জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-৩৪ /সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-৩৪

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

জীবনের ক'ঘন্টার পদাবলী

অতীত গত, আগত ভবিষ্যৎ? চলে যাচ্ছিল সময় দিন মাস এক একটা বছরের বেড়া টপকে। শিমুল লিখে ফেলল আনমনে...

–- “জানো পলাশ? আরেকবার, শেষবার তোমায় বিশ্বাস করলাম। শেষবার তোমায় কাছে পেলাম। আমি পরমপুরুষ শ্রী শ্রীরামকৃষ্ণের আশ্রয়ে থাকি। কাজেই আমি সত্যিই নিকিঞ্চন নই, নিরাশয় নই, নই আমি পরিত্যক্ত, প্রত্যাখ্যাত। আমার আর কেউ নেই, না থাক, আমার তুমি আছো। তুমি শুধু আছো এর মধ্যে আমার তৃপ্তি নেই। তুমি আমার একান্ত হয়ে আছো-এই আমার পরম শান্তি।

তুমি বলবে, “ বিশ্বাস কেন করো এত?” বিশ্বাস করতে ভাল লাগে বলে বিশ্বাস করি। জানি বিশ্বাস করে পদে পদে ঠোক্কর খেয়েছি বা বলতে পারো এখনও খাচ্ছি। তা খাই, তবে তো এই সুন্দর জীবনটাকে চিনতে পারছি, তাই না?

আমার জীবনে একঘেয়েমি নেই। সেদিন তোমার রাশিয়ান বন্ধু যিনি আমার প্রথম উপন্যাস “মেটামর্ফিক পোর্ট্রেট”- তোমার করা ইংলিশ অনুবাদ পড়ে বলেছিলেন, “শিমুল! তুমি বিশ্বাস করো কেন এত? আমি তো তোমার উপন্যাসকে আমার ভাষায় অনুবাদ করে আমার নাম দিয়ে লিখতে পারি? তুমি পুরো পান্ডুলিপি আমাকে পাঠালে শুধু আমাকে বিশ্বাস করে? তুমি তো খুব সিম্পল। ”

“স্যার! বিশ্বাস না থাকলে পৃথিবীর আলো সব চলে যায়...আমি আমার কাজ করেছি। এর পর আপনার দায়িত্ব সেটাকে মেন্টেন করার।” খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি আমার এই কথায়।

বিশ্বাস করেছি তোমাকে এও ভেবে যে, যা চরমতম ভালো তাই তুমি করেছ আমার জীবনে। ঠাকুর কী বলেছেন বলো তো: “পাথর হাজার বছর পরে থাকলেও তার ভেতর জল কখনও ঢোকে না। কিন্তু মাটিতে জল লাগলে তখনি গলে যায়। মন নিয়েই সব। মনেই বদ্ধ, মনেই মুক্ত।” কুঁজী, না ঐ খুঁজি! ঠোঁট টিপে হেসে ফেলল শিমুল।

--বাবা এর মানে আবার কি? 'কুঁজী, না ঐ খুঁজি'। তুমি তো দেখছি বাংলায় না থেকেও এতসব জানো?

--মানে হল... 'যে যা ভালবাসে তা পেলে'- এই প্রবাদ ব্যবহার হয়। হাসি আর থামতে চায় না শিমুলের এবার।

কিছু বই প্রকাশ পেয়েছে কলকাতা বইমেলা থেকেঃ
১) উপন্যাস -মেটামর্ফিক পোট্রেট
২) যুগ্ম(আমার স্বামীর)কবিতার বই – ডগ ও পনিটেল
৩) গল্প সংকলন- এন আর বে'র জলসাঘর
৪) গল্প সংকলন-অল্প কথায় গল্প
৫) ইংরাজি (যুগ্ম-আমার আর স্বামীর) -লাভ পোয়েমস।
বইরা আমার সন্তান। ওরাও আদর পেয়েছে যতটা দরকার। ব্যাস! আমি খুশি।

আমি বরাবরই একটু ট্যালেন্টেড মানুষ ভালবাসি। মানুষ করেছি্লেন মেজদিদিয়া, সে মারা যাবার পর ধ্বংসের শিকড় পুঁতে ফেলল বৌদিরা।

বৌদিরা ছিল আমার মা -এর মতন। কিন্তু আমার এইভাবে উত্তরণ ওরা চায় নি। চেয়েছিল মা মরা মেয়েটাকে নিজেদের কাজে ব্যবহার করা উচিত। ঠিক যেমনটি থাকে গল্পের বই-এর প্রতিটি ছত্রে ছত্রে।

তাই ছেলে মেয়ে মানুষ হয়ে গেলে--তাকে আর সহ্য করতে পারে নি। অন্য বৌদিরাও তাই তাদের কাছে রাখতে চেয়েছিল। আমি আমার যতটুকু জ্ঞান তাই দিয়ে নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে তাদের সন্তানদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করলে হয়ত ওদের আদরের পাত্রী হতাম। তাই এখন অন্য দাদা/বৌদিদের কাছে শুনতে হয়, “খালি সেজদাদার ছেলে মেয়েরা ব্যানার্জ্জী বাড়ির ভবিষ্যৎ সূরি।”

চুপ করে শুনি আর ভাবি দিদিয়া বিয়ে না করেও ভাইদের সংসার-কে নিজের ভেবেছিল, পরিবর্তে কি কিছু পেয়েছিল? ওরা আমাকেও তাই করবে ভেবেছিল।

সবচেয়ে বেশি কষ্ট কি জানো? হৃদয় উজার করে ভালবেসে আর সেই ভালবাসার বিনিময়ে অবহেলা পাওয়ার নামই হল কষ্ট। কথাটা শুনেছিলাম কিন্তু কিছু বলতে পারিনি, হয়ত তখন বুঝতে পারি নি-

আজকাল চনমনে থাকতে চাইলেও পারি না। ক্লান্ত হয়ে পড়ি কোন কোন দিন, করোনা-১৯ নামক এক অনু ভাইরাসের আবির্ভাবের জন্য। অদ্ভুতভাবে পুরো পৃথিবীর খেলাকে “স্টপ” করে থামিয়ে রেখেছে। এইসব ভাবনারা ঘণ্টায় সত্তর স্পীডে ছুটে চলে হৃদয়ের ডান থেকে বামে। বড্ড ভয় পেয়ে গেছিলাম তখন। এটাও তো পৃথিবীর একটা বিরাট ইতিহাস।

কিসের একটা অস্বস্তি সারাক্ষণ মনের মধ্যে গুজগুজ ফুসফুস করে। কবে যে সেই প্রভাত সূর্য উঠবে- “আমরা মুক্ত কোভিড-১৯” থেকে। সেইদিন নতুন জন্ম হবে আমার মতন মানুষদের।

এখন চলো সারাজীবন পাশাপাশি হাঁটি। যেমন করে হাঁটত চর্যাপদের সেই শবর -শবরী। প্রাচুর্য, খ্যাতি, স্বীকৃ্তি তথাকথিত সাফল্যের প্রত্যাশা সঅব ছুঁড়ে ফেলে হাঁটি জনহীন রাস্তা ধরে। এখন তো আর আমাদের কোনও পিছুটান নেই। মন চাইলেই হল। 'চল মুসাফির, বাঁধো গাঠরিয়া।' শিমুল রিনরিনে গলায় বলল।”

-জানো শিমুল ভাঙা জিনিসকে ভগবান খুব সুন্দর ভাবে ব্যবহার করেন; যেমন দেখো মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টির রূপ দেন, বীজ ভেঙে নতুন চারা গাছের জন্ম দেন, তাই কখনও কোনও ভাবে ভেঙে পড়লে বুঝে নিতে হবে-ভগবান তোমাকে কোনও বড় কাজে ব্যবহার করতে চাইছেন; ধৈর্য রাখো, সুদিন আসতে বাধ্য।

রাতের স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসে এবার ঝরঝরে ইংলিশে পলাশ জিজ্ঞেস করল। ইংরাজিটা বড্ড ভালো জানে পলাশ, বিশ্বাস করতেই হয়।

“হোয়াট আর ইউ রিডিং, হানি!” বলে কঠিন একখানা হাতে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরল, চুম্বনে চুম্বনে শরীরের শাখায় প্রশাখায় সুখ বেঁধে দিল। সদ্য স্নানপ্রসাধিত তার বাহুমূলের গন্ধে শিমুল তখন এক প্রচণ্ড শীতে জর্জরিত। তার বাহুবেষ্টনের আড়াল থেকে জানলা দিয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে দেখি চাঁদের আলো আরও ঘন হয়ে উঠেছে। হয়ত ঋতু বদল ঘটিয়ে বসন্ত আসছে। বাইরে তার আসা স্পষ্ট নয়। এখনও আড়ালে রয়েছে।

সেদিকে মুখ রেখে ইংলিশে প্রতিউত্তর দিলাম... “ রিডিং দ্য স্টোরি অফ “মাই লাইফ” -নানান অভিজ্ঞতা আর মনের তাগিদেই লিখে ফেলা মায়াদর্পণে কিছু স্মৃতির আনাগোনা থেকেই ডাকি “ও শিমুল-ও পলাশ”-কেন তোমরা মন রাঙালে...?

এই গল্পটা হল একটা ছোট্ট মেয়ের পরিযায়ী জীবন। অনেক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে সে কি ভাবে এক পরিপূর্ণ নারীতে রূপান্তরিত হল। তারপর সে এগিয়ে যায় ভবিষ্যতের দিকে এক পূর্ণ যোদ্ধার মত। আমরা ইতিহাসে অনেক মেয়ে যোদ্ধার গল্প পড়েছি কিন্তু পৃথিবীর কোণে কোণে সেই মেয়ে যোদ্ধাদের মত কত মেয়ে যোদ্ধা আছে। আমরা কি সব জানি? এটা স্মৃতিকাতরতা নয় মোটেই, এটা একটা শৌখিনতা বলতে পারো।

--দারুন তো! বেশ, এটাকে কি বলে? তুমি তার নাম জানো কি? এইবার তার ভালোবাসার রং শিমুলের ঠোঁটে...

--শিমুলের ডায়েরি! শিমুলের জীবন! শিমুলের ইন্সপিরেশন! শিমুলের মন! সুখ ও দুঃখের অস্থায়ী আবরণ । এই সুখ-দুঃখের আসা যাওয়া অনেকটা বাংলা ঋতু শীত আর গরমের মত। কেউ কারুর তোয়াক্কা করে না। তারা ইন্দ্রিয় সাহায্যে উপলব্ধি করে যে, একজনকে বিরক্ত না করে নিজে নিজে সব কিছু সহ্য করা। এবং সেটাই শিমুল।

--"স্যালুট! একটি আশ্চর্য তালিকা। কল্পনায় অভিনব। বর্ণনা-ব্যঞ্জনায় অপরূপ। তোমার প্যাসেজ টু লাইফ সত্যি অন্য অনুভূতির।” এই বলে শিমুলের পলাশ তখন শুধুই শিমুলের...

--আর 'তুমি' মানে আমার জীবন-যাকে 'আমার প্রেম ' আখ্যা দিয়েছি। সেই জীবন চলছে ভবিষ্যতের দিকে... শেষ হয়েও শেষ হয় নি শিমুল পলাশের আকাশ ছুঁতে পাওয়া আর না -পাওয়ার খেলা।

“পৃথিবী থেকে চলে যেতে আমাদের আর দূরত্ব নেই-শুধুই কমে কমে আসছে। আমাদের পেয়ে ও না-পেয়ে চলার বোধহয় বিরাম নেই। জীবনের শেষ ভাগে নানান অতৃপ্তির হা-হুতাশে বুঝি একটা চোরা সুখও থাকে। দুঃখবিলাসে ভাসতে ভাসতে স্বপ্ন থাকে মনে।

এতদিন মনের সাথে দ্বন্দ্ব দ্বন্দ্ব খেলেছি-এইবার শরীরের সাথে সেই দ্বন্দ্বের মোকাবিলা করতে হবে...এও এক যুদ্ধ।

ডাক্তাররা বলেন, 'বি কেয়ারফুল! -ফাইট -ফাইট শিমুল', লড়ে যাচ্ছি কর্কট রোগের সাথে। রেডিয়েশন দিয়ে আট বছর ভালো আছি। জিতে যাব -এবার ও জিতে যাব। শুনেছো তো বলেছি, 'আই উইল উইন ডক্টর'। ডাক্তার আর নার্সদের চোখে জল এসে গেছিল শুনে। দুঃখের ব্রিফকেসেই আমাদের চাওয়া-পাওয়ার তেজষ্ক্রিয়তা রয়েছে। বড্ড ভালোবাসে ডাক্তার-নার্স রা।

এখন শরীর কাঁদালেও আমি কাঁদি না। মনে হয় মা-বাবা-দিদিয়া, সেজদার কাছে জ্যোৎস্নায় উড়ে উড়ে বেড়িয়ে এলাম। লিখে ফেললাম...

দুর্দান্ত দেশে বসে প্রাকৃতিক অতিপ্রাকৃতিক

বাধ্যতামূলক প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়

অলৌ্কিকভাবে একটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায় কিছু জন

কিছু যেন নেমে আসে উদ্ধার দিতে

তবু যা আলোক নয়, স্মৃতি ,

তাকে স্পর্শ করে মনে।

আমি চেয়ে দেখি নিষ্প্রভ প্রাণে...

আকাশের এক কোন থেকে শুধু দেখেন আদরের 'ফাউ-সিমটি-শিমু'-এর যুদ্ধ। যে আদরের মেয়ের একটু জ্বরে বাবা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে মা মরা মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকতেন, সেই মেয়ে আজ মানসিক আর শারীরিক যুদ্ধে সামিল হয়েছে।

-ইনসিগনি প্লেয়ার এ গান বেজে চলেছে মন্থরগতিতে, “ও শিমুল ও পলাশ কেন মন এত রাঙালে...” ঘুমে দুই চোখ বন্ধ হয়ে এল দুজনেরই... চাঁদ তখন মেঘের আড়ালে... পাহাড়, বন ও বনতল সব রঙের নেশায় মাতামাতি করছে...

পলাশ ও শিমুলের থোকা থোকা লাল রঙ ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে ম্যাজেন্টা ক্রিমসন এর আঁকিবুঁকি...বন্ধ দুয়ার নাকি জীবের উপমা। বাইরেটা বন্ধ না হলে আত্মপ্রকাশ কী অসম্ভব? যখন দুয়ার খুলে গেল, তখন সাক্ষী রইল একটা মেয়ের দুঃসাহসীক অবিরাম পথ চলা কাহিনী।

সব মানুষের মনের ভিতরে এক যুদ্ধের প্রস্তুতি চলতে থাকে অবিরাম। এই যুদ্ধ সত্যি অনেক বড় যুদ্ধ। সত্যিকারের বড়। একটু একটু করে বাস্তব চেনা আমিটা এখন ভীষণ রকমের পরিনত, আত্মবিশ্বাসী। প্রতিটা আঘাত শিখিয়েছে জীবনের মানে। প্রতিটা ব্যর্থতা বুঝিয়েছে আরও পরিশ্রমের প্রয়োজন। প্রতিটা লড়াই বুঝিয়েছে সাফল্যের আনন্দ।

আইভরি ভারী পর্দায় ঢেকে গেছে চতুর্দিক। মনের ছোট্ট খুপরিগুলো জুড়ে এখন শেষবিকেলের আলোছায়ার রমরমা।

বাতাস নিজে নিজেই উলটে দেবে সেই শিমুলের খেয়াল খাতার পাতা, যেখানে লেখা থাকবে শিমুলের পদ্মপাতায় টলটলে জীবন... দু একজনের চোখের জলে ফুটে উঠবে সারি সারি পদ্মফুল...শেষ হবে জীবনের 'ক' ঘন্টার পদাবলী...
-সমাপ্ত-

Post a Comment

0 Comments