জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-২৮/প্রীতম সেনগুপ্ত


পর্ব ২৮

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

ঈশ্বরে তন্ময় হতে গেলে কী করতে হবে সেই বিষয়ে স্বামী তুরীয়ানন্দজী বলছেন -- “আহার, নিদ্রা, ভয়, মৈথুন এই চারেতে মানুষ পশুর সমান। Life (জীবন) যত low (নিচু) হবে, তত sense-এ (ইন্দ্রিয়ে) pleasure (আনন্দ); যত উন্নত হবে তত philosophy (দর্শন) জ্ঞানে সূক্ষ্ম আনন্দ। নিম্নস্তরের লোকেরা এসব আনন্দ বুঝতে পারে না। দেখ না, মদ খাচ্ছে, শিকার ইত্যাদি কচ্ছে। এ তো একেবারে পশুর মতন। পশুরাও তাই করছে। মানুষজীবন পেয়ে বৃত্তিকে আরও উচ্চ না করলে কি হলো? যাদের মন উঁচুতে রয়েছে তাদের মন এসবে নামে না। Impossible ( অসম্ভব)। ওলা মিছরির পানা খেলে চিটা গুড় ছ্যা হয়ে যায়। বিলাত যাবে? কি হবে গিয়ে -- বহির্মুখ করে বৃত্তিকে? খুব ধ্যান জপ করে তাতে মগ্ন হয়ে যাও। তদগতান্তরাত্মা হও, তদগতান্তরাত্মা হও। খালি ঠাকুরকে নিয়ে যদি পাঁচ বৎসর থাকতে পার তাহলে ঠিক হয়। বিলাত, এখান -- সব এক হয়ে যাবে।” (স্বামী তুরীয়ানন্দের স্মৃতিকথা, সংকলক ও সম্পাদক -- স্বামী চেতনানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়)

 শরীরের উপর অসম্ভব নিয়ন্ত্রণ ছিল তুরীয়ানন্দজীর। কেননা মনটি ছিল যথার্থ যোগীর মতো সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন। ডায়াবেটিস রোগে ভুগলেও সর্বদাই আনন্দে থাকতেন। কতটা নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল তাঁর মন একটি ঘটনা থেকে তা ধারণা করা যায়। ওঁর পিঠে একবার কার্বাঙ্কল হল। ডাক্তার অপারেশনের জন্য অ্যানাস্থেসিয়া করতে চাইলে আপত্তি জানালেন। এরপর ছুরি চালাতেই যন্ত্রণায় কাতর হয়ে বললেন, তাঁকে আগে থেকে জানিয়ে যেন ছুরি বসানো হয়। অতঃপর ডাক্তার সম্মতি চাইলে তিনি সম্মতি দিলেন। তার আগে একটু সময় নিলেন মনকে সম্পূর্ণভাবে শরীর থেকে তুলে নিতে। ডাক্তার ছুরি দিয়ে কার্বাঙ্কল কাটলেন, টিপে পুঁজরক্ত বার করলেন। ক্ষততে গজ ঢোকালেন। তুরীয়ানন্দজী বিন্দুমাত্র কাতর হলেন না। মনে হচ্ছিল কোনও প্রাণহীন জড়বস্তুর কাটাছেঁড়া চলছে। ডাক্তাররা তাঁর এই সহনশক্তি দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। এত যন্ত্রণা কীভাবে সহ্য করলেন! বস্তুতপক্ষে সন্ন্যাসের আদর্শে দীক্ষিত জনেদের কাছে তুরীয়ানন্দজীর জীবন এক আলোকবর্তিকা। গৃহস্থ ভক্তজনের কাছেও তিনি প্রেরণাস্বরূপ। আলমোড়া থেকে অতুলকৃষ্ণকে একটি পত্রে ( ১৪.৪. ১৯১৫) লিখছেন--“এখানে আসিয়া ঔষধাদি আর কিছু খাই নাই। সঙ্গে আছে, পরে দেখা যাবে। কবিরাজ রোগ সারাইব বললে ভগবান হাসেন -- মনে আছে ত ঠাকুরের কথা!  তবে ঔষধ খাইতে হয় বলিয়া খাইয়া যাই। তাঁর যা ইচ্ছা তাই পূর্ণ হয় -- ইহা নিশ্চয়। শরীর চিরস্থায়ী নয়, একদিন যাইবেই। প্রভুপদে মন রাখিয়া যাইতে পারিলেই শরীরধারণ সার্থক। সমস্তই তাঁহার হাত। যাহা করেন তাহা হইবে। তবে তিনি মঙ্গলময় এই মাত্র ভরসা।” ( স্বামী তুরীয়ানন্দের পত্র, দ্বিতীয় ভাগ, উদ্বোধন কার্যালয়) 

 বেলুড় মঠ থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ মানসপুত্র স্বামী ব্রহ্মানন্দজী গুরুভ্রাতা রামকৃষ্ণানন্দজীকে লিখছেন, “ মহাসাধু শ্রীশ্রীহরি মহারাজ এখন এখানে আছেন।” অন্যদিকে কঠোর বৈদান্তিক তুরীয়ানন্দজী শ্রীরামকৃষ্ণ মানসপুত্রকে বিপুল অধ্যাত্মশক্তির আধার মনে করতেন। সেই সময় তুরীয়ানন্দজী কাশীধামে অবস্থান করছেন।  মহারাজের এক সেবক কাশীধামে এসেছেন বিশ্বনাথ দর্শনে। তিনি স্বামী তুরীয়ানন্দজীকে প্রণামপূর্বক তাঁর আগমনের কারণ ব্যক্ত করলেন।

 তুরীয়ানন্দজী তাঁর কথা শুনে বললেন,  “ তুমি মহারাজকে ফেলে বিশ্বনাথ-দর্শন করতে এসেছ?  সাক্ষাৎ বিশ্বনাথ ছেড়ে বিশ্বনাথ দর্শন?”  তিনি এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে সেবকটি ভয়ে কোনওরকমে প্রণাম করে স্থান ত্যাগ করলেন। গুরুভ্রাতাদের মধ্যে এমনই পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল। আরেকটি চমকপ্রদ ঘটনার অবতারণা হয়েছিল। সেটি এইরকম -- পুরীতে হরি মহারাজ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ব্রহ্মানন্দজীও সেখানে আছেন। স্বভাবতই চিন্তিত। সারদানন্দজী ( শ্রীরামকৃষ্ণের অপর এক সন্ন্যাসী সন্তান) দুর্গাপদ ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা থেকে এসে পৌঁছলে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলেন। তিনি তুরীয়ানন্দজীর সেবকদের ডেকে শিখিয়ে দিলেন কীভাবে রোগীর পরিচর্যা করতে হবে। তাঁদের বললেন,  “দেখ হরি মহারাজ চটে গেলে চুপ করে থাকবে, আর বেশী চটে গেলে হাত জোড় করে বলবে, আজ্ঞে আমার অন্যায় হয়ে গেছে মাপ করুন। ” এইভাবে সেবকদের নানা পরামর্শ দিলেন। একদিন হরি মহারাজের সামনে চৌকিতে সেবক প্রিয়নাথ বসবার সময় বেশ জোরে শব্দ হল এবং হরি মহারাজ তাঁকে খুব ধমক দিলেন। সেবক এবার ব্রহ্মানন্দজীর শেখানো বিদ্যা অনুযায়ী  হাতজোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করল।  হরি মহারাজ শান্ত হয়ে গেলেন। পরে জানতে পারলেন ব্রহ্মানন্দজী সেবককে এইরকম আচরণ করতে শিখিয়েছেন। এ কথা জেনে বলেন,  “মহারাজ শিখিয়ে দিয়েছেন, তাই ফস করে বলতে পেরেছে।  দেখেছ,  মহারাজের কীরকম দূরদর্শিতা,  এইরকম অসংখ্য ব্যাপারে দেখেছি।”


 ১৯২১ সাল। ব্রহ্মানন্দজী, তুরীয়ানন্দজী ও সারদানন্দজী কাশীতে বাস করছিলেন।  একদিন মহারাজ অর্থাৎ  ব্রহ্মানন্দজী হঠাৎ সারদানন্দজীকে বললেন, “দেখ শরৎ, ইচ্ছে হচ্ছে হরি মহারাজকে প্রণাম করি। এমন মহাপুরুষ দুর্লভ।  ব্যাধির অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে তিনি কেমন সুস্থ আছেন।” ( ব্রহ্মানন্দ চরিত,  স্বামী প্রভানন্দ,  উদ্বোধন) রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রাচীন ও বরিষ্ঠ সন্ন্যাসী (যিনি দীর্ঘকাল সঙ্ঘের সহাধ্যক্ষ পদে আসীন ছিলেন) স্বামী নির্বাণানন্দ মহারাজ একবার হরি মহারাজকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,  “মহারাজ মা-বাপ ছাড়লুম, ঘরবাড়ি ত্যাগ করলুম, আপনাদের সান্নিধ্যে এলুম -- কই এখনও তো ভগবান লাভ হলো না।”

 হরি মহারাজ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “দেখ,তোমরা সব কল্পতরুর নিচে এসেছ। ওই বৃক্ষে অজস্র ফল ঝুলছে।  একদিন না একদিন ওই ফল পড়বেই পড়বে এবং তুমি যদি ওই গাছের নিচে থাক তবে ফল ( মুক্তি বা ভগবদ্দর্শন) পাবেই পাবে। তবে যদি ওই ফল এখুনি চাও -- Shake the tree, shake the tree -- অর্থাৎ ওই গাছে দারুণ ঝাঁকুনি দাও।  তীব্র পুরুষকার প্রয়োগ করলে শীঘ্রই মুক্তিরূপ ফল পাওয়া যাবে।” ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের আকর্ষণে যাঁরা সঙ্ঘের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে ছিলেন, আছেন বা থাকবেন -- তাঁদের কাছে এ যে কত আশার কথা তা সহজেই অনুমেয়। হরি মহারাজ এমনভাবেই ঈশ্বরের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়েছেন মানুষকে,  শুনিয়েছেন আশার বাণী। 

১৯২২ সালের ২১ জুলাই (৫ শ্রাবণ, শুক্রবার) অপরাহ্ণ ৬টা ৪৫ মিনিটে কাশীধামে মহাসমাধিতে প্রবেশ করেন চির তপস্বী স্বামী তুরীয়ানন্দজী। আকুমার অখণ্ড ব্রহ্মচর্যের অধিকারী এই দীপ্ত সন্ন্যাসীর মুখমণ্ডল এইসময় স্বর্গীয় প্রসন্নতায় ও মাধুর্যে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সারারাত ভজন-পাঠাদিতে অতিবাহিত করার পর পরদিন শনিবার সকাল ন'টার সময় ভক্তেরা তাঁর পূতদেহ আরাত্রিকাদি সমাপনান্তে মণিকর্ণিকায় জলসমাধি দেন।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments