জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৩৩/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৩৩

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

স্বামী সারদানন্দ

শ্রীরামকৃষ্ণের এক ধুরন্ধর সন্ন্যাসী সন্তান হলেন স্বামী সারদানন্দ। কলকাতায় ধার্মিক ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান ছিলেন। পূর্বাশ্রমের নাম শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী। যুবা বয়সে কেশবচন্দ্র সেন প্রবর্তিত ব্রাহ্মসমাজের সদস্য ছিলেন। ব্রাহ্মসমাজের দৌলতেই শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসেন। 

১৮৮৩ সালে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে ব্রাহ্মসমাজের বার্ষিক উৎসবে যোগদান করতে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম দর্শন করেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর এক আত্মীয় (তুতো ভাই শশী )। শ্রীরামকৃষ্ণদেব অত্যন্ত সাদরে অভ্যর্থনা জানান তাঁদের। কিছু প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর ঠাকুর বলেন, আধ্যাত্মিকতার পথে তাঁদের এগনো উচিত, তাহলে জাগতিক মলিনতা স্পর্শ করতে পারবে না। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসারের পঙ্কিল আবর্তে পড়ে যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেন। দুই যুবা ঠাকুরকে প্রশ্ন করেন, “তাহলে বিবাহ করা কি অপরাধ? এটি কি ঈশ্বরের ইচ্ছাবিরুদ্ধ?” তিনি তখন তাঁদের ঘরের তাক থেকে একটি বই পেড়ে আনতে বলেন। বইটির নির্দিষ্ট একটি অনুচ্ছেদ পাঠ করার নির্দেশ দেন। বইটি বাইবেল। সেখানে যিশু খ্রিস্ট ও সন্ত পলের উপদেশাবলি লিপিবদ্ধ। বিষয়--অবিবাহিতরা ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়ার ব্যাপারে এগিয়ে। খ্রিস্টের উক্তি এইরকম --“For there are some eunuchs, which were so born from their mother's womb: there are some eunuchs, which were made eunuchs of men; and there be eunuchs, which have made themselves eunuchs for the kingdom of heaven's sake. He that is able to recieve it, let him recieve.” আবার সন্ত পলের উক্তিটি এইরকম -- 

“I say therefore unmarried and widows, it is good for them if they abide even as I. But if they can not contain, let them marry: for it is better to marry than to burn.” এই অনুচ্ছেদ পাঠকালে শ্রীরামকৃষ্ণ স্পষ্টতই তাঁদের জানালেন, বিবাহই সমস্ত বন্ধনের মূল। এইভাবে শরৎ ও তাঁর আত্মীয় ( তুতো ভাই শশী ) ত্যাগসমৃদ্ধ জীবনের মাহাত্ম্য শুনলেন।


 শ্রীরামকৃষ্ণের প্রবল অনুরক্ত হয়ে পড়লেন শরৎ। দক্ষিণেশ্বরে প্রায়ই তাঁর কাছে যেতে থাকলেন। শীঘ্রই একান্ত অনুগামী হয়ে ওঠেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময় শরৎ কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে এফ এ ক্লাসে পাঠরত ছিলেন। পরীক্ষা পাশের পর মেডিকাল কলেজে যোগদান করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ স্বভাবসিদ্ধভাবে তাঁর সামনে নির্দিষ্ট আধ্যাত্মিক আদর্শের রূপ প্রতিভাত করেছিলেন। একবার তিনি শ্রীশ্রীগণেশের গুণবন্দনায় মুখর হন। গণেশের অপার প্রেম ও পবিত্রতার কথা বলেন। উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্য থেকে শরৎ বলে ওঠেন, “গণেশের এই ভাবনা আমার খুব প্রিয়। গণেশের আদর্শই আমার আদর্শ।” ঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে সংশোধন করে বলেন, “না, গণেশ তোমার আদর্শ নয়। তোমার আদর্শ হল শিব। তোমার মধ্যে সুপ্তাবস্থায় বিরাজ করছে শিবের গুণাবলি। সর্বদা নিজেকে কল্পনা করবে শিবরূপে এবং আমাকে তোমার শক্তি হিসেবে। আমিই চূড়ান্তভাবে সমস্ত শক্তির আধার।” এই কথার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বহন করা দুরূহ। তবে পরবর্তী সময়ে সারদানন্দজী মহারাজের সান্নিধ্যে এসে অতি সাধারণ মানুষও অনুভব করতেন তাঁর শিবতুল্য গাম্ভীর্য ও মহিমা। আর প্রকৃত অর্থেই জীবনে রূঢ় বাস্তবরূপী ‘বিষ’ পান করেও সকলকে অকাতরে বিলিয়েছেন স্নেহ, আশীর্বাদ, ভালোবাসা ও করুণা! 

 শ্রীরামকৃষ্ণের দেহাবসানের পর নরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে তাঁর ত্যাগী সন্তানেরা বরানগর মঠে অপূর্ব তপস্যাপূত জীবনের সূচনা করেন। বরানগর মঠই ছিল রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রথম মঠ। তাঁদের সমস্ত মনপ্রাণ নিবেদিত থাকত ঈশ্বরের প্রতি। ঈশ্বর ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। কোনও কোনও সময়ে শরৎ-এর ধ্যান ও আধ্যাত্মিক উত্তাপের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন নরেন্দ্রনাথ। কিন্তু মঠের এই কঠোর তপস্যাপূত জীবন ত্যাগী যুবক সন্ন্যাসীবৃন্দকে সম্পূর্ণভাবে পরিতুষ্ট করতে পারেনি। ফলে শীঘ্রই পরিব্রাজক জীবনের অনুগামী হলেন তাঁদের অনেকেই। পুরী গমনের পর সারদানন্দজী কলকাতায় ফিরে পুনরায় হিমালয়াভিমুখী হন। কেদারনাথ ও বদরিনরায়ণ তীর্থ দর্শনের পর এসে পৌঁছন আলমোড়ায়। সেইসব দিনগুলি ছিল কঠোর তপস্যায় পরিপূর্ণ। হৃষিকেশেও কিছুকাল সাধনায় অতিবাহিত করেন। এইভাবে কয়েক বৎসর সাধনায় পরিপূর্ণ জীবন যাপনান্তে তিনি বরানগর মঠে প্রত্যাবর্তন করেন। সেখানে দীর্ঘকাল অবস্থানের পরিসর গড়ে ওঠার পূর্বেই ১৮৯৫ সালে স্বামী বিবেকানন্দ কর্তৃক লণ্ডনে আহূত হন। স্বামীজী তখন লণ্ডনে। ১৮৯৩ সালে শিকাগো ধর্মহাসভার ঐতিহাসিক ঘটনা ততদিনে ঘটে গিয়েছে। বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছেন স্বামী বিবেকানন্দ।

 ১৮৯৫ সালের এপ্রিল মাসে লণ্ডনে গিয়ে পৌঁছন স্বামী সারদানন্দ। মার্কিন মুলুকে বেদান্ত শিক্ষানবিশদের আন্তরিক আগ্রহে ও অনুরোধে স্বামীজী তাঁকে নিউ ইয়র্কে বেদান্ত প্রচারের জন্য প্রেরণ করলেন। তাঁর অতীব মিষ্ট, গাম্ভীর্যপূর্ণ আচার্যতুল্য ব্যক্তিত্ব অচিরেই তাঁকে সকলের শ্রদ্ধাভাজন করে তোলে। গ্রিন একরে তুলনামূলক ধর্ম সম্মেলনে অন্যতম আচার্য হিসেবে আমন্ত্রিত হন বেদান্ত বিষয়ক বক্তৃতা ও যোগ ক্লাসে শিক্ষাদানের উদদ্দেশ্যে। অধিবেশনান্তে সারদানন্দজী বক্তৃতা দান করেন ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক ও বস্টনে। ব্রুকলিন এথিকাল অ্যাসোসিয়েশনে তিনি হিন্দু নৈতিক আদর্শ বিষয়ে বক্তৃতা দান করেন। সর্বত্রই বেদান্ত প্রচারকালে বহুসংখ্যক একনিষ্ঠ অনুগামী গড়ে ওঠে তাঁর। এরপর চূড়ান্তভাবে নিউ ইয়র্কে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেন। উদ্দেশ্য আরও ভালোভাবে বেদান্ত প্রচার। নিউ ইয়র্কে বেশ কিছু সেরা মানুষের মধ্যে ও পরিপার্শ্ব অঞ্চলে তাঁর বেদান্ত ভাবধারার প্রচার গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। কেমব্রিজ সম্মেলনেও আচার্যের ভূমিকা পালন করেন। এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন এইরকম --

 “In Cambridge the classes in the Vedanta philosophy, constituting a single feature in the broad field of comparative study outlined for Cambridge conferences, attracted large and intelligent audiences, in part made up of professors and students of the Harvard University. The swami's exposition of the principles of the Advaita Doctrine, in just comparison with other views which are held in India, admirably lucid and clear. His replies to questions were always ready and satisfactory. His great fairness of mind and soundness of judgment enabled him to present the doctrine in a manner which at once convinced all of his sincerity and earnestness, while it disarmed the factious oppositions which are stirred up by a more dogmatic and assertive manner. In Boston, Waltham and Worcestar, Mass., the Swami Saradananda also conducted courses of lectures which were largely attended and which everywhere manifested a sustained interest in his subject. At Worcester he addressed the students of the Clark University by invitations of President G.Stanley Hall, and in providence, R.I., he spoke before the philosophical club of the Brown University by invitation of Prof. E. B. Delbatre whose guest he was in the city.” ( প্রবুদ্ধ ভারত, অক্টোবর,১৯২৭ সংখ্যা )

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments