জ্বলদর্চি

এলডোরাডো /শ্রীজিৎ জানা

এলডোরাডো

শ্রীজিৎ জানা



জীবনের পরিণতি শেষ অব্দি এখানে এসে থামবে কোনদিনই ভাবেনি অর্চিতা। ভাববার ফুরসত মেলেনি তার।চোখের সামনে ম্যাজিকের মতো সব ঘটে যেতে থাকে।যেন প্রদীপের দৈত্য তার সমস্ত  হুকুম তামিল করছে।আর অম্নি ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে নিমেষে! হাউই চরকির মতো অর্চিতা তখন সকলকে ছাড়িয়ে উঠে যাচ্ছে উঁচুতে।যেদিকে তাকাচ্ছে, সেদিকেই রঙিন আলোর হাতছানি। মরীচিকার মতো তাকে টেনে নিয়ে গ্যাছে সকলের থেকে দূরে,অনেক দূরে। শেষমেষ ঠিকানা হয়েছে সংশোধনাগারের অন্ধকার এক কুঠুরিতে। বিচারাধীন এক আসামীর বন্দী জীবন। মায়ামৃগ তাকে ভয়ঙ্কর এক অপরাধের চক্রব্যূহতে টেনে নিয়ে গ্যাছে। সেখান থেকে বেরোবার  পথ তার অজানা।

বয়সে তখন খুব বেশি না অর্চিতার। ক্লাস ফোরে পড়া মেয়েকে ছোটই বলা যায়। তবে গড়ন দেখে সেকথা কারুর বিশ্বাস হবে না। কথাবার্তা শুনলে একটু বেশিই পাকা বলে মনে হবে। ফাঁক পেলেই সাজুগুজুতে ব্যস্ত থাকে সে। পাড়া-পড়শীরা ঠেস মেরে কথা বলে আড়ালে আবডালে,
---মা গুণে ঝি। দেখতে হবে ত মা ক্যামন। ঘরে নাই টাকা কড়ি ঝি হবে রাজকুমারী।
স্কুল যাওয়ার পথে ওই কথা অনেকবার শুনেছে অর্চিতা। চা দোকানের মাচা থেকে তাকে দেখলেই বলে,
---গাঁয়ের মেইয়া শ্রীদেবী।
কেন এসব বলে অর্চিতা বোঝে। সে কত আর সাজগোজ করে! স্কুল ড্রেস পরেই তো যায়। শুধু কিনা তার টিউনিকটা হাঁটুর উপরে থাকে। অন্যদের অনেকটা নীচে। আর বাকিরা তেল জবজবে মাথায় ফিতে বাঁধে। তার রেশমের মতো শ্যাম্পু করা চুলে থাকে একটা হেয়ার ব্যান্ড। গা থেকে ভুরভুর করে রজনীগন্ধার সেন্ট বেরোয়। তার মায়ের ওই সেন্টটাই নাকি পছন্দের। এতে কার কী এসে গেল অর্চিতা ভাবে না। তবে রাগ অথবা হিংসে যাই বলা যাক তা যে তার উপরে নয় সেটা বুঝতে অর্চিতার অসুবিধা হয় না।
তার মাকে নিয়ে গ্রামে অনেকেরই চোখ টাটায়। আনাচে কানাচে রসালো গল্প চালাচালি হয়। সবটা মিথ্যে বলে ফেলে দেওয়া যায় না।
তিন ভাইয়ের ঘরে তৃপ্তি মেজ বউ। বড় আর ছোট থাকে কলকাতায়। বড় পোস্টে চাকরী তাদের। অশোক পড়ে আছে বাবার জমিজমা ভিটে আগলে। রোজগারপাতি বলতে তেমন তো কিছুই নেই। কিন্তু তারা যেভাবে থাকে তাতে অনেকের চোখে কৌতুহলের অন্ত  নেই। পাড়ার সবাই জানে অর্চিতাদের রাজার হালে থাকার মূলে তার বিভাস জেঠু। মাসে একবার আসবেই সে কলকাতা থেকে। দিন দুয়েক থেকে আবার চলে যায়। ওই দুদিন বাড়ির পরিবেশ হঠাৎ যেন অন্যরকম হয়ে যায়। কত রকমের ভালো ভালো খাবার আয়োজন হয়। রাত অব্দি হাসিঠাট্টা চলে। বিভাস জেঠু শোয় মাটির বাড়িতে। অর্চিতারা থাকে হালে তৈরী দোতলা পাকার ঘরে। ঝাঁ চকচকে তাদের বাড়িটাও বিভাস জেঠুরই টাকায় তৈরী। তার মা যখন পুরানো মাটির বাড়িতে জেঠুর বিছানা ঠিক করে দিয়ে আসে তখন রাত ঘুমিয়ে পড়ে। তার বাবাও ঘুমের গভীরে তলিয়ে যায়। শুধু তার চোখে ঘুম আসত না। লাগোয়া মাটির ঘরটাতে একবার নিঃশব্দে  গিয়েছিল সে। মা আর তার জেঠু কেন অমন করে শুয়ে ছিল ছোট্ট অর্চিতা জানত না। বড় হয়ে জেনেছে। ওই কটাদিন তার বাবা ক্যামন আনমনা থাকত। প্রথম দিকে জোর ঝগড়া বাঁধত তার মা-বাবার।
---আমি কিছু বুঝিনা ভেবেছো তৃপ্তি?
---বুঝে কী করবে?কিছুই তো মুরোদ নেই তোমার। এই ঘরবাড়ি,সোনাদানা,অর্চির নামে ফিক্সড ডিপোজিট সব আমার জন্য। এই গতরটার জন্য। শরীর নিয়ে অত শুচিবাই রাখলে ভিখিরি হয়ে থাকতে হবে। সে আমি পারব না।
---বিবেকে বাঁধে না তোমার? কী লাভ এতসব পেয়ে?
---এগুলো আজকের দিনে কিচ্ছু না। শরীর থাকতে আরো পেতে হবে। তুমি যেমনটি আছো,তেমনটিই থেকো। 

অর্চিতা জেনে যায় মায়ের ফর্সা সুঠাম শরীরের দাম বহুগুণ। যার জন্য তার জেঠু সব দিয়ে দিতে রাজি।স্কুলে সোহিনীকে আবছা আবছা করে কথাটা বলে। ঘরের কথা তার উপর মা-জেঠুর সম্পর্ক! রাখঢাক করেই সোহিনীকে বলে সে।তারপর ছুটির শেষে বাড়ি ফেরার পথে সোহিনীর কথা শুনে অর্চিতার মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে থাকে। এতদিন কিছুতেই তার কাছে প্রশ্নটার উত্তর মিলছিল না। তার চেয়ে সোহিনী কোনমতেই পড়াশোনায় ভালো না। তবু রেজাল্টে সবদিন সোহিনী তার চেয়ে এগিয়ে থাকে। রহস্যটা নিজেই ফাঁস করে সোহিনী,
---আসলে নিশীথ স্যার আমাকে হেল্প করে।
--কীভাবে?
----সাবজেক্টের প্রশ্ন আমি অনেক আগেই জানতে পেরে যাই।
---তোকেই শুধু  স্যার হেল্প করে কেন?
---প্রমিস কর কাউকে বলবি না। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড অর্চি। তোকেও এবার থেকে হেল্প কোরবো ভাবছি।
--ঠিক আছে আগে তো বল কেন তোকে স্যার হেল্প করে।
----কাল টিফিন আওয়ারে আমাকে ফলো করিস। তাহলেই জানতে পারবি।
কথামতো অর্চিতা পিছু নেয় সেহিনীর। স্কুল থেকে কয়েক পা দূরেই নিশীথ স্যারের ভাড়াবাড়ি। প্ল্যান মতো একটা জানালা খুলে রাখে সোহিনী। অর্চিতা চোখ পাতে সেখানে। নিশীথ স্যার দুহাত দিয়ে যেন কতরকম ভাবে সোহিনীকে পিষে দিচ্ছে। সোহিনীও সমানে লড়ে যাচ্ছে স্যারের সাথে। অর্চিতার হাত-পা কেঁপে উঠে থরথর করে। ছিটকে চলে আসে।
একটু পরেই সোহিনী একেবারে স্বাভাবিক মুডে ক্লাসে হাজির। হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলে,
---কিরে ক্যামন দেখলি। হেব্বি না? তুই যা দেখতে তোর একটা স্মাইলেই সব কুপোকাত হয়ে যাবে। কোন কিছুই আটকাবে না তোর লাইফে।
মনে ভিতরে অর্চিতা অনেকবার কাটাছেঁড়া করে সোহিনীর কথাগুলোকে নিয়ে। হতাশার জী্বন থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে সোহিনীর পন্থাকেই ঠিক বলে মনে করে সেদিন। তাকে অনেক অনেক আগে যেতে হবে।  তার জন্য নিজের শরীর বিনিময় করতেও পিছুপা হবেনা সে। সেহিনীর শেখানো কথাটা মনের ভিতর পাক খায়-চামড়ায় চামড়ায় যুদ্ধ, ধুয়ে দিলেই শুদ্ধ।

সেই বছর ক্লাস নাইনে মারাত্মক রেজাল্ট করে অর্চিতা।সামনের দিন গুলোতেও  নিশীথ স্যারের কাছে পড়তে যেতে শুরু করে সে। বাড়িতে আসেন বিকাশ স্যার। তৃপ্তি কিছুটা আন্দাজ করতে পারে। শাসনের স্বর গলার কাছে এসে আটকে যায়। ক্রমে তার বযেস বাড়ছে। আকর্ষণ হারাচ্ছে বিভাসের চোখ থেকে। আগাম অনিশ্চয়তার মেঘ তাকে গ্রাস করে। এখনো তার কত ইচ্ছে পূরণ হয়নি। মেয়েকে সে তার মতো অপ্রাপ্তির বিষময় আবর্তে পড়ে কাতরাতে দেবে না। যেভাবে হোক মেয়ে তার সাধ পূরণ করুক।
অর্চিতা বাধাহীন গতিতে ছুটে বেড়ায়।
কলেজে সায়নকে  চুম্বকের মতো টেনে নেয় কাছে। সায়ন একজন বড় বিজনেসম্যান বাবার একমাত্র ছেলে। অর্চিতার চোখের আলো আশ্চর্য এক জাদু ছড়ায়। সেই আলোর ধাঁধায় সায়ন নিজেকে হারিয়ে ফেলে। এক লজ থেকে আরেক লজের নরম বিছানায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে থাকে অর্চিতা। বান্ধবীরা হিংসে করে তার লাইফ স্টাইলে। না চাইতেই কত রকম দামী উপহার উপচে পড়ে ঘরে। অ্যাকাউন্টে জমা হতে থাকে বিছানার বিনিময়।
তবে ভীষণরকম এক আড়াল তৈরী করে রাখে অর্চিতা নিজের চতুর্দিকে। সায়নকে স্পষ্ট জানিযে দ্যায়,
--আমাদের রিলেশনটা বেডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। যেদিন ইচ্ছে হবে পরস্পর বেরিয়ে যাবো। হার্টব্রেক শব্দটা আমার সিলেবাসে নেই।
সায়নও অনেক আগে থেকেই এমন খেলায় পটু। অর্চিতার প্রস্তাব তার কাছে মেঘ না চাইতে জলের মতো। কারো সাথে দীর্ঘদিন ফেভিকলের আঠার মতো সেঁটে থাকা তার নাপসন্দ। শুধু এনজয় করো তারপর যে যার রাস্তা দেখো।

এতদিন অর্চিতা চারাপোনা গেঁথেছে বঁড়শিতে। ইয়ুনিভার্সিটিতে সব বোয়াল। রাঘব বোয়ালও থাকে দু'চারজন। বড় কিছু করতে হলে বড় একটা মাছকে ছিপে আটকাতে হবে। শুধু টাকাকড়ি নয়,এবার লাইমলাইটে আসা তার দরকার। মায়ের মতো বিভাস জেঠুকে শরীর দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তির মতো জীবন সে কাটাবেনা। পুরুষ মানুষের দুর্বলতা জেনে গ্যাছে অর্পিতা। মধ্যম পান্ডবকে যেভাবে জানিয়ে দিয়েছিল দুর্যোধনের শরীরের দুর্বল স্থান। অর্চিতাকে পুরুষের মনের তরল গলিঘুঁজি চিনিযেছে তার মা। স্কুলের বান্ধবী সোহিনী। অর্চিতা ওই নরম স্থানে তার যৌন আবেদনের গুপ্ত বাঘনখ বসিয়েছে পুরুষের বুকে। শিকারে সফল হয়েছে সে বারবার। কিন্তু আরো সফলতা চায় অর্চিতা।সবার আড়ালে ধীরে ধীরে ছুঁতে চায় সে তার স্বপ্নের শিখর।শুধু অর্থ নয়, সুনাম চাই তার। একটা পোক্ত চাকরী।এডুকেশানাল ইন্সটিটিউট তার সেফ জোন। মানুষের প্যাঁচালো নজর এদিকে সহজে পড়ে না।
তবে ইদানীং তার দিকে চোখ পড়েছে ইকনমির প্রফেসর নির্মাল্য বোসের।দারুণ লোভনীয় চেহারা।অনেক মেয়েই ভীষণ পছন্দ করে নির্মাল্য বোসকে। অর্চিতার কাছে নির্মাল্য স্যারের নরম চাউনি যেন অযাচিত প্রাপ্তি। ইয়ুনিভার্সিটি জুড়ে তাঁর মারাত্মক সুনাম। একটা এনজিও আছে তাঁর। অনাথ আর প্রতিবন্ধীদের নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে চলেছেন। শহর থেকে অনেক ভিতরে গাঁয়ের এক শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে তাঁর আনাথালয়। দেশ-্ববিদেশ ঘুরে বেড়ান। কত সম্মান ইতিমধ্যে তার খ্যাতির মুকুটে সেজেছে। অর্চিতা তার  মনের ভিতরের গণিতের সমস্ত সূত্রের জট একে একে সমাধান করে। সামনে তার আলিবাবার আশ্চর্য গুহার পথ যেন উন্মুক্ত হয়ে যায়।

নির্মাল্য স্যারের চোখের আমন্ত্রণকে আলাপে বদলে দিতে মরিয়া হয়ে উঠে অর্চিতা। নানা অছিলায় তাঁর কাছে গেলেও, অর্চিতার উদ্দেশ্য পূরণে বাধা এসে হাজির হয়। তারপর হঠাৎ একদিন নির্মাল্য স্যার নিজে থেকেই অর্চিতাকে ডেকে পাঠান তার রূমে। প্রতিবারের মতো অর্চিতা যুদ্ধের সমস্ত কৌশল প্রয়োগে উন্মুখ হয়ে উঠে। কলিং বেলে হাত রাখতেই দরজা খুলে যায়। সামনেই স্যারকে দেখে কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও স্বভাবসিদ্ধ নিঃশব্দ জাদু হাসিতে সামলে নেয় দুইদিক। 
--আরে,এসো এসো অর্চিতা।
---নামটা মনে রেখেছেন স্যার?
---রাখবো না। ইউ আর প্রিটি । স্মার্ট এন্ড ইন্টেলিজেন্ট অলসো।
--থ্যাংক ইউ স্যার। বাট আমি, আপনার ভীষণ ফ্যান। বিশেষ করে আপনার এনজিওকে নিয়ে অনেকের মতো আমিও এক্সসাইটেড।
---আর ইউ ইন্টারেস্টেড? 
---এটা আমার তাছে একটা বড় অপারচুনেটি হবে স্যার কিছু একটা করার কাজে।
অর্চিতা মনে মনে উত্তেজিত হতে থাকে। এতটা সহজ গতিতে কথা এগোবে ভাবতে পারেনি সে। আনাচে কানাচে কয়েকটা কথা তার কানে এসেছিল ঠিকই। কিন্তু পরে ভেবেছে ওই কথাগুলো পার্সোনাল ইগোর জায়গা থেকে। কথার মাঝে কফি আসে এক রাউন্ড।অর্চিতা নিজেই কিচেনে গিয়ে কফি বানিয়ে আনে। সোফা থেকে বসেই কোথায় কী আছে শুধু জানিয়ে দেন নির্মাল্য স্যার। কফির কাপ হাতে অর্চিতা এবার সোফা ঘেঁষে দাঁড়ায়। রজনীগন্ধা পারফিউমটা সেই ছোট থেকেই গায়ে লেগে থাকে সারাক্ষণ। ওই মিহি সৌরভটুকু আজ সে স্যারকে দিয়ে যেতে চায়।

তারপর অর্চিতার নিত্য যাতায়াত। ইকোনমিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট অর্চিতা নন্দী। নির্মাল্য বোসের আনন্দম্ অরফ্যান হাউসের সর্বময় কর্ত্রী সে বর্তমানে। মিডিয়ায় মাঝে মধ্যেই খবর বেরোয় আনন্দমের। অর্চিতার কাছে এ এক অন্য জগৎ। অর্থ আছে,সম্মান আছে তার সাথে অসহায় ছেলেমেয়েদের মুখে হাসি ফোটাবার মানসিক তৃপ্তি আছে। বিভিন্ন সেমিনারে এখন তাকেই যেতে হয়। নির্মাল্য বোসের ছায়াসঙ্গী অর্চিতা নন্দী। চাকুরী আর এনজিওর কাজে ডুবে থেকে বিয়ে করা হয় নি নির্মাল্য বোসের। তবে কোন কিছুর অভাব বোধ তার মনে শূন্যস্থান তৈরী করতে পারেনি। শরীরের জন্য আরেকটা শরীর লাগে। অনেকের ভীষণরকম লাগে। কারুর আবার না হলেও দিব্যি কাটিয়ে দেয় জীবন। মনের মানুষ প্রকৃত কে হয়ে উঠে তার অন্বেষণেই একটা জীবন কাবার হয়ে যায়। নির্মাল্য বোস তাই শরীরের প্রতি বেশি মনযোগী। আপাতত অর্চিতাতেই সন্তুষ্ট আছেন কিছুদিন।
সম্প্রতি দুজনে বিদেশে একটি সেমিনার এটেন্ড করে ফিরে এসেছে। অনেক ফরেন ফান্ড আসে ট্রাস্টের নামে। ফিনান্সের বিষয় পুরোটাই দেখেন নির্মাল্য বোস নিজেই। অর্চিতা অনেকদিন থেকেই ওই জায়গায় সূঁচ হয়ে ঢুকতে চেয়েছে। কতবার তার মনে হয়েছে ট্রাস্টের সবকিছুই তার নখদর্পণে। অথচ কোথাও যেন একটা অদৃশ্য আড়াল আছে। গুচ্ছের কর্মচারী থাকলেও কেউ কিছু টের পায় না। বহুবার ঘনিষ্ঠ মুহুর্তে অর্চিতা যখন প্রসঙ্গ তোলে,
---স্যার ট্রাস্টের কিছু কিছু বিষয় আমার কাছে ক্যামন যেন খটকা লাগে।
---যেমন?
---যেমন আমি এত ক্লোজ আপনার,তবু অনেক মিটিং আমাকে এড়িয়ে করেন।
---নেক্সট?
---এত টাকা আসে অথচ কতটুকু খরচ হয় ছেলেমেয়ে গুলোর পেছনে?
---ওকে ডার্লিং। সব প্রশ্নের আনসার পাবে বাট্ এই মুড্টা তেতো করে দিও না। 
বলেই অর্চিতার সাথে তুমুল হয়ে উঠে বিছানায়।
পরের দিনই একটা দলিল হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
---লুক ইট অর্চিতা। নতুন একটা জায়গা নিলাম  ট্রাস্টের জন্য। তোমার নামেই আপাতত রেজিস্ট্রি করেছি। বাই দি বাই এই বিশ লাখের চেকটা তোমার অ্যাকাউন্টে জমা কোরো।এবার থেকে তুমিই ফাইনান্সটা দেখো। আমি সব ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি। এত ওয়ার্ক প্রেসার আমি নিতে পারছি না। ইউ নো ইট।
অর্পিতা আপত্তি করে না। বহুদিন ধরেই সে এটাই চেয়েছিল। এনজিওটাকে সে আরো বড় করে তুলতে চায়। ছোটবেলার সেই আড়াল থেকে শোনা মা-বাবার ঝগড়ার কথাটা মনে পড়ে যায় তার। শরীর থাকতে সুযোগকে কাজে লাগাতে হয়। জীবনের সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছে সে বিছানায়। শরীর বিনিময়ে করেছে শুধু কারো অধীনস্থ হয়ে বেঁচে থাকতে নয়।তাকে গুছিয়ে নিতে হবে সময় থাকতে। আনন্দম্ চ্যারিটেবল্ ট্র্যাস্ট হবে অর্চিতা নন্দীর নামে। প্রযোজনে নির্মাল্য বোসকে সরানোর সিদ্ধান্তেও দ্বিধা বোধ করবে না সে। মাথায় ভাবনার পোকামাকড়রা সারাক্ষণ আঁচড়কামড় করে। তাদেরকে শান্ত করার উপায় খুঁজতে থাকে অর্পিতা খুব সন্তর্পণে।

আগেই নির্মাল্য বোসের সুপারিশে একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কের রিজিনাল হেড পোস্টে জয়েন্ট করে অর্চিতা। নির্মাল্য বোস হাসিমাখা চোখে বলে ওঠেন,
---ইটস্ এ গিফ্ট ফর্ ইউ? তোমার জন্য এটুকু করতে পেরে আই ফিল ভেরি হ্যাপী।
সেদিনই প্রথম রিটার্ন গিফ্ট হিসেবে শরীর উজাড় করে দ্যায় অর্চিতা। কিন্তু আজ যখন নিজে থেকেই প্রস্তাবটা দ্যান তখন বিশ্বাসই করতে পারেনা অর্চিতা। ট্রাস্টের সবকিছু লিগ্যালি অর্চিতার নামে করে দিতে চান নির্মাল্য বোস। বয়সের কথা মাথায় রেখে এই ডিসিশনটা তিনি দ্রুতই বাস্তবায়িত করতে চান। ইতিমধ্যে ইয়ুনিভার্সিটি ছেড়েছেন স্বেচ্ছায়। অর্চিতা আনন্দে দিশেহারা হয়ে পড়ে। একটা মারাত্মক সারপ্রাইজ দেবার জন্য ছটপটিয়ে উঠে। লজের রুম বুক করে। নাইট স্টে করবে তারা দুজনে। আলাদা করে ডেকোরেশন করায় অর্চিতা। নির্মাল্য বোস কিছুই জানে না। ব্যাঙ্ক থেকে ফিরেই নির্মাল্য বোসকে গাড়িতে নিয়ে সোজা লজের রুমে। অবাক হয়ে বলেন,
---ইটস মাই প্লেজার। তবে কেন এত বাড়াবাড়ি কোরছো অর্চিতা। আমার সবকিছু তো তোমারই।
---আই অ্যাম সো লাকি। আমার তরফ থেকে এটা একটা রিটার্ন গিফ্ট ভাবতে পারেন।
সারারাত লজের নরম বিছানায কাটালেও অর্চিতা অনুভব করে নির্মাল্য বোস আগের মতো উৎসাহী নয় তার শরীরি মাদকতায়। খুব স্পষ্ট বুঝতে পারে একটা অনিচ্ছুক চাহিদা তার শরীরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে নিরুদ্যম ভাবে। অর্চিতা শঙ্কিত হয় মনে মনে। তবে কী নির্মাল্য বোসের চোখে তার আকর্ষন  ফিকে হয়ে যাচ্ছে। যে কোন দিন টুপ করে খসে পড়বে সে নির্মাল্য বোসের ভাললাগার আকাশ থেকে। 
অথচ আজকের প্রস্তাব তার সমস্ত হিসেব গুলিয়ে দ্যায়। নিজেকে দোষারোপ করে নিজেই। কত সন্দেহবাতিক হয়ে গ্যাছে তার মনটা। যাইহোক ট্রাস্টের সমস্তকিছু এখন তার হাতের মুঠোয়।

এক সপ্তাহ হল নির্মাল্য বোস বিদেশে গ্যাছেন। ফোনে তাঁকে  সেভাবে পাচ্ছে না অর্চিতা। ট্রাস্টের যিনি সবকাজ দেখেন মানে অনীশ বাবু অর্চিতাকে বলেন,
---ম্যাডাম, বোধহয় একটা ঝামেলা বাঁধতে চলেছে। যদ্দুর মনে হচ্ছে স্যার আর এদেশে ফিরবেন না।
অর্চিতা হতবাক হয়ে যায় অনীশ বাবুর কথা শুনে। কেননা নির্মাল্য বোস বিদেশ যাওয়ার পর থেকেই আনন্দমের কাজকর্ম নিয়ে বিস্তর লেখালিখি শুরু হয়েছে। ওদিকে কোনভাবেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না তাঁর সাথে। অর্চিতা দিশেহারা হয়ে পড়ে। নিউজ চ্যানেল থেকে বারবার ফোন করছে তাকে বিভিন্ন বিষয় জানতে।
সেদিন যখন ব্যাঙ্ক ফেরত আনান্দমের অফিসে স্টাফেদের নিয়ে মিটিংয়ে ব্যস্ত অর্চিতা। উদ্ভূত পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবে তার পন্থা খুঁজতে মরিয়া। তখনই সি আই ডি অফিসারের দল হানা দ্যায় সেখানে। শিশু পাচার কান্ডে তাঁরা গ্রেপ্তার করেন অর্চিতাকে।
একটা মায়ামৃগ তাকে শেষ অব্দি পৌঁছে দিয়েছে গরাদের ভিতর ছায়ান্ধকার একটা প্রকোষ্ঠে। শরীর এখন তার কাছে যেন কাঁটার চাদর। ভেতরে একটা নিভু নিভু মন কোনক্রমে বেঁচে আছে। যতদূর ভাবনা হেঁটে যায় আপনজন কাউকে খুঁজে পায় না অর্চিতা। ছোটবেলায় ক্লাসে শোনা সেই গল্পটাই শুধু কানে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, সোনার হরিণ আসলে তো ছলনাকারী ভয়ঙ্কর দৈত্য!রামকে ফুসলে নিয়ে গিয়েছিল। অনেককেই নিয়ে যায় তার মতো।  


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments