জ্বলদর্চি

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় /পর্ব - ১২ / দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় 
পর্ব - ১২                                

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী    

১৯৩০ সালে জানুয়ারী মাসের তীব্র শীতে গওহরজান শারীরিক দিক দিয়ে অসুস্থ হয়ে মহীশূরের কৃষ্ণরাজেন্দ্র হাসপাতালে ভর্তি হলেন। তবে শারীরিক অসুস্থতার থেকেও মানসিক অবসাদ ও হতাশায় তিনি যেন মৃত্যুর পথে এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রচন্ড জ্বরে তিনি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মহীশূর রাজপ্রাসাদ থেকে যদিও তাঁর চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোন ত্রুটি রাখা হয়নি কিন্তু অত্যধিক মানসিক হতাশায় গ্রামোফোন কোম্পানির এক নম্বর সেলিব্রিটি, ভারতীয় সংগীতের সম্রাজ্ঞী, কলকাতার মিস গওহরজান ১৯৩০ সালের ১৭ই জানুয়ারী মাত্র ৫৭ বৎসর বয়সে চির নিদ্রায় ঢলে পড়লেন। কৃষ্ণরাজেন্দ্র হাসপাতালের এক নির্জন কোণের শয্যায় একাকী নিঃসঙ্গ অবস্থায় চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। সারা জীবন যে গওহরজান অগণিত সংগীত রসিকের হৃদয়ের মনি ছিলেন তাঁর মৃত্যুর সময়ে তাঁর শয্যার পাশে দুফোঁটা চোখের জল ফেলারও কেউ ছিলনা।                   

২৮শে জানুয়ারী, ১৯৩০ সালে কলকাতার 'স্টেটসম্যান' পত্রিকা গওহরজানের মৃত্যু সংবাদ পরিবেশন করে লিখেছিলেন "মহীশূরের মাদাম গওহরজানের মৃত্যুতে ভারতীয় সঙ্গীত জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো তিনি মহীশূরের মহারাজার সভা গায়িকা ও নর্তকী ছিলেন ১৮৭৩ সালে আর্মেনীয় পিতা ও ভারতীয় মাতৃত্বে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর বাবা রবার্ট উইলিয়াম ইয়েওয়ার্ড একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং মা অ্যাডেলিন ভিক্টোরিয়া হেমিংসের মেয়ে গওহরজানের পূর্ব নাম ছিল এলিন অ্যাঞ্জেলিনা ইয়েওয়ার্ড। তাঁর জন্মের ছয় বৎসর বয়সে তিনি ও তাঁর মা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে বেনারসে চলে আসেন এবং গওহরজান এবং মলকাজান নামে পরিচিত হন। ১৮৮৩ সালে তিনি ও তাঁর মা হায়দ্রাবাদের নিজামের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতায় চলে আসেন এবং সারা জীবন সেখানে কাটান। ব্যতিক্রম ছিল দু'বছর বোম্বেতে এবং শেষের দু'বছর মহীশূরে। গায়িকা হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি তাঁকে 'ভারতের বুলবুল' নামে অভিহিত করেছিল এবং গ্রামোফোন কোম্পানী যখন ভারতীয় ভাষায় গান রেকর্ড করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন তাঁকেই প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিলেন।" 
                                                               


গওহরজান নিজের চেহারা নিয়ে এবং সাজসজ্জা নিয়ে খুব সচেতন ছিলেন এবং সাজসজ্জার ব্যাপারে খুব পরিপাটি ছিলেন যার জন্য মঞ্চে উঠলে প্রচারের সব আলো তিনি একাই গ্রহণ করতেন। শোনা যায় মঞ্চে অনুষ্ঠানে আসার সময় তাঁর বাঁ কাঁধে একটি বহুমূল্য হীরের ব্রোচ লাগিয়ে আসতেন এবং সেই হীরের নিরাপত্তা জন্য তাঁর দুদিকে দুজন বন্দুকধারী সিপাই দাঁড়িয়ে থাকতেন। তাঁর গায়ের রঙের সাথে মানানসই পোশাক পরতেন এবং একই পোশাক ও গহনা পরবর্তী কোন অনুষ্ঠানে পুনরায় পরে যেতেন না। তাঁর নিজস্ব ছয় ঘোড়ায় টানা দামি ফিটন গাড়ীতে দামি সিল্কের পর্দা লাগিয়ে তাঁর সেরা পোশাক ও গহনায় সজ্জিত হয়ে প্রায়ই তিনি কলকাতার রাস্তায় শুধু ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করার জন্য বেরোতেন। একবারের ঘটনা। এক সন্ধ্যায় গভর্নরের সারি সারি ফিটন গাড়ি গওহরের ফিটন গাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় তাঁকে কোন রাজ পরিবারের বা সম্ভ্রান্ত মহিলা ভেবে গভর্নর গাড়ি থেকে নেমে টুপি খুলে অভিবাদন জানিয়ে ছিলেন। পরে যখন গভর্নর জানতে পারেন যে গওহর একজন বাঈজী তখন তিনি গওহরের বিরুদ্ধে আইন অমান্য করার জন্য এক হাজার টাকা জরিমানা করেছিলেন, কারণ সেই সময়ে আইন ছিল গভর্নর বা রাজ পরিবারের কোনো সদস্য ব্যতীত অন্য কেউ ফিটন গাড়িতে চেপে যাতায়াত করতে পারতেন না। বলাবাহুল্য আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ফিটন গাড়িতে যেয়ে এক হাজার টাকা জরিমানা দিয়েছিলেন। এই রকমই ছিল তার অহংকার। 

আবার বিভিন্ন সময়ে গওহরজান তাঁর ব্যবহারের জন্য পরে অনুতপ্ত হয়েছিলেন। দাতিয়াতে অনুষ্ঠানের জন্য দাতিয়ার মহারাজাকে একটি সম্পূর্ণ ট্রেনের ব্যয় ভার বহন করতে হয়েছিল সে কথা পূর্বে উল্লেখ করেছি। সেই অনুষ্ঠানটি ছিল দাতিয়ার যুবরাজের রাজ্যাভিষেকের। গওহর এবং তাঁর দলবল দাতিয়াতে যেয়ে দেখলেন সারা শহরকে খুব সুন্দর ভাবে সুসজ্জিত করা হয়েছে এবং দেশের বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পীরা সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। একটি বিলাসবহুল প্রাসাদে গওহরের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল এবং দিনপ্রতি তাকে দু হাজার টাকার পারিশ্রমিক দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অভিষেক অনুষ্ঠানে অন্যান্য শিল্পীদের অনুষ্ঠানের পরে গওহরকে কিন্তু গান গাইবার কোন সুযোগ না দিয়ে অনুষ্ঠান পর্ব শেষ হয়েছিল। এই রকম ব্যবহার পেয়ে গওহর খুব মুষড়ে পড়লেন অথচ মহারাজ প্রতিদিনই পারিশ্রমিকের টাকা ও দামি দামি উপহার পাঠাতে লাগলেন। তিনি বুঝতে পারলেন না কেন তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে গান গাইতে দেওয়া হচ্ছে না। একদিন তিনি পুরুষের বেশে সজ্জিত হয়ে মাথায় সিল্কের চাদর জড়িয়ে দুর্গের প্রবেশদ্বারে মহারাজ যখন ঘোড়ায় চেপে প্রাতঃর্ভ্রমণ করে প্রবেশ করছেন তখন বিচারপ্রার্থী হয়ে তিনি তাঁকে অভিবাদন জানালেন। গওহরকে এই সময়ে দুর্গ দ্বারে দেখে মহারাজ তার অপেক্ষা করার কারণ জিজ্ঞেস করতে গওহর অনুতপ্ত হয়ে মহারাজকে বললেন তিনি নিজের শিল্পের অহংকারে অন্ধ হয়ে তাঁর কাছে সংরক্ষিত ট্রেনে আসার দাবী করেছিলেন। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে না দেওয়ার কথা উল্লেখ করে বললেন একজন সংগীতের শিল্পীকে অনুষ্ঠান করতে না দিলে তার মর্মবেদনা কিরকম হয়। মহারাজ বুঝতে পারলেন তিনি গওহরের গর্বের ফানুস উড়িয়ে দিতে পেরেছেন এবং সেইদিন সন্ধ্যায় গওহরের অনুষ্ঠান করার অনুমতি দিলেন। 

সেই সন্ধ্যায় গওহর তাঁর জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছিলেন এবং তার পরেও তিনি দাতিয়াতে ছয় মাস থেকে গিয়েছিলেন। সেখানে থাকাকালীন তিনি কিরানা ঘরানার উস্তাদ মওলা বক্সের কাছে তালিম নিয়েছিলেন। ফিরে আসার সময় মহারাজ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি কি উপহার আশা করেন। যে উপহার চেয়েছিলেন মহারাজ তাঁকে মেয়ের মতো সেই উপহার দিয়েছিলেন। আসার সময়ে মহারাজা ও তাঁর গুরু পন্ডিত কুদু সিংহের পদতলে প্রণাম জানিয়ে এবং তার পূর্বের ব্যাবহারের জন্য অনুতপ্ত হয়ে চোখের জলে বিদায় নেবার সময় বলেছিলেন ভবিষ্যতে মহারাজ যখনই তাঁকে ডাকবেন তখনই তিনি দাতিয়াতে আসবেন। মহারাজ আশীর্বাদ করে গওহরকে একটি সুন্দর উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন "গওহর, শিল্প ও কলার জগতের সাফল্য সাময়িক। আজ তুমি সংগীতজগতের সম্রাজ্ঞী কিন্তু জীবন পথের তুমি একজন সাধারণ পথিক মাত্র। সংগীত জগৎ নদীর জলের মত প্রবহমান। কিছুদিন পরে সঙ্গীতের জগতে তোমার স্থান অন্য কেউ নিয়ে নিবে। অহং বা আমিত্ববোধকে বিসর্জন না দিলে একজন প্রকৃত সংগীত শিল্পীর জন্ম হয় না। প্রশংসা বা তোষামোদকে কখনো মনের গভীরে যেতে দিও না।" তাঁর উপদেশ গ্রহণ করে গওহর পরবর্তী জীবনে নিজের ব্যবহারের পরিবর্তন এনেছিলেন।                      

ইন্দোরে একবার গওহর অনুষ্ঠান করতে যেয়ে দেখলেন একটি বিরাট মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছে। অনুষ্ঠানের শেষে তাকে উপহার ও সাম্মানিকের পরিবর্তে ইন্দোরের রাজা ঘোষণা করলেন পুরো মঞ্চ গওহরকে উপহার দেওয়া হবে। এই ঘোষণা শুনে গওহর খুব বিস্মিত হলেন। কিন্তু যখন মঞ্চের উপরের কাপড় ও ফুলের সাজ সরিয়ে নেওয়া হলো  তখন দেখা গেল সাদা চাদরের তলায় গওহরের জন্য অপেক্ষা করছে এক লক্ষ মুদ্রা এবং সম্পূর্ণ অর্থ গওহরকে দেওয়া হল। এক্ষেত্রে দাতিয়ার মহারাজার উপদেশ স্মরণ করে গওহর বললেন মহারাজ আমি সংগীতের সাধিকা আমি আপনার উপহার আন্তরিকভাবে গ্রহণ করছি কিন্তু আমি এই অর্থ গরিবদের মধ্যে বিতরণ করতে ইচ্ছুক। এই কথা শুনে গওহরের প্রতি ইন্দোরের রাজার সম্মান ও শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। রাজা ভাবলেন গওহরজান শুধুমাত্র সংগীতেরই সম্রাজ্ঞী নন, তিনি মনের দিক দিয়েও একজন উচ্চস্তরের মানুষ। গওহরজান যে সত্যিই সঙ্গীত জগতের সম্রাজ্ঞী ছিলেন তার পরিচয় আমরা পাই তার সময়ের কয়েকটি ঘটনায়। প্রথমটি হল ১৯১১ সালে। 
                                                            ক্রমশঃ…….

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments