জ্বলদর্চি

অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান-১৪/দিলীপ মহান্তী


অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান

দিলীপ মহান্তী
                                                                       
 ।১৪।
বকরূপী যক্ষ(ধর্ম) যুধিষ্ঠির কে প্রশ্ন করেছিলেন- 'এই জগতে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা কি?' যুধিষ্ঠির উত্তর দিয়েছিলেন, ' আমরা আমাদের চারপাশে দেখছি, মানুষেরা মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে, কিন্তু যারা জীবিত আছে তারা ভাবে তারা কোনোদিন মরবে না। এটাই আশ্চর্যজনক ঘটনা। মানুষ মৃত্যুকে সামনে দেখেও কখনো ভাবেনা সে মরবে।' মহাভারতের জ্ঞান থেকে আমরা জানি যুধিষ্ঠির একজন বড় দার্শনিক ও যোগী ছিলেন।

      মহাভারতের যুগ থেকে সরে এসে এই সময়ের পৃথিবীতে দৃষ্টিপাত করলেও যুধিষ্ঠিরের মতো না হলেও দু'একজন দার্শনিক ও যোগী মানুষ খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধার কথা নয়। তাঁদের চিন্তাভাবনা, কর্মজগৎ, জীবনযাপন আর সমাজের জন্য কিছু বার্তার আলোকে এই ধরণের মানুষকে খুঁজে পেতে পারি। কবি অশোক মহান্তীও তেমনই এক দার্শনিক ও যোগী পুরুষ। তাঁর কবিতা প্রসঙ্গে এই মৃত্যুর প্রসঙ্গ আনার প্রধান কারণ, তাঁর জীবন ও কবিতার মাঝখানে আশ্চর্য সেতুবন্ধন করেছে এই মৃত্যু। মৃত্যুর প্রসঙ্গ তাঁর কবিতায় বারবার এসেছে। সে কথায় যাওয়ার আগে দু’একটি মৃত্যুর কথা বলবো। যে মৃত্যু তাঁর জীবনে স্থায়ী প্রভাব রেখে গেছে। অশোকদা শৈশবেই তাঁর মাকে হারিয়েছিলেন। সেই যন্ত্রণা তিনি সারাজীবন বুকের মধ্যে পুষে রেখেছিলেন। গভীর বিষাদে আচ্ছন্ন ছিলেন। সেই দুঃখের আগুনে পুড়ে তৈরি হয়েছে তাঁর কবিমন। আর একটি মৃত্যুর ঘটনা অনেক পরের। অশোকদার বাবার মৃত্যু ২০০১-এর কালী পুজোর কয়েকদিন আগে। সেই সময়ে শ্মশানে দাহ করার সময় অশোকদা'র সঙ্গে আমিও উপস্থিত ছিলাম। সেই মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে আমি কবি অশোক মহান্তীকে গভীরভাবে জেনেছিলাম। তার আগে যে জানতাম না তা নয়। এই সময় তাঁকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করেছিলাম। মানুষ হিসেবে তিনি কত মহৎ- সেই স্থান নির্ণয় করতে পেরেছিলাম। আর তিনি কতো বড় মাপের কবি এটাও বুঝতে পেরেছিলাম।

