জ্বলদর্চি

কবিতা অ্যাভিনিউ/পর্ব ১৮ /বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা অ্যাভিনিউ

পর্ব ১৮ 

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় 

ছয়ের দশকের বাংলা কবিতা  অনেকগুলি ম্যানিফেষ্টো ভিত্তিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হলেও কবি রণজিৎ দেবের কবিতা এই সমস্ত ইস্তাহার থেকে এক স্বতন্দ্র দূরত্বে দাঁড়িয়ে নিজস্ব হৃদয়ের স্পন্দনে জারিত হয়েছে।হাংরি, শ্রুতি, থার্ড লিটারেচার প্রভৃতি আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাংলা কবিতাকে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যখন গড়ে তোলা হচ্ছে তখন এই স্রোতের বাইরে সম্পূর্ণ নিজস্ব কক্ষপথে মেধা এবং বোধ সমন্বিত নানামুখী আল্পনায় জারিত হচ্ছে কবি রণজিৎ দেবের কবিতাসম্ভার। সমকালীন বৈশ্বিক ভাবনার সাথে সঙ্গতি রেখে ভারতীয় ঐতিহ্যের গর্বিত উত্তরাধিকার তাঁর শাব্দিক অভিজ্ঞানে। নিপুণতার সঙ্গে যে কোন দূরতিক্রম্য বিষয়ের গভীরে অবগাহন করে তিনি তুলে আনেন অন্তর্বতী নির্যাস। প্রকৃতির গভীরে ছায়া ফেলে তাঁর মননের দৃষ্টি এবং এই সক্রিয় পর্যবেক্ষন থেকে জন্ম নেয় কবিতার সত্তা। অভীপ্সার সুক্ষ্ণতা, অর্জিত অভিজ্ঞতার নিহিত আলোছায়া তাঁর ভাবনার অবয়ব স্থাপনে সাহায্য করে।অঙ্কনের শৃঙ্খলায় যা কবিতার নানামুখী বলয় তৈরি করে। প্রেম ও প্রকৃতি থেকে নির্যাস সংগ্রহ করেই জীবনের মুগ্ধতার  দিকে তাঁর পদযাত্রা। এই দেখাকে সাম্প্রতিক সময়ের ভাবনায় তিনি   বিনির্মাণ করেন ।ঐতিহ্য সচেতন কবির কলমে মিথ এবং বর্তমান এক পঙক্তিতে এসে দাঁড়ায় ,কখনও বা হয়ে ওঠে একে অপরের প্রতিকল্প। কৃষ্ণকথা তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ পড়লে দেখা যাবে পরিচিত জগতের আবেষ্টনী থেকে তিনি  তুলে এনেছেন জীবন ও চলিষ্ণু মৌল দৃষ্টিভঙ্গির মোহমুক্ত অথচ তন্নিষ্ঠ এবং দুর্মর এক শিল্পজিজ্ঞাসা। মানবিক চেতনাসম্পন্ন যেকোন শিল্পীই বিধ্বস্ত সমাজের দিকে তাকিয়ে নিজেদের শেকড় থেকে ,ঐতিহ্য থেকে,  সন্ধান করেন দিব্যজীবনের এক সঙ্গতিপূর্ণ রূপরেখা। জীবন এবং প্রকৃতির উপত্যকা থেকে তা লাভ করে মৌলিক পর্যবেক্ষন। কবি রণজিৎ দেবের হেমন্তের সকাল ও একসারি বালিহাঁস কাব্যগ্রন্থের  কবিতাগুলি পড়লেই আমাদের এই ধারণা আরও দৃঢ় ও সক্রিয় হয়ে ওঠে ।
  
 মাথায় গোঁজার জন্যে যে পালক তুলেছিলে হাতে
সেই পালকের জন্যে ময়ূরীর পেখম আজও মেলায়নি
মেঘ জমে জমে পাথর হয়েছে
আকাশ ফেটে কোনদিন বৃষ্টি আসবে না
কিংবা মেঘও যাবে না ফিরে 
ভালবাসবো কি করে ? (পদ্মের নাল জড়িয়ে সাপের ফনা) 
 তুমি কাশফুলে হাওয়ার লুকোচুরি খেলা দেখে বলেছিলে’ আমার অধিকার”
কিন্তু তুমি দাঁড়িয়ে থাকার কথা ভাবনি। (লুকোচুরি খেলা)
  ৩
 জন্মে জন্মে এই মাটির স্পর্শ বয়ে আনবে দেবদূত নিশ্চয়তা
হাত ধরাধরি করে দাঁড়াবো  জানালা থাকবে খোলা (জানালা থাকবে খোলা )
৪ 
সূর্যাস্ত ঢেলেছে লাল চারদিকে অলৌকিক খরা (ফেরার পথ ভুল হয়ে যায়)
 আমি ভালোবাসি মাটি, ষাট কোটি মানুষের সরলতা
ধানশীষে দুলে-ওঠা নিবিড় হাওয়া,
আমি ভালোবাসি 
ততোধিক ভালোবাসি স্নেহময় এ দুটি হাত (স্নেহময় এ দুটি হাত) 
 প্রিয়লিপি ছিঁড়ে দেয় কেউ ঘূর্ণজাল
সাগরের টোলে মিলায় হাসি
ভালোবাসা এবার তুমি কোনদিকে যাবে?
দুঃখের নিশান পুঁতেছি মোহনায় । (দুঃখের নিশান পুঁতেছি মোহনায়)

৭ 
আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি পথে
আদিগন্ত সবুজ মাঠ পড়ে আছে 
পাশ দিয়ে সাপের মতো নদীর শরীর
এসব পার হয়ে আমি চলে যাবো 
অভিমানী তোমার কাছে
শুধু এই কাব্যগ্রন্থেই নয়  মধ্যরাতের বিশল্যকরণী, প্রভু, অন্ধকারে আমি একা, নির্জন ভূমিতে জলপ্রপাত , অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র  শাখাপ্রশাখা শেকড়গুচ্ছ সহ প্রায় প্রত্যেক কাব্যগ্রন্থের ভেতরেই কবির রোম্যান্টিক সত্তার প্রতিফলন ঘটেছে। শাব্দিক স্থাপত্যে তিনি নির্মাণ করেছেন এক একটি চিত্র  যা মননে সৌন্দর্যবোধের স্থায়ী অভিঘাত তৈরি করে।  
 নদীর রেখার মতো এক ঝাঁক সাদা পাখি উড়ে গেছে
পিছনে পিছনে পদছাপ
শুধু পূর্ণতার কথা মনে পড়ে 
বুকে ধরেছি কি সুবিস্তৃত মাঠ ? ( তিতির পাখির ডাক।। হেমন্তের সকাল ও একসারি বালিহাঁস  ) 
২ 
আর কত ভালোবাসা দেবো, উলঙ্গ রাত্রির 
মতো উদ্বাহু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছো? 
আমি তো রেখেছি তোমায় 
অভিমান, শিল্প ও সভ্যতায়।
তুমি আছো গোপন ভূখণ্ড ছুঁয়ে ।( গোপন ভূখণ্ড।। মধ্যরাতের বিশল্যকরণী) 
৩ 
কতকাল তোমায় বলিনি
এই নাও পাহাড়ি শীত 
দিও এনে পাখির পালক( বলা হয়নি।। নির্জন ভূমিতে জলপ্রপাত )
কবি রণজিৎ দেব   নির্জনতার ভেতর রচনা করেন বাস্তব এবং অধিবাস্তবের সংযুক্ত দ্বিরালাপ।মৃদু এবং মর্মভেদী উচ্চারণে তিনি প্রতি মুহূর্তে নিজেকেই লেখেন।আত্মক্ষরণ মিশে থাকে তাঁর কবিতার নিভৃত অবয়বে। চেতনা  নিংড়ে তুলে আনেন শব্দের নির্যাস। কবিতার প্রতিটি লাইন জুড়ে  অন্তস্বরের নিভৃত গ্রন্থনা। অফুরন্ত জীবন অভিজ্ঞতার মূলধন অবলম্বনে তা রূপ পায় অনুভবস্পর্শী কবিতার । তাই এই  কবিতা বারবার উচ্চারিত হয় নিজের অজান্তেই। মনে হয় এই কথাগুলো এত সহজভাবে বলা যেত। কই কেউ তো বলেনি  আগে। বহুরৈখিক ভাবনার বিচিত্রগতিকে একটি মাত্র সরল সমীকরণে প্রকাশ করার স্পর্ধা তিনি  অর্জন করেছেন তাঁর মেধাসঞ্জাত পর্যবেক্ষণের ভেতর দিয়ে।  তাঁর কবিতায় রয়েছে সত্যের বিচিত্র পরিসর উন্মোচনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। যেখানে মানুষের পা পড়েনি সেই দুর্গমতার অনুসন্ধান জটিল ও ধোঁয়াশা মাখা এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু মানুষের চিন্তবিশ্বের অনাবিস্কৃত তরঙ্গকে স্পর্শ করাও খুব সহজসাধ্য বিষয় নয়। অথচ এই জগতকে কত সহজে মোলায়েম ভাবে স্পর্শ করেছেন তিনি। তাঁর এই প্রাণদায়ী কবিতা আমাদের চিন্তা ও চেতনার স্তরকে উস্কে দেয় এবং উদ্দীপিত করে। ডুয়ার্সের  প্রকৃতিকে তিনি আত্মস্থ করেছেন বলেই তাঁর অনুভবের গভীরে মিশে আছে গাছপালা নদী ও পাহাড়ের শ্বাসপ্রশ্বাসের সুস্পষ্ট শব্দ। তিনি প্রকৃতির  যন্ত্রণাকে রূপ দিতে পারেন শব্দের আবরণে, ভাষার আকল্পে। নতুন রঙ সৃষ্টি করে  মানুষের অন্তর্লোকের যথার্থ চিত্ররূপ দিতে পারেন অনায়াসেই। একুশ শতকের পঙ্কিল,হতশ্রী নির্মাণবায়িত সভ্যতার ভেতর স্বপ্নাশ্রয়ী ছায়ার প্রলেপ বুলিয়ে দেওয়াই একজন মগ্ন শিল্পীর সাধনা।      

১ 
একদিন এই গাছ বড় হবে অফুরন্ত শস্য নেবে বুক
অস্তিত্বের মিল খুঁজতে  শরতের ঢেউয়ে দুলবে দুরন্ত কিশোর 
তবে কি কান্না চেপে রেখেছিলে? এমনও তো নয়।
তুলির টানে এই বুক ছুঁয়েছিল কেউ ( এ হৃদয় ছুঁয়েছিল কেউ) 
 কবে যে এই বন গড়ে উঠেছিল 
অফুরান ছায়ায় ছায়ায় বেড়ে উঠেছিল 
   এ সকল মদেশীয় নারী ( চিলাপাতা ফরেস্টে ভোর ) 
৩ 
 হিম হয় বুক যেন হিজলের জল
আঁধার ঘনিয়ে আসে বাঁশের ছায়ায়
বৃষ্টি ঝরে অবিরত দুঃখময়
কেবলই পাহাড়ি ঝোরার কলতান
সে কি মনে পড়ে ? ( সে কি মনে পড়ে)  
৪ 
দেখতে দেখতে উঠে এল ট্রিগারে হাত-
কেঁপে উঠে একদিকে ফাগুন বাতাস আর একদিকে শীত।
পাহাড় গর্জন করে- পাহাড়ের এক খাদে ভালোবাসা নেই,
নেই মায়া, সৌন্দর্যের জীবন।
পর্যটক ,তোমার দৃষ্টি কত দূর যেতে পারে। ( পাহাড়ে পর্যটক)
 ৫ 
 দু একটি সাঁওতালী রমণীর পা-ঝুমঝুম আওয়াজ
চা-পাতার জাজিমে মাথা রেখে শুয়ে আছে নিশুতি আঁধার (মধ্যরাতের বিশল্যকরণী)
৬ 
 ক্লান্ত ডানার পাখি
যেটুকু আলোর বৃত্ত গড়ে তুলেছিল
বুক থেকে ছিঁড়ে আজ 
সেটুকুও তোমায় দিলাম। ( মৃত্যুর কাঙাল) 
৭ 
 তোমার মুখের ওপর এলোচুল অন্ধকার ছায়া
তোমার ওপর পড়ছে সারাদিনের বিষণ্ণতা 
নিতান্ত, উপায়হীন দিন গড়িয়ে যায় তোর্ষার জলে
অল্প আলোর জন্যে পৃথিবীটা যখন কাঁপছে
তখন তুমি জীবন খুঁজতে এলে ? ( জীবন ) 
প্রকৃতির আশ্রয়েই জীবনকে অন্বেষণ করেছেন এবং দেখেছেন প্রেমের বিচিত্র বর্ণ যা একাধারে মানবিক, দৈহিক আধারে আবদ্ধ আবার কখনও যা অতিরিন্দ্রিয় চেতনাকে বিকশিত করে। জীবনের নগ্ন সত্যকে প্রকাশ করার ‘ঋজুতা তাঁকে পরম আভিজাত্য দিয়েছে।  
বাড়িঘর ভেঙে গেছে উড়ে গেছে উনুনের ছাই 
ফুলের নির্বোধ হাসি মিশে গেছে 
থেমে গেছে স্নায়ুর বিশ্রাম ।‘ 

 স্নায়ুর বিশ্রাম নেই । নতুন কোন ভাবনায় উজ্জীবিত হওয়ার জন্য স্নায়বিক যে অবকাশ লাগে তা যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে আমাদের। আজও সত্যিই মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি। অর্জিত হয়নি গণতান্ত্রিক চেতনার বিস্তৃত পটভূমি। তাই মানুষের কণ্ঠ রোধ করবার আগ্রাসী প্রবণতাগুলি দানা বাঁধছে । ব্যক্তির স্বাধীনতা অর্জিত না হলে সামাজিক মুক্তির যে ধারণা  তা অস্পষ্ট এবং ভ্রান্ত থেকে যায় । তাই নিজের ভেতরে নিজস্ব আবাসভূমির কেন্দ্রেই প্রথম স্বাধীন নিশানকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। 
বাড়ির উঠোনে পোঁতা স্বাধীন নিশান
                     হাঁটু পেতে করজোড়ে আমার প্রার্থনা
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি প্রভু, এখন নয় আমার বিশ্রাম (মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি প্রভু )
শাখাপ্রশাখা শেকড়্গুচ্ছের কবিতাগুলির ভেতর স্মৃতি এবং স্বপ্নের যৌথ উদযাপিত উপলব্ধির প্রকাশ। যে ভূমির উপর দাঁড়িয়ে জীবনের সতেজ স্বপ্নের ডালপালা মেলে দেয় জীবন। ব্যক্তিগত চাহিদা এবং তাচ্ছিল্যের বিপরীতে এই জীবনের ভেতর নিসর্গের ভেতর  সত্যের বিম্বনচিহ্ন সনাক্ত করবার দায় থাকে কবির।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments