জ্বলদর্চি

নলিনী বেরা /বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

বাংলা গল্পের পালাবদল—৭

নলিনী বেরা 

বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

জীবনানন্দ দাশ সেই কবে গ্রাম-পতনের শব্দ শুনেছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বড়ো দ্রুত বদলে গিয়েছে বাংলার গ্রামগুলি। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কার পৌঁছে গিয়েছে গ্রামগুলিতেও। যত দিন যাচ্ছে গ্রাম-শহরের ব্যবধানও ম্লান হয়ে যাচ্ছে তত। গ্রাম-বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতি, নিজস্ব ঐশ্বর্যকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে আধুনিকতার আগ্রাসন। তা সত্ত্বেও গ্রামীণ মানুষের যাপনের আনাচে-কানাচে, গ্রামীণ-প্রকৃতির সত্তার অভ্যন্তরে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে সেই দেশজ সংস্কৃতি, লোকায়তনিক বৈভবকে কোনওভাবেই নিশ্চিহ্ন করা যাচ্ছে না। হয়তো যাবেও-না কোনও দিন। পল্লীবাংলার সেই শাশ্বত অন্তরাত্মা আধুনিকতার খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে থাকবে।

মিডিয়ার জৌলুসের আড়ালে খানা-খন্দে অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা গ্রামীণ ভারতবর্ষকে নিরন্তর অন্বেষণ করছেন, আবিষ্কার করে চলেছেন এসময়ের কয়েকজন লেখক। তাঁদের মধ্যে অন্যতম কথাকার নলিনী বেরা (জন্ম-১৯৫২)। তাঁর শিল্পী সত্তায় সম্পৃক্ত হয়ে আছে পল্লীপ্রকৃতি ও গ্রামীণ সংস্কৃতি। কংসাবতী শিলাবতী ময়ূরাক্ষী দ্বারকেশ্বর টটক-কুমারী রাঢ়-কঁকর ডুলুং সুবর্ণরেখা নদীবিধৌত ঝারিখণ্ডের আসনবনি কুড়চিবনি জামবনি শালবনি কেঁদবনি বনকাটি মুড়াকাটি আমডিহা বাঘমারি ভালুকঘরা ল্যাকড়াগুড়ি বাঘুয়াশোল টিকরপাড়া রণজিৎপুর লবকেশপুর হাতিবাঁধা গোপীবল্লভপুর রোহিণী কুলটিকরি ইত্যাদি গ্রামনামের অনুষঙ্গে তৈরি হয়েছে নলিনীর গল্পের জমি। এই ভৌগোলিক অঞ্চলকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে দেয় এই এলাকার গাছ-গাছালিও। হিঙ্‌চা হিড়িমিচা ঘলঘসি আঁটারি চরচু ডকা কুচলা ধ আসন শাল পিয়াশাল কেঁদ্‌ করম ভাদু ভুড়রু করণ কইম বাদাম বাদভেলা কদম গাবগুলি গুটিমন দধিয়া কুড়চি গোনালি জাড়া জারুল চাঁড়াশ পাকুড় কষাফল ইত্যাদির আধিক্য চোখে পড়ে এই অঞ্চলে।

ভারতবর্ষের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক মানচিত্রে অঞ্চলটির একটি পৃথক গুরুত্ব রয়েছে। তিনটি প্রাদশিক ধারার মিলন সঙ্গমক্ষেত্র— এই অঞ্চল-সংলগ্ন দুটি রাজ্য— একদিক উড়িষ্যা, অন্যদিকে ঝাড়খণ্ড। আমাদের শহুরে শিক্ষিত আধুনিক মানুষের কাছে এই অঞ্চলের মানুষজনের জীবনযাত্রা মাঝে মাঝেই অদ্ভুত ঠেকে। অদ্ভুত লাগে তাদের নামগুলিও। যেমন, রাইবু চামটু গড়গুড়িয়া সামাই সোমবারি ঢালো খেকরে কুলাই ছোটরাই পিথো কাঁদ্‌রা পিলচু পিতাম গুরা বড়কাই সুনি ভুসকি ধনু গুরুভা ভুটুং মোনা পরভা বাল্‌কা পিঁদাড়ি মিতিঞা ভট্টা ইত্যাদি। শ্রমজীবী গ্রামীণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন এই মানুষদের জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে আছে তুকতাক নলচালা বাণমারা তেলপোড়া ভূত-প্রেত ওঝা-গুনিন ইত্যাদি। এই মানুষদের কথা বলতে গিয়ে নলিনী বেরা একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন— “সেখানে মানুষ ভূত পোষে। আর সে ভূত বাঁদরের মতো ঘাড়ে মাথায় করে রাস্তাঘাটে ঘুরেও বেড়ায়। পোষাভূত অন্যের খামার থেকে ধান চুরি করে এনে ভূতের মালিককে বড়ো লোক বানায়। ধরা পড়লে আবার সভাস্থ পাঁচগ্রামের দশজন বিচারকের সামনে ‘গ্রামফান্ডে’ জরিমানাও দেয়। এখানে অভাবী কন্যাদায়গ্রস্ত মেয়ের বাপ গলবস্ত্র হয়ে, নদীর দহের দিকে চেয়ে, ঘন্টার পর ঘন্টা ধ্যানস্থ বসে থাকে, দহের ভূত কখন হুস করে নদীজলে ভেসে উঠবে তার মেয়ের যৌতুকের দানসামগ্রী হাতে নিয়ে। এখানকার কামারপাড়ায়, কামারশালে, গভীর রাতে হাতুড়ির ঠুকঠুক আওয়াজ করে জলাশয়ের ভূতের জন্য ঝিঁজরি গড়ে দেয় কামারের কামার রাজাকামার, যে-ঝিঁজরি বা শেকল মানুষের পায়ের আঙুলে শ্যাওলার মতো জড়িয়ে জলাশয়ের ভূত অমোঘ টান দেয়। এখানকারই যুবতী বধূ বনডুংরির ধারে গভীর রাতে ধনুকের মতো শরীর উলটে, চার হাত-পায়ে জন্তুর মতো হেঁটে, কপালে জ্বলন্ত প্রদীপ রেখে চরে বেড়ায়। ঘাস নয়, গু খায়। ফাঁকা মাঠে মরা মানুষের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা সেনির বা আঁশ-পাল্‌নার ভাত-মাংস খিদের জ্বালায় খেয়ে ফেলেছে ছেলে, তার বাপ তাই গালে হাত দিয়ে ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছে না, মরা মানুষের ভাত জ্যান্ত মানুষের পেটে গেলে সে মানুষ বাঁচে কি বাঁচে না ?” (‘প্রিয়ংবদা’, ২০০৭)

তাঁর কত কত গল্পের প্রধান চরিত্র এই ভূত বা ডাইন। ‘ভূত ভূত’ (‘শ্রেষ্ঠ গল্প’, করুণা প্রকাশনী, ২০০৩) গল্পের সেই ঝাঁপড়ীভূতটাকে মনে পড়ে। রাজারামের বিপুল ধনসম্পত্তির আসল কারণ যে ঝাঁপড়ীভূত তা রতিলের জানা। তাই তো বড়োলোক হওয়ার আশায় সেও একটা ঝাঁপড়ীভূত পুষতে চায়। কিন্তু পাবে কোথায় ? মন্মথ-র দ্বারস্থ হয় রতিল। মন্মথ তাকে শোনায় ঝাঁপড়ীভূতের কীর্তি। 

ধানঝাড়ন শেষ হলে রাতে পাহারায় থাকে ঝাড়েশ্বর। সব মানুষের আঙিনায় যখন ধানের সমারোহ তখন কে চুরি করে জানবে সে। আচমকা, “যেকালে ঘুমে বিভোর ধরিত্রী, সে আসে— রুনু রুনু রুনুর ঝুনুর পায় সুন্দরী যে যায়! ঝাঁপড়ী ভূত আবার কে ? পাছা ছেড়ে ধুলায় লুটোচ্ছে মাথার কেশ। এক হাত দেড় হাত উচ্চ শরীর। হাতে এই টুকুন এক দাঁড়িপাল্লা। টুরটুর— টুরটুরিয়ে এসে খপাৎ করে পাল্লাটি গুঁজে দেয় ধানগাদায়। কিছু ধান সরসর উঠে আসে— সে এক মজার কল।” 

হতভম্ব ঝাড়েশ্বর দ্যাখে, ভূত যত এগোয় ধানের গাদা তত কমে। কমতে কমতে এক জায়গায় ঠেকলে হুঁশ হয় তার। পিছু পিছু গিয়ে ভূতটাকে জাপটে ধরে। “ই-রিঃ কী ঠান্ডা, কী ঠান্ডা শরীর! জাঁতাকলে পড়ে ঝাঁপড়ী তো করে চিঁচিঁ। করে তো। ঝাড়েশ্বর তত পিষে ফেলতে চায় দুহাতে। আজ তুকে চিপটে মেরে ফেলবনি খালভরি—দে আমার ধান দে।”

রতিকান্ত মন্মথর পরামর্শে ভূত ধরতে যায় ধ’তলে। এক টিপ সিঁদুর, কয়েকটা আস্ত তুলসীপাতা আর কাতান নিয়ে। গাছটির গোড়া আগাপাশতলা ছেঁটে ফেলল প্রথমে। মাটিতে রাখল সাতটি তুলসী। সাতটি কাঁড়াল-কোঁড়ল পাতা। একে একে সাতটি পাতায় সাত ফোঁটা সিঁদুর গাছের গায়ে। মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে শুদ্ধ মনে বলে— “ধ’তলের ভূত তালে এসো, ঘরে এসো।” দূরে কাতান হাতে অপেক্ষায় থাকে সে। ভূত আর নামে না। অধৈর্য রতিল কাতানের চটা মারে গাছে।

পরে অবশ্য অন্য এক ভূত ধরতে চায় রতিকান্তকে। ততদিনে সে শহুরেবাবু। চাকরি পেয়েছে। গ্রামে এসেই পড়ে ভূতের সামনে। যার জন্য সারা শৈশব ঢুঁড়ে মরেছে সর্বত্র, সেই হাজির সশরীরে। কে তুই ? “—আমি ভূত”। “কী চাস, তুই ?” দুহাত বাড়িয়ে ছায়ামূর্তি বলে “আমাকে রাখো”। “থেকে কী করবি ?” —“যা বলবে তুমি”।

“‘শুতেও পারি তোমার সঙ্গে, পিছু পিছু যেতেও পারি। বল তো উঠব বসব তুমার কথায়’। এক ঢোঁক গিলে রতিকান্ত বলল, ‘আর ?’ নেচেকুঁদে আনন্দে ভূত-উত্তর, ‘কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। ধনদৌলত। চাও কি রাতমধ্যে মহাজন বানিয়ে ছাড়ব তুমাকে। রাখো’। ঘর্মাক্ত রতিকান্ত, না। ‘ন্না-আ’। ভূতের তোষামোদী হল শুরু। ‘রাখো না। হাতের নোক্‌খী পায়ে ঠেলছ! যাচা ধন।’ ‘উহুঁ’ বলেই রতিকান্ত পিছু হটল। হটে গিয়ে ত্রাসে-ভয়ে দৌড়ল। অশরীরীও দৌড়ুচ্ছে, ‘রাখো, রাখো, রাখো আমাকে। লাভ বই তুমার ক্ষতি কিছু না। রাখো তো রাখো’। সবেগে দৌড়ুচ্ছে রতিকান্ত। ‘হাহা হিহি হাহা হিহি’— হাসতে হাসতে ভূত দু’হাত বাড়িয়ে রতিকান্তকে ধরতে চাইছে।”

ধ’গাছের ভূতের আরও একটি ক্ষমতার কথাও বলা হয়েছে এখানে। ধ’তলের ঝোপঝাড়ে কাগজের কুচো রেখে এলে সকালের মধ্যে তা নোট হয়ে যায়। দিদি মানকুর বিয়েতে টাকার দরকার। রতিকান্ত তাই ধ’তলের ঝোপঝাড়ে কাগজ রেখে ধ’গাছের ভূতকে বলে এসেছে, “কাল সকালের মধ্যে একেকটা একশ’ টাকার নোট করে দাও। এসে করকরে পাই যেন। দেখ ভুল না হয়—দেখ ভুল না হয়।” এক নিঃশ্বাসে বলে পিছনে না তাকিয়ে দৌড়েছিল। 

নলিনী বেরার ‘ভূত-বভিষ্যৎ’ (‘শারদীয় গল্পগুচ্ছ’, ২০০৮) গল্পটির কথাও এখানে স্মরণ করা যেতে পারে। এই গল্পের কুচলা গাছের ভূতের এরকম ক্ষমতা আছে। এখানে দেখছি গ্রামের ভূতকে শহরে আনা হয়েছে। গ্রামে-ঘরে ভূতেরা খেতে পায় না। শহরে এলে দুধটা ঘিটা পাবে। তাই শহরবাসী লেখকের অনুরোধে তাঁর গ্রামের দুই বন্ধু ভুজু আর ডিবরা পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম থানার বাছুর খোঁয়াড় গ্রাম থেকে মাটির হাঁড়িতে ভূতের চারা এনেছে। হাঁড়ির মুখ শালপাতায় মুড়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা। দিনক্ষণ না দেখে ভূতগুলোকে ঘরে তুলল না ভুজু-ডিবরা। রক্তকরবীগাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখল দুটো হাঁড়িকে। একবার মোড়ক খুলে দু-ঘটি জল আর দুমুঠো মাটি ঢেলে দিল। এতেই সপ্তাহখানেক নিশ্চিন্ত। ঠিক দুদিন পর মাটির হাঁড়ি থেকে অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচিতে আসবে ভূতগুলো। সাতদিন পর থেকে ওজন বাড়বে। সুষম খাদ্য তালিকাও প্রস্তুত করে দিল ভুজু-ডিবরা। ওজন বাড়া সম্পর্কে লেখক প্রশ্ন করেন, “তবে যে লোকে বলে ভূত অশরীরী ?” ভুজু-ডিবরার চটজলদি উত্তর, “ধুস! যতসব বাজে কথা, প্যাঁদের কথা, হঁ— মরলেই যদি ভূত’ হয়, মরার পরে মড়ার দেহের কি ওজন থাকে না— না— আকার থাকে না ?”

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর লেখক ভুজু-ডিবরাকে কলকাতা দ্যাখাতে নিয়ে যান। লঞ্চঘাটে এসে ইঞ্জিনচালিত লঞ্চ দেখে ডিবরা ফিসফিস করে লেখককে বলে, “চিড়্‌কিন্‌ ভূতের ‘পোনা’ আরেকটু গায়ে-গতরে হোক, লেজ গজাক খয়েরি রঙের— তখন তাকে যদি ‘অড়ার’ কর, দেখবে কেমন তেল-দাঁড়-ইঞ্জিন ছাড়াই লঞ্চ তো লঞ্চ জাহাজ তো জাহাজ ‘উড়োজাহাজ’ও উড়িয়ে দেবে।” মনুমেন্টের উঁচু চূড়ার দিকে তাকিয়ে ভুজু বলে, “আমাদের কদমডাঙারহুড়িতে গোমূহা-কালীমুহি-ঝাঁপড়ি-কুচলা-চিড়্‌কিন্‌দের দিয়ে এমন একটা বানিয়ে ফেললে হয় না ?” এরপর ভিক্টোরিয়া-দর্শন। মাথার উপর উঁচুতে ডানা-ওয়ালাপরী। ডানাই আছে। আর ঘোরে না। ডিবরা পরামর্শ দিল, “চারাগুলো টুকচার পুরুষ্টু হোক, তার পিছুকে ওই গোমূহাকেই বলো টুকচার ঠেলে দিতে—”

ভুজু ডিবরা গ্রামে ফিরে যাওয়ার সময় লেখককে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে গেছে ‘গাঁইয়া ভূত’ বলে তাদের যেন অনাদর না করেন। সর্বদা সন্তান স্নেহে ‘মানুষ’ করেন। সত্যিকারের কোনো দোষ করলে আচ্ছা করে কানমলা দিয়ে শাস্তি দিতেও যেন না ভুলে যান তিনি।

মানুষের শৈশব আর ভূতের শৈশব একেকার। সবাই শিশু, মানুষ ভূত নির্বিশেষে। এরকম ভূত আমরা আগে দেখিনি। বড় ভালো লাগে নলিনীর ভূতদের। 

ভূতের চারাগুলো ধীরে ধীরে বড়ো হল। পুষ্ট হল ‘উদরখণ্ড’। উপাঙ্গগুলো শক্তসমর্থ হল। দাঁত বেরুল। ক-মাসের মধ্যেই গোলাপি রঙ বদলে হল কালচে বাদামি। দেওয়ালির রাতে একটা হাউয়ের ডগায় গোমূহাকে বসিয়ে পলতেই আগুন ধরিয়ে ভিক্টোরিয়ার দিকে তাক করে লেখক বললেন, “যা গল্লু!” খালি একটা শব্দ হল ‘ট-ক্কা-স্‌!’ পরের দিন খবরের কাগজে প্রকাশ ‘উড়ন্ত পরী ভিক্টোরিয়ায়!’ কীকরে পরী উড়ল সেসব খবর লেখা নেই। তবে মাস দুয়েক আগে ব্রিটেন না আমেরিকা থেকে কিছু ইঞ্জিনিয়ার এসে কীসব খুটখাট করেছিল, তারই ফল ফলল এতদিনে বলে লিখেছে। লেখকও ঘটনার দায় স্বীকার না করে চুপ করে থাকলেন।

লেখক তার পোষা ভূতদের নামকরণও করেছেন, গোল্লু, কাল্লু, ঝাঁপড়ি, কুচুল্লা। সবটাই বিপণন যোগ্য হয়েছে। সন্ধান পেয়ে নাসার লোকজন গোল্লুকে নিয়ে গেল। গোল্লু যাবে মঙ্গলে। ভুজু-ডিবরাসহ গ্রামের লোক খবর পেয়ে গর্বিত হল খুব। তেল-সিঁদুর মাখিয়ে গোল্লুকে ছেড়ে দেওয়া হল আকাশে। পৃথিবীর লোকজন দেখতে পাচ্ছে না তাকে। মঙ্গল থেকে সে এক ঝুড়ি মাটি পাথর আনবে। সুবর্নরেখার নদীধারের প্রকাণ্ড মাঠের, গ্রামের বাঁশ-শ্যাওড়াগাছের বাসিন্দারা, ভুজু-ডিবরারা, নাসার লোকজনেরা সকলে মহাকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। কখন কাঁধে শক্তিমান হনুমানের মতো এক ঝুড়ি মঙ্গলের মাটি আর পাথর নিয়ে ধরনীতে নেমে আসবে!

“নেমে আসবেই আসবে। তবে ‘নাসা’ বা আমেরিকা আমাদের গাঁইয়া ‘গোল্লু’র এহেন ঘটনার দায়ভাগ স্বীকার করবে কি ? পরন্তু ফাজলামো করে বলবে না তো, ‘ইহাদের পেট নাই তবু ইহারা বেশি খায় ?”   

প্রচলিত ভূতের গল্পের থেকে নলিনীর ভূত-বিষয়ক গল্পগুলি আলাদা। কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস এভাবে না দেখে ভূত-সম্পর্কিত মানুষের বিশ্বাস-সংস্কারকে আঘাত না করেই গল্প বলেন তিনি। ফ্যানটাসিও বলা যায় না ঠিক। নলিনীর গল্পেরর ভূতেরাও জগৎ সংসারের একটি প্রাণী বিশেষ। মানুষের সঙ্গেই তাদের সহবাস। যে আঞ্চলিক পটভূমিকায় তাঁর গল্পগুলি লেখা সেই অঞ্চলের ভূগোল ইতিহাস সবই তো অদ্ভুতুড়ে। মানুষগুলোও। লেখক নিজেও সেই অদ্ভুতুড়ে আবহে সম্পৃক্ত। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি এই প্রসঙ্গে বলছেন— “সেখানকার নদনদী পাহাড়-টিলা বন-ডুংরি বট অশ্বত্থ-ধ-আসন-চুল্লা-চুরচু-শাল-পিয়াশাল গাছেরা আমার সঙ্গে কথা বলে, হাঁটে। এমনকি, ভুদু-মহুল-কুচলা ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ গাছে যে সমস্ত ভূত থাকে, সেই সমস্ত ভূতেরাও কতদিন বাঁশের কলম চাঁছতে সাহায্য করেছে। উপদেশ দিয়েছে, এই কর, সেই কর, তবেই কলমের ডগাল খুব ছুঁচালো হবে। তারা আমার সঙ্গে ‘দাঁড়িয়া’ ‘বাঘবন্দী’ ‘হাডুডু’ ‘কিত্‌কিত্‌’ ‘কাতি’ কতরকম খেলা খেলেছে। খেলতে খেলতে হাত-পা কেটে গেলে টিঞ্চার আয়োডিন ডেটল না হোক তাদের ক্ষতস্থানে গাঁদা চাকুন্দার রস তো লাগিয়ে দিয়েছি। প্রচণ্ড খুশি হয়ে তারা আমাকে বরদান করেছে। আর সেই বরে আমি এখনো মাঝে মাঝেই দেখে ফেলি, মানুষগুলো স্থির, স্ট্যাচু।” (‘প্রিয়ংবদা’, জানুয়ারি ২০০৭)

নলিনী বেরার গল্পে বেশ কিছু গ্রামীণ পরব-উৎসবের দৃশ্য এসেছে। হরিনাম সংকীর্তন ও মহোৎসব ধর্মীয় উৎসবগুলির মধ্যে অন্যতম। সময় মতো বৃষ্টি না হলে কৃষিপ্রধান অঞ্চলে সমবেত উদ্যোগেই অনুষ্ঠান হয়। আবার গৃহশান্তির জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগেও এই নামসংকীর্তন মহোৎসব হয়। 

‘শতরঞ্জি’ (‘শ্রেষ্ঠ গল্প’, করুণা প্রকাশনী, ২০০৩) গল্পে বিস্তৃতভাবে এসেছে মহোৎসবের প্রসঙ্গ। এই বৃহৎ উৎসবের আমন্ত্রণ পত্র এরকম—

“হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম্‌।
কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা।।”  
“মহাশয়,
আগামী ৫ই আষাঢ় ১৪০৫ ইং ২০শে জুন ১৯৯৮ শুক্রবার আমাদের বাছুর খোঁয়াড় গ্রামে অষ্টপ্রহরব্যাপী হরিনাম সংকীর্তনের জন্য ব্রতী হইয়াছি।   
অতএব আপনি সবান্ধবে উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত হইয়া হরিনাম সংকীর্তন শ্রবণপূর্বক শুভকার্য সুসম্পন্ন করিবেন ও করাইবেন। পত্রদ্বারা নিমন্ত্রণে ত্রুটি মার্জনীয়।
ইতি—
বাছুর খোঁয়াড়, মেদিনীপুর                                বিনীত
২৮শে জৈষ্ঠ্য, ১৪০৫                             বাছুর খোঁয়াড় গ্রামবাসীগণ
সময়সূচিঃ ৫ই আষাঢ় ১৪০৫ শুক্রবার—সকাল ৬ ঘটিকায় ঘটোত্তোলন ও হরিনাম আরম্ভ। রাত্রি ১২টায় মহাপ্রসাদ বিতরণ এবং ৬ই আষাঢ় শনিবার সকাল ৯টায় দধিমহোৎসব।”

মহোৎসবে উচ্চনীচ ভেদাভেদ থাকে না। লেখক খুব সুন্দর বর্ণনা করেছেন— “তৃণাদপি সুনীচেন— আজ রামচন্দ্র থেকে ভাঁড়ারী, সকলেরই খাতির কত! গ্রামের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা, যারা বাপের ধূতি মায়ের শাড়ি কিংবা একেবারে নতুন নতুন জামাকাপড় পরে এসেছে— তাদেরই আজ দাপট কত! ইচ্ছা মতো তারা পাতা শতরঞ্জির এ-প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত কুদি মেরে দৌড়চ্ছে, শতরঞ্জির ওপরই কানামাছি চোর-চোর দাঁড়িয়া হা-ডু-ডু খেলছে, কেউ কেউ হঠাৎ দলছুট হয়ে মণ্ডপে মূল কীর্তনীয়াদের দলে ভিড়ে দোয়ারকি দিতে দিতে বারকতক ঘুরপাক খেয়ে ফের দলে এসে ভিড়ে যাচ্ছে। দু’ঠোঁটে এমনি ভঙ্গি করছে, যেন— ধুস, আজ কে কাকে মানে, আজ সব মাগনা মাগনা! শতরঞ্জির ওপরই ডাঁই করা হয়েছে বৈতাল, কুমড়ো, ঝিঙে, চিচিঙা, পুঁইখাড়া, আলু, পটল। একদল ছোকরা হাসি-হাসি মুখ করে সেখানে যত খুশি আনাজপাতি কুটে যাচ্ছে। তাই দিয়ে আজ রাত ১২টায় অষ্টপ্রহরের মহাপ্রসাদের ঘন্ট হবে...।”

খোল-করতালের শব্দে মুখর চারদিক। চৌদ্দটা মণ্ডপে চৌদ্দ রকম নামগান চলছে। কোথাও ‘হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে’, কোথাও ‘জয় রাধে গোবিন্দ রাধে’, কোথাও-বা ‘হরে মুরারে মধুকৈটভ ভারে’, আর কোথাও ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।’ চৌদ্দ দল কীর্তনীয়ারা চৌদ্দটা মণ্ডপে পালা করে নামগান করছে। স্মরণীয়, নলিনীর একটা গল্প সংকলনের নাম ‘চোদ্দমাদল’। চোদ্দটি গল্পের সংকলন। গল্পগুলির পৃথক কোনও নাম নেই। প্রতিটি গল্পের পটভূমি মেদিনীপুরের পূর্বে উল্লেখিত বিশেষ গ্রামীণ অঞ্চল।

‘শতরঞ্জি’ গল্পে আর একটি প্রসঙ্গও এসেছে। তৃণাদপি সুনীচেন... হলেও এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কিছু নিয়ম-নিষ্ঠাও থাকে। বিরাট অঞ্চল জুড়ে রঙ-বেরঙের বাহারি শতরঞ্জি পাতা। শতরঞ্জির কম্‌পিটিশান গ্রামে গ্রামে। মহাপ্রসাদের আয়োজন চলছে শতরঞ্জির উপর। আর সেখানে হাজির মোঘিয়া সাজ্জাদ। কাবুলিওয়ালা। পরনে লুঙ্গি, গায়ে ঢোলা পাঞ্জাবি। পায়ে টায়ারের ধ্যাবড়া চটি। হাতে লাঠি। চটি পায়ে সে এগিয়ে যায় মস মস করে। কিছুটা হেঁটে হকচকিয়ে যায়। এগোলেও শতরঞ্জি, পিছোলেও শতরঞ্জি। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না।

তখনই সোরগোল ওঠে— ‘ধর, ধর শালাকে!’ ‘মার, মার শালাকে!’ ‘এতদূর আস্পর্ধা!’ ‘নামগান হচ্ছে মণ্ডপে, সেই মণ্ডপের গা-ছুঁইয়ে পাতা শতরঞ্জির উপরেই কী না পা! তাও আবার জুতো পরা।’

হইহই করে ধেয়ে আসে লোকজন। সাজ্জাদ সামনের দিকে দৌড়োতে শুরু করে। তার ডান পায়ের চটি খুলে যায় আচমকা। এক পায়ে চটি পরে দৌড়োয়। ঘূর্ণী হাওয়ায় উড়ছে শতরঞ্জি। শতরঞ্জি থেকে পা ছাড়িয়ে দৌড়োতে পারে না সাজ্জাদ।

ধর্মীয় আফিম মানুষ-মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ তৈরি করে। হিংস্র করে তোলে মানুষকে। তবে এই হাওয়া বেশিক্ষণ বয়ে যায় না। ঘূর্ণী ঝড়ের মতো একসময় প্রকৃতির নিয়মেই থেমে যায়, এটাই সত্যি। 

কৃষি-ভিত্তিক গ্রামীণ ভারতবর্ষের বিচিত্র রূপী মানুষজন উঠে এসেছে নলিনী বেরার গল্পে। তাঁর ‘শ্রীকান্ত পঞ্চম পর্ব’ (‘এই এই লোকগুলো’, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৮৮) গল্পের শ্রীকান্ত গ্রামেরই মানুষ। শ্রীকান্ত বেরা, সাং বাছুরখোঁয়াড়, পোঃ রোহিণী, জেলা মেদিনীপুর। ছোটবেলায় স্কুলে যাবে না বলে ধান সেদ্ধ করার বড়ো জালার মধ্যে লুকিয়ে থাকত। ফ্রি প্রাইমারির হেডস্যার বাড়িতে এসে “বেছে বেছে একটা জালার মধ্যে হাত গলিয়ে চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলবেন শ্রীকান্তকে। মাটি থেকে কম করেও ছ’ইঞ্চি ওপরে। পরিহাস করে বলবেন, এই কিনা শ্রীকান্ত ?”

এই শ্রীকান্ত পড়াশুনো ছেড়ে কৃষিকাজে লেগে পড়ে। বাবা-মা দু’জন মারা যাবার পর ভাই নলিনীকান্তকে পড়ানোর দায়িত্ব তো তার। যে কোনো মূল্যেই মানুষ করতে হবে ভাইকে। নিজে পড়াশুনো করতে পারেনি তেমন করে, ছোটোভাই নলিনীকান্ত তার অহংকার। তার পড়ানোর খরচ জোগাতে, বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রামে জমি জিরেত অনেকটা চলে যায়। শেষ সম্বল তার প্রিয় বলদ জোড়াটাও চলে যায় কাকার বেইমানিতে। ভাই নলিনীকান্ত ভালো চাকরি করে। সেই টাকার একটা বাড়ি করে দিলেও দরজা-জানলা বসাতে পারে না। কিন্তু শ্রীকান্ত তারজন্য চিন্তা করে না। সে শুধু একজোড়া বলদ চায়। তা দিয়ে সবকিছু করে ফেলবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাই কিনে দিতে পারে না। মৃত্যুশয্যায় শুয়েও ভাইকে আশ্বাস দিয়ে বলে, “তুই একদম চিন্তা করিস না ছোটোভাই— আমাকে এক হাল গরু কিনে দে, দেখবি ওই দিয়ে খেটে ঘরের দরজা-জানালা সব আমি করে ফেলব।” একজন কৃষকের কাছে বসত ভিটের থেকে একজোড়া বলদ অনেক বেশি জরুরি, শ্রীকান্ত তার ভাইকে সেটাই বোঝাতে চেয়েছে। শহরের শিক্ষিত ভাই-র প্রতি গ্রামের অশিক্ষিত দাদার অকৃত্রিম স্নেহভালোবাসার চূড়ান্ত পরিচয় পাই শ্রীকান্তর মধ্যে। 

ভাই ঘরে ফিরলে তাকে খাওয়ানোর জন্য “বেছে বেছে বাঁশ পতরি শুঁটকি কিনল গোটা কতক। পাল জমিনের বেগুন পুড়িয়ে তার মধ্যে মুচমুচে পোড়া বাঁশ পতরি শুকা মাছ গুঁজে একটু নুন লঙ্কা সরষের তেল একফোঁটা মিশিয়ে একসঙ্গে চটকে আহুত করে খেতে কী ভালোই না বাসত আমাদের ছুটু। মেয়ে সুরুবুড়িকে দিয়ে শাক তোলালে হরেকরকম— চালধোয়া, ঘোড়াকানা, নাহাঙাশাক। নেহাৎ কুরকুটের সময় নয় এসময়, না হলে লোধা-লোধানীদের দিয়ে কুরকুট ও না আনিয়ে ছাড়ত না শ্রীকান্ত ? শিলনোড়ায় কুরকুট বেটে শালপাতার ঠোঙায় মুড়ে পুড়িয়ে ছোটবেলায় সে কী কম খাওয়া খেয়েছে আমাদের নলিনীকান্ত ? আজ না হয় সে একটু বাবু হয়েছে। আপনার মনে হেসে শ্রীকান্ত চলে গেল খাল ধারে সাপখোপের গর্তে ডিমাল কাঁকড়া ধরতে। নলিনীকান্তকে সে আজ কাঁকড়ার ঝোল খাওয়াবে।” 

একটি নির্দিষ্ট এলাকার লোকায়ত যাপনের প্রতি নলিনীর বিশেষ আগ্রহ আছে। লোকায়ত বিশ্বের কোনো সীমা নেই। চৌহদ্দি নেই। দেশ-কাল নেই। যে অঞ্চলে তিনি জন্মেছেন সেই অঞ্চলটি পুরাভূমির অন্তর্গত ছিল। সেই অঞ্চলই তাঁর অধিকাংশ গল্পের পটভূমি। সেই পরিবেশকে তিনি প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো নিরন্তর খনন করে চলেছেন। তাই তাঁর সমগ্র রচনার মধ্যে আপাতভাবে পটভূমি-প্রেক্ষাপটের একটা সাদৃশ্য লক্ষ করা গেলেও প্রতিটি রচনাই ভিন্ন ভিন্ন দ্যোতনা নিয়ে হাজির হয় পাঠকের বোধে চেতনায়। আসলে লেখকের অবলোকনভঙ্গিটাই নিরন্তর বদলে যায়। পর্যবেক্ষণের নিত্য-নতুন প্রয়াস থাকে তাঁর। তাই একটি বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলের মানুষজন-সংস্কৃতির ভিতর দিয়ে আমরা দেখতে পাই অন্যন্য ভারতবর্ষকে।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments