজার টাকা। ভাবা যায় কি বেহিসাবি খরচা করতেন। তাঁর সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে অনুষ্ঠানপিছু তাঁর পারিশ্রমিকই ছিল সর্বোচ্চ - এক হাজার টাকা। 

আবার একবার মধ্যপ্রদেশের একটি ছোট স্ব-শাসিত রাজ্যের রাজা মহারাজ ভবানী সিংহ বাহাদুরের কাছ থেকে তাঁর পুত্রের বিবাহ অনুষ্ঠান উপলক্ষে এক সঙ্গীত অনুষ্ঠান করার আমন্ত্রণ পান। মহারাজ সংগীতের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং নিজেও ভালো পাখোয়াজ বাজাতে পারতেন তিনি বিখ্যাত পাখোয়াজ শিল্পী পন্ডিত কুদু সিংহের ছাত্র ছিলেন। সেই সময়ে গহরের আমন্ত্রণ আসতো বিখ্যাত সব রাজ পরিবার থেকে। দাতিয়ার মতো একটি ছোট রাজ্যের রাজার আমন্ত্রণ পেয়ে সংগীতের দুনিয়ার শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত গওহরজান তাচ্ছিল্য ভাবে সেখানে অনুষ্ঠান করতে যাওয়ার জন্য এক অন্যায্য দাবি করে মহারাজের কাছে গওহর দাবি করেছিলেন তাঁর ১১১ জন সঙ্গীর জন্য তাঁকে একটি সম্পূর্ণ ট্রেন রিজাভ করে পাঠাতে হবে। অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী মহারাজ অবশ্য তাঁর দাবি মেনে একটি পুরো ট্রেন রিজার্ভ করে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবার পরে গওহরজান কি পরিমান অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে অবশেষে মহারাজার কাছে নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছিলেন সে কথা আমরা পরে বলছি।                                             

মহীশূরে যে কি আড়ম্বর সহকারে দশেরা উৎসব পালিত হয় তার একটি খন্ডচিত্র এখানে উল্লেখ করছি। দশ দিন যাবৎ রাজপ্রাসাদে, বিভিন্ন মন্দিরে বিশেষত্ব চামুন্ডি পাহাড়ে মা চামুণ্ডার মন্দিরে বিভিন্ন ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম অনুষ্ঠিত হয়। সমগ্র রাজপ্রাসাদ সহ মহীশূরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলি আলোকমালায় সুসজ্জিত করা হয়। দশ দিন ও নয়রাত্রি ব্যাপি প্রাসাদ সংলগ্ন প্রাঙ্গণে মল্লবীরদের কুস্তি সহ বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সংগীত ও নৃত্যের অনুষ্ঠান, আতশবাজি পোড়ানো, জাঁকজমকপূর্ণ দেবী চামুন্ডেশ্বরীর বিজয় উৎসবের স্মরণে বর্ণাঢ্য মিছিল চলে রাজপ্রাসাদ থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের চামুন্ডি পর্বতে দেবী চামুণ্ডার মন্দির পর্যন্ত। শেষ দিনের বিজয় মিছিলে মহারাজা ও তার পরিবারের সদস্যেরা সুসজ্জিত হাতীর হাওদায় বসে এই মিছিলে, যাকে 'জুম্বো সাভারি' বলা হয়, অংশগ্রহণ করতেন। মিছিলের পুরোভাগে অর্কেস্ট্রা দল সামরিক বাহিনীর মিলিটারি ব্যান্ড, লোকনৃত্যের দল নৃত্য-গীত সহকারে এগিয়ে যেত।    
   ক্রমশঃ…….
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments