জ্বলদর্চি

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী / তৃতীয় পর্ব /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী                       তৃতীয় পর্ব     
                                    
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী          

রেওয়া থেকে দিল্লী
১৫৬২ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মের এক তপ্ত নিদাঘে দিল্লির সম্রাট মহামান্য জালালুদ্দিন আকবর রেওয়া রাজ্যের পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ তাঁর ইচ্ছে হলো রাজা রামচন্দ্র সিংহের সঙ্গে একবার দেখা করে যাবেন। যেমন ভাবনা তেমনিই কাজ। রাজা রামচন্দ্র সিংহের রাজসভায় উপস্থিত হতে রাজা রামচন্দ্র খুব খুশি হলেন। যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করে তাঁর আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন এবং সম্রাটের মনোরঞ্জনের জন্য তাঁর সভাগায়ক রামতনু মিশ্রকে গান শোনানোর জন্য অনুরোধ করলেন যাতে ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত সম্রাটের মনে খুশির হাওয়া বয়ে যায়। রামতনু মিশ্র তাঁর তানপুরা নিয়ে শুরু করলেন রাগ মল্লার ও বৃন্দাবনী সারাঙ রাগের সংমিশ্রণে 'মিয়া কি সারাঙ' রাগ' যা তানসেনের নিজস্ব সৃষ্ট।এই বৃন্দাবনী সারাঙ রাগের স্রষ্টা রামতনু মিশ্রর গুরু হরিদাস স্বামী, যে রাগের মাধ্যমে তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আগমন বার্তা সূচিত করেছিলেন। তানসেনের গান শুনে সম্রাট অভিভূত হয়ে রাজা রামচন্দ্রকে অনুরোধ করলেন রামতনু মিশ্রকে তাঁর নবরত্ন সভায় পাঠানোর জন্য। আকবরের সভায় যদিও আরো ৩৬জন সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন কিন্তু রামতনুর গান শুনে সম্রাটের মনে হয়েছিল তাঁরা কেউই রামতনুর সমকক্ষ নয। সম্রাট আকবর মুসলমান হলেও হিন্দু মুসলমানের ভেদাভেদ ভুলে তিনি তাঁর রাজসভায় সেই সময়ের ভারতবর্ষের সংস্কৃতি জগতের ন'জন দিকপাল ব্যক্তিত্বকে, যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে উজ্জ্বলভাবে বিরাজ করছিলেন তাদের নিয়ে এসে তাঁর রাজসভার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিলেন। তাঁর নবরত্ন সভায় ছিলেন আবুল ফজল, টোডরমল, বীরবল, আব্দুল রহিম খান-ই- খানা, ফৌজি, মোল্লা দোপিঁয়াজা, ফকির আজিউদ্দিন, রাজা মানসিংহ প্রভৃতি। আকবরের রাজসভায় এই সকল গুণী ব্যক্তিরা ছিলেন তাঁদের নিজস্ব ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ ও অতুলনীয়।         

দিল্লি ফিরে গিয়ে সম্রাট তাঁর দূত জালাল খান কুরচিকে রাজা রামচন্দ্রের কাছে একটি চিঠি দিয়ে অনুরোধ করে পাঠালেন যাতে মহারাজ রামতনুকে দিল্লিতে পাঠিয়ে দেন এবং সেজন্য তিনি তার অন্যতম সহৃদ মহেশ দাস বা বীরবলকে রেওয়া রাজ্যে পাঠাচ্ছেন। এর কয়েকদিন পরে নবরত্নের অন্যতম বিচক্ষণ ব্যক্তি বীরবলকে পাঠালেন রামতনুকে দিল্লির রাজসভায় নিয়ে যাবার জন্য। দিল্লির সম্রাটের অনুরোধের কথা রাজা রামচন্দ্র রামতনুকে বলার পরে রামতনু কিন্তু রেওয়া ছেড়ে যেতে রাজি না হওয়ায় রাজা রামচন্দ্র রামতনুকে বুঝিয়ে বললেন "গুরুজী, আজ আপনার গানের কদর কেবলমাত্র রেওয়া রাজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ, কিন্তু দিল্লিতে গেলে আপনার গানের সুখ্যাতি সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়বে। আপনি অবশ্যই সম্রাটের প্রস্তাব গ্রহণ করুন। রামচন্দ্রের কথা মত রামতনু দিল্লি যেতে রাজি হলেন।                                   

কয়েকদিন পরে বীরবলের সাথে গ্রীষ্মের তপ্ত দিবসে রেওয়া থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে রামতনু দিল্লি এসে সম্রাটকে অভিবাদন জানালেন। তাকে দেখে সম্রাট যারপরনাই অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। অতিথি আপ্যায়নের পরে সম্রাট বীরবলকে বললেন "কবিবর রেওয়া থেকে এতোখানি পথ এসে আপনাদের দু'জনকেই শ্রান্ত ও ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আপনার আবাসগৃহের সন্নিকটে যে সুরম্য আবাস গৃহ আছে সেখানেই সংগীত সম্রাটের বিশ্রামের ও থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আপনারা দুজনেই নিজ নিজ গৃহে যেয়ে খানাপিনা করে বিশ্রাম গ্রহণ করুন। আজ রাত্রে আমরা রামতনুর গান শুনব। দিল্লির সমস্ত আমীর-ওমরাহদের দেওয়ান মারফত এত্তেলা পাঠিয়ে দিয়েছি যাতে তারা এই স্বর্গীয় সংগীতের আস্বাদ গ্রহণ করতে পারেন।                                

সম্রাটের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বীরবল রামতনুকে তাঁর নির্দিষ্ট আবাস গৃহে পৌঁছে দিয়ে তাঁর রেওয়াজের নির্দিষ্ট কক্ষ, গোসলখানা দেখিয়ে নিজের বাসগৃহে চলে গেলেন। রামতনু তাঁর নির্দিষ্ট সুরম্য আবাস গৃহ দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন কোথায় তিনি রেওয়াতে ছিলেন আর কোথায় এই সুরম্য প্রাসাদ গৃহে এসে পৌঁছালেন। সেই প্রাসাদ গৃহের বৈভব দেখে তিনি তাজ্জব হয়ে গেলেন। ভাবলেন সবই সেই ভগবানের আশীর্বাদ। গোসলখানায় গিয়ে স্নান করে জামা-কাপড় পরিবর্তন করলেন।      

সূর্য অস্ত যাবার পূর্বে প্রত্যেক আবাসগৃহ আলোকমালায় সজ্জিত করে দিল ভৃত্যেরা। সম্রাটের নির্দেশে দিল্লীর সমস্ত প্রধান প্রধান গৃহগুলি এবং রাস্তাগুলি আলোয় আলোকিত। সন্ধ্যার পূর্বে বীরবল রামতনুর আবাস গৃহে এসে দেখলেন রাঁধুনিরা সম্রাটের নির্দেশমতো সমস্ত রকম পদ রান্না করে ওস্তাদজীর সামনে সাজিয়ে দিয়েছে। গুরুজি খেতে বসেও গুনগুন করে রেওয়াজ করছেন কিন্তু খাবার খেতে শুরু করেননি। বীরবল বললেন "গুরুজি, খাবার খেতে শুরু করুন, সমস্ত আমির-ওমরাহেরা প্রাসাদে এসে গেছেন"। 

প্রাসাদের বৈভব দেখে রামতনু তাজ্জব হয়ে বললেন "কবিবর, আজ আমার জীবনের এক উল্লেখযোগ্য দিন। কোনদিন ভাবতেও পারিনি ভারত সম্রাটের প্রাসাদে বসে আমি খাবার খাচ্ছি। শুধু তাই নয় স্বয়ং সম্রাট নিজে আমার খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। এ কেবল পরম করুণাময়ের আশীর্বাদে আমার জীবনে আজকের এই সৌভাগ্য। ভারত সম্রাট আমার গান শুনবেন বলে অপেক্ষা করছেন। সম্রাটের দরবারে গান শোনানোর আমন্ত্রণ পাবেন এ ছিল আমার কল্পনারও অতীত"। 

বীরবল বললেন "গুরুজি, একজন গায়কের সর্বোচ্চ সম্মান ও স্বীকৃতি আপনি পাবেন বলে আপনাকে সুদূর রেওয়া থেকে এখানে নিয়ে এসেছি। আপনার গান শুনে সম্রাটের খুশি হওয়ার অর্থ আপনি তামাম হিন্দুস্তানের সংগীত রসিকদের সম্মান পাবেন। আপনার গানের সুর ও কথা সকলের কাছে পৌঁছে যাবে। যদিও আমি মনে করি তামাম হিন্দুস্তানের আপনি শ্রেষ্ঠ গায়ক একজন পন্ডিত ব্যক্তির যতই থাকুক না কেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ অনেক বেশি ওস্তাদ সাধারণ মানুষের দিলে পৌঁছাতে। আপনি আজ এমন গান শোনান সম্রাটকে যেন আপনার গান শুনে তিনি আরো বেশি উদার হয়ে ওঠেন"।   

বীরবলের কথা শুনে রামতনু ভাবলেন রেওয়ারাজ রামচন্দ্র যেমন তার গান শুনে বুঁদ হয়ে থাকতেন সম্রাটকেও তেমনি বুঁদ করে রাখতে হবে সুরের মায়াজাল বিস্তার করে।       

কিছুক্ষণ পরে বীরবলের সমভিব্যাহারে রামতনু রাজপ্রাসাদে এলেন যেখানে আজকের এই সঙ্গীতের আসরের আয়োজন করা হয়েছে। এসে দেখলেন আমীর ওমরাহ ও দিল্লী নগরের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সাথে সম্রাট তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। নিজের দেরী হওয়ার জন্য তিনি মনে মনে লজ্জিত হলেন। রামতনু ও বীরবলকে বসার অনুরোধ জানিয়ে সম্রাট রামতনুকে তাঁর ঐশ্বরিক কন্ঠ মাধুর্যের পসরা সাজাতে অনুরোধ করতে রামতনু  বললেন "মহামহিম সম্রাট, আমি এই সভায় অবশ্যই গান গাইব কিন্তু তার পূর্বে আমায় একটি শর্ত আছে, যে শর্ত পূরণ না হলে আমার গানের ব্যাঘাত ঘটবে"। 
                                                                   ক্রমশঃ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments