খর্জুর বীথির ধারে
মলয় সরকার
(৯ম পর্ব ) নবম পর্ব
আমরা তো খাবারের থালা দেখেই ঘাবড়ে গেছি।এত খাবার তো আমরা খেতেই পারব না। আমাদের বাঙ্গালীর রোগা পেটে কি এত সব রাজকীয় জিনিস ঢুকবে! আর যা থালার সাইজ তাতে, বোধ হয় একটা ছোট বাচ্ছা শুয়ে পড়তে পারবে।আমরা তো চোখ কপালে তুলে বসে আছি। তবে হ্যাঁ, দেখলাম আশে পাশে যারা বসে খাচ্ছে, তাদেরও থালার এই সাইজ। সব্বাই জমিয়ে খাচ্ছে আর জমিয়ে আড্ডা মারছে।চারপাশ আওয়াজে সরগরম। বাইরেও অনেক লোক দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।
ওরা বলল, আর যা লাগবে, বলবেন। খেয়ে দেখি অতুলনীয়। যেমন সুন্দর নরম তুলতুলে মাংস, তেমনি তার স্বাদ গন্ধ।সব মিলিয়ে মিশিয়ে সত্যি, রায়েধ যা বলেছিল, তাই। সারা জীবন মনে রাখার মত। মাংসটা ছিল ল্যাম্ব বা দুম্বার। আমি সেই থেকে পাঁঠার মাংসের থেকেও ল্যাম্বের মাংসের বেশি ভক্ত হয়ে গেছি। খুব খাতির করে খাওয়াল। তবে, আর নেব কি, যা দিয়েছে তাই শেষ করতে পারলাম না। সঙ্গে যে পানীয়টা দিয়েছিল, সেটাও অপূর্ব । কেমন যেন, দই জাতীয় কিছু দিয়ে তৈরী।
পরে জেনেছিলাম, এই যে খাবারটি ওরা দিয়েছিল, তার নাম ‘মন্সাফ’ । এটিই এদের জাতীয় খাবার। তবে সেটিকেও নাকি এরা কি কায়দা করে একটু পরিবর্তন করে আরও সুস্বাদু করেছে, যার জন্যই লোকে বড় বড় হোটেল ছেড়ে এসে এখানে খায়। দেখলাম, আমাদের মত বিদেশিদেরও মন ভরে গেছে এদের খাবারে।এতে নাকি অনেকে উটের মাংসও দেয়।আর এটা নাকি মন্সাফই হবে না যদি না এতে ছাগলের দুধের জমানো দই দেয়। আর সেই দইয়ের নাম জমীদ।আমাদের এখানে অনেক বড় বড় দোকানের বিরিয়ানি, এমনকি বিরিয়ানী খ্যাত হায়দরাবাদে গিয়ে সবচেয়ে বড় প্রসিদ্ধ দোকানের বিরিয়ানীও খেয়েছি, কিন্তু এটা যেন সম্পূর্ণ অন্য রকমের।
পরে জর্ডনের আর যে সব প্রসিদ্ধ খাবার আছে, সেগুলোও অনেকটা খেয়ে দেখেছি, যেমন সাওয়ারমা, যেটি মেক্সিকান ট্যাকোর পূর্বপুরুষ, এ ছাড়া ফালাফেল (এক ধরণের বড়া), আরায়েস,সাম্বোসা (আমাদের সিঙ্গারার মত), কাবাব, হাম্মাস,বাবা ঘানাউস,ইত্যাদি।বেশ ভাল লেগেছে। তবে এদের অনেক খাবারেই মাংস বেশি।
রিয়াধকে বলছিলাম, এরা এত বেশি ব্রেড দেয় যে খাওয়া যায় না। ওরা বলল, ওটাই এই সব খাবারের নিয়ম। আর, ওরা ওই সব না খাওয়া ব্রেড ফেরৎ নেবে না। ওগুলো সব, এরপর ওরা, যত ভিখারী আছে তাদের দিয়ে দেবে।
খাওয়ার শেষে মালিক জিজ্ঞাসা করল, কেমন লেগেছে?
বললাম, মন খুশ হয়ে গেছে।
ও জানাল, আদাব। আপনারা বিদেশী মেহমান। আপনাদের, আমার সেবা যদি ভাল লেগে থাকে, সেটাই আমার তোহফা।
ফেরার সময় রায়েধ বলল, ভাল লেগেছে স্যার? সিস্টারের কেমন লেগেছে?
আমরা দুজনেই বললাম, ভীষণ ভাল লেগেছে।
শুনে ওরও মুখে হাসি ফুটে উঠল।
ফেরার সময় ওকে বললাম, আচ্ছা রিয়াধ, আমাদের তো ডানা যাওয়ার কথা ছিল , তাই না? তা, আমরা দেখলাম না তো?
ও বলল, হ্যাঁ, আমি ইচ্ছা করে যাই নি । যাওয়ার কথা ছিল ঠিকই। দেখুন, টুর কোম্পানী গুলো অনেক জায়গার নাম দেয় টুরিস্টকে খুশি করার জন্য। কিন্তু দু ধরণের টুরিস্ট আছে। একধরণ, যারা জায়গা ভাল করে দেখতে চায় না, গুনতে চায় ক’টা জায়গা দেখা হল। আর এক ধরণের আছে, তারা সমস্ত জায়গাটা ভাল করে দেখে মন দিয়ে বুঝতে চায়, উপভোগ করতে চায়, জায়গা গুনে সংখ্যা বেশি করতে নয়। আমি দেখলাম, আপনারা প্রতিটি জায়গা , ছোট বড় সব কিছু খুঁটিয়ে ধীরে ধীরে দেখছেন মন দিয়ে, সব উপভোগ করছেন। এতে সময় বেশি লাগে। তবে এই দেখাই সব চেয়ে ভাল দেখা হয়। কিন্তু এরকম দর্শক সব সময়ে পাই না।এই ভাবে দেখতে, ও সব দেখতে হলে আপনাদের আরও বেশ কয়েকটা দিন সময় নিয়ে আসতে হত। তাহলে সব ধীরে ধীরে দেখাতাম। তাই আমি ইচ্ছা করে ডানাটা বাদ দিয়েছি। ওটা অনেক কম ইম্পর্টান্ট। ওখানে একটা ভুতুড়ে, পুরানো দিনের কিছু বস্তি আছে। এখন বিশেষ কিছু নেই। সরকার থেকে টুরিষ্টদের ডাকার জন্য নানা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে।ওর থেকে, যা দেখছেন, সেগুলো অনেক বেশি দরকারী। সে রকম দেখলে এক মাস লাগবে আপনার জর্ডন দেখতে। আরও অনেক ক্যাসল আছে, শুধু পেট্রাতেই আরও কয়েকদিন লাগবে। আমিএই সময়ের মধ্যে আপনাদের মত মানুষের যা যা সব চেয়ে বেশী ইম্পর্টান্ট তাই দেখাচ্ছি। ভবিষ্যতে মনে রাখতে পারবেন।
আমি ভাবলাম, ওর কথা যুক্তিযুক্ত। আমি ঐ ঘোড়াদৌড়ের মত কিছু দেখতে পছন্দ করি না। যেখানে যাই অনেক দিন ধরে তারিয়ে উপভোগ করতে চাই। রোম গিয়ে রোমেই ছিলাম পাঁচদিন। তাও মনে হয়েছে কম হয়েছে। চীনে প্রায় একমাস ঘুরেছি, সে-ও অনেক কম।
আসলে ডানা একটি পুরানো পরিত্যক্ত পাহাড়ী বেদুইন বসতি। এই ৩০৮ বর্গকিলোমিটারের মরু পাহাড়ী উপত্যকাকে ১৯৮৯ সালে রিজার্ভ বায়োস্ফিয়ার বলে স্বীকৃতি দিয়ে প্রচারের আলোয় আনা হয়েছে। এখানে প্রায় ৬০০০ বছর আগেকার মনুষ্য বসতির খোঁজ মিলেছে। এখানে নাকি, প্যালিওলিথিক যুগ থেকে আরম্ভ করে নাবাতিয়া, মিশরীয়, রোমানদের বসবাসের চিহ্নও পাওয়া গেছে।
বর্তমানে কিছু কৃষক শ্রেণীর মানুষ বাস করে এই ডানা গ্রামে। এখানে যারা অতি উৎসাহী , তাদের জন্য হেঁটে চলার কিছু পাহাড়ী রাস্তা (ট্রেল)আছে, যেগুলি দিয়ে গেলে এই অঞ্চলটিকে ভালভাবে উপলব্ধি করা যায়।, প্রায় ২০০ প্রজাতির পাখীর ডাক শুনতে শুনতে ছোট খাট বন্য জীবজন্তুর সাথে পরিচয় করতে করতে আর প্রকৃতির শান্ত মনের গান শুনতে শুনতে যদি একটা দিন প্রকৃতির কোলে কাটানো যায় অবশ্যই ভাল লাগবে। এই রকম জায়গায় তো আর গেলাম এবং দেখে চলে এলাম, এ রকম করা যায় না, সেটা অর্থহীন। ভেবে দেখলাম, রিয়াধ ঠিকই বলেছে। আমরা আরও কয়েকটা দিন বেশি করে হাতে আনলে হয়ত সুবিধা হত।
কি আর করা যাবে। মূল ইতিহাসটাকে দেখেই চোখ সার্থক করতে হবে। তার মধ্যে, আগামী কাল যেতে হবে, যার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হবে, সেই সত্যিকারের আরব মরুভূমির।কাজেই চোখে এবং মনে প্রচণ্ড উৎকন্ঠা নিয়েই আমরা আজকে ফিরলাম আবার সেই আগেকার হোটেলেই অর্থাৎ পেট্রার হোটেলেই । আজকের মত রিয়াধকে দিলাম বিদায়। ও বলল,কালকে কিন্তু আবার ঠিক সকাল সাড়ে নটায় তৈরী থাকবেন, আপনাদের ভাই, রিয়াধ ঠিক হাজির থাকবে। আমরা হেসে বিদায় দিলাম।
সত্যিই ও সারাদিনে যা ব্যবহার করে, ঠিক একেবারে ভাইয়ের মতই । যখন যা লাগে রিয়াধকে বললেই হাজির। কাল বলেছিলাম, রিয়াধ, এখানে পাতিলেবু পাওয়া যায় না? আসলে এই গরমে একটু লেবু পেলে ভাল হত। ও ঠিক এনে হাজির করল একটা ছোট বাজারের মধ্যে, যেটা দেখে ঠিক আমাদের দেশের স্থানীয় মানিকতলা বা ব্যারাকপুরের বাজারের মতই লাগল। নিলাম পাতিলেবু- দামও বিশেষ কিছু বেশি নয়।
আজকের মত ফিরলাম হোটেলে।
পরদিন ভোরে উঠে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে পাশের দোকান থেকে ব্রেকফাস্ট করেও এলাম। সকালের রোদ ঝকঝকে সোনার মত । এখানে কি জানি, শহরের বাইরে বলে কি না, কিংবা মরুভূমি অঞ্চল বলেই বোধ হয়, রাতে একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগে, সকালেও তার খোঁয়াড়ি চলতে থাকে। অথচ সারা দিনে বেশ গরম । আজকে রিয়াধ বলেই দিয়েছিল, যাবেন মরুভূমিতে। মাথার রোদের টুপি , সঙ্গে জলের বোতল ইত্যাদি নিতে ভুলবেন না। আমরা সব নিয়ে তৈরী।
রিয়াধ এল। আমরা মনে মনে জর্ডনের বুকের মণিমুক্তো ভরা পেট্রাকে বিদায় দিয়ে চললাম। উদ্দেশ্য,জর্ডনের আর এক অন্য রূপ দেখার জন্য।
আমরা ১১৫ কি মি রাস্তা ভেঙে চললাম সেই কিংস ওয়ের বুকের উপর দিয়ে , যে রাস্তা দিয়ে সেই অতীত কাল থেকে রাজা মহারাজা, আর দেশী বিদেশী সার্থবাহের দল চলেছে তাদের গন্তব্যে। কত রক্তাক্ত জয় পরাজয়ের পথ, কত ব্যবসা বাণিজ্য লাভ লোকসান কান্না হাসির ইতিহাস বুকে নিয়ে সুদীর্ঘ অজগরের মত পড়ে রয়েছে এই রাজপথ।প্রায় ৫০০০ বছর ধরে এই পথ অনেক ইতিহাসের সাক্ষী।এই রাস্তাতেই খ্রীষ্টান পূণ্যার্থীরা চলেছে মাউণ্ট নেবোতে তাদের পূণ্যভূমি পরিদর্শণ করতে। মুসলিমরা এই পথে চলেছে সুদূর মিশর (প্রাচীন হেলিওপোলিস)থেকে দামাস্কাস হয়ে রেসাফায়( বর্তমান সিরিয়া) । এই রাস্তাই অন্য রাস্তার সাথে মিশে চলে গেছে মুসলমানদের তীর্থক্ষেত্র মক্কায়।
চারপাশে অনন্ত বালিয়াড়ির মাঝ দিয়ে চলেছে মৃত অজগরের মত পরিচ্ছন্ন পথ। সবুজের চিহ্ন বা বিশেষ জনবসতির চিহ্ন প্রায় চোখে পড়ে না। এরকম রাস্তায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা তো নেই।রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
“ ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন, চরণতলে বিশালমরু দিগন্তে বিলীন–”
আমার তো দেখেই ভয় লাগছে যে,এই রকম বিশাল মরুর মাঝে যদি সত্যিই ছেড়ে দেওয়া হয় আমাদের মত কাউকে, তার মোটেই আরব বেদুইন হওয়ার ইচ্ছা হবে না। ”কঙ্কণা নদীর ধারে — দুর্বাদল ঘন মাঠে-” র কোন ছেলে এই আদিগন্ত মরুভূমির মাঠে দিকশূন্যপুরের ঠিকানা কি খুঁজে পাবে?
মরুভূমির কথা বইতেই পড়েছি, আর দেখেছি কিছুটা আমাদের জয়শলমীরের থর মরুভূমিতে।কিন্তু এ যে একেবারে আরব মরুভূমি!
চলুন এর পর ঢুকব ভিতরে—
ক্রমশঃ–
0 Comments