জ্বলদর্চি

"পরম চেতনার ম্যানিফেষ্টো" জেড(z) প্রজন্মের কবিতা যুগের সূচনা /লেখক-অরুণ দাস /আবীর ভট্টাচার্য


"পরম চেতনার ম্যানিফেষ্টো"
 জেড(z) প্রজন্মের কবিতা যুগের সূচনা
             লেখক-অরুণদাস

আবীর ভট্টাচার্য 


আমরা যারা এখনও বইপত্র পড়তে ভালোবাসি,  কোন বিশেষ নামের অথবা কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্যময় বই হাতে এসে পড়লে, মনে বেশ রোমাঞ্চ আসে; লৌকিক শতব্যস্ততার মধ্যেও কুহকিনী আকর্ষণে সে ডাকে। সাড়া দিতে বাধ্য হই। তা সে বইটির আয়তন যেমনই হোক না কেন!         

     বিশেষত এই রোমাঞ্চিত অনুভবই আমায় আচ্ছন্ন করলে, অমিত্রাক্ষর প্রকাশনীর,অরুণ দাস লিখিত 
        "পরম চেতনার ম্যানিফেষ্টো", 
   জেড(z) প্রজন্মের কবিতা যুগের সূচনা

নামের ক্ষীণদেহী, মাত্র বত্রিশপাতার বইটির পরিচয়পত্র দেখে।  স্বীকার করতে বাধা নেই, প্রথমবার তেমন আকর্ষণ বোধ না করলেও এক নতুন ভাবনার উদ্রেক হলো, আবার পড়লাম, আবার। বারে বারে নতুন নতুন ক্ষেত্র যেন উন্মোচিত হতে লাগলো, আকর্ষণ এবং মুগ্ধতা বাড়লো। বিশেষতঃ যে ক্ষেত্রটি নিয়ে আলোচনা, অর্থাৎ 'জেড প্রজন্মের কবিতা যুগের সূচনা' - বিষয়টির অভিনবত্ব নিয়ে সমসাময়িক কেউ এমন গভীরভাবে ভেবেছেন বলে জানা নেই; যদিও লেখালেখি চলছে নিরন্তর।

সাধারণ ভাবে, জেড প্রজন্ম বলতে আমরা বয়সে নবীন,জ্ঞান-বুদ্ধিতে পরিনত আজকের তরুণ দলের কথা জানি; যারা প্রাযুক্তিক বিকাশের নিরিখে মানবজাতির সর্বশেষ প্রজন্ম। এই শতাব্দী অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত যারা জন্মেছে সেই প্রজন্মের আন্তর্জালিক প্রযুক্তি ব্যবহারে পটুত্ব, বাস্তববাদী জীবনচেতনা আমাদের মুগ্ধ করে। আবার একইভাবে,যুগসমস্যায় অতিষ্ঠ এই প্রজন্মের নিঃসহায় একাকীত্বও আমাদের ব্যথিত করে।
  
              তাই, বইটির জ্ঞানগর্ভ বিষয়-বক্তব্য আলোচনা করার আগে,একথা বিশেষ ভাবে মনে রাখা প্রয়োজন এই যে, লেখক তাঁর চেতনার আলোয় ভবিষ্যত নতুন প্রজন্মকে এক শ্রেয়তর দিশা দেখতে চেয়েছেন। এবং তাই কি 'ম্যানিফেষ্টো'-কথাটি ব্যবহার করেছেন? বিশেষতঃ 'ম্যানিফেষ্টো'-কথাটি; কথাটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে কমিউনিস্ট কথাটি। কিন্তু বইটির বিষয়বস্তু পরম চেতনার, এবং উৎসর্গ করা হয়েছে "হৃদয়ে তরুণ কবি ও শিল্পীদের"...অতয়েব দুই ভিন্নধর্মী মনন এবং চেতনা কিভাবে লেখক মিলিয়েছেন,তা জানার আগ্রহ সৃষ্টি হবেই মরমী পাঠকের। এবং এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই দুই বিপরীতধর্মী চেতনাকে লেখক আলোচনা করেছেন সম্পূর্ণ  নির্মোহ দৃষ্টিতে।
  
  আজন্মই এই ধারনা স্বতঃসিদ্ধ এই যে, মানবহৃদয় সততঃ প্রকাশপিয়াসী, আপন আবেগের কাছে সে বাঁধনহারা। সেই কোন অনাদিকাল থেকেই দিনযাপনের গ্লানিমুক্তির সংগ্রাম শেষে,গুহাবাসী মানুষ সারা দিনের প্রাণান্ত পরিশ্রমের অর্ঘ্য নামিয়ে রাখতো চিত্রে,কাব্যে। এই সব সান্ধ্য বিশ্রামে আপন আনন্দ প্রকাশের মাধ্যম ছিলো ধ্বনি বা বর্ণ, আদপে যা তার সৃষ্টি-আয়ুধ।
ভীমভেটকা, আলতামিরা হয়ে  ঋদ্ধ সংস্কৃতির উচ্চাবচ এই যাত্রাপথরেখা আজ এসে পৌঁছেছে জেন(z) প্রজন্মের কাছে; রবীন্দ্রনাথের কথায় যারা 'নতুন যৌবনের দূত'...
                       তবে পুস্তিকাটির পাঠপ্রতিক্রিয়া আলোচনার প্রারম্ভে মনে রাখা প্রয়োজন ,যে আধুনিক যাপনে, ক্রমবর্ধমান সমস্যাদীর্ণ যৌবন বড়ো অসহায়। লেখন-বিশ্বেও স্বাভাবিক ভাবেই তার প্রভাব পড়ছে; তবু আশার কথা এই যে, তার মধ্যেই অমিত শক্তিতে নবপ্রজন্ম জ্বেলে রাখছে অন্তরের প্রাণের প্রদীপখানি সৃষ্টিসুখের উল্লাসে।তাই,শিল্প, বিজ্ঞান,দর্শন প্রভৃতি বিষয়ের মতোই কবিতারও ভিন্নভিন্ন ক্ষেত্রে পরীক্ষা নীরিক্ষা চলছে। এবং সুখের কথা,আলোচিত বইটির লেখক 'অরুণ দাস'ও এমনই একটি নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন করলেন তাঁর বোধি এবং অভিজ্ঞতার আলোয়। তাই যখন তাঁর উচ্চারণে শুনি,
'উচ্চতর চেতনায় কবি উপলব্ধি করেন চেতনা আসছে জড় পদার্থ থেকে। তাই তারা জড় পদার্থের মধ্য দিয়ে চেতনার অন্বেষণ করেন। প্রকৃতপক্ষে জড়ের উদ্ভবও চেতনা থেকে। চেতনার অস্তিত্ব সবসময়ই আছে। তা অজ্ঞানের দ্বারা আচ্ছাদিত হলে আমাদের কাছে অচেতন মনে হয়।

পরমচেতনায় কবি অনুভব করেন চিৎ-শক্তি জড় ও চেতন সবকিছুর উৎস। চিৎ-শক্তি ছাড়া জড়শক্তি অস্তিত্বহীন। জড় জগৎ ক্ষনস্থায়ী, কিন্তু চিন্ময় জগৎ নিত্য। সুতরাং পরমচেতনার মধ্য দিয়ে জড় বস্তু ও জীবনকে উপলব্ধি করলে তার যথার্থ রূপকে ছোঁয়া যায়। পরমচেতনায় ব্যক্তি-বস্তু, সব কিছুই নিত্য, শ্বাশ্বত ও চিন্ময়।'-বড়ো স্বস্তিপ্রলেপ পড়ে অশান্তি দহন-ক্ষতে।

এক্ষেত্রে আরও একটি কথা বলতে ইচ্ছে হয়,এই সমর্পণ বা আনতিকে হয়তো বা লেখক তুলনা করেছেন আধিবিদ্যামূলক লেখনীর সঙ্গে, যেখানে প্রকৃতি  এবং মানুষও পূজ্য; অতীন্দ্রিয় বোধে শব্দই ঈশ্বর।
 অন্যদিকে, শব্দকে ব্রহ্মজ্ঞানে পূজা,অন্ন শুধু নয়,বর্ণও ব্রহ্ম- উপনিষদের এই তত্ত্বজ্ঞান উঠে এসেছে আধুনিক মননের যুগপুরুষ 
বিবেকানন্দের কথাতেও - “ঠিক ভাবে নিয়োজিত হলে কল্পনা আমাদের পরম বন্ধুর কাজ করে। কল্পনা যুক্তির রাজ্য ছাড়িয়ে যায় এবং একমাত্র কল্পনার আলোই আমাদের সর্বত্র নিয়ে যেতে পারে। 
তার কথাই ‘আমাদের অবচেতন স্তরে যে সব অসংখ্য চিন্তা ডুবিয়া রহিয়াছে, আমাদের জ্ঞান-নিরপেক্ষ হইয়াই যেগুলি নিজে নিজে কাজ করিয়া চলে, সেগুলিকে স্ববশে আনিতে চাওয়াই হইল আমাদের সর্বপ্রথম কাজ। 

মনে পড়ে,পাবলো নেরুদা একদা বলেছিলেন, সবাই একভাবে লিখবেন না। অর্থাৎ একই ঘটনাবলী বা দৃশ্যান্তরে কেউ দেখেন আকাশ, কেউ মাটি,কেউ পূজা,কেউ বা প্রেম। তবু একথা ভুলি কি করে, সত্য,শিব,সুন্দরের আরাধনা ছাড়া কবির আর কোন ধর্ম নেই, উপাস্য দেবতাও নেই। তাই,বাস্তব, পরাবাস্তব, অবাস্তব...যে নামেই ডাকি না কেন, সত্য ও কল্পনায় মিলে যে অর্ঘ্য নিবেদিত হয় সেই পরমের শ্রীপাদপদ্মযুগে, উচ্চতর অনুভব সুখে তাই জন্ম দেয় অনুপমা কবিতার; এবং এই সর্বৈব সত্য কথাটিই ক্ষীনদেহী পুস্তিকাটির নিটোল দেহায়বয়বে সুচারুভাবে সজ্জিত।

পরিশেষে আমাদের বলার কথা এই যে, কবিতা যদি হয় শব্দ আহরিত বিমুর্ত ব্যঞ্জনা, বোধ বা অনুভব তার মহার্ঘ্য অহঙ্কার। সুচারু শব্দচয়নে,ভাবানুভূতির উচ্চতর অভিনিবেশ সন্ধানে লেখকের তন্নিষ্ঠ প্রয়াস পুস্তিকাটির সর্বাঙ্গে এক অপরুপ মাধুরী দান করেছে, মাত্র একবারের পাঠে তার স্বরূপ হয়তো অধিগত করা দুঃসাধ্য। শুক্তির মধ্যের মুক্তাসন্ধানী মন নিয়ে ভাবগহীনে ডুব দিলেই সে রূপসাগরে অরূপরতনের সন্ধান মিলবে।পড়তে হবে, বারংবার পড়তে হবে। আন্তরিক শুভকামনা সহ প্রত্যাশা রইলো লেখকের আগামী রচনাপাঠের, নমস্কার।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. সুনিপুণ পাঠ প্রতিক্রিয়া বইটি পড়ার আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম. ধন্যবাদ.

    ReplyDelete