বাংলা গল্পের পালাবদল—১
নারায়ণ মুখোপাধ্যায়
বিশ্বজিৎ পাণ্ডা
(বাংলা ছোটোগল্পের ইতিহাসের দিকে তাকালে দ্যাখা যাবে, মাঝে মাঝেই বাঁক বদল ঘটেছে তার। বিষয়—আঙ্গিক সমস্ত দিক থেকেই ব্যাপক বদল ঘটেছে। আর এই বদলের সঙ্গে গভীরভাবে সংযোগ রয়েছে সময়ের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে বিশ শতকের পঞ্চাশের বছরগুলিতে লিখতে আসা গল্পকারদের নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু পঞ্চাশ-পরবর্তী ছোটোগল্প ও গল্পকারদের নিয়ে তেমন আলোচনা আমাদের নজরে আসেনি। কিন্তু এই সময়ে বাংলা ছোটোগল্প বৈভব ও ঐশ্বর্যে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে। এই সময়-পর্বে লিখতে আসা নির্বাচিত লেখকদের চারটি করে গল্প নিয়ে বিন্যস্ত হবে এই আলোচনা। কিন্তু ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় আলোচনা সম্ভব হবে না। বিভিন্ন সংখ্যায় বিভিন্ন সময়ের গল্পকার উঠে আসবেন। এভাবেই বাংলা গল্পের অভিমুখকে চিহ্নিত করবার চেষ্টা করা হবে।)
নারায়ণ মুখোপাধ্যায়
নারায়ণ মুখোপাধ্যায় (১৩ এপ্রিল ১৯৩৭—১৮ অক্টোবর ২০১৩)-এর গল্প রচনার ধারাটি প্রথমাবধি স্বতন্ত্র। তিনি তাঁর মতো করে গল্প লেখেন। সেখানে আদি-মধ্য-অন্ত্য যুক্ত কোনও নিটোল কাহিনি থাকে না ; থাকে প্রগাঢ় এক অনুভূতি। সূক্ষ্ম ও অনুপুঙ্খ সেই অনুভূতি কবিতার মতো গভীর ও ব্যঞ্জনাময়। তাঁর মনন-নির্ভর গল্পগুলি উঠে আসে বোধ থেকে। পরতে পরতে উন্মোচিত হয় বোধের এক একটি স্তর। এই স্তর-উন্মোচনই তাঁর গল্প। সেই গল্প পাঠককে কখনও বিপন্ন করে, কখনও-বা আবিষ্ট। আবার কখনও হয়ে ওঠে অনন্ত শুশ্রূষা। ভাবায়-কাঁদায়, আমাদের বোধের ওপর জলের মতো অবিরল ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়। আমরা তাকে এড়াতে পারি না।
বিশ শতকের ষাটের দশক থেকে গল্প লিখলেও তাঁর প্রথম গল্প-সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯৮০-তে। পাঁচটি ছোটোগল্পের সংকলন তাঁর—‘সমকালের উপকথা’ (১৯৮০), ‘পা’ (১৯৮০), ‘ছুঁয়ে দেখো’ (১৯৮৯), ‘বোধ-ই বৃক্ষ’ (১৯৯৭) এবং ‘ক্ষেত্রসম্ভব’ (২০০৩)। এছাড়া গল্পসমগ্র ‘১৯৩৭’ (২০১১)। ১৯৩৭ তাঁর জন্ম সাল।
আশ্চর্য গদ্যে রচিত তাঁর গল্পের ব্যাখ্যা অবান্তর। পাঠকের মেজাজ ও মানসিকতা অনুযায়ী তার ব্যঞ্জনা বদলে যায়। তাঁর অধিকাংশ গল্পেই বহির্বাস্তব কিছুটা ম্লান। মানুষের অন্তর্লোকের রহস্যময়তা, গহীনতা প্রাধান্য পায় সেখানে। সেই রহস্যময় অনুষঙ্গ থেকে উঠে আসে তাঁর গল্পগুলি।
ডিসেম্বর, ২০০৩-এ প্রকাশিত নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের ‘ক্ষেত্রসম্ভব’ গল্প সংকলনটি বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল ও দুর্লভ একটি গ্রন্থ। সচেতন পাঠককে হতচকিত করেছিল। গল্পের আখ্যান, ভাষা এরকম হতে পারে তা বাঙালি পাঠক আগে জানত না। ন-টি গল্পের প্রথম চারটি গল্পের আখ্যান গৃহীত হয়েছে রামায়ণ-মহাভারত থেকে।
প্রথম গল্প ‘পিতামহ’-র শুরু এরকম— “আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। বাতাসে আজ প্রগাঢ় অশ্রুবিন্দুর মতো জলকণার ভার। এক অনন্ত আয়ত আঁখির ন্যায় আকাশ যেন কোনও এক অতল বিষাদে দুই চক্ষু অশ্রুতে অশ্রুতে ভরিয়া রাখিয়াছে।...।”
এ-তো সাধারণ বর্ণনার ভাষা নয়, এ যেন বাণী। ধ্যানগম্ভীর এই উচ্চারণ মন্ত্রমুগ্ধ করে আমাদের। এই গল্পে দেখি শরশয্যায় শুয়ে আছেন ভীষ্ম। রাতের অন্ধকারে কুন্তী এসেছেন তাঁর কাছে। প্রতিদিন কুন্তী পিতামহর পা মুছিয়ে পরমুহূর্তে দেখেন— “আপন অশ্রুতে তাহা একেবারে সিক্ত, যেন ঈশ্বরের চরণ হইয়া উঠিয়াছে।” একদিন কুন্তী দেখলেন অদূরে পাতলা ধূসরকালো রক্ত বেয়ে একটা বন্য জন্তুর মতো দ্রুত এগিয়ে আসছে। তিনি ভয় পেয়ে যান। ভীষ্ম ভয় দূর করে বলেন, জন্তু নয়, মানুষ, দুর্যোধন। তার চারপায়ে হেঁটে আসার কারণ হিসেবে তিনি বলেন— “অন্তর্দাহ! অন্তর্দাহ! অন্তর্দাহ মানুষকে চার পায়ে হাঁটায়”। তিনি আরও জানান সে কাঁদতে আসছে। প্রতি রাতে এসে অঝোরে কাঁদে আর বলে— “ভারতবর্ষে কাহারও ব্যক্তিগত অধিকার নাই ; ইহা সর্বমানবের।”
গল্পটি শেষ হচ্ছে এভাবে— “কুন্তী দেখিলেন— তাঁহার সম্মুখে চিরকালের দুঃখ দুই কাঁধে লইয়া দাঁড়াইয়া দুর্যোধন। দুই চক্ষু তাহার অশ্রুতে ভাসিয়া যাইতেছে। শরশয্যার আবরণ ভেদ করিয়া, পিতামহ শালপ্রাংশু ভারতবর্ষের মতো উঠিয়া দাঁড়াইয়া এক হাতে কুন্তীর অন্য হাতে দুর্যোধনের অশ্রু মুছাইয়া দিয়া মনে মনে কহিলেন, ইহা কী আর মুছানো যায়!”
গল্পের চরিত্রের নামগুলিই মহাভারতের। বলা ভালো, মহাকবি বেদব্যাসের। আর বাকিটা নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের। তিনি মহাভারতের নতুন ব্যাখ্যা করেননি, নতুন মহাভারত লিখেছেন। তাই তো তিনি দুর্যোধনকে চার পায়ে হাঁটিয়েছেন। আর এই চার পায়ে হাঁটার কারণ তার ভগ্ন ঊরু নয়, অন্তর্দাহ। বেদব্যাসের আখ্যান অনুযায়ী ভীষ্ম আটান্ন দিন শরশয্যায় ছিলেন। সে সময় কৌরব-পাণ্ডব ছাড়াও কর্ণ-কৃষ্ণ-ব্যাস-নারদ-অসিতদেবল আরও বহু রাজা এসেছিল তাঁর কাছে। কিন্তু কুন্তী আসেননি। কুন্তী তো শুধু রমণী নন, একজন জননী। নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের নতুন মহাকাব্যে আমরা দেখলাম সেই জননীকে।
লেখার বিষয়ের সঙ্গে এ গল্পের ভাষার বিন্যাসও মহাকাব্যিক মূর্ছনা পেয়ে গেছে। উপমাও প্রচলিত পাঠাভ্যাসে নতুনমাত্রা নিয়ে এসেছে। “সর্বকালের ভারতবর্ষের ন্যায় ভীষ্ম”, “বাতাসে আজ প্রগাঢ় অশ্রুবিন্দুর মতো জলকণার ভার”, “এক আয়ত আঁখির ন্যায় আকাশ যেন কোনও এক অতল বিষাদে দুই চক্ষু অশ্রুতে ভরিয়া রাখিয়াছে”, “অস্তগামী সূর্য যেরূপ পশ্চিমাকাশে প্রণামের ভঙ্গিতে ঢলিয়া পড়ে, সেইরূপ কুন্তীও খুল্লতাতর চরণে প্রণাম করিয়া”... এরকম বহু উপমাই উদ্ধৃত করা যায়।
এ গল্পের এক জায়গায় লেখক বলেছেন— “কবি! জগতে অন্য কেহ যাহা পারে না, একজন কবি তাহা পারেন।” আর এক জায়গায় বলছেন— “মহাকবি জানেন। তিনি সবই জানেন। কিন্তু তাঁহাকে সবকিছু খোলাখুলি প্রকাশ করিতে নাই, আভাসটুকু রাখিয়া যান মাত্র।” এতো শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে অমোঘ উচ্চারণ। কবি নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যভাবনা। এভাবেই একজন কবি, একজন মরমী দার্শনিক পা টিপে টিপে গল্পের ভিতরে ঢুকে পড়েছেন। কিছু গভীর ও গহন কথা বলে পাঠকের অজান্তেই ফিরে গেছেন আবার। তাই কারও কারও এই গল্প সংকলনকে দর্শনের গ্রন্থও মনে হয়।
পুরাণ এবং লোকভাবনা অনুযায়ী চাঁদ পুরুষ চরিত্র। আর নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের ‘পাণ্ডুর চাঁদ’ গল্পে সে যুবতী নারী, মহাভারতের পাণ্ডুর প্রেমিকা। চাঁদের যা সৌন্দর্য তা তো যুবতী নারীর-ই। তাই লেখকের চিন্তায় সে সুন্দরী রমণী। অথচ সে স্বামী পেল না। “কোনও কোনও রূপ আছে যাহার খুব কাছে যাওয়া যায় না। একটি স্বভাবজ দূরত্ব আপনা হইতেই রচিত হয়। ইহার পর্যাপ্ত বৈভব ইহার রহস্য। ইহার মায়া। এই-ই নিয়মিত ইহার—স্বামী চাইতে দেয় না। প্রেমিক তাহাকে কামনা করে, কিন্তু কাছে যাইতে দেয় না। নয়নে নয়ন মিলিয়া যাইবার পরেও না।”
পাণ্ডুর মৃত্যুর পর কুন্তী নিদ্রাহীন। রাতে মাঝে মাঝে “ঈশ্বরের দেহের ন্যায় প্রকৃতির নির্জনতায় এসে বসেন। চাঁদকে ডেকে গল্প করেন। চাঁদ ও কুন্তী দুই সপত্নী (?)-র অসূয়া-ঈর্ষা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে গল্পে। সুযোগ পেলেই উভয়েই উভয়কে খোঁচা দেবার চেষ্টা করেন। চাঁদকে কুন্তী পান সাজতে বললে তিনি বলেন “মহারাজ পাণ্ডু এক-একদিন কত যে পান খাইতেন!” অথচ স্বামীর পান খাওয়ার কথা কুন্তীর অজানা। বিস্মিত কুন্তী খোঁচা দিয়ে বললেন— “পান কি আর নিজ নারী সাজিয়া দিলে নেশা হয়।”
পাণ্ডুর প্রেমিক হৃদয়ের বেদনা মূর্ত হয়েছে এ গল্পে। পাণ্ডু যে নিজ নারীর কাছেও প্রতারিত তার ইঙ্গিত আছে। তিনি বিশ্বাস করতে ভালোবাসতেন। “ইহা যে মৃত্যুর কারণ হইতে পারে, এই ক্ষত্রিয়বোধ তাঁহার ছিল না। তাঁহার ন্যায় সরল বালক লইয়া মহাকবি কী করিবেন, ভাবিয়া না পাইয়া, যাহা করিলেন তাহা চিরকালীন অবগুণ্ঠনে ঢাকা রহিয়া গেল।”
এই গল্পে দুটিমাত্র লাইনে বিদুরের প্রসঙ্গ এনে কুন্তীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের গভীরতার ইঙ্গিত দিয়েছেন লেখক। রাতে কুন্তী ঘর ছেড়ে নির্জন প্রকৃতির মধ্যে এসে বসলে, মাঝে মাঝে বিদুর এসে পাশে বসতেন। কুন্তী তাঁর আঁচল পেতে দিলে বিদুর খুশি হতেন। লেখক বিদুরের মুখে বসিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের গান— “কাঁদালে তুমি মোরে...”। বিদুর এ প্রসঙ্গে বলেছেন— “বহুদিন পর বেদব্যাসের উত্তরপুরুষ ইহাকে সম্পূর্ণ করিবেন।” বলা বাহুল্য এখানে রবীন্দ্রনাথকেই ইঙ্গিত করেছেন লেখক।
রামায়ণ-মহাভারতের মহাকবিরা আভাসে-ইঙ্গিতে যে কথা বলেছেন অথবা বলেননি, তাঁদের উত্তরপুরুষ নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের হাতে তা পূর্ণতা পেয়েছে। মহাকাব্যের খলচরিত্রগুলিও তাঁর হাতে মহৎ হয়ে উঠেছে। এই গল্পগুলির আবেদন চিরন্তন, সময়ের সঙ্গে তা ফুরিয়ে যাবে না।
নারায়ণ মুখোপাধ্যায় আশৈশব রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের ভাবনায় মগ্ন থেকেছেন। এই গল্প লেখার অনেক আগে থেকেই তাঁর ভাবনালোকে চলেছে মিথ-কিংবদন্তীর এহেন পুনর্নির্মান। আত্মজীবনী ‘অনুধ্যান’-এ এই প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে এসেছে বারবার।
“সেই ঘন বর্ষার রাতে আমি মনে মনে এক অদ্ভুত রামায়ণ রচনা করতাম। সে রামায়ণের সঙ্গে মহাকবির মহাকাব্যের তেমন কোনও মিল থাকা তো সম্ভব নয়, থাকতও না। তা ছিল আমারই অ-লিখিত কাব্য...
সীতা কহে এই বনে রাক্ষসের ঘর।
কোথায়, দেখাও মোরে, ও আমার বর।।
এই যে গাছেরে দেখি দেখি লতাপাতা।
একবারও শুনি না তো রাক্ষসের কথা।।
কী কও লক্ষ্মণ ভাই, দেখাও রাক্ষস।
ঘুমাতে না পারি রাত্রে শুনি খস খস।।
আসলে, রামায়ণ-মহাভারত-মনসামঙ্গল এবং ভূতের গল্প, পরির গল্প, পাতালপুরীর গল্প এবং আঞ্চলিক রহস্যময় কাহিনি শোনার পরই মন থেকে তারা ধুয়ে মুছে যেত না। প্রকৃতিজগতের এমন একটা ঘনত্ব ছিল যে তাদের সত্য সত্যই একবার দেখতে চাইত মন। মন দেখত : বেহুলা পান সাজছেন শ্বশুর চাঁদ সদাগরের জন্যে। কী সবুজ নিটোল পান ; কত প্রকারের মশলা! শ্বশুর গল্প করছেন, সাগরের গল্প। সেই গল্প শুনতে শুনতে অসতর্কে জাঁতিতে আঙুল কেটে ফেলেছেন বেহুলা। কী রক্ত কী রক্ত! পিতার মতো করে কোলে বসিয়ে চাঁদ বেহুলার কাটা আঙুলে চুন লাগিয়ে দিচ্ছেন। সনকার দুই চোখে জল আর ধরে না বেহুলার আঙুল কেটে রক্তপাতে।
না, কোনো যোগ থাকত না বাস্তবতার সঙ্গে। বিয়ের রাতেই তো বিধবা বেহুলা। শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে ঘর করবার সুযোগই তো আসেনি তার জীবনে। সে কবে, কখন চাঁদকে পান সেজে দেবার সুযোগ পেল, এসব কোনো কথাই কল্পনার কাছে কিছু নয়। রামায়ন-মহাভারত-মনসামঙ্গল— এই তিন মহাকাব্য আমাদের শৈশবকে প্রাচুর্যে ভরিয়ে রেখেছিল। আমার তো এখন একটা কথা খুবই মনে হয়, তা হল, এই তিন মহাকাব্য কি মায়ের স্থান গ্রহণ করেছিল!
কত কী কত কিছু ভাবতাম এসব নিয়ে! মনে হত— যুধিষ্ঠিরকে দুপুরে ভাত বেড়ে দিয়েছেন কুন্তী। অন্য চার ভাই ভাত নিয়ে বসে আছে, দাদা ভাত মাখবে আলুভাতে ও ঘি দিয়ে। সেই মাখাভাত চার ভাই একমুঠো করে পাবে সবার আগে এবং এভাবেই শুরু হবে মধ্যাহ্নভোজনপর্ব। মাটির দাওয়া। মধুর দক্ষিণাবাতাস আর শান্ত সবুজ চারদিক— এর মধ্যে একটা রাজপরিবার কেন খেতে বসবে, যাঁরা তখনও বনগমন করেনি, এর কোনো যুক্তি নেই।”
নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের গল্পে সবসময় বাস্তব যুক্তি খুঁজলে হতাশ হতে হবে। শুধু পুরাণ অনুষঙ্গে লেখা গল্পে নয়, তাঁর কোনও গল্পেই বহির্বাস্তব গুরুত্ব পায়নি। প্রাধান্য পেয়েছে অন্তর্বাস্তব এবং কল্পনা। গল্পগুলিতে মায়াবি ও রহস্যময় আবহ তৈরি হয়েছে এই লেখকের আত্মদর্শন ও বোধের প্রগাঢ়তায়। সমগ্র গল্প নয়, গল্পের এক-একটি অংশ, কখনও-বা এক-একটি লাইন বা একটি শব্দ— তার অপার ব্যঞ্জনা ও রহস্য নিয়ে পাঠককে ভাবায়। সেই ভাবনার বৃত্ত ভেঙে সহজে নিষ্কৃতি পান না দীক্ষিত পাঠক। তাই বহুদিন পর্যন্ত পাঠকের চৈতন্যে এবং অস্তিত্বে মিশে থাকে গল্পগুলির পাঠ-অনুভূতি।
যেমন ‘বৃষভ’ গল্পটি। রক্তের সম্পর্কহীন তিন জা সম্পর্কিত নারীর সংসারে লালিত বছর পঁয়তিরিশের এক স্বভাব বালক একদিন বুঝল— “এই জগতে গরুই একমাত্র প্রাণী যাহার সত্তায় কোথাও চতুরতা নাই এবং এই অর্থে আত্মার মুক্তি।” স্কুলছাড়া গরুতে নিমগ্ন এই বালকটিকে স্নান করিয়ে দেওয়া হয়, খাইয়ে দেওয়া হয়। তার যৌনানুভূতি দেখা যায়নি। একদিন-ই শুধু মেজ জা দেখেছিল— “বালকের পুরুষাঙ্গ হইতে গলিত হীরকের মতো শুক্র নির্গত হইতে এবং তাহা গড়াইবার কালে বালকের মধ্যে ধীর স্থির শান্ত সমাহিত এক দুর্জ্ঞেয় পুরুষের দ্যুতিময় প্রকাশ।”
তারপর বালক বলে “বাঁশি বাজিল।”
আপাতভাবে একটি বালকের যৌবনোদ্গমের এই গল্পে পুরাণের অনুস্মৃতি রয়েছে। এই রূপকধর্মী গল্পেও তিনি সময় সচেতন। বালকটিকে রেখে পাকিস্তান চলে যাবার সময় তার বাবাকে বলতে শুনি— “সংখ্যালঘু না হইলে সভ্যতার স্বরূপ চেনা যায় না।”
এই ছোট্ট একটি মন্তব্যে বোঝা যায় সময় ও রাজনীতি সচেতন লেখকের অবস্থান ও মানসিকতা। নারায়ণ মুখোপাধ্যায় তাঁর লেখায় সমসময়কেও ছুঁয়ে থাকেন। কিন্তু শুধু সমসময়ের চৌহদ্দিতে তা আটকে থাকে না। সমকালকে আবহমানেরই অনিবার্য অঙ্গ হিসেবে দেখেন তিনি।
লেখকের এই সময় সচেতনতার স্বাক্ষর ‘শ্যামবাবু’ গল্পটি। শ্যামবাবু আসলে একটি ফোটো। কার ফোটো কেউ জানে না। বাড়ি বদলের সময় অন্যান্য জিনিসপত্রের মতো এই ফোটোটিকেও নিয়ে যাওয়া হয়। পারিবারিক যে কোনও উৎসবে অনুষ্ঠানে, শাদ্ধে, পূজায় চন্দনের ফোঁটা পড়ে শ্যামবাবুর ফোটোয়। অথচ কেন মানুষটি সম্মানীয় তা কেউ-ই জানে না।
আধুনিক মানুষের যান্ত্রিকতা ও বিভাজিত সত্তার চরম রূপটি প্রকাশিত এই গল্পে। আমাদের চমকে উঠতে হয় যখন দেখি, দু-কাপ চা এনে এক কাপ লেখক নেন আর এক কাপ চা রাখেন শ্যামবাবুর ফোটোর নীচে। নির্বিকার শ্যামবাবু তখনও স্থির। নিবিড় নির্জন এই স্থিরতা। এই ফোটোতে যেন আবহমানকে ধরা রয়েছে। একটিও কথা না বলে শ্যামবাবু বাঙ্ময় এ গল্পে।
নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের গল্পে বড়ো জায়গা জুড়ে থাকে নৈঃশব্দ্য। কখনও-বা তা বিষয় হয়ে ওঠে। আর গল্পের পাঠক্রিয়ায় বোঝা যায় বাঙ্ময় সেই নীরবতার অপার ঐশ্বর্য। সাধারণ ঘটনা দিয়ে যে গল্পের শুরু হল তা শেষ পর্যন্ত অন্য এক মাত্রায় উন্নীত হয়ে গেল। শুধু শোনার চাকরি করা একটা সাধারণ মানুষ কোনও কিছু না বলেও অসাধারণ হয়ে উঠতে পারল। নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের মুনশিয়ানা এখানেই।
নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের গল্পে এক ধরনের আলো-আঁধার ক্রিয়া করে। জীবন-রহস্যের গহন থেকে উঠে আসা তাঁর গল্প আমাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে। কখনও বা সুররিয়ালিস্টিক সিনেমার মতো দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজানো এই গল্পের পাঠক্রিয়ায় বুনুয়েল বা তারকোভস্কির ছবি মনে পড়ে কারও কারও। আবার কখনও মনে হয় এক-একটি কবিতাই পড়ছি যেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্রকে ছাপিয়ে, কবিতাকে ছাপিয়ে তা হয়ে ওঠে ছোটগল্প। সেই গল্পের আঙ্গিকে এক ধরনের দেশজতা আছে। ছোটোগল্পের প্রচলিত ধারণাকে অতিক্রম করে গেছে এই গল্প। এভাবেই এগিয়ে চলে একটি ভাষার সাহিত্য। বাংলা ছোটোগল্পকে সমৃদ্ধ করেছে নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের অতি বিশিষ্ট গল্পগুলি। আর এই গল্পগুলি পাঠককে শুধু গল্পপাঠের আনন্দই দেয় না, কখনও শিহরিত করে, কখনও আচ্ছন্ন করে, আবার কখনও-বা তাকে স্রষ্টাও করে তোলে।
শুধু গল্প নয়, তাঁর গদ্য, এমনকী আত্মজীবনীর ভাষাও একাধারে কাব্যময়, মায়াবী, বোধ ও দার্শনিকতায় মোড়া। সন-তারিখের প্রামাণ্যতা সেখানে নেই। তাঁর লেখক জীবনের সাফল্য ব্যর্থতার প্রসঙ্গও পাওয়া যাবে না সেখানে। নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের ‘অনুধ্যান’-কে আত্মজীবনী হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও তা আত্মচরিতের থেকে বেশি কিছু। একে আত্মগত স্মৃতিকথন বলা অধিকতর সঙ্গত। নিজের জীবন— বেঁচে থাকা— স্মৃতি সম্পর্কে তিনি বলছেন— “আয়ু থেকে জীবনকে আমি অনেকটাই তো বের করে আনতে পেরেছি। আয়ুকে বলেছি : আপনি দীপ-টিপ নিবিয়ে অনন্ত নিদ্রা যান। আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আমারই ‘অসীমে প্রাণমন লয়ে’ থাকব। এ আমার নিজের থাকা। এর কোনো দাগ নেই, স্মৃতি থাকবে না, বন্ধু থাকবে, যেন খেয়া। কোনো কারণ, কোনো উদ্দেশ্য, কোনো তাগিদ নয়— আমি আত্মার কানে কানে কওয়া অস্পষ্ট কিছু কথার প্রকৃত অর্থ না বুঝতে পেরে ভেবেছি— বুঝি আমার স্মৃতি, নিজের জীবনের স্মৃতি আমি নিজেই শুনতে চাইছি।”
ধ্যানলোকে নিজেই শুনেছেন নিজের কথা। নিজের সঙ্গে নিজের সংলাপ। এরই নাম ‘অনুধ্যান’। এখানে লেখকের প্রাত্যহিক ঘটনা প্রবাহ প্রাধান্য পায়নি। বিশেষ কোনও চরিত্রও নয়। তবুও ভিড় করে অজস্র মুখ। স্মৃতির সরণী বেয়ে উঠে আসা মুখশ্রীকে লেখক নিজেই ফিরে ফিরে দেখেন। মনের মাধুরী মিশিয়ে কথায় কথায় আঁকা সেই সব চরিত্র। খুঁজতে চান মানুষের ভিতরের এক অচিন মানুষকে। জীবন-অভিজ্ঞতার সূত্রেই তদ্গত এবং নির্জন তাঁর সেই অন্বেষণ।
“এখন খোঁজ-এ পেয়েছে আমাকে। কোনোকিছুই অ-সার হয় না। এই প্রকার অবস্থা যাকে বীভৎস বলে সবাই; আমার যেন মনে হয় এসব মিথ্যা। এসব ছলনা। শুধু ভয় দেখানোর একটা চলমান চলচ্চিত্র। একে সিরিয়াল ছাড়া কিছুই মনে হয় না।
আবার, এই যে সিরিয়াল, যারা দেখে, আমার সংসারের লোকেরাও দেখে, তাদের মনে এর এফেক্ট কই, দেখি না তো! একটু দুর্বৃত্ত স্বভাবের হবে তারা। কিন্তু, দেখতে পাই, একদিন যে রমণী ভারতীয় নারীত্ব তুচ্ছজ্ঞান করে কিছুটা পাশ্চাত্য স্বভাব ধারণ করে প্রতিহিংসাপরায়ণ, হিংস্র প্রকৃতির বিলোপনীতির পথে আত্মধ্বংসের দিকে ছুটেছিল,— আজ সে শিশির যেমন করে পত্ররাজিতে নিজেকে ঢেলে দেয় নীরব রাত্রির বসুন্ধরায়, সেইভাবে, কী একটা মুদ্রায়, নিভৃতে কিছু একটা করছে। এটি অনুশীলন পর্ব। অনুশীলনপর্বে শব্দ করতে নেই। নৈঃশব্দ্য ধারণ পত্ররাজির আত্মার ধর্ম। মানুষ পারে না তেমন।
আমার মনে পড়ে, এমন করে মনে পড়ে যেন আমি নিজের চোখে দেখি— কৃষ্ণকে। কুরুক্ষেত্র-টেত্র সব মিটে গেলে কৃষ্ণের এই নৈঃশব্দ্যধারণপর্ব শুরু হল, অগোচরে। এমনকী, যাঁর অবলোকন থেকে জগৎ সংসারের একটি রেণুকারও অগোচর কিছু নেই,— সেই মহাকবিরও অগোচরে। সেই, সে-ই অগোচরে বসে নৈঃশব্দ্য ধারণ করছেন কৃষ্ণ। চতুর্দিকে, প্রথমে পেলেন দুর্গন্ধ।
যে যত বড় লোভী তার মৃতদেহের গন্ধ তত তীব্র, তত বমন উদ্রেককারী। একটা যেন হা হা হা। অথচ যার মধ্যে দাঁড়িয়ে তাঁর সাধের কদম্ববৃক্ষ নির্বিকার। তার বাঁশি নীরব হলেও, অন্য কী একটা সুর যেন গাইছে যার নিথর বাণী অনেকটা নৈবেদ্য বুঝি-বা।
কেউ তাঁর মনের খবর জানলে খণ্ড জীবন অখণ্ডের পানে ধায় না। তাই জানিয়ে দিলেন তিনি—কে এক আধুনিকতার ব্যাধ তাঁকে আড়ষ্ট করে দিয়েছে। জানল সবাই— নাই সে পথদ্রষ্টা নাই। কিছু করবার নেই— কাঁদালে তুমি মোরে— এ হল আত্মোপলব্ধির জানান।
দেখলেন কৃষ্ণ অঙ্কুরের মতো নির্বাপণপর্বের শ্বেত স্ফটিক উদ্ভাসের একেবারে সংগোপনে প্রাণ উঠছে জেগে। তার কাঁপন এমন ছাঁদে যে কাঁপন নিজেই কিছু টের পায় না। শ্যামল হয়ে থাকা তাঁর শুভ্র শ্বেত ধ্বনিবিহীন শুদ্ধ কান্না যেন-বা।”
চমৎকার গদ্য, ব্যঞ্জনা, প্রসাদগুণ, আখ্যান, চরিত্র সব বাদ দিলেও নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের গল্প-আত্মজীবনী— সমগ্র রচনায় যা পড়ে থাকে তা হল দর্শন। তাঁর সমগ্র রচনায় নিহিত রয়েছে এক ম্যাজিক্যাল ইউনিভার্স-এর অতল জগত। এখানেই তিনি স্বমহীম। তিনি বাস্তববাদী নন কোনোকালেই। বরং তিনি বিশ্বাস করেন যে—“যা ঘটছে তার সবই মিথ্যা। মিথ্যার কি এত বড় ধৃষ্টতা হতে পারে যে তা সত্যকার জীবনে অতিথি হয়েও কাটাতে পারে!”(‘অনুধ্যান’) তিনি যে সত্যে বিশ্বাস করেন তা চোখে দেখার সত্য নয়। এই বোধ এবং চেতনার সত্যতাই তাঁর গল্প এবং আত্মজীবনীর বড় সম্পদ। গভীর বিশ্বাস থেকেই উঠে আসে বলে তাঁর রচনাগুলি পড়তে পড়তে আমরাও কোন্ গহনে তলিয়ে যাই। শুধু রচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা যায় না আর। তাঁকে পড়তে গিয়ে আমরা যেন নিজেকেই পড়ে ফেলি। এ এক বিশেষ অভিজ্ঞতা। আশ্চর্য অনুভব। এই ধ্রুপদী অনুভবই আমাদের ভবিষ্যতের অন্নজল।
6 Comments
অসাধারণ। এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হীরকখন্ড তুলে এনে আমাদের কাছে সাবলীল ভাষায় উপস্থাপিত করার জন্য লেখক বিশ্বজিৎ পাণ্ডাদা ও জ্বলদর্চি পত্রিকাকে অশেষ ধন্যবাদ দিচ্ছি।--আজ নারায়ণ🙏 মুখোপাধ্যায়কে চিনলাম ও জানলাম।--যার '' সমগ্র রচনায় নিহিত রয়েছে ম্যাজিকেল ইউনিভার্সের -এর অতল জগত।
ReplyDeleteআগামী পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDeleteকেয়া বাত!!!💐💐💐
ReplyDeleteজানতাম না। জেনে বিস্ময়ে মুগ্ধ। লেখককে ধন্যবাদ এই অসামান্য লেখকের সংগে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য।
ReplyDeleteভালো লেখা। অনেকেই তো জানেনা নারায়ণ মুখোপাধ্যায়কে।পড়ে যদি আগ্রহ জন্মায়। তোমাকে ধন্যবাদ নয় ভালোভাসা।
ReplyDeleteনারায়ণ মুখোপাধ্যায়কে পড়তেই হবে। এখনই। এই আগ্রহ জাগিয়ে দিলেন লেখক। ধন্যবাদ দিই।
ReplyDelete