জ্বলদর্চি

পাঁতা নাচ ও পাঁতা গান /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ৩১

পাঁতা নাচ ও পাঁতা গান

সূর্যকান্ত মাহাতো


আখড়া মা দুলদুল
আখড়া তলে বিটি দাঁড়ালি কেনে
নাচ গ বিটি নাচ, খেল গ বিটি খেল
ই জীবন গ বিটি আড়াই দিন।

 একটি "পাঁতা গীত"। এর মানে হল, বাজনার শব্দে আখড়া দুলদুল করে কাঁপছে। সেখানে মেয়ে কেন এসে দাঁড়ালি। আবার এসেই যখন পড়েছিস তখন নাচ কর, খেলা কর। কারণ এই জীবন মাত্র আড়াই দিনের। 

একটা মানুষের জীবন মাত্র আড়াই দিনের? আড়াই দিন কখনও একটা মানুষের জীবন হতে পারে নাকি! সেটা কীভাবে সম্ভব?

সেই দার্শনিক তত্ত্বের একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক পশুপতি প্রসাদ মাহাতো। সোম থেকে রবি এই সাতটি বার নিয়ে হয় এক সপ্তাহ। আর এই সাত দিনের মধ্যে মানুষ একদিন জন্ম লাভ করেন। একদিন মারা যান। বাকি রইল পাঁচ দিন। এই পাঁচ দিনের অর্ধেক সময় মানুষ ঘুমিয়ে কাটায়। তাহলে বেঁচে থাকে মাত্র আড়াই দিন।

 কি দারুন বিশ্লেষণ! সত্যিই তো তাই! সোমবার থেকে রবিবার সাত দিনের এই চক্রাকারেই তো আমাদের জীবন বাঁধা। এই দার্শনিক তত্ত্ব জঙ্গলমহলের প্রবাদেও স্থান পেয়েছে। যেমন---

ধন যৌবন আড়াই দিন, নজর ভরে মানুষ চিন।

আমাদের জীবন ও যৌবন খুবই ক্ষণস্থায়ী। তাই ক্ষণস্থায়ী এই জীবনকে উপভোগ করার ইন্দ্রিয়বাদী চিন্তাই ফুটে উঠেছে উপরের পাঁতা গানটিতে।

"পাতা" না "পাঁতা" হবে তার সঠিক ব্যবহার নিয়েও অনেকেই ভুল করে থাকেন। "পাঁতা" শব্দটি পঙক্তি শব্দ থেকে এসেছে। ঝাড়খণ্ডী উপভাষায় 'পাঁতা' শব্দটি পঙক্তি অর্থেই ব্যবহৃত হয়। পঙক্তি মানে হল সারি। মাহাতো কুড়মি সম্প্রদায়ের করম পরব বা উৎসবকে ঘিরে সারিবদ্ধ ভাবে নেচে নেচে এ গান গীত হয় বলেই বোধ হয় এমন নামকরণ। তবে পাঁতা নাচ ও গান করম উৎসব কেন্দ্রিক হলেও অন্যান্য সময়েও একাধিক উৎসবে এই নাচ ও গান অনুষ্ঠিত হয়। তাই শব্দটি হবে "পাঁতা"।
অন্যদিকে 'পাতা' শব্দটির সাঁওতালি অর্থ হল মেলা বা পরব। সুতরাং 'পাতা' শব্দটি সাঁওতাল ভাষা থেকে যদিও বা এসে থাকে তাহলেও তাদের সেই নাচ ও গান একেবারেই ভিন্ন। পাঁতা গানের সঙ্গে যার কোনও সম্পর্ক নেই।

গত ২৩ শে জুলাই ২০২২ এর সংবাদ প্রতিদিন সংবাদপত্রে "পাতা নাচে আনন্দ পাতা" শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। লেখিকা সুনিপা চক্রবর্তী সাঁওতাল সম্প্রদায় ও মাহাতো সহ অন্য সম্প্রদায়ের দুই ভিন্ন ধর্মী নাচকেই "পাতা" অর্থে ব্যবহৃত করেছেন। এটা বিভ্রান্তিকর। আবার ড: আশুতোষ ভট্টাচার্যও 'পাঁতা' শব্দের বদলে 'পাতা' শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যা ঠিক নয়।

পাঁতা গীত বা পাঁতা গানের একাধিক নামকরণ রয়েছে। ভাদ্র মাসে অনুষ্ঠিত করম পরবকে ঘিরেই এ গানের উৎস। তাই একে "করম গান"ও বলা হয়। কিছুটা ঝুমুরের ছোঁয়া আছে বলে এ গান "পাঁতা ঝুমুর" নামেও পরিচিত। এছাড়াও দাঁড়শাল, দাঁড়শাল‍্যা, দাঁড়শালিয়া, দাঁড়ঝুমুর দাঁড়গীত,পাঁতাশাল‍্যা, পাঁতাশালিয়া ইত্যাদি নামেও পরিচিত। একই গান ও একই নাচ, অথচ বহু নামকরণ। এই নামগুলোর মধ্যে "দাঁড়" শব্দটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নামের আগে এই "দাঁড়" কথাটি কেন ব্যবহৃত হয়? বিশিষ্ট লোক গবেষক ও লেখক বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতো বলেছেন, "দাঁড়" শব্দটি 'দন্ড' থেকে এসেছে। 'দন্ড' অর্থাৎ দাঁড়িয়ে বা দাঁড়ানো অবস্থায় এই নৃত্য পরিবেশিত হয়। সেখান থেকেই 'দাঁড়' শব্দটি এসেছে বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ পাঁতা নাচ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠিত হয় বলেই এই গীতের নাম "দাঁড় গীত"।

তবে আমার ব্যক্তিগতভাবে এ নাচ দেখে মনে হয়েছে নর্তক ও নর্তকীরা নাচের সময় তাদের হাতগুলোকে নৌকার দাঁড় টানার মতোই ব্যবহার করেন। "দাঁড়" টানার মতো হাতের ভঙ্গিমা বরং নামকরণে অনেক বেশি মানানসই হতে পারত।

পাঁতা গানের সুরের কথায় আসা যাক। অধ্যাপক ডঃ চিত্তরঞ্জন লাহা-র মতে,পাঁতা গানের প্রতিটি পংক্তির শেষ স্বরকে বেশ টেনে টেনে গাইতে হয়। বিশেষ করে দ্বিতীয় ও চতুর্থ পঙক্তির শেষ স্বরে টান থাকে সব থেকে বেশি। যেমন

পিলকা দুলালী
পরের ভিতে  এ  এ
হাতি ঘড়া লিখি রাখিল....অ....অ....অ
ভালা রে মিস্ত্রি, ভালা রে কারিকল....অ....অ
জীবন টুকু লালি কেনে নাই দিলি.....ই....ই......ই

পাঁতা গানগুলোতে বিষাদ মাখা একটা মেটো সুর আছে। মাটির টান যেন বড্ড বেশি গানের পরতে পরতে। অধ্যাপিকা ডঃ বীনাপাণি মাহাতো বলেছেন, স্বরের ওঠানামা ঘোরাফেরা করে তিন ছন্দ থেকে পাঁচ ছন্দে। এই স্বরের দীর্ঘতার Stress বা জোর হল এই গানের প্রাণ।

পাঁতা গানের বিষয়ও বেশ বৈচিত্র্যময়। জীবনযাত্রার প্রতিটি মুহূর্তই এ গানের বিষয় হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক পশুপতি প্রসাদ মাহাতো বলেছেন, প্রতিদিনের ছোট ছোট দুঃখ কষ্ট, অভাব অভিযোগ, দিন যাপনের যন্ত্রণা বিষাদ, জীবন রঙ্গের বিশুদ্ধ মুহূর্ত, যৌবন আর জীবনের সাত রং, হাসি মশকরা, ভালবাসা, প্রেম সবকিছুই ফুটে ওঠে পাঁতা গানে।

তবে পাঁতা গানে নারীদের ভাবনা বিশেষভাবে মনে দাগ কাটে। বাঁজা বা সন্তানহীনা নারীর মর্ম বেদনা দারুণ ভাবে ফুটে উঠেছে পাঁতা গানে।

যার ঘরে ছেল‍্যা নাই
(তার) মন কেমন করে হে।
ডাবুক ডুবুক ছেল‍্যা মুতে
ঘর কাদা করে হে।

মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে আছে ননদকে নিয়ে সমস্যা। সে কথাও এ গানে প্রকাশিত। আবার ঘরের পুরুষ মানুষ জঙ্গলে কাঠ কাটতে গেলেও মেয়েরা তাদের পুরুষকে নিয়ে সর্বদাই উৎকণ্ঠিত থাকেন। সেরকমই একটি গান হল---

আমার বন্ধু কাঠ চিরে গবরিয়ার বনে
ও ননদ লো, হামি যাবো নিজেই ব‍্যাইসাম দিতে।

চাষের কাজে নিজের মরদ মাঠে হাল করতে গেলেও মেয়েরা উদ্বেগে থাকেন। থাকে বজ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টির ভয়।

আমার বন্ধু হাল করে কেঁদ কালানীর ধারে
গরাগায়ে খরা কাটে দেখে পরাণ ফাটে।

বাড়িতে অতিথি আসার আনন্দে কখনও বউ বলে ওঠে---

পস্তু বাঁটি ঘসর ঘসর, মুগ বির‍্যির ডাল লো।
নাই আ্যল বড় বহুর ভাই লো।

অভিসারের পাঁতা গানগুলো শুনলে বৈষ্ণব পদাবলীর কথা মনে পড়ে যাবে। লুকিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সমস্যা কেবল রাধারই ছিল না। এই সমস্যা রাধার মতো জঙ্গলমহলের মেয়েদেরও। তবে পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট কিছুটা আলাদা। অভিসারে যাওয়ার সময় যদিও বা ঘরের মানুষগুলোকে ফাঁকি দেওয়া যায়, আঙিনার কুকুরকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। সে ডেকে উঠবেই।

আঙিনায় কুকুর ভুকে রে দুয়ারে প্রহরী জাগে রে
পায়ের নুপুর বাজে রুমঝুম ক্যাইসে হামে বাইরাব রে।

কৃষ্ণের মতোই জঙ্গলমহলেরও কোনও কাড়া বাগাল বাঁশিতে সুর তুললে, সেই বাঁশির সুর শুনে তার প্রেয়সির মনও আনচান করে ওঠে।

কাড়া বাগাল কাড়া খুলে বাঁশি এ দেয় শান
কি কইর‍্যে বাইরাব বাগাল ঘরে কুটি ধান।

অর্থাৎ গেরস্থালির কাজ ছেড়ে দিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া যে প্রায় অসম্ভব। সে কথাই এ গানে ফুটে উঠেছে। জঙ্গলমহলের মাহাতো সমাজের নারীদের দৈনন্দিন কাজের চিত্রটাও ফুটে উঠেছে এই গানে।

এতেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে বৈষ্ণব পদাবলীর প্রভাব পাঁতা গানেও বিশেষ ভাবে পড়েছে।

প্রেমিকের সঙ্গে কেবল মিলন নয়, তার উপেক্ষাও ফুটে উঠেছে পাঁতা গানে।

সড়প ধারে ঘর কর‍্যেছি আলে গেলে সামাও না
কিসে তুমার মন ভাঙ‍্যেছে আমায় খুল‍্যে বল না।

তবে সব কিছু ছাপিয়ে জীবন দর্শন হয়ে উঠেছে পাঁতা গানের মূল শক্তি। অদ্ভুতভাবে সেগুলো পাঁতা গানে প্রস্ফুটিত। জীবনের প্রকৃত মানে কী, প্রকৃত সত্য কী, তা যেন গানগুলোর চরণে চরণে প্রকাশিত হয়েছে।

কিবা লয়ে আলিরে মন কিবা লয়ে যাবি
এমন সুন্দর দেহ মাটিতে মিশাবি
রে মন এ ভব সংসার ছাড়‍্যে যাবি।

আবার জীবন কত ক্ষণস্থায়ী সে কথাও ফুটে উঠেছে পাঁতা গানে

মানুষ জনম ঝিঙা ফুলের কলি রে
সাঁঝে ফুটে সকালে যায় ঝরি।
এবার পাঁতা গানের নাচ অর্থাৎ পাঁতা নৃত্যের কথায় আসা যাক। জঙ্গলমহলে এই নৃত্য ভীষণ জনপ্রিয়। নারী পুরুষ উভয়ই এ নাচে অংশগ্রহণ করে। তবে পৃথক পৃথক দলে। কমপক্ষে ছয়জনের উপরে এক একটি দলে নাচ করে।মেয়ে ও  পুরুষেরা নাচের সময় বিশেষ রকমের পোশাক পরেন। পায়ে পরেন ঘুঙুর। নর্তক বা নর্তকীরা পরস্পর পরস্পরের হাতগুলো জড়িয়ে থাকে। দলের প্রথম ও শেষ জনের কেবল একটি করে হাত মুক্ত থাকে। ওই হাতে তারা রুমাল জাতীয় কিছু একটা ধরে নাড়তে নাড়তে নাচ করে। সকলেই বাজনার তালে তালে কয়েক পা সামনে এগিয়ে আবার কয়েক পা পিছনে পিছিয়ে যায়। এটাই হল পাঁতা নাচের ধরন। এবার এ নাচকেই বিশেষভাবে রপ্ত করে তার সঙ্গে নানান অঙ্গভঙ্গি যুক্ত করে নৃত্যশৈলীকে আরও বেশি সৌন্দর্যময় করে তোলেন শিল্পীরা। গানের রিদম বা ছন্দের সঙ্গে তাল রেখে নাচের গতি বাড়া কমা হয়।


বাদ্যযন্ত্র হিসাবে এ গানের প্রাণ হল মাদল। মাদলের ধিতাং তাং বাজনা ছাড়া এ গান ও নাচ একেবারেই বৃথা। বর্ষায় চাষের কাজ সম্পন্ন হলেই ভাদ্র মাসের প্রতি সন্ধ্যায় বসে পাঁতা গানের আখড়া। উদাত্ত কন্ঠে চলে নাচ ও গান। সে নাচে মনের আনন্দ যেন বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। গানের সেই মাটির সুরের মাদকতায় সকলে তখন মত্ত হয়ে উঠে।


পাঁতা নাচ ও পাঁতা গানের কিছুটা ভাটা পড়তে শুরু করেছে। আনন্দ বিনোদনের ধারাটাই এখন একটু একটু করে বদলে গেছে। তবে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে ক্ষীয়মান এই নাচ ও গান আবার যেন কিছুটা অক্সিজেন পেয়েছে। এই গানের রস কখনোই পাঠ করে উপলব্ধি করা যায় না। নাচে গানে অংশগ্রহণ করলেই বোঝা যায় এ গানের ও নাচের কী মহিমা!

তথ্যসূত্র: ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য - বঙ্কিম চন্দ্র মাহাতো
জঙ্গলমহল ও ঝাড়খন্ডী লোকদর্শন - পশুপতি প্রসাদ মাহাতো

আরও পড়ুন

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments