জ্বলদর্চি

কালীপদ চৌধুরী (ব্যাকরণবিদ, শিক্ষক, লেখক, পত্রিকা সম্পাদক) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৭

কালীপদ চৌধুরী (ব্যাকরণবিদ, শিক্ষক, লেখক, পত্রিকা সম্পাদক)

ভাস্করব্রত পতি

কচিকাঁচাদের কাছে তিনি প্রিয় দাদু। আর বাকিদের কাছে 'শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই'। বয়সের পার্থক্য থাকলেও তিনি আপন করে নেন ছেলে বুড়ো সকলকেই। তাঁর মিস্টি হাসি আর স্নেহভরা আদর যে পেয়েছে সে ভাগ্যবান। এহেন মানুষটির কিন্তু এইটুকুই পরিচয় নয়। কর্মগুণে তিনি হয়ে উঠেছেন 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'।

তিনি পড়তে ভালোবাসেন। পড়াতেও ভালোবাসেন। বই ভালোবাসেন। আর সেই ভালোবাসার অন্দরমহলকে জাগাতে প্রতিষ্ঠা করেছেন গ্রন্থাগার। নিজের উপার্জনের অর্থেই তাঁর এই গ্রন্থাগারের কঠিন উপপাদ্য অতি সহজে প্রতিভাত। হাতের কাছে, চোখের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন বই। আপামর পাঠকের জন্য। জ্যামিতি, পরিমিতি আর ত্রিকোনমিতির যাবতীয় কঠিন গাণিতিক রূপ এখন 'গ্রন্থলোক'-এর অন্দরমহলে। "মুখবই" মুখো বাঙালিকে "বইমুখো" করতে তাঁর অপরিসীম প্রয়াস। এই লড়াই তাঁকে অনন্য করে তুলেছে। পড়তে ভুলে যাওয়া মানুষদের জন্য তিনি বানিয়েছেন গ্রন্থাগার! সারা জীবনের সংগ্রহ করা সঞ্চয় তিনি ব্যায় করছেন এলাকার মানুষকে বই পড়ানোর অঙ্গীকার নিয়ে। শুধু বইকে পাথেয় করে ১৯৭৭ এ প্রথম প্রকাশ করেন হাউর সাহিত্য পাঠচক্রের মুখপত্র 'সূর্যসারথী'। আর গত ২০০৬ থেকে নিয়মিত প্রকাশ করে চলেছেন লিটল ম্যাগাজিন 'মরশুমি'।

তিনি কালীপদ চৌধুরী। বাংলা ভাষার মানুষজন একডাকেই তাঁকে চেনেন। পূর্ব মেদিনীপুরের হাউরের এই বর্ষীয়ান মানুষটির আজ ধ্যানজ্ঞান বই। দুঃখে সুখে বই হোক মানুষের সাথী -- এই ভাবনা থেকে এক অসাধারণ লক্ষ্য নিয়ে সফলতম মানুষ তিনি। 

১৯৩৩ এর ৩১ শে ডিসেম্বর। ঘাটালের মহারাজপুরে জন্ম তাঁর। গোবর্ধনচন্দ্র চৌধুরী এবং সিন্ধুবালা দেবীর আট সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থতম। ছোট থেকেই পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তাঁকে পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক হতে সাহায্য করেছে।

ছোট থেকেই লেখালেখির ঝোঁক। ১৯৪৮ এ 'দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল' তাঁর লেখা প্রথম প্রবন্ধ। এরপর আর থেমে থাকেননি কোনো দিনই। ১৯৬৪ তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর করার আগেই সেই ১৯৫৫ থেকে দুটো বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু। তারপর তৃতীয় কর্মজীবন নারায়ণগড় হৃষীকেশ শিক্ষা নিকেতন থেকে ১৯৬৭ তে ঘোষপুর উচ্চবিদ্যালয়ে যোগ দেন। লেখালেখির কাজ কিন্তু থেমে নেই। এই বিদ্যালয় থেকেই ১৯৯৩ তে অবসর নেন।

১৯৭১ এ প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস 'হার্ট পেশেন্ট'। ঠিক দু বছর বাদে ১৯৭৩ সালে বাণীসংসদ থেকে স্নেহের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য লেখেন প্রথম পাঠ্যপুস্তক "রচনা প্রসঙ্গ" ( নবম দশম )। যা আজও নিয়মিত ছাত্র ছাত্রীদের জন্য প্রকাশিত হচ্ছে টানা ৫০ বছর ধরে! নবম দশম শ্রেণীর জন্য শুরু হলেও ১৯৮৯ তে সপ্তম অষ্টম শ্রেণীর, ১৯৯২ তে একাদশ দ্বাদশ শ্রেণীর জন‌্যেও প্রকাশ শুরু করেন। এখন তো কচিকাঁচাদের জন‌্যেও কালীপদ চৌধুরীর ব‌্যাকরণ বই বাজারে মিলবে।

'রচনা প্রসঙ্গ' বইটির বহু সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরাতে। এই বই ছাত্রছাত্রী মহলে ব্যাপক জনপ্রিয় এখনও। এই দীর্ঘ সময় ধরে 'রচনা প্রসঙ্গ' ছাড়াও ছাত্র ছাত্রীদের জন্য তিনি লিখেছেন 'বাংলা ব্যাকরণ', রচনা প্রসঙ্গ ( নির্মিতি), মাধ্যমিক বাংলা ( নির্মিতি), মাধ্যমিক বাংলা ব্যাকরণ, বাংলা সহায়িকা, বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা প্রসঙ্গ, সাহিত্য প্রসঙ্গ, সহায়ক পাঠ প্রসঙ্গ, বাংলা ব্যাকরণ প্রসঙ্গ, বাংলা নির্মিতি প্রসঙ্গ, ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গ ইত্যাদি ব্যাকরণের বই। প্রতিটি বই ছাত্র ছাত্রীদের কাছে দারুন মূল্যবান। বই লিখেই প্রাপ্ত অর্থের অংশ দিয়ে বানিয়েছেন মানুষের জন্য গ্রন্থাগার। তিনি তাঁর এই অসামান্য কীর্তিতে সব সময় পাশে পেয়েছেন সহধর্মিনী উষারাণী চৌধুরী, দুই ছেলে এবং বেশ কিছু প্রিয়জন ও গুণমুগ্ধদের।

হাউর স্টেশনের থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে গড়ে উঠেছে তাঁর স্বপ্নের গ্রন্থাগার 'গ্রন্থলোক'। একটা অত্যাধুনিক গ্রন্থাগারের সফল দৃষ্টান্ত। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুকুট হয়ে উঠেছে এই 'গ্রন্থলোক'।
ভোগবাদী মানসিকতার মানুষজন যখন নিজেরটাই গোছাতে ব্যস্ত, তখন তিনি বই ভালোবাসেন বলেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সব ধরনের বইয়ের সম্ভার সংগ্রহ করে রেখেছেন এখানে। রয়েছে ১২৬ ধরনের অভিধানের বই। প্রায় ৮০ টি বিষয়ের দশ হাজারের বেশি বই তিনি তুলে দিয়েছেন পাঠকদের জন্য। 

প্রচুর বই লিখেছেন মেদিনীপুরের গর্ব কালীপদ চৌধুরী। এখন ৯০ ছুঁইছুঁই। তবে 'নড়বড়ে নব্বুই' নয়, 'চড়বড়ে নব্বুই'। এই বয়সেও লেখনী থেমে নেই তাঁর। বয়সের ভারিক্কি কিছুটা হলেও ছাপ পড়েছে দেহে এবং মনে। কিন্তু তবুও মন যেন কৈশোরের গন্ডী পার হয়নি। তাই এই বয়সেও এতো সজীব তিনি। উদ্যমী তিনি। 

'হার্ট পেশেন্টে'র পর লিখেছেন 'রাক্ষসী সরোবর (১৯৯২), 'বন্ধ‌্যা বিভাবরী' (২০০১), পরাবৃত্ত (২০০৭), জীবনভিলা (২০০৭), দাদু বহুরূপে (২০০৭), মড়কের রাজ্যে (২০০৯) উপন্যাসগুলি। ছোটদের সচিত্র বাংলা অভিধান, বিদ্যার্থী ইতিহাস অভিধান, বিদ্যার্থী ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান অভিধানও উপহার দিয়েছেন পাঠকদের।

বর্তমান প্রজন্মের ছাত্র ছাত্রীদের কথা ভেবে পরিবর্তন করেছেন ব্যাকরণ বইয়ের অবয়ব। হাউর স্টেশনের কাছে ২৭ শতক জমিতে গড়ে উঠেছে তাঁর এই 'তৃতীয় সন্তান। তিনি মানেন, বই হল তাঁর সেই সন্তান। তাঁর কথায়, 'সারা জীবন রক্ত মাংসের দুই সন্তানের জন্য যা করার করেছি। এবার তৃতীয় সন্তানের কিছু করতে চাই।' সেই তৃতীয় সম্ভান আজ পেয়েছে ‘গ্রন্থলোক' এ থাকার নিরাপদ আশ্রয়। 

তাঁর সাহিত্যসেবা বহু মানুষের কাছে অন্যতম অনুপ্রেরণা। সাহিত্য চর্চার দিকনির্দেশনা তাঁর হাত ধরেই। বহুলাংশে পর্দার আড়ালে থাকা নিরহঙ্কারী এবং সদাহাস্যময় মানুষটি পেয়েছেন বহু পুরস্কার। না, সরকারি তকমা এখনও জোটেনি। তাই বলে তাঁর সাহিত্যভক্ত এবং গুণমুগ্ধ ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা কিন্তু কমেনি একরত্তি। বরং বাড়ছে দিনের পর দিন। মেদিনীপুর কুইজ কেন্দ্র সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি এই মহান মানুষকে দিয়েছে "মেদিনীপুর রত্ন" (২০২২) সম্মান। এছাড়া পেয়েছেন সৃজন সম্মাননা (২০১৪), জন্মভূমি দেশরত্ন সম্মান ( ২০০৬), রক্তকরবী সম্মান (১৪২৪), লোককৃতি সম্মান (২০০৩), নারায়ণ চৌবে স্মৃতি পুরস্কার (২০০৫), মালীবুড়ো স্মারক সম্মান (২০১০), মধুসূদন স্মারক সম্মান (২০১৫), তুর্য সাহিত্য সম্মান (২০১০), কোরাস সুজন সম্মান (১৪২০) ইত্যাদি। যদিও এসব পুরস্কার তাঁর কাছে ভক্তদের শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। অকুন্ঠ ভালোবাসার ফল। তিনি পুরস্কারের জন্য কখনো কাজ করেননি। তিনি চেয়েছেন চারিদিকে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে। বাংলা ভাষায় ব্যাকরণকে সহজভাবে এবং সরলভাবে বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দিতে। সে উদ্যোগে তিনি সফল।

অনেকেই নাক সিঁটকেছেন হাউরের মতো প্রত্যন্ত এলাকায় এরকম বড় গ্রন্থাগার নির্মাণ করায়। তাঁদের তিনি ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি। তাঁর মতে, একদিন হাউরও বিখ্যাত হয়ে উঠবে এই গ্রন্থাগারের সৌজন্যে। অথচ এখানে এলে মিলবে যে কোনো বই পড়ার সুযোগ। লোকসংস্কৃতি থেকে বিজ্ঞান, ইতিহাস থেকে ভূগোল -- যাবতীয় বইয়ের হদিশ মিলবে 'গ্রন্থলোক'-এ। ছোটদের জন্যও প্রচুর সম্ভার। থাকছে ভিডিওর মাধ্যমে পাঠ্য দানের পদ্ধতিও। দৃশ্য শ্রাব্য মাধ্যমকে ব্যবহার করে কিভাবে গ্রন্থাগারকে আরও আকর্ষনীয় করা যায় তার চেষ্টা চালাচ্ছেন নিয়মিত।

না, কোনো অর্থ দিতে হবে না গ্রন্থাগারে আগত পাঠকদের। থাকছে আরও নানা সুযোগ। সেইসব পাঠকদের নিয়ে প্রতি মাসের শেষ রবিবার বসে এখানে সাহিত্যের আড্ডা। দীর্ঘদিন ধরে চলছে তা। তাঁর প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা 'মরশুমি' এখন লেখক ও  বইপ্রেমীদের স্বার্থে পৃথিবীর মুখ দ্যাখে। আসলে বই পড়লে মনের কালীমা মুছে যায়। বই পড়লে মনের কষ্টের উপশম হয়। তাই, সারা জীবনের উপার্জন খরচ করে 'তৃতীয় সন্তান' রূপী 'বই' এর রক্ষণাবেক্ষণে ব্যায় করেছেন অকাতরে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments