জ্বলদর্চি

আসুন স্বীকার করি: আমরাই খুনী, আমরাই ধর্ষক /ঋত্বিক ত্রিপাঠী

আসুন স্বীকার করি: আমরাই খুনী, আমরাই ধর্ষক

ঋত্বিক ত্রিপাঠী 



এই শিরোনাম আমার আপনার অপছন্দ। কারণ আমরা খুন করিনি, আমরা ধর্ষণ করিনি। কেবল শিরোনাম পড়ি।

শিরোনাম কেন পড়ি! কাগজে শিরোনাম হয়, তাই। কেন শিরোনাম হয়! ঘটনা ঘটে, তাই।

এখন প্রশ্ন : সংবাদ মাধ্যম কেন বারবার নেতিবাচক দিকগুলোকে তুলে ধরে! সহজ উত্তর : জনগণ জানতে চায়। জনগণ কি এর সুরাহা চায়! সন্দেহ জাগে। কারণ জনগণের নির্বাচিত সরকার ও তার সিস্টেম সমাধানে অপারগ। এবার প্রশ্ন : কেন অন্যের কৃতকর্মের দায় আমাদের সবার ওপর বর্তাবে! আমরা যারা খুন ধর্ষণ দেখে হাহাকার করি, মিছিল করে ধিক্কার জানাই, প্রতিবাদে সোচ্চার হই, কিছুদিন বাদে 'কিছুই হল না' বলে হতাশ হই, সেই আমরা কেন খুনী ও ধর্ষকের দায় নেব! সঙ্গত প্রশ্ন। তবে, কিছুটা বোকাবোকা। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে আপামর জনগণের ভোটে সরকার গঠন করবার সময় গনগণকে মান্যতা দেব, কিন্তু 'গণ'-র আনাড়িপনার দায় নেব না! তাহলে সবার সব কাজের দায় বাকি সবারই! না। তা নয়। কিন্তু ক্ষতকে সমাজ-বিচ্ছিন্ন করে দেখলে সমাধান হবে না। যেমন আজও হয়নি। তাই আগে দায় নিতে হবে। স্বীকার করতে হবে এই এত খুন এই এত ধর্ষণের দায় আমাদের সবার।

কেন! এমন উদ্ভট সিদ্ধান্ত! আসুন, ভাবি। অন্তত একবার নিরপেক্ষভাবে ভাবি আসুন। সমাজে অনাচার যাতে না হয়, তার জন্য কি আমরা কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়েছি! ধর্মীয় অলৌকিকত্বে যে পরিমান উন্মাদনা দেখাই, নীতিশিক্ষা কিংবা বিজ্ঞান মনস্কতায় তার সিকিভাগও কি আগ্রহ দেখাই! একজন সংবেদনশীল, সৎগুণের মানুষকে আমাদের সমাজ নিছক বোকা মানুষ হিসাবেই বিবেচনা করে। অসৎ অথচ ধনবান বিত্তবান মানুষকে আমরা সম্মান জানাই। সৎ গরীরের কান্নাকে সন্দেহ করি। পাশাপাশি এও ঠিক, আমরা মনে করি অধিকাংশ ধনী অসৎ উপায়ে ধনী। কিন্তু তাঁদের সমীহ করতে বাধ্য হই। যিনি সৎ, যিনি ভালো মানুষ, তিনি কি তাঁর ওই গুণে সমাজে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা পান! পান চাকরির সিলেবাসে বাড়তি নম্বর! না। তার মানে সততা, ভালোমানুষি গুণগুলো শুধুমাত্র অলংকার! তিনি না খেয়ে মরলেও প্রশংসা পাবেন। হ্যাঁ, তা পাবেন। কিন্তু তাঁর বাঁচার অধিকার নেই! 


কেন আজও আমরা সেই সিলেবাস নির্মাণ করতে পারলাম না, যেখানে সৎগুণের জন্য তিনি বাড়তি নম্বর পেয়ে সমাজে প্রতিষ্টা পেতে পারতেন! তবে কি আমরা ভেতরে ভেতরে সবাই অসৎ! না কি ঘরে আগুন লাগলে পুকুর খুঁড়তে যাওয়ার মজায় রসেবসে বেশ আছি। বলছি এই অনাচার বন্ধ হোক। বলছি ঘরে আগুন লেগেছে। সরকার নিবিয়ে দিক। সরকাররাজ ও প্রজা-আমরা ভাবিনি, আগুনের প্রতিরোধে আগেই পুকুর খোঁড়ার দরকার। আগুন আমাদের বন্ধু না। আমাদের প্রচেষ্টার ওপর তার আস্থা নেই। সে একে একে সব ঘর বাড়িকে গ্রাস করছে। আমাদের কেউ ভাবছি, দল পরিবর্তন জরুরি, কেউ ভাবছি 'নিয়তি, ভাগ্য', কেউ ভাবছি খুনের বদলে চাই খুন, ধর্ষণের বদলে চাই ধর্ষণ, কেউ চাইছি দোষীর ফাঁসি, কেউ চাইছি প্রতিবাদী কবিতা গল্প প্রবন্ধ লিখে সমাজ বদলে দিতে। কেউ চাইছি রসালো টক-শো। আর সবাই ফেসবুকে করছি ছিছিকার। লাইক কমেন্টে প্রমাণ হচ্ছে আমরা কেউই চাই না অনাচার। সরকার, পুলিশ, আইনজ্ঞ, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, ধনীদরিদ্র, লম্বাবেঁটে, নারীপুরুষ, রূপান্তরকামী সবাই বলছে : এই খুন, ধর্ষণ চাই না। কিন্তু কেউ আমরা স্বীকার করছি না, আমরাই খুনী, আমরাই ধর্ষক!


আপনি বলবেন, আচ্ছা, না হয় দায় স্বীকার করলাম। তাতে কী লাভ! লাভ এটাই, রোগ ও রোগী চিহ্নিত করতে পারলে তবেই চিকিৎসা সম্ভব। চিকিৎসা শুরু হলে রোগের শেকড়ে পৌঁছানো সম্ভব। তখন বোঝা যাবে ওষুধের মতোই গুরুত্বপূর্ণ পথ্য। অসুখ যাতে না হয়, তার জন্য বরং সচেতনতা বাড়াতে হবে।

এক সমীক্ষায় উঠে আসছে ভারতে (২০২০ সাল) প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৭৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, আর খুন হয়েছেন ৮০ জন। এর পিছনে আমরা কবে পিতৃতন্ত্র ও অসিহষ্ণুতাকে দায়ী করবো? অধিকাংশ নারীই পিতৃতন্ত্রের আগ্রাসনকে সযত্নে লালনপালন করে। আর আমরা অধিকাংশ মানুষ খুনের মতো সামাজিক অপরাধের মূল শেকড়ের সন্ধান না করে ফাঁসি, জেল, এনকাউন্টার ইত্যাদির মাধ্যমে এক অসম প্রতিহিংসার খেলা খেলি। 

খেলার চরিত্রই হলো, খেলা শেষ হয় না কখনোই।

এটা তো ঠিকই যে, আমরাই তো গড়ে তুলেছি কাল্পনিক পৃথিবী। ধর্ম থাকলে অধর্মও থাকবে, এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না। কিন্তু ধর্মকে যদি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কার না করা হয়, তবে সে ধর্ম আত্মঘাতী। টিভিতে ভালোবাসার সিন শুরু হলে পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে অস্বস্তিতে পড়ি, কিন্তু খুন রক্তপাত দেখলে, হিংসার বদলা প্রতিহিংসা দেখলে, বলে উঠি 'বাহ'। আমরা ব্যক্তিজীবনে আমাদের ক্ষমতা অনুযায়ী অসৎ, কিন্তু দিনরাত চোর নেতা, লম্পট অধ্যাপক, ঘুষখোর অফিসারকে গাল দিই। আমাদের সন্তানরা আমাদের দেখে, শেখে -- প্রতিবাদ আর বাস্তবতার পার্থক্য। আমরাই নারী পুরুষকে আলাদা করেছি। মানুষ ভাবার আগে লিঙ্গের সংজ্ঞা দিয়েছি। ভালোবাসা ও যৌনতাকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাপ বলে মান্য করেছি। আমরা কবে মানবো, ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন ঝোপজঙ্গলের চাইতে পরিবারের মধ্যেই বেশি হয়! কবে মানবো কিশোরীদের মতো কিশোররাও যৌনলালসার শিকার হয়! আর এটাই বাস্তব যে, পরিবারের মধ্যেই গড়ে ওঠে এই শিকারের ক্ষেত্রভূমি। অনিচ্ছুক স্ত্রীকে যখন বলপূর্বক মিলনে বাধ্য করায় তার স্বামী, তখন তাকে ধর্ষণ বলবো না? বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেমিক ফেরার হলে তাকে ধরে এনে থানায় প্রেমিক প্রেমিকার নামকরণ করে, বিয়ে দেবার সময় ভাবিনি আসলে এ বিয়ে এক নারীর সঙ্গে এক লম্পটের বিয়ে। এক সমস্যা সমাধানে আরেক সমস্যা ডেকে আনি। খুনের বদলে খুন, ধর্ষণের বদলে ফাঁসি-- এই ওষুধে সমাজ সুস্থ হয়নি, আজও। তাও চিকিৎসা পদ্ধতি বদলাবো না! তবে কি আমরা মনে মনে চাই এই খুন, এই ধর্ষণ!


স্কুলে জীবনশৈলি, গুড-টাচ ব্যাড-টাচ, যৌনচেতনার পাঠ এলে রে-রে করে উঠলাম। পরিবারের বয়স্ক সদস্যের কাছে কিশোর কিশোরী যৌনতার শিকার হলে, হয় গোপন করি কিংবা কিশোরকিশোরীর দোষ ধরি। আসলে আমরা স্রোতে ভাসি। ছোটোবেলা থেকে যা দেখি যা শিখি তাকেই আঁকড়ে থাকি। নতুন করে কিছু ভাবতে চাই না। নতুনকে গ্রহণ করতে কষ্ট। তার চাইতে ধর্মের মানে, সমাজের নামে, ঐতিহ্যের নামে পুরোনোকে আঁকড়ে ধরি।

'ধর্ম' বলতে বোঝাতে চাইছি প্রথানুগ ধর্মের রীতি ও মানুষের স্বভাব প্রবৃত্তিকে। প্রবৃত্তি নিবৃত্তির বিপরীতে ডালপালা বিস্তার করে। সে নানা অনাচারে নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। নিবৃত্তির জন্য চাই অনুশীলন ও যুক্তির চর্চা। চাই বিজ্ঞানমনস্কতা। নিবৃত্তি জন্ম নিলে মানুষ নিরপেক্ষ, সংস্কৃতিবান ও নাস্তিক হতে চাইবে। 


 ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে সবসময়ই নিজের ধর্মকে ঘিরে এক অভাববোধ থাকে। সব ধর্মই সময়োচিত সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী না হয়ে বিশেষ প্রাচীন ব্যাকরণে অভ্যস্ত। তাই বিশেষ ধর্মাবলম্বী মানুষের মনে হওয়া স্বাভাবিক, তাঁর ধর্ম-ব্যাকরণ যাঁরা মানেন না তাঁরা প্রতিবেশী হয়েও বন্ধু না। হয়তো শত্রুর মতো বা শত্রু-ই। সুতরাং তাঁর অস্ত্র : প্রবৃত্তি। অন্যদিকে নাস্তিকের লড়াই আরেক নাস্তিক কিংবা কোনও ধর্মপ্রাণ মানুষের সঙ্গে না। তাঁর লড়াই তাঁর নিজের সঙ্গে। তাঁর লড়াইয়ের অস্ত্র : যুক্তি। 

ভেবে দেখার প্রস্তাব দিই। ধর্মের নিয়মকানুন যাঁদের পছন্দ নয় তাঁদের নাস্তিকতা নতুন পথ দেখাতে পারে। যাঁরা ধর্মশাস্ত্রকে মানতে চান তাঁরা ধর্মশাস্ত্রের সময়োচিত সংস্কারে সোচ্চার হোন। সংস্কারহীন ধর্ম সংস্কৃতিহীন। সংস্কৃতিহীন মেজাজ খুন ধর্ষণে বিশ্বাসী হতে বাধ্য। রাষ্ট্র সচেষ্ট হোক ধর্ম ও নাস্তিকতাকে সংস্কৃতির অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ করে তুলতে।

ধ্বংসের পর শ্মশানভূমিতে লোকদেখানো মোমবাতি মিছিল করে কী লাভ! কী প্রমাণ করতে চান! খুন ধর্ষণ, অনাচার চান না! তবে আসুন, আগে স্বীকার করি: আমরাই খুনী, আমরাই ধর্ষক।


আরও পড়ুন 

🍂

Post a Comment

10 Comments

  1. AnonymousJuly 19, 2022

    ভাল লাগল। অমিতরূপ চক্রবর্তী।

    ReplyDelete
  2. AnonymousJuly 19, 2022

    সৎলোক বেশির ভাগ মানুষের দৃষ্টিতে বোকা বলে প্রতিপন্ন হয়।

    ReplyDelete
  3. AnonymousJuly 19, 2022

    সময়োপযোগী রচনা। আরো প্রশ্ন অপেক্ষায় আছে, আছে আরো সম্ভাবনা। অভাব সদ্ভাবনার।

    ReplyDelete
  4. AnonymousJuly 19, 2022

    অসাধারণ সত্যি কথা, পরিবারই যুগ যুগ ধরে যৌন হিংসার বীজ বুনে চলেছে। পুরুষতান্ত্রিক আগ্রাসনকে লালন করছে। শুভশ্রী রায়

    ReplyDelete
  5. যুক্তি সুন্দর

    ReplyDelete
  6. খুব গুরুত্বপূর্ণ লেখা। শুধু পাঠক না সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের পড়া উচিত এই আলোচনাটি। ধন্যবাদ জানাই দাদা তোমাকে এমন একটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করার জন্।

    ReplyDelete
  7. AnonymousJuly 24, 2022

    বেশ

    ReplyDelete
  8. খুব ভালো লাগলো। সত্যি খুব যুক্তি গ্রাহ্য লেখা টি।ভাববার বিষয়।

    ReplyDelete
  9. লুকিয়ে আছে একটা খুনী সব মানুষের অন্তরে। খাঁটি কথা। মোমবাতি মিছিল শুধু নিজেকে হোয়াইটোয়াশ করার চেষ্টা। সবাই জানি কি ভূয়ো এটা। তবু রিচুয়াল। ইন্টেলেকচুয়াল।

    ReplyDelete
  10. অনেক দিন পর একটা বাস্তবোচিত সমাজ বিশ্লেষণ পড়া গেল। আর একটা ধর্ষণে প্রকারভেদ নিয়ে ভাবতে হবে। শুধু যৌণ ধর্ষণকেই একমাত্র ধর্ষণ বলা চলে না।
    এ নিয়েও ভাবা দরকার। আমদের আন্দোলন খড়ের আগুন তাই শাষক মজা দেখে আর নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়।

    ReplyDelete