জ্বলদর্চি

টান /শ্রীজিৎ জানা

টান

শ্রীজিৎ জানা


রোদ্দুর ফিরে যাচ্ছে বাড়ি। অস্তাচলের পিছনে তার ঘর। শেষ পথটুকু সে হেঁটে যাচ্ছে শ্লথপায়ে।
সারাদিনের ক্লান্তিতে তার চোখমুখের ঔজ্জ্বল্য যেন ম্রিয়মাণ। অথবা যেন গভীর এক পিছুটান তার পথ আগলে রেখেছে। যেন এক নাছোড় বালক তার মায়ের আঁচল টেনে ধরেছে যেতে দেবো না বলে। তাকে খুশি করতেই দূরের মাঠে,পুকুরের জলে,গাছের ডালপালায়,আকাশের উঠোনে ছড়িয়ে দিয়েছে পাকা কুমড়ো রঙের রোদের হাসিখুশি। চিলতে আভাটুকু চরাচরের গায়ে লেপ্টে আছে যেন মায়ার মতো। ঈশিকাও জড়িয়ে থাকতে চায় সংসারে। প্রতি মুহুর্তে অর্কর সাথে। একটুকু দুরত্ব তার নাপসন্দ। মন খারাপের বাতাস হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ুক তার সংসারে ঈশিকা চায় না কক্ষনো। এমন কি অর্ক আর তার মাঝে কোনরকম শূন্যস্থান কোনভাবেই বরদাস্ত করবে না সে।

ঈশিকার ছোটবেলা মানেই পুবদিকের দুয়ারে এক রূপকথার দেশ। সেখানে রোজই তার পুতুলের বিয়ে হয়।কোনদিন রাজপুত্তুর-রাজকন্যা,কোনদিন রাজা-রানী।আবার কোনদিন টুকাই-তুতুলের বিয়ে।যেদিন যার বিয়ে সেদিন তাদের মতো করে সাজপোশাক আসে। মায়ের উপর ছোট্ট ঈশিকার জোরজুলুম চলে। মায়ের সাজবার এটা ওটা নিয়ে সাজিয়ে তোলে তার খেলাঘরের বরকনেকে। তবে বর ও কনে পক্ষের লোক বলতে সে একাই একশো। দেখাশুনো থেকে কনে বিদায় একাই সব চরিত্রে সমান তালে সংলাপ আউড়ে যায়। বিয়ে বাড়ির ভোজেও থাকে এলাহি আয়োজন। মাছ, মাংস,তিন-চার রকমের তরকারি সাথে চাটনি দই মিষ্টি পাঁপড়, আইসক্রিম, মুখশুদ্ধি কিছুই বাদ থাকে না। একআধ দিন মুড ভালো থাকলে পাশের বাড়ির রিনিয়াকে নেমতন্ন দ্যায়।

ঈশিকার চোখে থেকে সেই ছোট্টবেলা কোনভাবেই মুছে যায় না। ফাঁক পেলেই ফুড়ুৎ পাখি হয়ে এক চোক্কর ঘুরে আসে পুবের দলিজদুয়ার থেকে। তার বরবউদের কক্ষনো ঝগড়াঝাঁটি হয় না। একটুআধটু যদিও ঠোকাঠুকি হয়,ঈশিকা তৃতীযপক্ষ হোয়ে সমাধান করে দ্যায়। ঠাকুমার মুখ থেকে শোনা একটা কথা বরপুতুল আর বউপুতুলকে মুখোমুখি রেখে শুনিয়ে দ্যায়। প্রথমে বরপুতুলের দিকে চেয়ে গিন্নির মতো চোখ নাচিয়ে বলে,
---অগ্নি সাক্ষী করে বে করেছো। সারাজেবনের ভাতকাপড়ের ভার নিয়েছো। মাথা গরম করলে চলবে?
তারপর বউপুতুলকে বলে উঠে,
---সোয়ামী হোলো গুরুজন। তাছাড়া পুরুষমানুষের একটুতেই  মাথা গরম হয়। সব কী গায়ে মাখনে চলে? নাকি মনে রাখলে চলে?
শেষে দুজনেরই উদ্দেশ্যে বলে উঠবে ঈশিকা গিন্নি,
---সংসারে হাঁড়ি-কলসী থাকলে ঠোকাঠুকি হবেই। ওতে রাগারাগি করতে নেই। দুজনে ক্যামন মিলেমিশে থাকবে জোড়াশালিক হয়ে,তবেই না!

বিয়ের প্রথম রাতেই ঈশিকা এই গল্প শুনিয়েছে অর্ককে। গায়ে তখন রজনীগন্ধার মিহি সুগন্ধ। কনে সাজে আলো ছড়াচ্ছে ফুলসজ্জার ঘরে।নরম গোলাপী আলোয় দুজনেই প্রেমরাগে অথৈ ডুব ডুব।কখন অর্কর গায়ে লতার মতো লতিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি ঈশিকা। দুটো হাতের ফাঁসে আটকে পড়েছে নাকি নিজে থেকেই সমর্পিত বোঝা দায়।তাদের সদরপুকুর পাড়ে করঞ্জ গাছকে যেভাবে জড়িয়ে ধরে থাকে স্বর্ণলতা।যেন গাছের সমস্ত স্বত্বাকে নিজের শরীরে শুষে নিতে উদগ্রীব। ঈশিকার আলিঙ্গন ভঙ্গিমা যেন সেই তীব্র অথচ অনুরাগভরা। এমন প্রগাঢ় মুহুর্তের মাঝে  তার আদুরে স্বরক্ষেপের বরবউ পুতুলের গল্প সযত্নে ঠাঁই পায়।

--আচ্ছা লাভবার্ডসের পাখি আসলে কোন পাখি?জানো তুমি? আমরা জোড়াশালিক হব।
অর্ক কোন উত্তর করে না। শুধু তার আঙুলগুলো হেঁটে যায শরীরময়। তারাদের খসে পড়ার মতো একে একে  আবরণ খসে পড়ে ঈশিকার শরীর থেকে।
---জানো তো জোড়াশালিক খুব পয়মন্ত হয়। জোড়া শালিক দেখলে দিন ভালো কাটে সবার। জোড় হাত করে সবাই বলে ,জোড়া শালিক নমস্কার/পা দুখানি পরিস্কার/মাথা দুটি কালো/ দিন কাটবে ভালো
আদরের আর্দ্রতায় ভেজা শেষের স্বর যেন ধীর লয়ে বেজে উঠে ঈশিকার ঠোঁটের বাঁশিতে।আশ্চর্য এক শিহরন তাকে গিলে খাচ্ছে অজগরের মতো। আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠার মতো চমক ভাঙে ঈশিকার। ঠাকুমা সৌদামিনীর কথা কানে বেজে উঠে।
সৌদামিনী ঠাকুমা ঈশিকার বান্ধবী। বয়সের আকাশ-পাতাল সেই ছোট থেকেই মিশে গ্যাছে গভীর সখ্যতায়। ক্লাস নাইন থেকেই সৌদামিনী আর সে রাতে এক বিছানায় শোয়। তখন ইশিকার শরীর অদৃশ্য কোন কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীর হাতে গড়ে উঠছে অপরূপ সৌকর্যে। সেই প্রথম যেদিন ঈশিকা তার প্যান্টির ভিতর কালচে রক্তের ছোপ দেখে আঁৎকে উঠে,সেদিনও ছুটে আসে সৌদামিনীর কাছেই।সৌদামিনী নাতনিকে বোঝায় রক্ত-ফাগুনের রূপকথা,
--কাঁদতে নাই দিদিভাই।মেয়েদের এমন হয়।তুমি এবার সত্যিই বড়ো হলে। সত্যিকারের মেয়ে হলে।
অত কথার মানে বুঝে উঠতে পারেনি ঈশিকা। কিন্তু ধীরে ধীরে সৌদামিনীই হয়ে উঠে তার সুখ-দুঃখের সহচরী। কত কথা,কত কথা -তার ইয়ত্তা নেই। স্বামী-স্ত্রী,ঘরকন্না, যৌনতা সবেতেই সৌদামিনীর অভিজ্ঞতার অন্ত নেই। সেই কথাগুলোই হঠাৎ করে এমন চরম ভালো লাগার মুহুর্তে ঈশিকা শুনতে পায় ভিতর থেকে,
---পথমেই শরীর দিতে নাই সোয়ামীকে। সবটা তো একেবারেই নয়। শরীরের জাল ফেলে মনটাকে আগে ঘেরতে হয়।
---জাল ছিঁড়ে যদি সে পালায়
---শরীর জাল কিন্তু মন তো পুকুর। জাল ছিঁড়লেও বাছাধনকে পুকুরেই থাকতে হবে।
----যদি না ঘেরে রাখতে পারি?
----না পারলে সব হারাবি। শরীরের ধস্মই হোলো নতুন নতুন  শরীর খুঁজে বেড়ানো। সবার সবই এক। না হয় কারো একটু ছোট, কারো একটু বড়। কিন্তু চোখের নেশায় সব পুরুষদেরই চরিত্তির ঠিক থাকে না। তাই বেশ করে মনের খুঁটে সোয়ামীকে গিঁট দিয়ে রাখবি। দুদিকে সামান্য হেলদোল হলেই টান লাগবে একেবারে গোড়ায়।
---কিন্তু এমন করে রাখা মানে তো জোর করে রাখা। জোর খাটিয়ে কদ্দিন সম্পর্ককে বাঁচানো যাবে বলো?
---অ্যাকে জোর বলে না দিদি। নিজের জিনিসকে আগলে রাখার নাম জোর হয়।
---তুমি যে বলো কেউ কারো নিজের নয়।
----সে তো নয়ই। তবু নিজের ভাবতে,নিজের করে রাখতে একটা আলাদা তৃপ্তি আসে মনে। মনের সেই তৃপ্তিটুকু নিয়েই তো বেঁচে থাকা জীবনভর।
ঈশিকা অবাক হোয়ে চেয়ে থাকতো তার ঠাকুমার মুখের দিকে। গাঁয়ের প্রাইমারী স্কুল অব্দি পড়া মহিলাটির জীবন সম্পর্কে  কী অসম্ভব অনুভব। তার একটা কারণ দাদু মারা যাবার পর থেকে নানানিধি বই পড়ার অভ্যেস। মাঝে মাঝেই দাদুর কথায় ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলত সে। ঈশিকা চোখ মুছোতে মুছোতে হাসি মাখিয়ে বোলতো,
---সোয়ামীকে খুব মনে পড়ছে বুঝি?
---তুমিও একদিন বুঝবে দিদি। টান কী জিনিস! বয়েস যত বাড়বে তত যেন টান জোরালো হবে সম্পক্কের গড়ায়।

ঈশিকা সেই রাতে অর্কর কাছে সম্পূর্ণ ধরা দ্যায় না।তবে মন ভরিয়ে দিয়েছে তার আদরের নানান অনুষঙ্গে। খিদেটাকে জিয়িয়ে রাখতে হবে শেষ অব্দি। সৌদামিনীর শিক্ষা ছিল তাই। স্বমীকে শুধুই রূপের মোহে ভুলিয়ে বেশিদিন আটকে রাখা যায় না।গাছ যত ঊর্ধ্বে বাড়ে, মাটির গভীরে শিকড় ততই ছড়িয়ে যায়।শরীরে রূপরস থাকতেই মনের সাথে মনের গাঁটছড়া বেঁধে নিতে হয়। চোখের চাহুনি দিয়ে,সাজগোজের বাহার দিয়ে,কথার মাধুর্য দিয়ে,একসাথে চলার বন্ধুতা দিয়ে,সেবার ঔদার্য দিয়ে,বিশ্বাস আর পারস্পরিক শ্রদ্ধার খড়কুটো দিয়ে একটা সুখী সংসার গড়ে উঠে। সেখানে সম্পদ শুধু প্রয়োজনের জন্য,অত্যাবশ্যক চাহিদার দাবানল হয়ে সম্পর্ককে পুড়িয়ে ছারখার করে না।

বরাবরই গুছিয়ে সংসার করতে চেয়েছে ঈশিকা। চাকুরীবাকরি করতে চাইনি সে কোনদিন। মা-বাবাও তাকে জোর করেনি। স্কুল-কলেজে দু'একজন ভাললাগার কথা জানালেও সে এড়িয়ে গ্যাছে সযত্নে। পুতুলখেলার ঘরের মতো সে চেয়েছে দেখাশুনো করে কনেসাজে সেজে ধুমধাম করে বিয়ের মন্ডপে বসবে সে। বিদায়ের করুণ সুরে বেজে উঠবে সানাই,সবার চোখ থেকে জল ছলকে পড়বে,শাঁখ আর উলুধ্বনি ছাপিয়ে বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ির যাবার হর্ষবিষাদ আবহে সে বিদায় নেবে সকলের কাছ থেকে। সব রীতি-রেওয়াজ হবে নিয়মমতো। হয়েছেও তাই সব। এই অব্দি তার পুতুলের বিয়ের সাথে হুবহু মিলে গ্যাছে। এমন কী অর্ককেও তার মনের মতো লেগেছে।

ঢেউদল দূরে গিয়ে আবার ফিরে আসে তীরে। পাখি দিনমান উড়াল দিয়ে  মগডালের ছোট্ট নীড়ে বিরাম দ্যায় তার পাখসাট। রাতটুকু কাটিয়ে পুব কোণে আলোর প্রকাশে ব্যক্ত হয় ঘরে ফেরার ব্যকুলতা।এর নামই বোধকরি পিছুটান। মায়া অথবা মোহ।ঈশিকা এই সবের ভিতর নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। অর্ককে জরিপ করে।
সবেমাত্র  তাদের বিয়ে হয়েছে ছ'মাস। অফিস যাওয়ার সময় আগের মতো অর্ক তাকে চুমু খেল কিনা। ইশারায় তাকে শোবার ঘরে ডেকে নিল কিনা।অফিসে পৌঁছে ফোন। অফিস আওয়ারের মাঝে কয়েকবার ফোনে কথা বিনিময় করল কিনা।উইকএন্ডে একটু কাছেপিঠে ঘুরতে নিয়ে গেল কিনা। মাঝেসাঝে কফি-রেস্তোঁরায় নিয়ে যাচ্ছে কিনা।  শপিং করলে বিরক্ত হচ্ছে কিনা। মাসের এপিঠে ওপিঠে বাপের বাড়ি যাওয়াতে আপত্তি কিনা।সবের চুলচেরা হিসেব ঈশিকা মনে মনে কষে। অর্ককে বুঝতে দ্যায় না।

আজ কাল কেন অর্ক তাকে আগের মতো জড়িয়ে ঘুমোয় না! কেন তুমুল যৌন সঙ্গম শেষে মুখ ফিরিয়ে ডুবে যায় গভীর ঘুমে!যেন শরীরটুকু পেলেই হোলো তার। ঈশিকা বুঝতে চায়। ইচ্ছে করেই রাগ করে। কথা বন্ধ করে দ্যায়। আর অপেক্ষা করে অর্ক এসে তার রাগ ভাঙালো কিনা! কখনো শরীর খারাপের ভান করে শুয়ে থাকে। সময় গোনে কখন অর্ক এসে তার কপালে হাত ছোঁয়াবে। ব্যকুল হবে তার অসুস্থতা নিয়ে। 
ঈদানীং এসবের মধ্যে ঈশিকা ইচ্ছে করেই ছন্দপতন খুঁজে পায়।আবার কখনো নিজেই নিজেকে ধমক দিয়ে বলে,
---ঈশিকা,তুই একটু বেশিই ভাড়াবাড়ি করছিস। বেশি ভেবে ফেলছিস।
কিন্তু পরক্ষণেই আবার আগের ভাবনায় তলিয়ে যায়। অর্ক কিছুটা আন্দাজ করতে পারে। ঈশিকার কাছে জানতে চায়,
---কদিন ধরেই দেখছি, তুমি ভীষণ আনমনা। কিছু কি হোলো?
---না তো
---বল্লেই হোলো!দেখছি, ক্যামন যেন তুমি পালিয়ে বেড়াচ্ছো আমার থেকে!
---সেইটা তো আমারো মনে হচ্ছে খুব!
---তুমি তো জানো বেসরকারি সংস্থার ওয়ার্ক লোড ক্যামন? তাছাড়া দিনের শেষে তো তোমার কাছেই ফিরে আসি। একটু তো শেয়ার করতে পারতে!
---তুমিও তো বলোনি তোমার মনের কথা।
---দুটো মন কাছাকাছি না এলে কী করে বিনিময হবে বলো পরস্পরের অনুভূতিগুলো!
---তাহলে বোলছো দুটো মন এখনো কাছাকাছি আসেনি।
---এসেছে বলেই হয়তো দুজনের মনের গোড়ায় একই টান পড়েছে।

ঈশিকা কথা হারিয়ে ফেলে।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অর্কর দিকে। আবার তার কানের কাছে ভাসছে সৌদামিনীর কথা। সত্যিই কি সে অর্ককে বাঁধতে পেরেছে মনের খুঁটে!  জাল ছিঁড়ে পালানোর ভয় তার করতে হবে না। পুকুরের মায়ায় বাঁধা থাকবে অর্ক আপনা থেকেই।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments