জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৩৭/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৩৭

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 নতুন বাড়িতে পদার্পণ করে শ্রীশ্রীমা শরৎ মহারাজকে অপার আশীর্বাদে পরিপূর্ণ করলেন। এই বাড়িতে মায়ের আদেশে সন্ধ্যারতির পর তিনি প্রায়ই ভজন গাইতেন। কেউ কেউ তাঁর কাছে সঙ্গীতশিক্ষাও লাভ করতেন। একপ্রকার আনন্দেই অতিবাহিত হচ্ছিল দিনগুলি। কিন্তু পাশাপাশি একটি উদ্বেগ তাঁকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করতে থাকল। বাড়ি নির্মাণের জন্য ঋণ পরিশোধ করবেন কীভাবে! তিনি ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ’ লিখতে আরম্ভ করলেন। এই অসামান্য গ্রন্থ রচনা বাংলা ধর্ম-দর্শন সাহিত্যের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা ও সাহিত্যের অনুপম মেলবন্ধন ঘটেছে এই গ্রন্থটিতে। যথার্থই ক্লাসিক। ঠিক কীরকম পরিস্থিতিতে ‘লীলাপ্রসঙ্গ’ লিখিত হয়েছিল সেই বিষয়ে গ্রন্থকার স্বয়ং জানাচ্ছেন --“যখন ‘লীলাপ্রসঙ্গ’ লেখা হয়, কতদিকে গণ্ডগোল ছিল -- মা উপরে রয়েছেন, রাধু রয়েছে, ভক্তের ভিড়, হিসাবপত্র রাখা, আবার বাড়ি তৈরী করায় অনেক টাকা ধার হয়েছে। নীচের ছোট ঘরটিতে ‘লীলাপ্রসঙ্গ’ লিখছি -- তখন আমার সঙ্গে কেউ কথা কইতে সাহস পেত না, সকলেই ভয় করত। আমার অনেকক্ষণ ধরে কথা বলবার সময়ই ছিল না। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করতে এলে, ‘চটপট সেরে নাও’ বলে সংক্ষেপে শেষ করতাম। 
লোকে মনে করত ভয়ঙ্কর অহঙ্কারী।” ‘লীলাপ্রসঙ্গ’- রচনার তৎকালীন পরিবেশের বিষয়ে ভক্তমালিকায় গম্ভীরানন্দজী লিখছেন -- “কর্মে অকর্ম-দর্শনে সিদ্ধকাম শরৎ মহারাজের মন এরূপ উপাদানে নির্মিত ছিল যে, জনকোলাহলের মধ্যেও উহা শান্তভাবে স্বকার্যসাধন করিত। একদিন ‘উদ্বোধনে’র অফিসঘরে জনকয়েক যুবক যৌবনসুলভ উচ্চৈঃস্বরে হাস্যকৌতুক করিতেছে, এমন সময়ে গোলাপ-মা কার্যোপলক্ষে সেখানে উপস্থিত  হইয়া তাহাদিগকে ভর্ৎসনাপূর্বক বলিলেন, ‘তোমাদের ধন্যি আক্কেল! উপরে মা রয়েছেন, নীচে শরৎ রয়েছে -- আর তোমরা এমন হৈ চৈ করছ? গোলাপ-মার স্বরও তখন একটু অস্বাভাবিক উচ্চ পরদায়ই উঠিয়াছিল। উহা শরৎ মহারাজের কর্ণে পৌঁছিলে তিনি বলিলেন,‘তুমিও বেশ তো, গোলাপ-মা! ছেলেরা অমন হৈ-চৈ করে, তাই বলে কি তাতে কান দিতে আছে? আমি তো পাশেই আছি; আমি কিছুতেই কান দিই না, কিছু শুনতেও পাই না। কানটাকে বুঝিয়ে দিয়েছি,‘তুই তোর প্রয়োজনীয় বিষয় ছাড়া কিছু শুনিস না। কান তো কিছুই শোনে না!’ এই অনাসক্তির ভাব সম্পূর্ণ আয়ত্ত ছিল বলিয়াই সেরূপ অবস্থায় ‘লীলাপ্রসঙ্গে’র ন্যায় তথ্যবহুল ও ভাবগম্ভীর গ্রন্থরচনা সম্ভব হইয়াছিল।”


 শরৎ মহারাজের মহাপ্রাণতা বিষয়ে শ্রীশ্রীমা'ও উল্লেখ করেছেন নানা সময়ে। এই বিষয়ে ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য লিখছেন -- “... একবার শরৎ মহারাজ, শ্রীশ্রীমহারাজ ও পূজনীয় হরি মহারাজের সঙ্গে পুরীধামে আছেন। ...এই সময়ে উড়িষ্যা অঞ্চলে ভীষণ দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব হয়। তদঞ্চলে সেবাকার্যে প্রেরিত সেবকদের নিকট হইতে নিত্য দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট নরনারীর করুণ কাহিনীসকল আসিতে থাকায় শরৎ মহারাজ একেবারে অস্থির হইয়া পড়িলেন। ...অনশনক্লিষ্ট জনগণের শোচনীয় অবস্থা বর্ণনা করত শ্রীশ্রীমাকে প্রায় আটপৃষ্ঠাব্যাপী এক সুদীর্ঘ পত্র লিখিলেন এবং সেই পত্রে, যাহাতে অন্নবস্ত্রের সংস্থান হইয়া তাহাদের সকল দুঃখের অবসান হয়, তাহার জন্য শ্রীশ্রীমার শ্রীপাদপদ্মে কাতর প্রার্থনা জানাইলেন। পত্রখানি শুনিতে শুনিতে করুণাময়ী মার অন্তর কাঁদিয়া উঠিল। তিনি অশ্রুপূর্ণ লোচনে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, ‘লোকের দুংখকষ্ট আর দেখিতে পারি না; ঠাকুর তাদের সকল দুংখ জ্বালার অবসান কর। ( নিকটস্থ ভক্তদের প্রতি ) শরতের দিল দেখলে! নরেনের পর এতবড় প্রাণ আর একটিও পাবে না। ব্রহ্মজ্ঞ অনেকে আছেন, শরতের মতো এমন দিলদরিয়া লোক ভারতবর্ষে নাই, পৃথিবীতে নাই। জীবের দুঃখে প্রাণ কাঁদা! যেন পালনকর্তা, সকলকে অন্নদান করছে।’ শ্রীশ্রীমা স্বয়ং যাঁহার মহাপ্রাণতার কথায় এইরূপে শত মুখ হইয়া উঠিতেন, আমরা স্বার্থান্ধ মানব, তাঁহার মহত্বের কতটুকই বা ধারণা করতে পারি! আর একবার মা বলিয়াছিলেন, ‘শরতের সমান কেউ নাই; শরতের যত বড় বুকখানি, তত বড় হৃদয়খানি।” অপরদিকে শ্রীশ্রীমায়ের সম্বন্ধে শরৎ মহারাজ যে ভাবনা পোষণ করতেন সেই বিষয়ে ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য লিখছেন --“একবার কথাচ্ছলে শরৎ মহারাজ বলিয়াছিলেন, ‘মাকে কি বুঝব, তবে এ কথা বলতে পারি  -- এত বড় মন দেখিনি, আর দেখবও না।’ আর একবার শরৎ মহারাজ কাশীতে কিরণবাবুদের বাড়িতে আছেন; সঙ্গে যোগীন মা, সাণ্ডেলমশায় প্রভৃতি।...জনৈক সাধু এই সময়ে মার কৃপাপ্রাপ্ত একজনের কোন গর্হিত আচরণের উল্লেখ করিয়া মার কৃপা লাভ সত্ত্বেও সে এমন অসাধুজনোচিত কার্য কি করিয়া করিল, এই কথা জিজ্ঞাসা করেন। প্রশ্ন শুনিয়া একটু চুপ থাকিয়া মহারাজ বলিতে লাগিলেন, যে ভাবের চিন্তা মনে স্থান দিলে নিজের ক্ষুদ্র বিশ্বাস ভক্তির হানি হয়, সে ভাবের চিন্তা কখনও মনের মধ্যে স্থান দিও না। আজ তোমরা তাকে এমন দেখছ, দশ বছর পর সে যে একজন মহাপুরুষ হয়ে দাঁড়াবে না -- কি করে জানলে? তখন তোমরাই বলবে, তা হবে না? সে যে মার কৃপা পেয়েছিল! মার মহিমা, মার শক্তি কতটুকু -- আমাদের কি সাধ্য বুঝি!” (স্বামী সারদানন্দের স্মৃতিকথা: স্বামী চেতনানন্দ সংকলিত ) বস্তুতপক্ষে মাকে তিনি সাক্ষাৎ জগন্মাতা বলেই জানতেন। সুতরাং তাঁর সকল কার্যই একমাত্র মার প্রীত্যর্থে অনুষ্ঠিত হত!
 ১৩৩৪ বাংলা সনের ১ ভাদ্র, বৃহস্পতিবার রাত্রি ২টো ৩০ মিনিটে স্বামী সারদানন্দজী মহাসমাধিলাভ করেন। এই বিষয়ে ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় লিখিত হয় -- “ ‘ভারতে শক্তিপূজা’র সিদ্ধ মহাপুরুষ, শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের অন্যতম প্রধান গঠনকর্তা ও পালয়িতা, শ্রীরামকৃষ্ণ-লীলা-বেদ রচয়িতা, শ্রীভগবানের নিত্যপার্ষদ ও লীলাসহচর, আশ্রিতবৎসল, আর্তত্রাতা, মহাপ্রাণ, আচার্যবর স্বামী সারদানন্দ, এ যুগের নির্দিষ্ট কর্ম সম্পাদন করিয়া বিগত (১৩৩৪ ) ১ ভাদ্র, বৃহস্পতিবার, রাত্রি ২টো ৩০ মিনিটের সময় মহাসমাধিযোগে স্ব-স্বরূপে মিলিত হইয়াছেন। তাঁহার স্থূল শরীরের এই অপ্রকাশ -- ‘সঙ্ঘের’, ভারতের, শুধু তাহাই নহে -- সমগ্র আধ্যাত্মিক জগতের এক বিরাট অংশকে শূন্য করিয়া দিয়াছে। এই শূন্যস্থান ততদিন শূন্যই থাকিবে, যতদিন না তিনি আবার আসিয়া তাঁহার স্থান পূর্ণ করিবেন।


 ...লোকহিতায় এই মহাপুরুষের অখণ্ড অনবদ্য জীবনকে আমরা বহুরূপে দেখিয়াছি। দেখিয়াছি, তাঁহাকে উদ্বোধনের সম্পাদক এবং ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ’, ‘ভারতে শক্তিপূজা’ ‘Stray thoughts on the Literature and Religion of India’ প্রভৃতির শক্তিমান লেখকরূপে, বক্তৃতামঞ্চে অপূর্ব বক্তারূপে, সঙ্ঘের পরিচালকরূপে, শাস্ত্রব্যাখ্যাতা আচার্যরূপে, জগজ্জননী শ্রীশ্রীমাতৃদেবীর একনিষ্ঠ সেবকরূপে, মাতৃজাতির সেবার জন্য ‘নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়ে’র প্রতিষ্ঠাতারূপে, সুরজ্ঞ গায়করূপে, লোকগুরুগণের ভাব কেন্দ্রীভূত করিবার জন্য শ্রীশ্রীমাতৃদেবী, আচার্যবর স্বামী বিবেকানন্দ ও স্বামী ব্রহ্মানন্দের সমাধিমন্দির নির্মাতারূপে এবং সর্বশেষ -- সমষ্টি ও ব্যষ্টি মানবের মুক্তির জন্য সকলের অকৃত্রিম সখা, স্নেহময় পিতা এবং উপদেষ্টা ধ্যানী ও জ্ঞানী গুরুরূপে। তাঁহার জীবনের এক একটি দিক, এক একটি ভাবের সম্পূর্ণ ছবি।”

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments