জ্বলদর্চি

খাদ্যের জোগানে বিজ্ঞান /নিশান চ্যাটার্জী

জীবনের গভীরে বিজ্ঞান- ১৩

খাদ্যের জোগানে বিজ্ঞান

নিশান চ্যাটার্জী

ঠিক এর আগের পর্বে আলোচনা করেছিলাম খাদ্যের চাহিদা আমাদের বিশ্বে যে হারে বাড়ছে তাতে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ সঠিক রাখার স্বার্থে পেস্টিসাইডের ব্যবহার একেবারে বন্ধ করা সম্ভব নয়। এর উপায় হিসেবে পেস্টিসাইডের সাথে সাথে ভেষজ উপাদান ব্যাবহারের কথাও তুলে ধরেছিলাম। আজকে অপর একটি উপায়ের দিকে আমরা দৃষ্টিপাত করবো। কথায় আছে "ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়"। সারাবিশ্বে গবেষকগণ সেই উপায়ের তাগিদেই নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যাই হোক শুধু প্রথাগত চাষের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে আধুনিক চাষাবাদ গড়ে তুলতে হবে।

 ধরুন যে পেস্টের আক্রমণের ফলে প্রত্যেক বছর কয়েক মেট্রিক টন খাদ্যশস্যের ক্ষতি হয় সেই কারণ অর্থাৎ পেস্ট কে যদি ভ্যানিশ করা যায়। এমনটাও সম্ভব নাকি? হ্যাঁ অবশ্যই সম্ভব। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা চাইলেই জীবনের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণকারী জিন কে এক জীবদেহ থেকে অন্য জীবদেহে প্রবেশ করিয়ে নতুন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জীব উৎপাদন করতেই পারেন। সেই পদ্ধতিকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ট্রান্সজেনেসিস। এবং যে জিনটিকে এক জীবদেহ থেকে অপর জীবদেহে স্থানান্তরিত করা হয় তাকে ট্রান্সজিন বলে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা এমন ফসল উৎপাদন করতেই পারি, যা পেস্ট দ্বারা আক্রান্ত হবেনা। অর্থাৎ উদ্ভিদকূলকে এমন ট্রান্সজিন প্রদান করা হবে যা পেস্টের সংক্রমণে বাধা দেয়।  যেমন মহারাষ্ট্র হাইব্রিড সীড প্রাইভেট লিমিটেড, একপ্রকার বেগুন(BT brinjal) উৎপাদন করে, যা বেগুন পোকা বা Leucinoides orbonalis দ্বারা আক্রান্ত হয়না। এই ধরনের খাদ্য কে বলা হয় জেনেটিক্যালি মডিফায়েড ফুড বা GMO। যদিও এই বিষয় নিয়ে মানুষের মনে অনেক দ্বিধা রয়েছে। যা সমাধান হলে কৃষিজগতে বিপ্লব ঘটে যাওয়া সম্ভব।
এছাড়াও আমরা বিকল্প খাদ্যের কথা ভাবতেই পারি। প্রোটিন জাতীয় বিকল্প খাদ্য কে আমরা বিজ্ঞানের ভাষায় বলি সিঙ্গল সেল প্রোটিন বা SCP ।  

বিভিন্ন অনুজীবকে কৃত্রিম পদ্ধতিতে পালন করে আমরা তার থেকে সহজপাচ্য যে প্রোটিন উৎপাদন করে থাকি তাকে সিঙ্গল সেল প্রোটিন বলে। মেক্সিকোর টেক্সকোকো  লেকের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী একটি বিশেষ জনজাতি আ্যজটিস(Aztees) গোষ্ঠীর লোকেরা স্পাইরুলিনা নামক নীলাভ সবুজ শৈবাল কে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। ভোজ্য জলজ শৈবালের মধ্যে এর স্থান সর্বোচ্চ। প্রোটিনের উৎস হিসেবে স্পাইরুলিনাতে লাইসিন এবং ট্রিপটোফ্যান নামক আ্যমাইনো আ্যসিড সমেত প্রায় সকল অপরিহার্য আ্যমাইনো আ্যসিড উপস্থিত। স্পাইরুলিনার ক্ষেত্রে মিউকোপ্রোটিন নামক পদার্থের উপস্থিতি তাকে মানুষের জন্য সহজপাচ্য করে তুলেছে। ১৬৫০ সালের থেকেই ছত্রাক বা আ্যগারিকাস একটি সমৃদ্ধকর খাদ্য শিল্প রুপে বিশ্বে দেখা দেয়। এর প্রতি ১০০ গ্রামে প্রোটিনের পরিমাণ প্রায় ৩.৮ গ্রাম। যেহেতু অনুজীবের বংশ বৃদ্ধিতে সময় অনেক কম লাগে এবং প্রোটিনের পরিমাণ গড়ে  ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ সেজন্য এটি ব্যবহার করা সহজ হতে পারে। এছাড়াও যেহেতু অনুজীবের বৃদ্ধি তেমন ভাবে জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত হয়না সেহেতু উৎপন্ন প্রোটিনের গুণগত মানের কোনো পরিবর্তন হয়না। এই জাতীয় খাদ্যে ফ্যাটের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম হয়। সুতরাং ইচ্ছে থাকলেই উপায় যে হয় সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার কথাই নয়। এ তো গেল প্রোটিন জাতীয় বিকল্প খাদ্যের সন্ধান। কিন্তু আমরা দৈনন্দিন জীবনে যে সকল খাদ্যশস্য গ্রহণ করি তাতে কি উচ্চ গুণ সম্পন্ন প্রোটিনের পরিমাণ বাড়িয়ে নেওয়া যেতে পারে? উওর হচ্ছে হ্যাঁ। যে পদ্ধতিতে আধুনিক জৈব প্রযুক্তি বিদ্যার মাধ্যমে অধিক ভিটামিন, প্রোটিন, উপকারী ফ্যাট সমৃদ্ধ শস্য উৎপাদন করা হয় তাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় বায়োফর্টিফিকেশান। অধিক ভিটামিন সমৃদ্ধ "গোল্ডেন রাইস"এই প্রক্রিয়াতেই তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এগুলো মানুষের কাছে তেমন ভাবে এখনো তুলে ধরা হয়নি। আমাদের এই বিপুল চাহিদার জোগান যদি অক্ষুন্ন রাখতে হয় তাহলে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে তার অন্যতম পথ। 

এ বিষয়ে মানুষের মনে এখনো বহু প্রচলিত ভুল ধারণা রয়েছে যা আগে দূরে করা প্রয়োজন। পেস্টিসাইড ব্যবহার করার সামান্য ঝুঁকি থেকে মুক্তি এবং জনবিস্ফোরনের ফল স্বরূপ বিপুল খাদ্যের চাহিদার যে সমস্যা সেই সংক্রান্ত সমাধান কিন্তু আমাদের জীবনের গভীরেই লুকিয়ে রয়েছে।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments