জ্বলদর্চি

পরিমাপের নানা দিক /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ২৩

পরিমাপের নানা দিক

সূর্যকান্ত মাহাতো

"বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী।" 
পাণ্ডবরা অজ্ঞাত বাস পূর্ণ করে ফিরে এসে রাজ্য দাবি করলেন। কিন্তু দুর্যোধন কর্ণপাত করলেন না। রাজ্যও ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করেন। শুধু তাই নয়, পান্ডবদের হুঙ্কারও দেন। উপরের বাক্যটি ছিল সেই হুঙ্কার। অর্থাৎ রাজ্য ফেরানো তো দূরের কথা, সূচের অগ্রভাগে যেটুকু মেদিনী বা মাটি উঠবে সেটাও দুর্যোধন দেবেন না। এর জন্য লড়াই করতেও বরং প্রস্তুত তিনি।  মহাভারতের যুগে পরিমাপের একক হিসাবে সবথেকে ক্ষুদ্রতম একক বোধহয় এটাই ছিল। সুচের অগ্রভাগের পরিমাপ টুকু। এর চেয়ে ক্ষুদ্রতম পরিমাপ তখন বোধহয় আর কিছু ছিল না। না হলে দুর্যোধন হয় তো বা সেটাই বলতেন।

তারপর কুরুক্ষেত্রের সময়কাল গত হল। একটু একটু করে আমাদের সময় কাল ফিরে এলো। সূচাগ্রের পরিমাপটাও একটু বড় হল। আমরা তো আর 'মহাভারতের' সময়কালের লোক নয়! আমরা হলাম গিয়ে শুধু ভারতের ক্ষুদ্রতম জঙ্গলমহলবাসী। তাই সূচাগ্র পরিমান ক্ষুদ্র পরিমাপ নিয়ে লড়াই হয় তো সম্ভব নয়। তবে কোনও অংশে আমরাও পিছিয়ে নেই। তার চেয়ে একটু বড় হয়ে পরিমাপটা মাথার চুলে এসে দাঁড় করালাম।এখন বাপের জমি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ হলে ভাইয়েরা পরস্পরকে বলে উঠে, "'একচুলও' জায়গা ছাড়বো না।" মহাভারতের পরিমাপটাকে একটু বাড়িয়ে "সূচাগ্র" থেকে মাথার "চুল"-এ স্থানান্তরিত করলাম।

সময় আবারও বয়ে যেতে লাগল। পরিমাপটাও একটু একটু করে বাড়তে লাগল। চুলের সমান ক্ষুদ্র পরিমাপটাও বাড়তে বাড়তে  আঙুলে এসে পৌঁছাল। তবে পাঁচটা আঙুলের ঠিক কোন আঙুলকে বোঝানো হয় তা অবশ্য পরিষ্কার নয়। জমি নিয়ে ঝগড়া হলে প্রায়ই বলি, "এক আঙুল জায়গা ছেড়ে কথা বলব না।" আঙুলের এই পরিমাপকে "কড়া" বলা হয়। মানে একটি আঙুল বসালে যতটা জায়গা তৈরি হয়, সেটাই হল এক কড়া। চারটি আঙুল কে পাশাপাশি বসালে যে পরিমান জায়গা তৈরি হয় তাকে বলে চার কড়া। ঠিক সেইরকম তিন কড়া, আবার দু কড়াও হতে পারে। এই 'কড়া' আবার 'কড়ি' নয়। 'কড়ি'-র মাপটা হল ভূমি মাপার শিকলের একশো ভাগের এক ভাগ মাত্র।

এই 'কড়া'-র বর্ধিত রূপ হল 'চাখ্খর'। যা কড়ার থেকে একটু বড়। এটা আবার কী ধরণের পরিমাপ? হাতের আঙুলগুলো যতটা সম্ভব সম্প্রসারিত করে হাতের চেটোটা (তালু) মাটির সঙ্গে একরকম মিশিয়ে বসাতে হয়। এরপর বুড়ো আঙুলের ডগা থেকে কড়ে আঙুল এর ডগা পর্যন্ত দূরত্বটাই হল 'চাখখর'। ছোটবেলায় অনেকে গুটি খেলার সময় এই শব্দটা খুব ব্যবহার করে থাকে। এটাও একটা পরিমাপ।

চাখখরের থেকে তুলনামূলকভাবে আরেকটু বড় পরিমাপ হল "হাত"। অর্থাৎ কনুই থেকে মধ্যমার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত অংশটি হল, এক হাতের মাপ। যে কোনও ধরণের লম্বা কোনও কিছু মাপতেই 'হাত' এর মাপ ব্যবহার করা হয়। এভাবেই বড় বড় শাড়ি, ধুতি, গামছা হাত দিয়েই মেপে কেনা হয়। শাড়ি যেন দশ হাতের অবশ্যই হয়। এখনও দু একজন মেপে তবে কেনে।

এখন জমির বাসস্থানের পরিমাপ  অনেক সহজ। কাঠা, বিঘা, একর তো আছেই। তবে সবচেয়ে ছোট পরিমাপ বলতে ডিসমেলকেই বোঝায়।

'মানুষ' তো কেবল প্রাণী নয়। পরিমাপ হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। নিচু গর্ত কিংবা উঁচু অংশ পরিমাপ করতে "মানুষ" শব্দটি ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ একটা মানুষ যতটা লম্বা সেই পরিমাপ টুকু বোঝাতেই 'মানুষ' শব্দটির ব্যবহার। যেমন কুয়ো বা কুয়া খোঁড়ার সময় প্রায় বলা হয়, এই তো দুই মানুষ কী তিন মানুষ পর্যন্ত গর্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ তিনটে মানুষের উচ্চতার সমান। কিংবা বলা হয় বাড়ির ছাদটা চার মানুষ সমান উঁচু। আবার এর চেয়েও উঁচু কিছু বোঝাতে "তালগাছ" কথাটি ব্যবহার করা হয়। যেমন মাঝেমাঝেই বলা হয়, বুবাইয়ের ঘুড়িটা এক তালগাছ উপরে বেশ উড়ছিল। তারপর হঠাৎ সুতো ছিঁড়ে ভোকাট্টা। আবার তার চাইতেও বেশি উচ্চতা বোঝাতে দুই তালগাছের সমান বলা হয়। দুটো তালগাছকে পরপর একটির মাথায় অন্যটিকে দাঁড় করালে যতটা উঁচু হয় সেই পরিমাপ।


যে সমস্ত দ্রব্যগুলোকে হাতে গোনা যেত তাদেরও পরিমাপ পদ্ধতি বেশ। যেমন একটাকে এক-ই বলা হয়। দুটোকে বলা হয় 'জোড়া'। আবার চারটিকে একত্রে বলা হয় 'গন্ডা'। গ্রামের দিকে মহিলারা যে কোনও জিনিস এই গণ্ডাতেই হিসাব করে থাকেন। গন্ডা-র থেকে আরেকটু বেশি বোঝালে তখন "পণ" কথাটি ব্যবহৃত হয়। কুড়ি গন্ডা অর্থাৎ সংখ্যায় ৮০ টা নিয়ে হয় এক 'পণ'। কিন্তু সংখ্যাটা যদি আরও বেশি বোঝায়  তখন বলা হয় 'কাহান'। জমির ধানের আঁটি কিংবা খড় গণনার সময় এই 'কাহান' কথাটি সবথেকে বেশি ব্যবহৃত হয়। ১৬ পণ নিয়ে হয় এক 'কাহান'। সংখ্যার হিসাবে যা ১২৮০টি। বাপ, কাকারা এখনও এভাবেই হিসাবের সময় এই শব্দগুলো ব্যবহার করেই পরিমাপ করে থাকেন।

বিদ্যাসাগর মহাশয় ইংরেজি শিখেছিলেন রাস্তার উপর মাইলস্টোনের লেখা দেখে। হ্যাঁ তখন 'মাইলস্টোন' কথাটাই ব্যবহৃত হত। কারণ বাটনা বাটা সিলের মতো আকারের স্টোনে মাইলের সংখ্যাটাই চিহ্নিত করা থাকত। এখন মাইল এর পরিবর্তে কিলোমিটারের চল। তাই কিমি কথাটাই উল্লেখ করা থাকে। এখন কিলোমিটার স্টোন রাস্তার পাশে দেখা যায়। এখনকার মতো তখন মিটার বা কিলোমিটার ছিল না। কিছুটা দূরত্ব বোঝালেই বলা হত কয়েক গজ। আর একটু বেশি হলেই  কয়েক পা। যেমন, আর কয়েক পা এগোলেই হবে। আসলে পা বা পদক্ষেপকেই দূরত্বের একক হিসাবে ব্যবহার করে হত। দূরত্বটা আরেকটু বেশি হলেই তখন কয়েক পা না বলে বলা হয় কুড়ি থেকে পঁচিশ পা এগিয়ে যান তাহলেই হবে। তারচেয়েও দূর হলে বলা হত মাইল। এক মাইল সমান ১.৬০৯ কিলোমিটার। মাইলের থেকেও আরেকটু বড় হল ক্রোশ। ক্রোশ কথাটি বয়স্ক মানুষদের মুখে  এখনও খুব ব্যবহৃত হয়। এই এক ক্রোশের পরিমাপ ছিল ৩.৬৫৬ কিলোমিটার।

মুড়ি, চিড়া, ধান, চাল প্রভৃতি দ্রব্য পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত হত কনা, সের, মান ইত্যাদি। সরু সরু বেতের তৈরি এইসব পাত্র দিয়েই তখন পরিমাপ করা হত। এখনও হয় তবে অনেক কম। এদের মধ্যে 'কনা' হল সবথেকে ছোট মাপার পাত্র। কনার চেয়ে বড় পরিমাপক পাত্রটি হল 'সের'। এই তো সেদিনও রমেশের মা রবীনের মাকে পাঁচ সের চাল ধার দিল। সময় মত রবীনের মা সেটা অবশ্য  পরিশোধও করে দিলেন। ওই সেরের মাপেই। 'সের' এর চেয়ে আরও বড় হল 'মান'। এবছর যেমন সরস্বতী পুজোয় চাঁদা ধার্য করা হয়েছিল দুই 'মান' ধান। খামারের শস্য মাপার জন্য 'মান' এর থেকে আরও বড় পাত্র হিসাবে ঠেকা, কুলাও ব্যবহার করা হয়। সুনীল যেমন তার বাবাকে বলল, এ বছর মাত্র দশ ঠেকা ধান কম ফলেছে। ঠেকার থেকে আরও বড় পরিমাপক হিসাবে বস্তা ব্যবহার করা হয়। যেমন এবছর কুড়ি বস্তা আলু বিক্রি করা হল। ত্রিশ বস্তা ধান ও দশ বস্তা তিল ফলেছে। এই রকম। এই পরিমাপগুলো আজও অনেকেই ব্যবহার করে থাকে। তখন 'কেজি' কথাটা অতোটা ব্যবহৃত হতো না। এখন যতটা হয়। তখন সকলের ঘরে ওজন দাড়ি কিংবা বাটখারাও ছিল না। এখন তো আবার ওজন দাড়ি কিম্বা বাটখারা দুটোই একরকম উঠে যাওয়ার জোগাড়। পরিবর্তে জায়গা করে নিচ্ছে কম্পিউটার কাঁটা।


পরিমাপের এমন বৈচিত্রের কারণ কী? প্রকৃত ওজন যন্ত্রের অপ্রতুলতা? নাকি সঠিক মাপ অনেকেই জানত না? না কি দুটোই? আসলে এই পরিমাপের পদ্ধতিগুলো  গড়ে তোলা হয়েছে নিজেদের মতো করেই। এমনকি খুবই বুদ্ধিদীপ্তের সঙ্গে। জটিল নামতা বা ধারাপাতের জ্ঞান সরিয়ে বরং ছোট ছোট সংখ্যায় গণনা করার মধ্য দিয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাতে পাল্টাতে।  দৈর্ঘ মাপার ফিতা, ওজনদন্ড, বাটখারা ওসব প্রতিটি বাড়িতে নেই। তাই কোনও কিছুর পরিমাপ এভাবেই গড়ে উঠেছে। ব্যাক্ষা করা হয়েছে। একেবারে কাছের পরিচিত বিষয়গুলো দিয়েই পরিমাপ ধার্য করায় উৎসাহ দেখিয়েছে। সেইসঙ্গে মুন্সিয়ানাও। এভাবেই ছোট ছোট পরিমাপকগুলো সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল। যেমন পাই। এই পাত্রটিকে চিড়া বিক্রেতারা খুব ব্যবহার করতেন।যেমন দু পাই ধান দিলে, পরিবর্ত হিসাবে এক পাই চিড়া মেলে।

এখন আধুনিক প্রযুক্তি এইসব পরিমাপকগুলোকে বাদের খাতায় ঠেলে দিয়েছে। এখন সবেতেই কম্পিউটার। উচ্চতা, ওজন, দূরত্ব ইত্যাদি সবকিছুই সঠিক ভাবে পরিমাপ পেয়ে যাচ্ছি। কম বেশি কিংবা একটু এদিক ওদিক হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। সেটাই বা কম কিসের! আধুনিক শিক্ষা ও বিজ্ঞানের অগ্রগমন যে দারুণ গতিশীল এটাই তার প্রমাণ।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

1 Comments