জ্বলদর্চি

পথরেখা গেছে মিশে - পর্ব ১/মিলি ঘোষ

পথরেখা গেছে মিশে - পর্ব ১

মিলি ঘোষ

বট বৃক্ষের ছায়ায়

 অপরাজিতা তখন বেশ ছোটো, স্কুলেও ভর্তি হয়নি। পাখার তলায় গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকত। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখে বাবা পড়াচ্ছে আর কত কত বড় দিদিরা সব পড়তে এসেছে। অপা উঠেই দৌড়।  তারপর থেকে বাবা যে ঘরে পড়াত,ঘর খালি থাকলেও অপা আর যেত না সে'ঘরে ঘুমোতে। দিদিগুলো যদি আবার হাসে তাকে নিয়ে। মায়ের কাছে অনুযোগ করেছিল, "বাবা কেন আমাকে ডেকে দেয়নি।" মা শুনে হেসেছিল। 

একটা জিনিস মাথায় ঢুকত না অপার, বাবা দুপুরের স্কুলে পড়ায়, সেখানে সবাই মাস্টার মশাই। আবার সকালে মেয়েদের স্কুলেও পড়ায় কেন, সেখানে তো অন্য কোনো মাস্টার মশাই নেই ? তবে, অপা এটা লক্ষ্য করেছে, মেয়েদের স্কুলে বাবা বেশিক্ষণ থাকে না। টিফিনের সময় বাড়ি আসে, মা'র বানানো রুটি, তরকারি খেয়ে, খবরের কাগজ পড়ে আবার চলে যায়। এক দেড় ঘণ্টার মধ্যে ফিরেও আসে। কিন্তু দুপুরের স্কুলে সেই যে বাবা যায়, ফেরে একদম বিকেলে। অপা জানত, বাবার স্কুল বাড়ির কাছেই। বাবা যে স্কুলের কাছেই বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল, তা বোঝার মতো বুদ্ধি বা বয়স কোনওটাই অপার তখন হয়নি। 

অপাদের বড় সংসার। বাবা'ই একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি। সে সময়ের শিক্ষকদের বেতন বর্তমানের প্রেক্ষাপটে বিচার্য নয়।
 ইতিমধ্যে অপা বুঝে গেছে সকালের স্কুলে একটু উঁচু ক্লাসের মেয়েদেরই বাবা পড়াতে যান। আর 'পার্ট টাইম' বলে একটা শব্দ তার কানে আসতে শুরু করেছে। এ ছাড়াও 'মর্নিং সেকশন', 'ডে সেকশন' এইসব শব্দের সাথেও সে পরিচিত হতে লাগল। সে দেখে, তার ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাবার ছাত্রীরা পড়তে এসে যায়। তারা চলে গেলে ওই পার্ট টাইম না কী যেন বলে, সেখানে যান বাবা। ফিরে এসে স্নান করে খেয়ে দুপুরের স্কুলে যান। সন্ধ্যের পরে আবার ছাত্ররা আসে পড়তে। তারপর রাত নটার পরে অপাদের ইংরেজি পড়ান বাবা। এখানেই অপার যত আপত্তি। যদিও মুখে সে'কথা বলার সাহস নেই। তবে সুবিধা একটা ছিল, পড়া বুঝিয়ে আর পড়া ধরতেন না বাবা। এই সুযোগে মনের আনন্দে ফাঁকি মারত অপা। 

 কেউ যদি জানতে চাইত, "তোমার বাবা কি সকালের স্কুলেও পড়ান ?" 
অপা ঘাড় নেড়ে গম্ভীর মুখে বলত, "হ্যাঁ, পার্ট টাইম।" 
আসলে মর্নিং সেকশনে অপার বাবা উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রীদের ইংরেজি ক্লাস নিতেন। কিন্তু ডে সেকশনে তো আর পার্ট টাইম পড়ানোর ব্যপার নেই। সেখানে ক্লাস অনেক বেশি। 
অপার বাবার মধ্যে ছিল সূক্ষ্ম রসবোধ এবং কখনো কোনো ছাত্রের সাথে রূঢ় ব্যবহার করতেন না। এর ফলে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হতো। বাড়িতে যারা পড়তে আসত, অপা দেখেছে, তারা অনেক সময়ই বাবার কাছে তাদের পারিবারিক সমস্যার কথা, আর্থিক সমস্যার কথা আলাদা করে ডেকে বলত। বাবা সেই মতো তাদের পাশে থাকতেন। অথচ, এই অর্থের জন্যই কিন্তু বাবা সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। 

অপরাজিতাদের আদিবাড়ি ছিল, বাংলাদেশের বরিশাল জেলায়। বাবার কাছে শুনেছে অপা, বরিশাল বিএম কলেজে বাবা চার মাইল পথ পায়ে হেঁটে যেতেন। সেখানে ছাত্রীদের আলাদা বসার ব্যবস্থা ছিল। একই ঘরে ছাত্রীরা বসত একটা পর্দা ঘেরা অংশে। 
বাংলাদেশ তখন উত্তাল। অপার বাবা, জ্যাঠা পরিবার নিয়ে কোলকাতায় চলে এলেন। শুধু থেকে গেলেন দাদু, একা। এদিকে কোলকাতায় বসে চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছেন বাবা, জ্যাঠা। খবর নেবার কোনও উপায় নেই। এ সবই অপার জন্মের বহু আগের কথা। 
এক সন্ধ্যায় একজন মুসলমান ভদ্রলোক, যিনি অপার দাদুকে খুব সমীহ করতেন, জানলা দিয়ে ডেকে বলেছিলেন, "দাদা, আপনি পালিয়ে যান। আজ এই অঞ্চল জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। এখনই পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান।"
বাড়ি-ঘর-পুকুর-গাছপালা সব কিছু ফেলে রেখে এক বস্ত্রে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন অপার দাদু। 
একদিন অপার মা, বাইরের দরজায় এলোপাথাড়ি কষাঘাত শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখেন দাদু দাঁড়িয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো। মা'কে দেখে চিৎকার করে কান্না, সব ফেলে এসেছি, সব ফেলে এসেছি। 
এই ধাক্কা নিতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারান দাদু। ঘরে আটকে রাখতে হতো, নাহলে জ্বালিয়ে দিল, জ্বালিয়ে দিল বলে ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে যেতেন। 
বাবার কাছে এসব ঘটনা যখন শুনত অপা, গলার কাছটা দলা পাকিয়ে আসত। প্রাণপণ চেষ্টা করত, চোখের জলটা যেন বাইরে বেরিয়ে না আসে। 

অপার বাবা যেদিন স্কুলের শিক্ষকতা থেকে অবসর নিলেন, সেদিন মর্নিং সেকশনের ক্লাস ফাইভের একটি ছোট মেয়ে স্টাফ-রুমের সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছিল আর বলছিল, "মাস্টার মশাই আপনি যাবেন না।" এমন নয় যে, মেয়েটিকে কোনওদিন পড়িয়েছেন তিনি। ফাইভের ক্লাস তো তাঁর থাকতই না। তবু মেয়েটি চাইল, মাস্টার মশাই থাকুন। অবুঝ বালিকা আশা করেছিল, তার অনুরোধে হয়ত মাস্টার মশাই থেকে যাবেন। স্টাফ রুমের অন্য সব দিদিমণিদের তখন চোখে জল। প্রধান শিক্ষিকা মহাশয়া মেয়েটিকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ক্লাসে পাঠান। ভালোবাসার এ বন্ধন ছিন্ন করে বেরিয়ে আসা যে কী কঠিন, অপার বাবা সেদিন তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। 
আরও একটি ঘটনার কথা না বললেই নয়। অপা তখন টু কী থ্রিতে পড়ে। সেদিন স্কুলের বাৎসরিক পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। ইলেভেনের একটি মেয়ে প্রায় দৌড়ে এসে তার মাস্টার মশাইয়ের কাছে আছড়ে পড়ল। বড়োদের কোনওদিন এভাবে কাঁদতে দেখেনি অপা। সেই বড়ো দিদিটার আকুল কান্না, "মাস্টার মশাই, আমি পাশ করতে পারিনি," যা অপার শিশু মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। 
বাবা বোঝালেন, "এবার প্রথম থেকে ভালো করে পড়ো, দেখবে তোমার ভালোই হবে।"
কিন্তু মেয়েটির কান্না থামে না। অপার মা, বাবা অনেক বুঝিয়ে তাকে বাড়ি পাঠাতে পারেন। 
একটি মেয়ে, তার অসাফল্যের কষ্ট কার কাছে উজাড় করে দিল ? তার মাস্টার মশাইয়ের কাছে। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কতটা সহজ, সাবলীল ও আন্তরিক হলে, এই ধরনের ঘটনাগুলো ঘটতে পারে। 
কালের নিয়মে বয়স বাড়ে অপার। আজকাল তার অদ্ভুত লাগে, যখন দেখে ছাত্ররা শিক্ষকদের চূড়ান্ত অসম্মান করছে। উপাচার্যকে ঘেরাও করে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলছে, হিসেব মেলে না অপার। এই কী ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক! 

অপার বাবা তখন মৃত্যুর সাথে শেষ লড়াই করছেন। খবর পেয়ে অপা শ্বশুরবাড়ি থেকে ছুটে গিয়েছিল নার্সিংহোমে। বৈশাখের শেষ বিকেলে ঝড় উঠেছিল খুব। বাবা বললেন, "বলো তো কাল বৈশাখী ঝড় ইংরেজি কী ?"
অপা তো অনেক কিছুই বলছে। কিন্তু বাবার মন ভরে না। 
বললেন, "নরওয়েস্টার ( norwester)।
উত্তর পশ্চিম কোন থেকে আসে বলে এর নাম 'নরওয়েস্টার'।"
শিখিয়ে গেলেন মৃত্যুশয্যায়। আর ভুল হয়নি কোনওদিন অপার। এখনো কালবৈশাখী ঝড় উঠলে মনে পড়ে সে'কথা। 

সেই বৈশাখের এক রাতে হারিয়ে গেলেন মাস্টার মশাই চিরদিনের জন্য। রেখে গেলেন অগণিত ছাত্রছাত্রী। স্কুল থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকারা এলেন। বহু লোক ফুলে মালায় ঢেকে দিলেন প্রিয় শিক্ষককে। যে গাড়িতে করে তাঁকে শেষ যাত্রায় নিয়ে যাওয়া হলো, সেই গাড়ির চালক মাস্টার মশাইয়ের এক আত্মীয়ের কাছে জানতে চাইলেন, "ইনি কি মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ?"
আত্মীয় বলেছিলেন, "না। ইনি একজন স্কুল শিক্ষক। ওঁর একটাই পরিচয়, 'মাস্টার মশাই'।"
গাড়ি ছেড়ে দেবার পরেও রাস্তা আটকায় প্রায় শ'দুয়েক লোক। বক্তব্য, "একবার আমরা প্রিয় মাস্টার মশাইকে দেখব।"
গাড়ি দাঁড় করিয়ে মালা ও একটি মানপত্র দেওয়া হয়। দেখতে পেলেন না মাস্টার মশাই। জানতে পারলেন না, এত মানুষের চোখের জলের খবর। মানুষ গড়ার কারিগর তখন চিরঘুমে।

একজন নিরহংকার, পরিশ্রমী, সৎ শিক্ষকের জীবনাবসান হলো। খবর পেয়ে ছুটে এলো ভিন্ন রাজ্যে কর্মরত ছাত্ররাও। আর দেখা হবে না জেনেও ছুটে এলো। 
এতকাল নিশ্চিত আশ্রয় ছিল অপাদের এক বটবৃক্ষের ছায়ায়। অপা অনুভব করল, মাথার ওপর থেকে সেই ছায়াটা যেন সরতে সরতে বহুদূরে একটা বিন্দু হয়ে গেল।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

8 Comments

  1. AnonymousJuly 05, 2022

    আমার চোখও জলে ভরে গেল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. AnonymousJuly 07, 2022

      ধন্যবাদ

      Delete
  2. AnonymousJuly 05, 2022

    সুন্দর লেখা। হৃদয়স্পর্শী।

    ReplyDelete
    Replies
    1. AnonymousJuly 07, 2022

      ধন্যবাদ

      Delete
  3. AnonymousJuly 05, 2022

    Khub mormosporshi lekha.

    ReplyDelete
    Replies
    1. AnonymousJuly 07, 2022

      ধন্যবাদ

      Delete
  4. AnonymousJuly 05, 2022

    বাহঃ খুব সুন্দর!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. AnonymousJuly 07, 2022

      ধন্যবাদ

      Delete