জ্বলদর্চি

খর্জুর বীথির ধারে--৮/মলয় সরকার

খর্জুর বীথির ধারে

মলয় সরকার
(৮ম পর্ব ) অষ্টম পর্ব


এগিয়ে চলি। সারি সারি চলেছে লোক। তবে এখন যাত্রী খুব বেশি নয়। রোদের জন্য অনেকেই দেখছি ফিরছে ঐ ঘোড়ায় চড়ে। আমাদের দুজনের পিছনে কয়েকটি ছেলে লেগেই রয়েছে , চলুন আরও অনেক জিনিস দেখাব। আমি বলি দাঁড়া, আমরা নিজেরা যা দেখছি, তাই হজম করি।

এর পর দেখলাম, দুশারে মন্দির (Temple of Dushares)।এটির স্থাপত্য ও সৌন্দর্য্য চমৎকার। বিশাল উঁচু এবং অনেক চওড়া দেওয়াল রয়েছে এটির। এতে যে আসলে কোন দেবতার মূর্তি ছিল বলা মুস্কিল। হয়ত নাবাতিয়াদের কোন অতীত দেবতা ছিলেন এখানে।যিনি এপোলো জুপিটার বা আফ্রোদিতির মত কেউ ছিলেন।
আমরা বুঝতে পারছিলাম, আর বেশি এগোতে পারব না। শরীর আর সঙ্গ দেবে না। যা রোদ বাড়ছে! মরুভূমির রোদ , তার উপরে আবার চারদিকের এই বালি পাথরের পাহাড়ের মাঝে , অসহ্য লাগছে ক্রমে। 
শেষে দেখলাম একটি মনাস্ট্রী। যেটি অনেকখানি সেই ট্রেজারী বা খাজানার মত গঠন। তবে একটু তার থেকে বড় বলেই মনে হল। এখানেও সামনে দরজার মাথায় রয়েছে কারুকাজ।নীচে রয়েছে দরজা। এখানে খাজানার মত অত মূর্তি দেখলাম না। সেই তুলনায় এটি একটু সাদামাটা। তবে আমরা আর ভিতরে ঢুকলাম না।

এর পর দেখি রাস্তা আরও এগিয়েই চলেছে। আমরা থমকে দাঁড়ালাম । আমি বুলবুলকে বললাম, এর যে অন্ত নেই । এ যে অন্তহীন পথ, কতদূর যাব! পাশ থেকে ছেলে গুলো বলল, সামনে যেটি দেখছেন, সেটি এক রাজার প্রাসাদ ছিল। আমি তাচ্ছিল্য করে বললাম। তারপর বল, তুই কি জানিস, এটার ব্যাপারে? সে বলল, আমাদের ঘোড়ায় চলুন, অনেক জিনিস দেখাব।আমি বললাম, তুই আগে বল, এই প্রাসাদের ব্যাপারে কি জানিস।ও বলল, এখানে রাজার মেয়ে ঐ দোতলার বারান্দায় বসে তার প্রেমিকের অপেক্ষা করত। তারপর শুনল যে, একদিন তার প্রেমিক যুদ্ধে মারা গেছে। সেই শুনে সে ওখান থেকে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। আমি বললাম, বাঃ ঐতিহাসিক পটভূমি তে তো ভাল প্রেমের গল্প।মনে বুঝলাম আমাদের রাজস্থানের পদ্মিনীর মত। সব দেশেই বোধ হয় এরকম প্রচলিত গল্পকথা চালু আছে। বললাম, তুই কি করে জানলি? ও বলল, আমার বাবা বলেছে। 
আমারও তাই মনে হল। এখানের ইতিহাস যা বলা হচ্ছে, তার কতটা সত্যি আর কতটা অনুমান, বলা মুস্কিল। এর সঙ্গে স্থানীয় মানুষের শোনা প্রাচীন গালগল্পও যোগ হয়।সব মিলিয়ে মিশিয়ে এক কাল্পনিক ইতিহাস খাড়া হয়। 

যাই হোক, আমি বললাম, আর যাব না।এবার ফিরব। ফেরার পথে দেখি, পরপর কয়েকটি বিক্রেতা বসে আছে নানা টোকেন স্মৃতি চিহ্ন বা এখানকার হস্তশিল্প নিয়ে। দেখতে গেলাম। খুব আহামরি যে তেমন কিছু নয়। অথচ তারই দাম চাইছে অনেক। কিই বা নেব! তবে লোকগুলি গরীব। রোদের মধ্যে বসে বিক্রী করছে। নিলাম একটা পেট্রার প্লাস্টারের খাজানার মডেল দু দিনার দিয়ে। 

ফেরার সময় সেই সব জিনিসের পাশ দিয়েই ফিরছি। কিন্তু সবই তো দেখা জিনিস। তাই আর দাঁড়ালাম না। তাছাড়া এখন রোদ চড়া হয়ে যাওয়ায় লালচে বালি মাটির পাহাড়ের গায়ে রোদ ঝলসাচ্ছে।চোখেও লাগছে।মাথা নীচু করে এগিয়ে পৌঁছালাম সেই খাজানার কাছে। এর আগেও অনেক ছবি নিয়েছি। বুলবুলকে বললাম, উটের পিঠে চড়ে ছবি তুলবে না কি? ওর বোধ হয় অনেকদিন আগে জয়শলমীরে উঠের পিঠে চড়ার দুঃস্বপ্ন মনে জেগে উঠেছিল। উট যখন বসা অবস্থা থেকে দাঁড়ায়, সেই অবস্থাটা মোটেই সুখকর নয়। তাই ও আর রাজী হল না। উটওয়ালারাও এগিয়ে এল। কিন্তু ও আর কিছুতেই রাজী হল না। তখন উটের সামনেই ছবি তোলা হল।

 পিছু ফিরে পেট্রার সবচেয়ে দামী আকর্ষণকে বিদায় জানিয়ে আমরা আবার ছায়ায় ঘেরা ‘সিক’ এ ঢুকলাম। এখানে মাঝে মাঝে রোদ। তবে ছায়াও অনেকখানি। ফলে জায়গাটা অনেকখানি ঠাণ্ডা। এখানে রাস্তায় যা যা ছেড়ে গিয়েছিলাম মনে হচ্ছে, বা যা দেখা হয় নি আবার দেখতে দেখতে চললাম। হঠাৎ দেখি পিছন থেকে এক জোড়া মাউন্টেড পুলিশ এসে হাজির। তরুণ আরব পুলিশ বেশ সুদর্শন। আমাদের কাছে এসে বলল, কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো? আমরা তো দেখে শুনে আশ্চর্য ! এর মধ্যেও পুলিশ ঘুরছে, কেউ কিছু ক্ষতি করছে কি না বা কারোর কোন অসুবিধা হচ্ছে কি না জানতে।এই সহৃদয়তা বিশেষ কোথাও দেখি না। আমরা হেসে বললাম, নাঃ, কোন অসুবিধাই নেই। বরং আপনারা একটু দাঁড়ান, আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাই আপনাদের স্মৃতি চিহ্ন। ওরা আমাদের ইচ্ছামত ঘোড়া নিয়ে বীরদর্পে দাঁড়াল। আমরা বেশ কয়েকটা  ছবি তুলে ওনাদের ধন্যবাদ দিয়ে এগোলাম ফেরত পথের দিকে।

এতক্ষণ তো আমরা পথের টানে এগিয়েছি । এবার শরীর জানান দিচ্ছে, তার ইন্ধন চাই।সব শেষ। ফলে পেটের ভিতর উথাল পাতাল তুফানের শব্দ শুনছি। এগোলাম, ঢোকার মুখের কাছেই যে দোকানগুলো রায়েধ দেখিয়েছিল, সেখানেই গিয়ে হাজির হলাম। এই প্রসঙ্গে বলি, আমি তো গিয়েছিলাম আজ থেকে প্রায় ন’-দশ বছর আগে। তখনও কিন্তু এত ভিড় এত দোকান ছিল না। খাবার দোকান ছিল মাত্র ওই দুটি। তাও খুবই সাধারণ মানের। কাছাকাছি বোধ হয় হোটেলও বেশি ভাল ছিল না। এখন শুনেছি, অনেক হোটেল হয়েছে।অবশ্য যাত্রীও অনেকগুণ বেড়েছে। আমরা খুব বেশি ভিড় কিন্তু দেখি নি। 

যাই হোক, গিয়ে দেখি, দুটোর মধ্যে আবার, একটা দোকান খোলা থাকলেও মালিককে খুঁজে পেলাম না। অগত্যা বাকী একটি দোকানই একমাত্র অগতির গতি। দোকানে দেখি আমরা ছাড়া কেউ নেই। আর দোকানটিও আমাদের এখানের একেবারে মামুলি দোকানের মতই। কয়েকটি বেঞ্চ আর টেবিল পাতা। তবে যেতেই মালিক শশব্যস্তে এগিয়ে এসে সাদরে অভ্যর্থনা করল।আমরা ওরই মধ্যে দুটি চেয়ার খুঁজে নিয়ে বসে একটু হাত পা ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। বুলবুলকে বললাম, তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। আজ তো আর প্রোগ্রাম কিছু নেই। ধীরে সুস্থে খেয়ে আরাম করে উঠব। মোটামুটি খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে বেরোলাম। ফোনে ডাকলাম রায়েধ কে।খাবারগুলো ভালই ছিল এবং পরিচ্ছন্ন।রায়েধ খানিকক্ষণ পরেই হাজির।

 ফিরলাম হোটেলে। রায়েধ এদিক ওদিক একটু জায়গাটা ঘুরিয়ে হোটেলে ছেড়ে দিয়ে বলল, আজ আপনাদের রাতে নিয়ে যাব একটা হোটেলে।আপনারা অনেকবারই বলছিলেন, এখানকার আসল ডিস খেয়ে দেখবেন। শুনেই আমি লাফিয়ে বললাম , বললাম, তাহলে কিন্তু এখানকার যা ‘বেষ্ট ‘এবং তোমার যা ভাল লাগে, সেরকম কিছু খাইও, যাতে আমি পরে মনে রাখতে পারি,  জর্ডনের খাবারের বিশেষত্ব। 
ও বলল, আমি আমার এক বন্ধুর দোকানে নিয়ে যাব, দোকান দেখে আপনাদের হয়ত খুব ভাল লাগবে না, কিন্তু আপনারা খেয়ে বলবেন। দোকানটা খুব বিখ্যাত এবং খুব ভিড় হয়। যাক,  আপাততঃ বিশ্রাম করুন। 

সন্ধ্যা একটু ঘনাতেই রায়েধ এসে হাজির। বলল চলুন।

নিয়ে হাজির করল, সত্যিই রাস্তার পাশের একটি দোকানে। গিয়ে দেখি, দোকানের বিশাল ঘর বাড়ি , কায়দা কেতা কিছুই নেই। নিছকই একটু বড় হোটেল। তবে ভিড় দেখে থমকে যেতে হল। আমার মনে পড়ল কোলকাতার ডেক্রস লেনে ‘চিত্তদার বিরিয়ানী’র দোকানের কথা। দোকান দেখতে যাই হোক, যারা ওই দোকানের বিরিয়ানী খেয়েছে, ভুলবে না।অবশ্য আজকের কথা জানি না, যখন কোলকাতায় অনেকে ছিল না তখন,’ চিত্তদা’ ছিল। যাই হোক, দেখলাম, ওখানে রায়েধের খাতির খুব। মালিক দৌড়ে এসে তাকে নিয়ে গেল ভিতরে। ও আমাদের দেখিয়ে বলল,আজ কিন্তু  আমাকে নয়, এঁদের খাতির করুন। শুনে মালিক নিজে আমাদের তো যথোচিত সমাদরে ওরই মধ্যে ভিড় ফাঁকা করে একটা টেবিলে বসাল।
এখানে দেখি ভিড় বেশ। বেশ কিছু মানুষ বাইরেও অপেক্ষা করছে টেবিল পাওয়ার আশায়। রায়েধ ইতঃমধ্যে কি দিতে বলল, ও-ই জানে। ও কিন্তু আমাদের সঙ্গে বসল না। ওকে বললাম, এসে বস আমাদের সঙ্গে। ও হেসে বলল, আমার জন্য অন্য স্পেশাল ব্যবস্থা আছে, বলে দূরে বসল। জানি না হয়ত কিছু পানীয় বা অন্য কিছু নেবে। তাছাড়া হয়ত শিষ্টাচারেরও পরিপন্থী বলেও বোধ হয়েছে ওর। তবে দোকানের মালিক যে, ওকে খুব খাতির করে এবং দোকানের প্রত্যেকটি কর্মচারীর সাথে যে ওর ভাল পরিচয় বা বন্ধুত্ব আছে, তা বুঝলাম, ওদের ব্যবহার ও কথাবার্তা থেকে।
যাই হোক, আমরা বসার একটু পরেই বিশাল একটি থালা এল আমাদের দুজনের জন্য। একটু আশ্চর্য হলাম, দুজনের জন্য একটা থালা দেখে,  তাও এত বড় থালা। সেটাও আবার কাঁচের প্লেট নয়, কাঁসা বা ওই জাতীয় কিছু ধাতব প্লেট।
দেখি তার মাঝে রয়েছে একটু উঁচু করা পোলাওয়ের মত কিছু এবং তার চারিদিকে রয়েছে বড় বড় মাংসের টুকরো, যা থেকে একটা সুন্দর সুগন্ধ বেরোচ্ছে। এ গন্ধ আমরা আগে কোথাও পাই নি। আর তার চারিদিকে বেশ অনেক পরিমাণে পাঁউরুটির টুকরো।তবে পোলাওয়ের চালের সঙ্গে অনেক কিছুই আছে দেখলাম, শুধু চালই নয়। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম, অনেকেই এরকম এক থালা থেকে খাচ্ছে, একসঙ্গে। সেই কবে বিয়ের সময় ছাড়া আর আমরা একসঙ্গে একথালায় কখনও খেয়েছি বলে তো মনে পড়ে না।
বুলবুল বলল, কিছু মনে পড়ছে?
হেসে বললাম, সেই প্রথম দিনের কথা মনে পড়ছে। তবে সেদিন তোমার লজ্জারাঙ্গা মুখ ছিল। আর আজ তুমি পাকা গিন্নী , আমাকে শাসন করার অধিকারী। পান থেকে চুন খসলেই বিপদ।ভয়ে ভয়েই থাকি! 
ও কনুই দিয়ে , সবাইকে আড়াল  করে, গুঁতো দিয়ে হাসল একটু।
এর পর যাব পরের পর্বে।সঙ্গে থাকুন—
ক্রমশঃ-

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments