জ্বলদর্চি

প্রকৃতির মিউজিক থেরাপি /নিশান চ্যাটার্জী

জীবনের গভীরে বিজ্ঞান-৭

প্রকৃতির মিউজিক থেরাপি

নিশান চ্যাটার্জী


কথায় বলে সঙ্গীত মনের সব যন্ত্রণা দূর করে দিতে পারে। তাই সঙ্গীতকে অনেকেই "pain killer"  হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। অনেক  ক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্যবস্থায় "মিউজিক থেরাপি" নামক পদ্ধতিরও প্রচলন রয়েছে। এই "থেরাপি" সাধারণত অবসাদগ্রস্ত রোগীদের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু জানেন কি এই সঙ্গীত বা মিউজিক সম্পর্কে ধারণা মানুষ কোথা থেকে পেয়েছে? অর্থাৎ আমাদের প্রকৃত সঙ্গীত শিক্ষক কে? যদি না জেনে থাকেন তাহলে তার উত্তর হলো পাখি। হ্যাঁ, অনেকের মতে পাখিদের কাছ থেকেই মানুষ গান গাওয়ার প্রেরণা লাভ করেছিল। কারণ বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় মানুষের যে সকল পূর্বপুরুষ রয়েছে যেমন অষ্ট্রালোপিথেকাস প্রভৃতিদের মিউজিক সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। 

ধ্বনি বিশারদ স্যার মিলমস রেসের মতে-"  মানুষের ভোকাল কর্ডে এমন কোনো জন্মগত বা উৎপত্তিগত বৈশিষ্ট্য নেই যা থেকে বলা যেতে পারে মানুষ একটি জন্মগত গাইয়ে প্রাণী"। পাখিদের এই বৈশিষ্ট্য জন্মগত। বিভিন্ন জাতের পাখিদের নিজস্ব ডাক আছে এবং তা বিভিন্ন সুর সমৃদ্ধ। কোনো মানবশিশু জন্মেই, পাখিদের মতো নির্দিষ্ট সুরে গাইতে পারেনা। কষ্ট করে গান শিখতে হয়। ভোকাল কর্ডের বিভিন্নতার জন্য অনেকে চেষ্টা করেও গান শিখে উঠতে পারেনা। পাখিরা তাদের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে নানা ধরনের মনোভাব ব্যক্ত করে। এটাকে আমরা পাখিদের "কথা বলা"ও বলতে পারি। এই কথা বলার পদ্ধতি মোটামুটি ভাবে দু-ধরনের। কাক, শালিক প্রভৃতি পাখি, যারা একসাথে দলবেঁধে বসবাস করে, তারা অপেক্ষাকৃত ছোট জায়গার মধ্যেই নিজদের কে আবদ্ধ রাখে। তারা শুধুমাত্র ডাকে কিন্তু তাদের ডাকে সুর এবং ছন্দের তেমন খোঁজ মেলেনা। একে বলা হয় " নন্ মিউজিক্যাল কল"। এর মাধ্যমে তারা মনের ক্ষোভ, প্রেম, আনন্দ, সতর্কীকরণ বার্তা, উড়ে চলার নির্দেশ প্রভৃতি আদান-প্রদান করে থাকে। 

 আবার কোকিল, পিউ-কাহা, ভীমরাজ প্রভৃতি পাখি অতন্ত্য সুরেলা গান করে, যাকে বলে "মিউজিক্যাল কল"। এই গান কয়েক সেকেন্ড থেকে এক মিনিট স্থায়ী হতে পারে এবং নির্দিষ্ট ছন্দে বারবার শোনা যায়। এই ধরনের গায়ক পাখিদের এলাকা সাধারণত অনেক বড় হয়ে থাকে। এলাকার দখল দারিত্ব এবং আগন্তুক পাখিদের সতর্ক করতে এই গান ব্যবহৃত হয়। আবার সেলুলয়েডে যেমন গানের দৃশ্যে নায়ক এবং নায়িকা এক এক লাইন করে গান গেয়ে তাদের প্রেমের বার্তা প্রেরণ করে তেমনি প্রেম স্পন্দন বোঝাতে দুই লাইন গানের প্রথম লাইনটি যদি একটি পাখি গায়, দ্বিতীয় লাইন ভেসে আসে অন্য পাখির তরফ থেকে। যদি দ্বিতীয় পাখিটি কাছাকাছি না থাকে তাহলে প্রথম পাখিটিই দুটি লাইন গেয়ে তার সঙ্গীত সম্পন্ন করে। আবার পাখি যে শুধু একরকম সুরেই ডাকে তা কিন্তু ঠিক নয়। কাকেদের ক্ষেত্রে প্রায় সাত রকম স্বর রেকর্ড করা হয়েছে। উত্তেজনায় তারস্বরে চিৎকার করে, খিদের সময় প্রার্থনা করে ডাকে, আবার বিশ্রামরত অবস্থায় শান্ত অথচ গভীরভাবে ডাকে। 

পাখিদের গান বিশ্লেষণ করার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রটিকে বলা হয় সাউন্ড স্পেক্টোগ্রাম। এই যন্ত্রটির মাধ্যমে পাখিদের গানের ভাষার তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে এও দেখা গেছে যে বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে পাখিদের ভাষা বদলে যায়। অনেক সময় পাখি নিজের স্বর ছাড়াও অন্য পাখিদের স্বর ও নকল করে। আবার কাকাতুয়া  প্রভৃতি পাখি যে মানুষের ভাষায় কথা বলে তা কিন্তু এরা না বুঝেই বলে। এইসব পাখি যদি কোনো কারণে কালা হয়ে যায় তাহলে তাদের কথা বলার ও গান করার ইচ্ছেও নষ্ট হয়ে যায়। তবে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে একথা বলা যায় যে এদের প্রাথমিক গান গাওয়ার ক্ষমতাটুকুই জন্মগত বাদ বাকি সুরের সৌন্দর্য তাদের শিখতে হয় বাবা-মা বা অন্য পাখিদের কাছ থেকে। তাই আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত খাঁচায় বন্দী করে পাখিদের দৃশ্যপট সৌন্দর্য আহরণ অপেক্ষা, প্রকৃতির বুকে তাদের শিখে আসা নতুন নতুন গান যদি আমরা শুনি এবং তা যাতে শোনা যায় সেই পরিবেশ রক্ষা করার চেষ্টা করি তাহলে তা চিরকালীন অবসাদ নিরাময়ের উপাদান হিসেবে আমরাই ফেরত পাবো।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments