জ্বলদর্চি

কার্তিক বাআঁদা (কোল তথা হো ভাষার জনগনের জন্য আন্দোলনকারী, সবং)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৩

কার্তিক বাআঁদা (কোল তথা হো ভাষার জনগনের জন্য আন্দোলনকারী, সবং)

ভাস্করব্রত পতি


তিনি 'রানার'। চিঠি নিয়ে আসেন। রোজ মদনমোহনচক থেকে যেতে হয় ৭ কিমি দূরে সবংয়ের তেমাথানির লুটুনিয়াতে। কষ্ট আছে। আছে উদ্যম। আসলে সংসারটাকে বাঁচাতে হবে তো! তিনি কার্তিক চন্দ্র বাআঁদা। পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ের মনিনাথপুরে বাড়ি। ১৯৬৫ সালে জন্ম এই কোল (হো) জনজাতির মানুষটির। কিন্তু আজ পর্যন্ত জোটেনি তপশিলী উপজাতির তকমা। তাঁর লড়াই নিজেদের সেই পরিচিতি পাওয়ার। মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের বুকে বসে আজ সারা রাজ্য জুড়ে চালিয়ে যাচ্ছেন আন্দোলন। চালিয়ে যাচ্ছেন লড়াই।

এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী প্রায় তিন লক্ষ কোল (হো) মানুষ রয়েছেন। তবে বেশিরভাগই সরকারি বদান্যতা না পেয়ে নিজেদের আর কোল (হো) বলছেন না। কার্তিক বাআঁদা পরিসংখ্যান দিয়ে জানান, বর্তমানে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ার জেলায় কেউ 'কোল (হো)' লেখেননা। সবাই নিজেদের 'মুণ্ডা' বলে। উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর এবং দার্জিলিং জেলায় 'কোল'ও লেখে, আবার 'মুণ্ডা'ও লেখে। বর্ধমান ও মালদা জেলায় 'কোল' লেখে। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলাতেই কোল (হো) সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছেন ৬০ থেকে ৭০ হাজার। এদের মধ্যে কেবল ডেবরা ব্লকেই ৩০ হাজারের বেশি রয়েছেন। সেইসব মানুষের স্বার্থে এই 'রানার' লড়ছেন।

অভাবের ঘেরাটোপে থেকেও লোকটা এখনো অচঞ্চল। কর্তব্য নিষ্ঠায় একরোখা। তাঁকে লড়তে হবে। নিজের জন্য নয়। সারা জনজাতির জন্য। এই কোল (হো) দের কারও তপশিলী উপজাতি তকমা জোটেনি। অথচ অন্য রাজ্যে তা মিলেছে। ইতিমধ্যে কার্তিকচন্দ্র বাআঁদা ‘হো মহাসভা'র যুগ্ম সচিব (চাইবাসা, ঝাড়খণ্ড) হয়েছেন। তেমনি চাইবাসার 'উপুরুম জুমুর' এর সদস্য হয়েছেন। এমনকি এখানকার 'সেন্ট্রাল হো ল্যাঙ্গুয়েজ এডুকেশানাল কাউন্সিল'-এর সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের 'কোল সমাজ হায়াম সানাগম সোসাইটি' তথা 'কোল সমাজ ভাষা সাহিত্য সমিতি'র সচিব তিনিই। তাঁর স্মরণে মননে এখন 'হো' ভাষার রক্ষা করা। সেই সাথে হো জনজাতির মানুষজনকে সরকারি তরফ থেকে তপশিলী উপজাতি তকমা পাইয়ে দেওয়া।

ইতিমধ্যে তিনি প্রকাশ করেছেন— 'কোল তথা হো ভাষার ব্যাকরণ' বই। যেসব মানুষ এই ভাষাটাকে ভুলে যেতে বসেছেন তাঁদের জন্য লেখা এই অদ্ভুত বইটি। লিখেছেন কবিতার বই 'দিশা ইপিল', 'বঙ্গানুবাদ সহ কোল তথা হো ভাষার কবিতা ও গান', প্রবাদ ছন্দের বই 'আঙ' এবং 'কোল ও হো'। লিখেছেন 'কোল তথা হো ভাষার উৎস' (চারিত)। খুব শিগগিরই প্রকাশিত হবে CRI থেকে কোল ভাষায় ছোটদের বর্ণপরিচয় 'অমন সাকাম' এবং কোল তথা হো জাতির সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও বিবাহ সংস্কার বিষয়ক বই 'জিড়িজুড়ি' এবং বিভিন্ন শব্দের আকর নিয়ে 'কলকল'।

পছন্দ করেন কোলভাষা চর্চা করতে। সবং, খড়গপুর ও নারায়ণগড় ব্লকের সীমান্তবর্তী মনিনাথপুর গ্রামের ছোট জুড়ে কুঁড়ে বসে নিত্যদিন চলে তাঁর কোলভাষা চর্চার আরাধনা। বেশ কয়েক বছর ধরে শুরু করেছেন কোল (হো) ভাষা তথা 'আড়াংচিতি'-র প্রশিক্ষণ শিবির। হাউর-এ শুরু হয়েছিল রাজ্যের মধ্যে প্রথম এরকম শিবির। লকডাউনেও চলছিল ডুঁয়া এবং ত্রিলোচনপুরে। এখন আপাতত বন্ধ।

কার্তিক চন্দ্ৰ বাআঁদা বলেন, কোল (হো)রা তপশিলী উপজাতির স্বীকৃতি না পেয়ে নিজেরা অন্য রূপে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন। ফলে তাঁরা ধীরে ধীরে অনেকেই হারিয়ে ফেলছেন নিজেদের সংস্কৃতি ভাষা এবং জনজীবন। এই মুহূর্তে তাই নিজেদের পরিচয় আদায়ের পাশাপাশি মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে হবে “আড়াংচিতি'-কে। ৩২ টি বর্ণমালা সমৃদ্ধ কোল (হো) ভাষাকে বাঁচাতে তাই তিনি ছুটছেন গ্রামে গ্রামে। কোল ভাষার ব্যাকরণ লিখে সেই অসাধ্য কাজটির অনেকটাই করে ফেলেছেন তিনি। সাঁওতালি ও মুণ্ডা ভাষার সঙ্গে এর সম্পর্ক এবং বাংলার সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ যোগ কোথায় এবং কতখানি, তারও আভাষ দিতে বদ্ধপরিকর এই 'রানার'।

কত বেতনই বা পান? কিন্তু অভাব' তাঁর জেদকে ঢেকে দিতে পারেনি। 'বঞ্চনা' তাঁর অধ্যবসায়কে অবদমিত করে দিতে পারেনি। 'অসহযোগিতা' তাঁর কর্মোদ্যমকে হারিয়ে দিতে পারেনি। তাঁর অন্তর স্রোতে বয়ে চলেছে কোল জনজাতির ১২৪ টি পদবীর মানুষের জীবনের যন্ত্রণা। যে কোল জাতির মানুষ স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে ১৮৩১-৩২ সালে বিদ্রোহ ঘোষণা করে জীবন বলিদান দিয়েছিলেন, সেই কোল জনজাতির মানুষজনের দুর্দশা আজও ঘোচেনি। কার্তিকের লড়াই এখানেই।


 পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments