জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহল জেলায় সতীদাহ /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব- ৩৩

জঙ্গলমহল জেলায় সতীদাহ

সূর্যকান্ত মাহাতো


আজ থেকে দুশো বছর আগের জঙ্গলমহল। আজকের মতো একাধিক জেলা নিয়ে নয়, তখন একটাই জেলা ছিল। নাম "জঙ্গলমহাল" জেলা। দাদা জগমোহনের মৃত্যুর পর রামমোহন রায় তার নিজ বৌদি অলকমঞ্জরী বা অলকমণির সতী হওয়ার যে যন্ত্রনা মাখা বীভৎস কান্না শুনেছিলেন, সেই অমানুষিক চিৎকার তখন জঙ্গলমহলের আকাশে বাতাসে কান পাতলেও শোনা যেত। বাতাসে কেবল শাল সেগুনের গন্ধই ছিল না। সেই নাকে ভেসে আসত ইউরোপিয়ান মহিলা ফেনি পার্কস(Fanny Parks) এর "Wondering of a pilgrim in seach of the picturesque, during four and twenty years in the east with revelations of life in the Zenana" গ্রন্থে ১৮৩০ সালের ৭ই নভেম্বর ঘটিত কানপুর নিবাসী এক ধ্বনি বণিকের স্ত্রীর সতী হওয়ার পোড়া গন্ধের মতো একটা বিকট গন্ধ।

সহমরণে যাওয়ার সময় বিধবা নারীদের আগুনে পোড়া জ্বালা যন্ত্রণার চিৎকার ঢাকা দিতে আরও দ্বিগুন জোরে বাজানো হত খোল করতাল। মৃতদেহ সৎকারে আজও সেই খোল করতাল জঙ্গলমহলের শ্মশান ঘাটে বেজে চলে। তবে সেই অভিশপ্ত কান্না চাপা দিতে নয়। সেই কান্না চাপা দিতে দিতে যে অভ্যাস তৈরি হয়েছিল তাকেই বোধহয় বাঁচিয়ে রাখতে।

জঙ্গলমহলে সতী হওয়ার ঘটনা অসম্ভব কিছু ছিল না। কারণ জঙ্গলমহল বাংলার বাইরে নয়। বাংলায় সহমরণ বিষয়ে রামমোহনের বন্ধু অ্যাডাম সাহেব বিলাতে সতীদাহ বিষয়ে যে কঠিন বক্তব্য রেখেছিলেন, তাতে 'জঙ্গলমহল' কোনও ভাবেই বাদ যাওয়ার কথা নয়। বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন "আমি নিশ্চয়ই করিয়া বলিতেছি যে, ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশে ইংরাজের রাজ্য সংস্থাপন অবধি গভর্মেন্ট ও তাহার কর্মচারী দিকের চক্ষুর সম্মুখে প্রতিদিন অন্তত এইরূপ দুইটি হত্যাকান্ড সুস্পষ্ট দিবালোকে সংঘটিত হইত, এবং প্রতি বৎসর অন্তত ৫/৬ শত রমণীকে এই রূপে নিহত করা হইত।"
বছরে পাঁচ ছ'শ রমণী কে হিন্দু ধর্মের দোহাই দিয়ে হত্যা করা হত! সংখ্যাটা যেখানে মারাত্মক সেখানে জঙ্গলমহলও যে বাদ যাবে না সেটা একরকম সুনিশ্চিত ছিল। পরবর্তী কালে সরকারি পরিসংখ্যান সেটা আরও বেশি করে প্রমাণিত করেছিল। আসলে ১৮১৫ সালের আগে সতীদাহের কোন সরকারিভাবে হিসাব রাখা হত না। ১৮১৫ সাল থেকে সেটা শুরু হয়। সেই মোতাবেক ১৮২১ সালে প্রকাশিত "Paper Relating to East India Affairs"গ্রন্থে জঙ্গলমহলের সতী হওয়ার একটি পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখা যায় যে ১৮১৯ সালে জঙ্গলমহলে মোট ৩১ জন সতী হয়েছেন। এদের মধ্যে শুধু ব্রাহ্মণই ছিল না। বিভিন্ন জনজাতির মানুষ ছিল। যেমন--- ব্রাহ্মণ ছিলেন ৬ জন, মাঝি ১ জন,সদগোপ ৩ জন, রাজপুত ৬ জন, সোনার ১ জন, নাপিত ৩ জন, বৈদ্য ১ জন,আগুরি ১জন, কলু ১ জন, ভূমিজ ১ জন,ভাট ১ জন, দৈবজ্ঞ ১ জন,পোদ্দার ১ জন, তাঁতি ১ জন, তেলি ১ জন, শুঁড়ি ১ জন, কুমারী ১ জন ।

১৮২০ সালে সেখানে সতীর সংখ্যাটা অদ্ভুতভাবে অনেকটাই কমে গিয়ে ১৮ তে নেমে আসে। প্রায় অর্ধেকের একটু বেশি বলা যেতে পারে। যদিও এটি সরকারি পরিসংখ্যান। এই ১৮ জন সতীর মধ্যে ছিলেন,
কায়স্থ ৬, বাউরী ১, চাষা ১, ডোম ১, তাঁতি ১, ব্রাহ্মণ ২, তেলি ১, ভূমিজ ১, সামন্ত ১, রাজপুত ১, সদগোপ ১জন।

এই ৪৯ জন সতীর পাশাপাশি এই দুই বছরে জঙ্গলমহলের বিভিন্ন জমিদারিতেও সতীদাহের ঘটনা ঘটেছিল। সেই সংখ্যাটাও নেহাত কম ছিল না। যেমন বরাভূমের পেয়ারি মাঝি (বয়স ২৪), স্বামীর নাম মলিরাম মাঝি। হরিপ্রিয়া সিং (বয়স ৪২), জাতিতে রাজপুত, স্বামীর নাম লোরাট সিং, পঞ্চকোট জমিদারির শিবানী সিং সর্দার (বয়স ৬০) ও কুত্রোমা সিং সর্দার(৬০), জাতিতে রাজপুত, স্বামীর নাম প্রেম সিং সর্দার, বাঘমুণ্ডী জমিদারীর প্রীতমমণি(৬০), জাতিতে রাজপুত, স্বামীর নাম লালু রাজপুত, বাঘমুণ্ডী জমিদারীর দুঃখী(৮০), জাতিতে রাজপুত, স্বামী রাজা আনন্দ সিংহ এবং বেগুনকোদর জমিদারীর কুমদি (বয়স ৭০) জাতিতে কুমার, স্বামীর নাম দয়ারাম মাহাতো, যমুনা বাউরি(৮০) স্বামীর নাম দুলাল বাউরি, পঞ্চকোট জমিদারির জুহি (৬০) স্বামীর নাম মনশুক মাঝি, জাতিতে তেলি, এবং কল্যাণী বালা (বয়স ৩৫) স্বামীর নাম অর্জুন দেব রাজপুত, পাতকুম জমিদারিতে সতী হন।

জঙ্গলমহল জেলাতে মূলত মূলবাসী মানুষের বাস। তাদের মধ্যেও সতীদাহের ঘটনা কিছুটা বিস্ময়কর তো বটেই। তবে পশুপতি প্রসাদ মাহাতোর মতো কিছু গবেষক একে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আগ্রাসনকেই একমাত্র কারণ হিসেবে মনে করেছেন। ব্রাহ্মণ্যদের এই প্রথা কিছুটা জোর করেই মূলবাসী মানুষদের সমাজে প্রবিষ্ট হয়েছিল। কারণ লাল সিং বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ভূমিজ হাঙ্গামার মতো একাধিক বিদ্রোহ সংঘটিত হলেও পাশাপাশি সংস্কৃতিকরনের একটা প্রবল চাপ তৈরি হয়েছিল।

জঙ্গলমহলে রামমোহনের ব্যক্তিগত প্রভাব সে সময় পড়েছিল এমনটা বলা যাবে না। তার "সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তকের সংবাদ"(১৮১৮) এবং "সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তকের সংবাদ দ্বিতীয়"(১৮১৯) বই দুটির প্রভাবও পড়েছিল এমনটা নয়। বই দুটিতে "অঙ্গীরা", ",ব্যাস" "হারীত" প্রভৃতি ঋষি বচনকে রামমোহন যুক্তি দিয়ে যেভাবে ফালাফালা করেছেন সেই শক্ত ও কঠিন যুক্তিও বোঝার মতো ক্ষমতা মূলবাসীদের ছিল না।

শাস্ত্র নির্ভর হিন্দুদের তাই রামমোহন মনুসংহিতার মতো শাস্ত্রে মনুর বিভিন্ন উপদেশ কে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করে দেখিয়ে দিয়েছেন সহমরণ কতটা শাস্ত্র বিরোধী। আসলে যে কোনও কাম্য কর্মই শাস্ত্র বিরুদ্ধ। "সহমরণ" তো একরকম কাম্য কর্মই ছিল। সেখানে বিধবা নারীদের স্বর্গ লাভের কামনা প্রকাশ করা হত। "মনুর বিধান" বরং বিধবা ধর্মের পক্ষে। সেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে "স্ত্রীলোক পতির কাল হইলে ব্রহ্মচর্যের দ্বারা মোক্ষ সাধন করিবেন" (দ্বিতীয় সংবাদ)। সেখানে সহমরণের কথা কোথাও বলা নেই। এইসব শাস্ত্রীয় কথা মূলবাসী মানুষদের কাছে পরিচিত ছিল এমনটাও নয়।

পরিবর্তে রামমোহনের সহায়তায় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং এর দ্বারা ১৮২৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বরে পাস হওয়া সতীদাহ প্রথা বিরোধী আইন সেই তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর ছিল।

বারবার একাধিক বিদ্রোহে জেরবার হচ্ছিল ইংরেজ। তাই সুদৃঢ় শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতেই ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে "জঙ্গলমহাল" নামে এই জেলা প্রতিষ্ঠা। সুতরাং বলা যেতেই পারে ইংরেজদের শাসন বা আইন এখানে যথাযথভাবেই প্রয়োগ হয়েছিল। তাই সতীদাহ নিবারণও এখানে অনেকটা সহজ হয়েছিল। এছাড়াও সতীদাহ বিষয়ে ব্রাহ্মণ্য প্রভাব সরকার নিয়ন্ত্রণ করতেই সে পথ আরও বেশি সুগম হয়েছিল।

সহমরনে বিধবা নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত ইচ্ছা একেবারেই ছিল না। বরং তাদের উপর বল প্রয়োগ করা হত। সতী হওয়ার জন্য ফোর্স দেওয়া হত। এই বিষয়টা প্রথম ইংরেজ সরকারের দৃষ্টিগোচরে এনেছিলেন রামমোহন রায়। শুধু তাই নয় শোকস্তব্ধ নারীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে "ভাং" জাতীয় নেশা খাইয়ে তাদের মত জোর পূর্বক আদায় করে নেওয়া হত। তাই একে শাস্ত্রসম্মত বিধান কোনভাবেই বলা যায় না। বরং এটা ছিল পরিকল্পিত নিধন বা হত্যা।

লর্ড বেন্টিং রামমোহনের তথ্য ও বক্তব্য খুবই গুরুত্ব সহকারে শুনেছিলেন। তাই আইন পাস করার পূর্বে হিন্দু শাস্ত্র কি বলছে বা হিন্দু পণ্ডিতরা কি ভাবছেন তাকে বিশেষ পাত্তা দিলেন না। বরং আইন পাস হওয়ার পর যারা নিয়ন্ত্রণ করবে সেই দক্ষ সেনাপতিরা কি চাইছেন, কিংবা বিচারপতিরাই বা কি চাইছেন, সে বিষয়ে তাদের মতামত কি, তাকেই অধিক গুরুত্ব দিলেন। ৪৯ জন দক্ষ সেনাপতির মধ্যে ২৪ জন এই প্রথা রদ করতে চাইলেন। ওদিকে পাঁচজন বিচারপতির চারজনই এই ভয়ংকর কুপ্রথা রদ করার পক্ষে মত প্রকাশ করলেন। তাই রামমোহন ও বেন্টিং এর মনিকাঞ্চন যোগে সতীদাহ নিবারণ আইন ১৮২৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু সমাজের অন্দরমহলে যেন আসল বোমাটি ফেটে পড়েছিল।

সরকার এটা কি করল! একেবারে শাস্ত্র বিরোধী হতচ্ছাড়া কান্ড করে বসলেন। এ তো হিন্দু সমাজের বিপর্যয়! চলল রামমোহনের বিরুদ্ধে অশ্রাব্য গালিগালাজ। খুনের হুমকি। সেটা এতটাই ভয়ঙ্কর যে রামমোহনকে আত্মরক্ষার জন্য সর্বদা একটা পিস্তল নিয়ে বেরোতে হত। আইন পাশের সঙ্গে সঙ্গেই হিন্দু পণ্ডিতরা ৮০০ জন অধিবাসীর স্বাক্ষর সম্বলিত একটি দরখাস্ত পাঠালেন সরকারের কাছে এই আইন তুলে নেওয়ার জন্য। এদিকে রামমোহনও থেমে নেই ৮০০ খ্রিস্টান ও ৩০০ জন অধিবাসীর স্বাক্ষর আইনের পক্ষে জানিয়ে অনুরূপ একটি দরখাস্ত সরকারের কাছে জমা করলেন।

শুরু হয়েছিল লড়াই ও পাল্টা লড়াইয়ের খেলা। হিন্দুরা আরও বেশি সঙ্ঘবদ্ধ হতে গড়ে তুললেন ধর্মসভা। প্রথম দিনেই ১১,২৬০ টাকা চাঁদ উঠেছিল। একটি 'মুখপত্র'ও প্রকাশিত হল। নাম "সমাচার চন্দ্রিকা"। সেখানে লাগাতার ভাবে রামমোহনের বিরুদ্ধে শাপ-শাপান্ত শুরু হয়ে গেল। থেমেছিল না রামমোহনও। তার "সংবাদ কৌমুদী"-তে ধারাবাহিকভাবেই চলল সহমরণের বিরুদ্ধে নানান যুক্তিপূর্ণ লেখা।

এই আন্দোলন ও পাল্টা আন্দোলনের প্রভাব বরং জঙ্গলমহলে দারুণ ভাবে পড়েছিল। তাছাড়া বরাবর মূলবাসী মানুষদের কাছে "স্ত্রী- জাতি" চিরকালই অনেক বেশি সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত। "দ্বিতীয় সংবাদে" স্ত্রী জাতির যে নিন্দা করা হয়েছে তা কেবল উচ্চ সম্প্রদায়ের মনোভাব ছিল। সেটা মূলবাসী জঙ্গলমহলের মানুষদের ছিল না। সুতরাং এটা যে ব্রাহ্মণ্য আগ্রাসনের ফল ছিল, সে কথা একরকম নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে।

তথ্যসূত্র: ১) রণজিৎ গুহ রচনা সমগ্র ১
২) মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবন চরিত/ শ্রী নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়
৩) জঙ্গলমহল ও ঝাড়খন্ডী লোকদর্শন/ পশুপতি প্রসাদ মাহাতো
৪)জীবনী সন্দর্ভ/ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
৫) রামমোহন প্রসঙ্গ/ প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়
৬) রামমোহন সমীক্ষা/ দিলীপ কুমার বিশ্বাস
৭)রাজর্ষি রামমোহন/ শ্রী অনিলচন্দ্র ঘোষ

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

2 Comments

  1. ভবাণীচরণের 'সমাচার চন্দ্রিকা' কিন্তু আগে থেকেই ছিল। পরবর্তীকালে প্রিভি কাউন্সিলে আবেদন করার জন্য ও ফ্রান্সিস বেথিকে বিলেত পাঠানোর জন্য সংস্কৃত কলেজের সামনের সভায় রাধাকান্ত দেব, ভবানীচরণরা ফান্ড তুলে যে পত্রিকা বের করেন তা 'ধর্ম্মসভা'-র মুখপত্র 'ধর্ম্ম'।

    ReplyDelete
  2. Nice ...onek ki6u jana gelo

    ReplyDelete