     আমাদের গ্রামের শ্মশানে সেই শীতের রাত্রিতে জ্যাঠামশাইকে দাহ করা হয়েছিল। আমি তখন জলপাইগুড়ি শহরের একটি কলেজে পড়াতাম;  সেই বছরই চাকরিতে ঢুকেছি। পুজোর ছুটিতে বাড়িতেই ছিলাম। সেইজন্য শ্মশান যাত্রায় সঙ্গী হতে পেরেছিলাম।
    শ্মশানের  সেই রাত্রি আমার জীবনের একটি অন্যতম স্মৃতিবহুল রাত্রি। হয়তো অলৌকিক রাত্রি। চিতা জ্বলছে। সেখান থেকে একটু দূরে প্রায় ১৫-১৬ ফুট দূরে একটি ছোট্ট টিলার ওপর বসে আমরা দুজন (আমি ও অশোকদা)গল্প করছি। চিতার আগুনের উত্তাপ সেখানেও পৌঁছাচ্ছে।  বাকি পরিবারের অন্যজন ও অন্য শ্মশান যাত্রীরা চিতার পাশে ও ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন। তাঁদের কেউ কেউ কথা বলছেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। কেউ বা চুপচাপ বসে শ্মশানের নীরবতা রক্ষা করছেন।
 আমরা কথা বলছি কবিতা নিয়ে। শুধু বাংলা কবিতা নয় দেশ বিদেশের কবিতা নিয়ে। সেইসঙ্গে সমকালে ও দূর অতীতে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো নিয়ে। যেগুলি জাতীয় জীবনে সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলেছে। কখনো তিনি  কথা বলছেন একজন চরম বাস্তববাদী হিসেবে, কখনো বা প্রাজ্ঞ দার্শনিক বা সমস্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন করে আসা এক ত্রিকালদর্শী ঋষির মতো, কখনো বা তুখোড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মতো। আর মাঝে মাঝে নিরাসক্তভাবে জ্বলন্ত চিতার দিকে দৃষ্টি ছুঁড়ে দিচ্ছেন। কখনো বা দৃষ্টি দিয়ে জড়িয়ে ধরতে চাইছেন চিতার আগুন। সেই দৃষ্টির গভীরতা আমি মাপতে পারছিনা কিন্তু তাঁর পড়াশোনার পরিধি দেখে চমকে চমকে উঠছি, বিস্ময়ের সীমা পরিসীমা পাচ্ছিনা। অন্য শ্মশান যাত্রীদের হয়তো এই আলোচনা ভালো লাগছেনা, তাঁদের মতে শ্মশানে চিতার পাশে বসে এই আলোচনা হয়তো শোভন সুন্দর নয়। তবে আমার কাছে এই রাত্রি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরম প্রাপ্তি। তাঁকে নিবিড়ভাবে জানার।
    এর একটি উপসংহার আছে। এই ঘটনার মাত্র বছর দেড়েক পরেই তাঁর আকস্মিক মৃত্যু হল। তাঁর পূর্বাভাস দিয়েছিলেন কয়েকটি কবিতায়। তাঁর অনেক কবিতাতেই মৃত্যুর প্রসঙ্গ আছে। অপ্রাপ্তির আগুন আছে। ক্ষুধার কথা আছে কিন্তু মৃত্যুর এই ঘটনাটি তাঁর বিলাসী কল্পনার সময় থেকে অনেক আগেই ঘটে গেছে।যা ঘটার কথা ২০২০ তে, তা ঘটে গেছে ২০০৩ -এ। আমি তখন জলপাইগুড়িতে। কিন্তু শুনেছিলাম তাঁর চিতার সামনে কবিতাপাঠ হয়েছিল। তাঁর একমাত্র পুত্র অনিরুদ্ধ তার বাবার চিতার পাশে দাঁড়িয়ে তার বাবার লেখা কবিতা পাঠ করেছিল।যাঁর জীবন ছিল শুধু কবিতা নিয়ে। সেদিনের শ্মশান হয়ে উঠেছিল কবিতাময়। না সঙ্গে অনিরুদ্ধের স্ত্রী ছিল না। অনিরুদ্ধ খুব অল্প বয়সেই তার বাবাকে হারিয়েছিল। নিজেও হারিয়ে গেছে। তার বাবার মৃত্যুর প্রায় দুবছর পর একটি চিঠি লিখে সে নিরুদ্দেশ! তার অনেক কাজ আছে, সেই কাজ সম্পূর্ণ করে সে ফিরে আসবে বলেছিল। না, অনিরুদ্ধ কথা রাখেনি। অশোক মহান্তী লিখেছিলেন:

   ' আমার ছেলে ভাবল- কই, ৯৮ সাল চলে গেল
  আমার বাবার ভাগ্যে একটা সংবর্ধনা পর্যন্ত জুটল না,
  তাহলে, আমার বাবা নিশ্চয় খুব ছোটোকবি।

  ধরে নিই, তারও বহু বছর পর, মৃত্যু হল আমার।
                                        তখন, ২০২০সাল।
    শ্মশানের আগুনের পাশে আমার ছেলের সঙ্গে ছেলের বৌ।
    ধোঁয়া পাক খেতে-খেতে উড়ে যাচ্ছে আকাশে।
    আমার ছেলে ভাবছে- কই, একজন কবির মৃত্যুদিনেও তো
                         শহর ভেঙে পড়ল না রাস্তায়,
     তাহলে, আমার বাবা নিশ্চয় খুব ছোটোকবি।

     শ্মশান থেকে ফেরার পর একটি চিঠি এলো।
     যার লেখক একটি ছোট কাগজের সম্পাদক
     আর নিজেও যিনি একজন ছোটোকবি
     লিখেছেন-'একটি সমুদ্র পাখি, যে অনেক জলস্তম্ভ পার হতে চায়,
                          সেই বিহান-এর জন্য
                         অনুগ্রহ করে একটি দীর্ঘ কবিতা পাঠাবেন।'
       আমার ছেলে ভাবল- অনুগ্রহ মানে কি?
   তাহলে, আমার বাবা নিশ্চয় ছোটোকাগজের এমন এক ছোটোকবি
   যিনি অনুগ্রহ করতেন, এবং অনুগৃহীত হতেন একসঙ্গে।

   কালো পিঁপড়ের মতো পাণ্ডুলিপির ঝাপসা অক্ষরে
         বাবার গর্বিত মুখ ভেসে উঠল।’
          ( ছোটোকবি:,৪৮ বছরের স্বীকারোক্তি)

 লিখেছিলেন 'শ্মশানভূমিতে কবিতাপাঠ' এর মতো কবিতা:

   শ্মশানভূমিতে এসে দেখা হলো।
   আমার মাংসের চোখ ধাতু-হয়ে-যাওয়া মৃত মানুষের চোখে
   যে-দৃষ্টি রেখেছে, সেই চোখ দিয়ে তোমাকে দেখলাম।
   দেখছি আধপোড়া কাঠ, ইতস্তত-ছড়ানো হাড়ের পাশেই পাথর, বালি
   ভাঙাচোরা সমাধিমন্দির।
  আর তুমি, দু'পাশে স্বপ্নের ঘন বনচ্ছায়া পার হয়ে টিলার উপরে উঠে এলে।

   তুমি এখানে এসেছো আরও কতবার।
   যখন  চাঁদের গায়ে ছায়া পড়ে, মোমবাতি জ্বেলে
   তোমরা গেয়েছো কত রবীন্দ্রসঙ্গীত, কত প্রিয় কবির কবিতা,
   কত বসন্তের দিন হাতে-নিয়ে এখানে এসেছো।

   আমি এ শ্মশানভূমি কখনো দেখিনি।
   ব্যক্তি-মালিকানাধীন এ-শ্মশান, এই শ্মশানের সব পাথর-ফলকে
   পাশাপাশি ঘুমিয়ে আছেন যাঁরা তাঁদের দেখিনি।
   তবু মনে হোল আজ আমাদের অনেকের সাথে ওঁরা মাটির গভীর তল্ বেয়ে
   উঠে এসে বসেছেন, শুনেছেন আমাদের গান ও কবিতা।
   যে সুর তাদের আজ মনে নেই, সেই ঘুম পাড়ানিয়া সুরে
   তাঁরা এ মাটির তলে বহুকাল ঘুমিয়ে অস্থির।
   মানুষ ঘুমোতে পারে কত আর?

   ঘুম আর জাগরণ দুটি হাতে নিয়ে তুমি তো স্বপ্নের দেশ থেকে এসেছিলে।
   তুমি তো আলোর দেশ থেকে এসেছিলে, জন্ম-মুহূর্তের আলো
   যখন ছড়িয়ে গেছে  ওপারে রাস্তায়
   যখন মৃত্যুর কথা মনে পড়ে, তুমি তো তখন এসেছিলে।

   নিজেকে উন্মুক্ত করে আমাকে দেখাও।
  ১৯ বছর ধরে যে স্বপ্ন দেখেছো তুমি সেই স্বপ্ন আমাকে দেখাও।
  আমি গ্রীষ্মের সন্ত্রাস থেকে   কিভাবে জলের দিকে ফিরে যাবো দেখাও আমাকে
          ( শ্মশানভূমিতে কবিতাপাঠ: মাটির মন)

    ছেঁড়া স্বপ্নের পাখায় ভর করে তিনি কল্পনার ইমারৎ গড়ে তোলেন। একসময় সেই নীল স্বপ্নগুলো পথের ধুলোয় ছড়িয়ে পড়ল আর কবিকে তুলে নিল মৃত্যু নামের দানব। মৃত্যুর রঙ তাই পংক্তিতে পংক্তিতে ছড়ানো। এমনকি প্রেমের কবিতাতেও মৃত্যুর ছায়া। প্রকৃতির কবিতাতে, জন্মভূমিকে কেন্দ্র করে নিবিড় ভালোবাসার কবিতাতেও জাগে ধূসর মৃত্যুর মুখ:

১. মৃত্যু যেন ঘুমের সমান।
      ভাবি, একা এই কবরখানায় আমি যে কবিতা লিখি আজ
      সেও কোন মৃত্যুর কবিতা।
      জীবিতেরা পাশাপাশি অন্ধকারে লুকিয়ে রয়েছে।

      যদিও সমস্ত রাত আলো জ্বলে, দূরে শুনি রেলের গর্জন
      তবু কাছে গিয়ে হাত রাখি, দেখি তুমি মৃতের সমান
      তোমাতে লাবণ্য নেই, ধ্বনি নেই ভালোবাসা নেই।

      হাত রাখি হাতখানি ফাঁকা। মুখ রাখি। মুখখানি ফাঁকা।
      হৃদয়ে হৃদয় রাখি, একবর্ণ উত্তাপ লাগেনা।

      তুমি প্রকৃতই রিক্ত হয়ে গেছো।
       (মৃত্যুরিক্ত: মাটির মন)


২. রাজা তোমার বাজনা বাজাও যাচ্ছি আমি দেশে
      রাজারে তুই বুক খুলে রাখ যাচ্ছি রাজার বেশে।
           (মরণ: আবহ সকাল)

 

 ৩.‘আমি চলে গেলে তুমি এই দুটি চোখ রেখে দিও।
   এই যে দুচোখ, যাতে ধরা আছে পরিদৃশ্যমান
   অনন্ত প্রবাহ। জল।
   এই যে দুচোখ যার ক্ষয়হীন অসম্ভব দ্যুতি
   দেখেছে সাকার, তুমি। তোমাকে দেখেছে।

   তুমি তাকে রেখে দিও। বাষ্প যেরকমভাবে রেখে দেয় অনন্ত সম্ভব
   বৃষ্টি কিম্বা ধূলিজাল, রেখে দেয় নিজস্ব বুকের ওমে
   সমুদ্রের বিশাল উদ্ভাস।
   তুমি তাকে রেখে দিও।

   হাত পা সকলই থাক, ছোঁয়া আছে যেমন মাটিতে
   মাটি ও-সকল খাবে। বুক? সে তো অত দিব্য নয়
   যত দিব্য ওই চোখ। দেখেছে সাকার, তুমি।
   তোমাকে দেখেছে।
    ( চোখ: ধৃতরাষ্ট্রের মা )

৪. ‘শুয়ে আছি জলে ও জঙ্গলে
   মৃত্যুর পালঙ্কে শুয়ে আছি।
   তা না হয় ভোর, এই ভোরবেলা কষ্ট হত।

   সূর্য এসে পুড়িয়ে দিয়েছে মাঠ। কর্তব্যমুখিতা। আর নারী
   এই বেঁচে থাকার ভেতরে কোনো আনন্দই নেই।
   আনন্দকল্পনা নেই।সৃষ্টি নেই। আবিষ্কার নেই।

   চতুর্দিকে মোহের বসন্ত নামে।
   গাছে গাছে ফুল পাখি, পাতাদের দূরে উড়ে যাওয়া।
   আর, একটি চঞ্চল হাঁস নদীতীর ধরে উড়ে যায়।

   পলক না ফেলি যদি এই চোখ অন্ধ হয়ে যাবে।
   অন্ধ হবে মন। মনের গভীর থেকে উঠে আসা কবিতার সব পঙক্তিগুলি।
   তুমি কি ফোটোনি, কৃষ্ণকলি?

   কৃষ্ণকলি ফুটেছে আবার।
   এই মধ্যনিশীথের তীর ছুঁয়ে জীবন ও মৃত্যুর তীর ছুঁয়ে
   মাঠের নরম ঘাসে কৃষ্ণকলি আবার ফুটেছে।

   এসো জল। অবাধ বাতাস এসো।পাখিরা উড়ুক নীলে নীলে।
   রক্তে হোক গান।
   মৃত্যুর আনন্দগান।
   জীবনের অনিত্যের গান।’
       ( আনন্দ গান: অতিবর্তী জাগো )

   রবীন্দ্রনাথ জীবনকে পরম সুন্দর জানতেন তেমনি মৃত্যুকেও পবিত্র হিসেবে ভেবেছিলেন। মৃত্যু দরজা ভেদ করেই অন্য কোন মহাজীবনে প্রবেশের পথ খোলা থাকে- আর মৃত্যুর মাধ্যমেই জীবন শু্দ্ধ হয়ে ওঠে: ‘তব নৃ্ত্য মন্দাকিনী নিত্য ঝরি ঝরি/ তুলিতেছে শুচি করি মৃত্যুস্নানে বিশ্বের জীবন।’ অশোক মহান্তীর কবিতাতেও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মহাজীবনে প্রবেশ করার ইঙ্গিত আছে। মৃত্যুর দরজা দিয়েও তিনি ঈশ্বরকে দেখতে চেয়েছেন। পৃথিবীর রহস্যের মধ্যে, প্রকৃতির রহস্যের মধ্যেও খুঁজে চলেছেন আশ্চর্য সুন্দরকে।

   ‘শস্যফলনের কিছু আগে থেকেই আমরা মাটির মন বুঝতে পারি।
   সে দশ লক্ষ এক হাজার ন’শো চুরানব্বই সাল আগের কথা।
   একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি গত কয়েকদিন আগের ফেলে দেওয়া
   আতাবিচিগুলি দু’পাতা ফাঁক করে আকাশের দিকে মুখ বাড়িয়েছে।
   পাতার গন্ধ শুঁকে চিনতে পারি তাকে। অসংশয় চিনতে পারি
   যখন সে গাছ হয়ে আবার ফুল দিয়েছে, ফল দিয়েছে, আর ফলের ভেতর থেকে
   উগরে দিয়েছে সেই কালো কালো আতাবীজ।’
       ( মাটির মন: মাটির মন )


    অনেক সময় মনে হয়, বারবার মনে হয় – উঁচুনিচু মালভূমির বাঁকা পথ বেয়ে, শাল জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যে সরু লাল রাস্তা চলে গেছে, সেই রাস্তা ধরে গেরুয়া বসন পরে এক মায়াবী চোখের ঋষি  আপন মনে এক শাশ্বত আনন্দময় মর্মলোকের সন্ধানে আকুল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি নিজেই বলেছেন – আবহ সকাল শুধু হেঁটে যাই কল্যাণের খোঁজে। অমৃতময় আনন্দই তাঁর ইষ্ট। কিসের সন্ধানে তাঁর এই পথ হাঁটা? – মানুষ? জীবনদেবতা? লীলাসঙ্গিনী? ঈশ্বর সাধনার? পৃথিবীর মঙ্গল সাধনায়–  বিশ্বরহস্য ও ব্রহ্মান্ড উপলব্ধির উপাসনার পথই সে খুঁজছে তার নিজের মতো করে। তাঁর এই উপাসনার সঙ্গে আমি মিল খুঁজে পাই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। একথা আগেও বলেছি আবারো বলছি - তিনিও ঈশ্বর প্রকৃতি ও মানুষ এই তিন রহস্যের সন্ধানে ব্রহ্মকে নিজের মতো করে জানতে চেয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে তাঁর  ‘মাকাল-লতার কাহিনী‘  ও ‘ কুশল পাহাড়ী’ নামের আশ্চর্য দুটি ছোটগল্পের কথা মনে পড়ছে। সেই জগৎকে উপস্থাপিত করলেই আমার বলার কথাটি সম্পূর্ণ হবে : দৈনন্দিন জীবনযাত্রার উর্ধ্বে একটি অকলুষ, উদার, দিব্য জগতের অকথিত বানী এই মাকাল লতার ঝোপের পথে আমার মনে প্রবেশ করে। সারা নাক্ষত্রিক বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ সাধন করে এই অদ্ভুত সুন্দর রাঙা ফলগুলি! রঙের কি তীক্ষ্ম কনট্রাস্ট! চিক্কণশ্যাম আপেল ফলের মতো গড়ন অবিকল, তবে পাকা আপেল হয় হলদে-লাল মেশানো–এর একেবারে সিঁদুরের মতো রং।
    এর মধ্যেই বিশ্ব। এই মাকাল ঝোপের নীচেই। এই যে মাকাল-পাতাগুলো এদিক ওদিক  অদ্ভুতভাবে ঝুলছে গাছ থেকে পড়ে, তার গাঁটে গাঁটে পাকা ফল, এই যে রহস্যময় সুন্দর দৃশ্য যার দিক থেকে চোখ ফেরানো যায় না, অবাক হয়ে বিমুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতে হয়- এই সৃষ্টির আইডিয়ারূপী বীজ কার মধ্যে ছিল? কোন দেবতা তিনি? কত বড় শিল্পী তিনি ?
                                     ‘ কল্পনাসৃষ্টিবীজঞ্চ ‘।
     কার মহতী কল্পনার মধ্যে এ সুন্দর মাকাল-লতার দুলুনি, এর শ্যামপত্রগুচ্ছ, এর টুকটুকে রাঙা, সুগোল, সুঠাম ফলগুলো ছিল বীজ রূপে অধিষ্ঠিত? বাষ্পাগ্নিপ্রোজ্জ্বল শত শত সহস্র সহস্র লক্ষ কোটি নীহারিকা যিনি সৃষ্টি করেছেন, সেই মহারুদ্রের ভয়ালরূপ কোথায় মহাশূ্ন্যের দূর প্রান্তে ; আর কোথায় এই ক্ষুদ্র পৃথিবী- গ্রহের এক কোণে সুনিভৃত নির্জন লতাবিতান, সূর্যের সে বিরাট হাওয়ার বাষ্পতেজ বহুমাইল ব্যাপী বায়ুমন্ডলের মধ্য দিয়ে, সজল বর্ষার মধ্য দিয়ে, বনকুসুমের সুবাসের মধ্য দিয়ে পরিশ্রুত হয়ে মোলায়েম হয়ে প্রভাতের রৌদ্ররূপে যে লতাবিতানকে আলো করেচে,- আর তারই মধ্যে এই সুন্দর চিক্কণ, সুস্পষ্ট, রাঙা মাকাল-ফল লতাগ্রভাগে দোদুল্যমান! 
যিনি অগ্নিতে, যিনি জলেতে …
যিনি মহারুদ্র, তিনি চির প্রাচীন অথচ চির তরুণ পুষ্পধন্বা দেবতা… সৃষ্টি বজায় রাখতে কামদেবের আবির্ভাবের প্রয়োজন হয়তো।“ 
     দ্বিতীয় গল্পটিতে গল্পকথক কুশল পাহাড়ীর ভৈরব থানে বেড়াতে গিয়েছিলেন। পথের বর্ণনাতেই বিশ্বরহস্যের ইঙ্গিত: ‘পথের শেষ নেই, অরণ্যের শেষ নেই, মুক্ত শৈলমালা বেষ্টিত ভূমিশ্রীরও শেষ নেই, প্রান্তরেরও শেষ নেই। বনে বনে ময়ূর, বনে কোটরা ভালুক, লেপার্ড।… বর্ষার দিনে পথের এই সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। সেদিন ভাবছিলুম, আজ এ বন যেন শেষ না হয়। শেষ হলেই তো মায়া ফুরিয়ে যাবে।‘ 
      তারপর কুশল পাহাড়ীতে পৌঁছে প্রবীণ সাধুর মুখে ঈশোপনিষদের ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে এক অলৌকিক জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করে ভাবলেন এই ব্রহ্মজ্ঞ ঋষির কাছে প্রকৃত শান্তি পাওয়া যাবে। সাধুজীর মুখে উচ্চারিত হল ঈশ্বর স্তুতি :
             
            “   ‘কবির্মনীষী পরিভু : স্বয়ম্ভু ‘ …কবিই তিনি বটেন বাবা। এখানে বসে বসে দেখি। এই শালগাছটাতে ফুলফোটে, বর্ষাকালে পাহাড়ে ময়ূর ডাকে, ঝর্ণা দিয়ে জল বয়ে যায়, তখন ভাবি কবিই বটেন তিনি। … তাঁর এই কবিরূপ দেখে ধন্য হয়েচি।‘

     পৃথিবীর ও মানুষের অপার জীবন রহস্য ও জটিলতায় এই কবি বিস্মিত ও মুগ্ধ । তাঁর আস্থা কবিতার চিরন্তন সৌন্দর্যে। শিল্পচর্চার মাধ্যমেও তিনি ঈশ্বরের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন। এটাও একটা পথ। সারা জীবনের তপস্যা। জীবনের জটিলতায়, নিঃসঙ্গতায়, একাকিত্বে বিষাদে রক্তাক্ত হয়ে আশ্রয় চেয়েছেন কবিতার কাছে। কখনো তাঁর মনে জেগেছে, কুরে কুরে খেয়েছে অস্তিস্তবাদের দর্শন। চারপাশের আগুনের মাঝখান দিয়ে হেঁটে পৌঁছাতে চেয়েছেন দারুচিনি দ্বীপে। বিশ্বাসের বিশল্যকরণীতে। যেখানে শস্যফলনের হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ধরিত্রী।
                                           ( আগামী পর্বে শেষ হবে )

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments