জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প – এশিয়া (চীন) -- ৯৩ /চারটি নদীর জন্মকথা /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প – এশিয়া (চীন)  -- ৯৩

চারটি নদীর জন্মকথা

চিন্ময় দাশ
 
অনেক অ-নে-ক কাল আগের কথা। সারা পৃথিবীতে কোন নদী বা হ্রদ ছিল না সেসময়। তবে, তাই বলে কি জলও ছিল না কোথাও? না, না—তা কেন? জল অবশ্যই ছিল। তবে, সেসময় একমাত্র ‘পূর্ব সমুদ্র’ (জাপান সাগর)টাই যা সৃষ্টি করেছেন বিধাতা। আর কিছু নয়।
তো, সেই পূব সমুদ্রে থাকতো চারটে দৈত্য—লম্বা-দৈত্য, হলুদ-দৈত্য, কালো-দৈত্য আর মুক্তা (সাদা)-দৈত্য। এক জলে চারজনের বাস। তাই ভারি ভাব চার দৈত্যের মধ্যে। যাকে বলে, একেবারে গলায় গলায় ভাব তাদের। 
একবার চার দৈত্যের মনে হোল, জন্ম থেকে একই জলে থেকে থেকে, একঘেয়ে হয়ে গেছে জীবনটা। জল থেকে একটু বেরুনো দরকার। 
যেমন ভাবনা, তেমনই কাজ। যার গায়ে যত জোর আছে, সব লাগিয়ে, বিশাল এক এক লাফ। সে কী লাফ, বলবার মত নয়। জল ছেড়ে উঠে গিয়েছে একেবারে আকাশে।
কী মজা, কী মজা! ফুরফুরে বাতাস বইছে। মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে। কখনও লাফাচ্ছে। কখনও দৌড়চ্ছে। এ ওর গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সে কী হুটোপাটি তাদের! মেঘেদের ভিতরে লুকোচুরি খেলা চলছে চারজনের।
হঠাতই মুক্তো-দৈত্য চেঁচিয়ে উঠল—সবাই একবার এখানে ছুটে এসো। খুব তাড়াতাড়ি!
ডাক শুনে, তিনজনেই অবাক। তিন জনেই হাজির হয়ে জানতে চাইল—কী হোল গো? 
নীচে পৃথিবীর দিকে আঙ্গুলের ইঙ্গিত করল মুক্তো-দৈত্য—চেয়ে দ্যাখো, নীচে, ওই দিকে।
দেখা গেল, বেশ কিছু লোক জড়ো হয়েছে এক জায়গায়। কেউ এনেছে ফল-মূল। সুগন্ধি ধূপ এনেছে কেউ বা। পূজার আয়োজন হয়েছে সেখানে। সামনে একজন বুড়ি। শনের নুড়ির মত এক ঝুড়ি চুল তার মাথায়। হাঁটু গেড়ে বসে, প্রার্থনা জানাচ্ছে বুড়ি-- হে সর্বশক্তিমান বিধাতা! একটু কৃপা করো আমাদের। তাড়াতাড়ি বৃষ্টি দাও, প্রভু। এক্মুঠো অন্ন নাই আমাদের শিশুদের মুখে। কতকাল বৃষ্টি নাই এখানে। একটু দয়া করো আমাদের। বেঁচে থাকতে দাও দয়া করে।  
চার দৈত্যই চেয়ে দেখল—বহুকাল একফোঁটা বৃষ্টি নাই দেশটাতে। খেতের ফসল জ্বলে গেছে। মাঠের ঘাস, গাছের পাতা সব শুকিয়ে হলুদ। গনগনে রোদের তাতে মাঠ-ঘাট সব ফুটিফাটা।
--আহা, কী দুর্দশা মানুষজনের! হলূদ-দৈত্য বলল—এখুনি বৃষ্টি না হলে, এরা সবাই তো মারা পড়বে। 
লম্বা-দৈত্য বলল—এক কাজ করা যাক। চলো, সবাই দল বেঁধে, বিধাতার কাছে যাই। দরবার করি গিয়ে।
সকলেই রাজি সে কথায়। লাফ দিয়ে চারটা মেঘের পিঠে চড়ে বসল চার দৈত্য। স্বর্গের উদ্দেশ্যে উড়ে চলল তারা। 
আকাশ, পৃথিবী আর সমুদ্র—তিনেরই অধীশ্বর হলেন বিধাতা। তাঁর কথাতেই চলে তিনটে জগত। যা কিছু ঘটে তিন জায়গায়, তিনি আঙ্গুল নাড়ালেই। বিশাল ক্ষমতা তাঁর। 
এক দল পরী নেচে নেচে গান গাইছে। সিংহাসনে হেলান দিয়ে বসে, গান শুনছিলেন বিধাতা পুরুষ। দৈত্যগুলোকে সেখানে হাজির হয়ে যেতে দেখে, মোটেই ভালো লাগল না তাঁর। একটু বিরক্তই হলেন বরং। 
--এখানে এসেছ কেন তোমরা? বিধাতা ধমকে উঠলেন দৈত্যদের। তোমাদের তো পূব সমুদ্রে থাকবার কথা। নিজেদের এক্তিয়ার জানো না? 
ভয় তো পেলই না, বরং সামনের দিকে দু’পা এগিয়েই এলো লম্বা-দৈত্য। মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানালো বিধাতাকে—পেন্নাম হই, প্রভু। খেত-খামার সব জ্বলে যাচ্ছে পৃথিবীতে। না খেয়ে মরতে বসেছে সবাই। দয়া করে তাড়াতাড়ি বৃষ্টির মেঘকে পাঠান সেখানে।
এতো সাহস দৈত্যগুলোর? তাঁর দরবার পর্যন্ত চলে এসেছে! তাঁকেই পরামর্শ দিচ্ছে! অবাক হয়ে গেলেন বিধাতা! কোন রকমে নিজেকে সংযত রেখে বললেন—ঠিক আছে, সে দেখা যাবে। আগে তোমরা চলে যাও এখান থেকে। 
আবার নাচ-গানে মশগুল হয়ে গেলেন বিধাতা। 
খুশি মনে ফিরে এসেছে দৈত্যেরা। কিন্তু ঐ আশ্বস্ত হওয়া পর্যন্তই। এক দিন যায়। দু’দিন যায়। চার দিন যায়। দেখতে দেখতে দশ দিন কেটে গেল গুণে গুণে। কালো মেঘের দেখাই নাই আকাশে। এক ফোঁটা বৃষ্টি তো অনেক দূরের কথা। 
দুর্দশার শেষ নাই মানুষজনের। কেউ গাছের বাকল তুলে খাচ্ছে। ঘাসের শেকড় চেবাচ্ছে কেউ। কেউ বা কিছু না পেয়ে, সাদা রঙের কাদা (বিখ্যাত ‘চিনে মাটি’) খাচ্ছে তুলে তুলে।
দেখে ভারি কষ্ট হোল দৈত্যদের। বেশ বুঝতে পারল, নিজের আমোদ-আহ্লাদ ছাড়া, অন্য কোন দিকে মন নাই বিধাতার। তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষজনকে। অথচ তাদের কথা অন্তর দিয়ে ভবেন না কখনও। 
লম্বা-দৈত্যের মনে হোল, মানুষদের দুঃখ লাঘব করতে হলে, যা করবার, তাদের নিজেদেরই করতে হবে। কিন্তু তার উপায়টা কী ? কীভাবে অনাবৃষ্টির যন্ত্রনা থেকে রেহাই দেওয়া যায় মানুষদের? 
সারা দিন ভেবে, মাথায় একটা উপায় এলো তার মাথায়। তিন দৈত্যকে ডেকে বলল-- এই সাগরে তো অনেক জল। এই জল থেকেই তো উপকার করা যেতে পারে মানুষের। 
তিনজনে জানতে চাইল—কিন্তু জল আমরা পাঠাব কী করে পৃথিবীতে? 
--কেন? মুখ ভর্তি জল নিয়ে, ফোয়ারার মতো আকাশে ছুঁড়ে দেব। বৃষ্টি ফোঁটার মতো সে জল গিয়ে পড়বে পৃথিবীর মাটিতে। তাতে ফসল বাঁচবে। মানুষরাও বাঁচবে তাতে। 
সবাই খুশি এ কথায়। সবাই তারিফ করল ভাবনাটার।
খানিক চুপ করে থেকে, লম্বা-দৈত্য বলল—তবে, একটা বিপদ আছে। বিধাতার নজরে গেলে, রেগে যাবে নিশ্চয়ই।
--মানুষের দুর্দশা মেটানোর জন্য, আমি সব কিছু করতে রাজি। হলুদ-দৈত্যের গলায় বেশ দৃঢতা। 
--চলো তাহলে। কাজে লেগে পড়া যাক। লম্বা-দৈত্য বলল—অনাবৃষ্টি ঠেকাতে, যত দূর যেতে হয়, যাবো আমরা। তাতে যাই ঘটুক, কোন কিছুতেই আফশোস করব না কোন দিন।
কালো-দৈত্য আর সাদা-দৈত্যও পিছিয়ে থাকবার নয়। তারা দুজনেই এগিয়ে এল প্রথমে। হাঁ-মুখে জল নিয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে লাগল আকাশে। লম্বা-দৈত্য আর হলুদ-দৈত্যও কাজে লেগে পড়ল। 
চার দৈত্য জল ছুঁড়ছে। আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে চারটে ফোয়ারা। তারপর ঝরণাধারার মত নেমে এসে, বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে ঝরে ঝরে পড়ছে মাটিতে। বিশাল আকারের ঘণ কালো মেখ দেখে মনে হচ্ছে, যেন পুরো পূব সমুদ্রটাই উঠে গেছে আকাশে। অঝোর ধারে বৃষ্টি ঝরছে সেই মেঘ থেকে। 
--বৃষ্টি পড়ছে গো, বৃষ্টি! ফসল বেঁচে যাবে আমাদের। আমরাও বেঁচে যাবো এবার। আনন্দে বৃষ্টির মধ্যে নাচানাচি করতে লাগল পৃথিবীর মানুষেরা।
কিন্তু ভারি গোঁসা হোল একজনের। সে হোল সমুদ্রের দেবতা। তারই জল আকাশে তুলে দিয়ে, বৃষ্টির ব্যবস্থা করেছে চারটে হতভাগা দৈত্য। কিন্তু একবার মুখের কথাটাও বলেনি তাকে। জল কি ওদের নিজেদের? 
আঁতে ভারি ঘা লেগেছে তার। সোজা বিধাতার দরবারে গিয়ে হাজির। দৈত্যগুলোর বিরুদ্ধে সাত-কাহন করে লাগিয়ে দিল বিধাতার কানে। 
--কী, এত বড় আস্পর্ধা! হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন বিধাতা। আমার হুকুম ছাড়া, নিজেরাই বৃষ্টির ব্যবস্থা করেছে? চরম সাজা পেতে হবে হতভাগাগুলোকে। 
নিজের চারজন সেনাপতিকে ডেকে আনলেন বিধাতা। হুকুম দিলেন—এক্ষুনি গিয়ে ধরে নিয়ে এসো চারটাকে। দলবল নিয়ে যাবে। সোজা এই দরবারে এনে হাজির করবে। 
বিধাতার হুকুম বলে কথা। বেশি সময় গেল না। চার সেনাপতি পিছমোড়া করে বেঁধে দরবারে এনে হাজির করল চার দৈত্যকে।
চার দৈত্যকে চোখে পড়ামাত্রই, ভয়াণক রাগে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল বিধাতার। গোল গোল চোখদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘণ ঘণ। 
পাহাড়ের দেবতা হাজির ছিল দরবারেই। বিধাতা তাকে ডেকে বললেন—সবার চেয়ে বড় চারটে পাহাড় এনে চাপিয়ে দাও এই চারটে হতভাগার উপর। কেরামতি দেখানো তো দূরের কথা, ভবিষ্যতে জীবনে আর যেন নড়াচড়াটাও করতে না পারে কোন দিন। 
পাহাড়ের দেবতার ক্ষমতা কারও চেয়ে কম নয়। তার হুকুমে, চার দিক থেকে চারটে বড় বড় পাহাড় উড়ে উড়ে আসতে লাগল বিধাতার দরবারের দিকে। আকাশ বাতাস ফুঁড়ে আসছে পাহাড়গুলো। শোঁ-শোঁ শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল চারদিক।
পাহাড়গুলোর চেহারা দেখে, বিধাতা ভারি খুশি। হুকুম করলেন—এক জায়গায় নয় কোন মতেই। কোন দিন যেন আর এক জায়গায় জমায়েত হতে না পারে। দূরে দূরে চার জায়গায় নিয়ে যাও বেকুবদের। এক একটা পাহাড় চাপিয়ে রেখে দিয়ে এসো। 
হুকুম মত, নীচের পৃথিবীতে ভিন্ন ভিন্ন চার যায়গায় নিয়ে যাওয়া হোল চার দৈত্য আর চারটে পাহাড়কে। নিজের হাতে ধরে, চারটে পাহাড়কে চার জন দৈত্যের উপর চাপা দিয়ে দিল পাহাড়ের দেবতা। হেসে-খেলে এতকাল ছিল সাগরের জলে। এবার শুকনো ডাঙ্গায় চিরকালের জন্য বন্দী হয়ে গেল দৈত্য চারজন।
গল্পটা এখানেই শেষ নয় কিন্তু। 
পাথর চাপানোর কাজ শেষ করে, বিধাতা পুরুষের দরবারে ফিরে গেল পাহাড়ের দেবতা। দৈত্যগুলো পড়ে রইল পাহাড়-চাপা হয়ে। 
কিন্তু কোনও দুঃখ বা আফশোস হোল না একজন দৈত্যেরও। পৃথিবীর রুখাশুখা মাটি আর মানুষের উপকার করবে বলে পণ করেছিল চার জন। সে কথা তারা ভুলে যায়নি। চারজন দৈত্য করল কী, চারটে নদীতে পালটে ফেলল নিজেদের। কোথায় দৈত্য, কোথায় কী! তার বদলে, চারটে নদী বয়ে যেতে লাগল খর বেগে। 
পূর্ব সমুদ্রের বাস ছিল চারজন দৈত্যের। সেই সমুদ্রের দিকেই চলতে লাগল চারটে নদী। উঁচু পাহাড়, গভীর গিরিখাত, বিস্তৃর্ণ মাল্ভূমি, গাঁ-গঞ্জ—কত কত জায়গা বেয়ে বেয়ে, এগিয়ে গেল নদীগুলোর স্রোত। পশ্চিম থেকে পূবমুখো হয়ে চলতে চলতে, পূর্ব সমুদ্রের জলেই এসে মিশে গেল চার জনে। এই পূব সমুদ্রই তো ছিল তাদের আদি বাসভূমি। 
……………………………………………………………………………… 
এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে চীন দেশের চারটি বিখ্যাত নদী ঃ ইয়াং ৎজে, হোয়াং হো, আমুর আর ঝু জিয়াং। এখনও চীন দেশের বুড়োবুড়িরা এই গল্প শোনায় নাতিনাতনিদের। দেশ-বিদেশের সমীক্ষকরা, দিনের পর দিন বছরের পর বছর, গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগ্রহ করে এনেছেন এই কাহিনী।   
( ৪টি নদীর ভৌগোলিক বিবরণ-- অতি সংক্ষেপে) ঃ 
১ ইয়াং ৎজে-- দৈর্ঘ্য ৬,৩০০ কিমি। কেবল চীন নয়, এশিয়া মহাদেশেরও বৃহত্তম নদী এটি। এই নদীটি সারা বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম। তিব্বত উপত্যকায় তাংগুলা পর্বতমালার ‘জারি পাহাড়’ থেকে এই নদীর উতপত্তি।  
২ হোয়াং হো (হলদে বা পীত নদী)— মধ্য চীন এলাকার ‘বায়ান হার’ পাহাড় থেকে উতপন্ন এই নদীর দৈর্ঘ্য ৫,৬৬৪ কিমি। সারা বিশ্বে এর স্থান ষষ্ঠ। নিজের চলার পথে ২৬ বার পথ বদল করেছে নদীটি। এই নদীর ভয়াবহ সেইসব ধ্বংসলীলা। একারণেই, হোয়াং হো নদীর নাম হয়েছিল—‘চীনের দুঃখ’। 
৩ আমূর (কালো)— এ নদীর জন্ম ‘ইয়াব্লোনর’ পাহাড়ে। দৈর্ঘ্য ২,৮২৪ কিমি। দৈর্ঘ্যের হিসাবে বিশ্বে এ নদীর স্থান দশম। উত্তর-পূর্ব চীনের এই নদীটি, মানচিত্রে চীন এবং রাশিয়া—দুই দেশের সীমারেখা। 
৪ ঝু জিয়াং (সাদা বা মুক্তো)— একেবারে দক্ষিণ-চীন এলাকায় এ নদীর অবস্থান। পূর্ববাহিনী এই নদীর দৈর্ঘ্য ২,১৯৭ কিমি। চীনদেশের তৃতীয় বৃহত্তম এই নদী। পূর্বকালে এর নাম ছিল—ক্যান্টন নদী।)
……

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments