জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা--৩৬/প্রীতম সেনগুপ্ত


৩৬

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 কোয়ালপাড়ায় পৌঁছতে শ্রীশ্রীমা, সারদানন্দজী প্রমুখের কেন বিলম্ব হয়েছিল এবং পৌঁছনোর পর কী ঘটেছিল সেই বিষয়ে স্বামী ঈশানানন্দ তাঁর ‘মাতৃসান্নিধ্যে’ বইটিতে লিখছেন --“...পরে সংবাদ আসিল, শিহড়ের রাস্তায় তাঁহাদের গাড়ি নদীর নিকট দঁকে পড়িয়াছে। এই সংবাদ শুনিয়া রাজেনদা প্রমুখ কয়েকজন সেই দিকে লণ্ঠন লইয়া অগ্রসর হইলেন। রাত্রি ৮টা নাগাদ সকলে আসিয়া পৌঁছিলেন। পূর্বব্যবস্থামতো শ্রীশ্রীমা-র গাড়িটি কেদারবাবুর বাড়ির দিকে এবং অন্যান্য গাড়ি স্কুলের দিকে চলিল। কিছু দূর যাইবার পর মায়ের গাড়ির গরু খুলিয়া দিয়া ভক্তেরা নিজেরাই গাড়িটি টানিয়া লইয়া চলিল, আমিও যোগ দিলাম। ঐ গাড়িতে মায়ের দুইটি ছোট ভাইঝিও ( রাধু ও মাকু ) ছিল। মা গাড়ি হইতে নামিয়া মাথায় বেশ ঘোমটা ও গায়ে চাদর মুড়ি দিয়া ডান পাখানি একটু টানিতে টানিতে ( মায়ের পায়ে সামান্য বাত ছিল ) কেদারবাবুর মায়ের সহিত তাঁহাদের ছোট ঠাকুরঘরে গেলেন। শ্রীশ্রীমা ঠাকুর প্রণাম করিয়া আসন গ্রহণ করিলে সমবেত স্ত্রী ও পুরুষভক্তগণ (আমার মা-বাবাও ছিলেন ) তাঁহাকে প্রণাম করিলেন, সঙ্গে সঙ্গে আমিও প্রণাম করিলাম। কেদারবাবুর মা কানে একটু কম শুনিতেন বলিয়া তাঁহার সঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলিতে হইত। আমি ঘরে উপস্থিত থাকায় মা আমাকে দিয়াই পুরুষভক্তগণের কথাবার্তার উত্তর দিতেছিলেন।

 এদিকে বেশি রাত্রি হইয়া যাইতেছে দেখিয়া শরৎ মহারাজ ব্রহ্মচারী জ্ঞানানন্দ দ্বারা তাগিদ পাঠাইয়াছেন। ব্রহ্মচারীজী সদর দরজার নিকট আসিয়া ঈষৎ বিরক্তির সহিত ‘বড্ড রাত্রি হয়ে যাচ্ছে’ বলিয়া একটু কড়া তাগিদ দিলেন। মা উহা শুনিয়া একটু ব্যস্ত হইয়া থালা হইতে একটু মিষ্টির কিছু ভাঙ্গিয়া লইয়া গ্রহণ করিলেন এবং একটু জলপান করিয়া গাত্রোত্থান করিলেন। মা যখন উঠানে নামিয়া পড়িয়াছেন, তখন সকলের সঙ্গে আমিও তাড়াতাড়ি উঠানের মধ্যে তাঁহাকে ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া আমার পিতা যাহা প্রণামী ( দুইটি টাকা ) দিয়াছিলেন, তাহা তাঁহার হস্তে দিলাম। মা সস্নেহে দাড়ি ধরিয়া চুমু খাইয়া বলিলেন, “বাবা, যা কিছু দিতে হয় সব পায়ে দিতে হয়।” মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিয়া তিনি ধীরে ধীরে গিয়া গাড়িতে উঠিলেন। গাড়ির সহিত আমরাও স্কুলবাড়িতে আসিয়া শরৎ মহারাজ, গোলাপ-মা ও যোগন-মাকে প্রণাম করিলাম। দেখিলাম তাঁহারা যেন রাত্রি হওয়ার দরুন একটু অস্বস্তি বোধ করিতেছেন। তথাপি সকলকে আশীর্বাদ ও সুমিষ্ট আপ্যায়নে মুগ্ধ করিয়া তাঁহারা চারিটি গরুর গাড়িতে রওনা হইলেন। আমাদের সহিত তাঁহাদের এই প্রথম আলাপ। আমরা সকলে মায়ের প্রসাদ একটু একটু গ্রহণ করিয়া অধিক রাত্রে বাড়ি ফিরিলাম।

 শ্রীশ্রীমায়ের নিকট সেই অল্পক্ষণ থাকিয়া মাত্র কয়েকটি কথার ভিতর তাঁহার স্নেহের ও আন্তরিক ভালবাসার যে আস্বাদ পাইয়াছিলাম, তাহার তুলনায় মাতাপিতার স্নেহ-ভালবাসাও ( যদিও আমি তাঁহাদের একমাত্র সন্তান ) সেই বয়সেই আমার ম্লান বোধ হইয়াছিল। সেই অবধি সর্বদা মনে হইত আবার তাঁহার নিকট কখন যাইতে পারিব! তাঁহাকেই যেন এই জগতে ঠিক ঠিক আপনার বলিয়া বোধ হইতেছিল। পরদিন সকালে খবর পাওয়া গেল যে, শরৎ মহারাজ কোতলপুরে অনুমান রাত্রি ১০ টা নাগাদ এক শিব মন্দিরের ( শান্তিনাথ মহাদেব ) নাটমন্দিরে সকলকে গাড়ি হইতে নামাইয়া জনৈক ময়রাকে ডাকাইয়া লুচি ভাজাইয়া সকলের আহারাদির ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীমা কখন আসিবেন ও কতক্ষণ কোয়ালপাড়ায় থাকিবেন পূর্বে জানা না থাকায় স্থানীয় ভক্তগণ শ্রীশ্রীমা ও সকলের জন্য রাত্রের আহারের কোনরূপ ব্যবস্থা করেন নাই। সুতরাং বিষ্ণুপুর রওনা হইতে তাঁহাদের খুবই রাত্রি হইয়াছিল। কেদারবাবু ও আমার পিতা এই সংবাদ শুনিয়া অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া মনস্তাপ করিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘তা কি করব? বেলা ৪টায় তাঁদের আসার কথা, সেজন্য সামান্য মিষ্টির ব্যবস্থা করেই তো নিশ্চিন্ত ছিলাম এবং সময়মতো পৌঁছাচ্ছেন না দেখে সকলে উদ্বিগ্ন ছিলাম, তাঁদের আহারের বন্দোবস্ত করার কথা কারোরই খেয়াল হয়নি।’ কোয়ালপাড়া হইতে যাইবার জন্য কেন যে তাঁহারা অস্বস্তি বোধ করিতেছিলেন এবং ব্যস্ত হইয়াছিলেন তাহা তখন কাহারও বুঝিতে বাকি রহিল না। পরে পূজনীয় গোলাপ-মা প্রায়ই আমাদের নিকট রহস্য করিয়া বলিতেন,‘তোমাদের তো সেই বুদ্ধি -- অত রাত্রে ঠকঠকে নারকেলের সন্দেশ’।”

 কলকাতায় শ্রীশ্রীমায়ের আবাসস্থল নির্মাণ সারদানন্দজীর এক অসামান্য কীর্তি। এর প্রকৃত ইতিহাস ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন স্বামী গম্ভীরানন্দজী। তিনি লিখছেন -- “১৯০৩-ইং-তে স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ আমেরিকায় চলিয়া গেলে ‘উদ্বোধন’ পত্রের পরিচালনা ও অর্থব্যবস্থাদি লইয়া গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব হইল। অবশেষে কর্তব্য নির্ধারণের জন্য স্বামী সারদানন্দের সভাপতিত্বে পত্রের হিতৈষীরা মিলিত হইয়া স্থির করিলেন যে, স্বামী শুদ্ধানন্দের পরিচালনায় পরীক্ষামূলকভাবে অন্ততঃ এক বৎসর উহা চালানো হইবে। তদবধি ১৯০৬ অব্দে গিরীন্দ্রলাল বসাক মহাশয়ের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁহারই ছাপাখানা হইতে উহা প্রকাশিত হইতে থাকে। অনন্তর ৩০ নং বোসপাড়া লেনে ‘উদ্বোধন’ অফিস স্থানন্তরিত হয়; কিন্তু গৃহস্বামী শীঘ্রই বাড়ি ছাড়িয়া দিতে বলিলে সারদানন্দজী স্থায়ী বাটীর কথা ভাবিতে বাধ্য হন। অধিকন্তু শ্রীশ্রীমা জয়রামবাটী হইতে কলিকাতায় আসিলে থাকার সুব্যবস্থা করা কষ্টসাধ্য ছিল -- তাঁহারও বাসস্থানের প্রয়োজন। এই সঙ্কটকালে শ্রীযুক্ত কেদারচন্দ্র দাস মহাশয় গোপাল নিয়োগী লেনে একখণ্ড ভূমি দান করিলেন। স্বামীজীর গ্রন্থ বিক্রয় করিয়া স্বামী সারদানন্দের হাতে ২৭০০৲ জমিয়াছিল; তদ্দ্বারাই গৃহনির্মাণ আরম্ভ হইল। স্বল্প অর্থ নিঃশেষিত হইতে কতক্ষণ লাগে? তখন বীরভক্ত সারদানন্দজী অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও নিজ দায়িত্বে ঋণ করিয়া বাটীর কার্য চালাইতে লাগিলেন। যথাকালে গৃহ সমাপ্ত হইলে উহার একতলা ‘উদ্বোধন’-এর জন্য এবং দোতলা শ্রীশ্রীমায়ের আবাসস্থল ও ঠাকুরঘররূপে নির্দিষ্ট হইল।

 ইহার পর শ্রীশ্রীমায়ের আহ্বানে মামাদের বিষয়বণ্টনে মধ্যস্থতার জন্য তাঁহাকে ১৯০৯ ইং-র ২৩ শে মার্চ জয়রামবাটী যাইতে হইল। প্রত্যাগমনকালে তিনি মাকেও সঙ্গে লইয়া আসিয়া ২৩ শে মে নূতন বাটীতে প্রতিষ্ঠা করিলেন। এখানে বলিয়া রাখা আবশ্যক যে, ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে স্বামী যোগানন্দের দেহত্যাগের পর সারদানন্দ মহারাজ শ্রীশ্রীমায়ের সেবাধিকার পাইয়া যথাসাধ্য কর্তব্যপালনে অগ্রসর হন। তাঁহার সেবায় পরিতুষ্ট হইয়া মা একদা বলেন, ‘শরৎ যে কয়দিন আছে সে কয়দিন আমার ওখানে ( অর্থাৎ কলিকাতায় ) থাকা চলবে। তারপর আমার বোঝা নিতে পারে এমন কে দেখি না। ... শরৎটি সর্বপ্রকারে পারে -- শরৎ হচ্ছে আমার ভারী।’ অন্য আর একবার শ্রীশ্রীমাকে পিতৃগৃহ হইতে কলিকাতায় লইয়া যাইবার কথা উঠিলে তিনি বলিয়াছিলেন, ‘আমাকে কি কেউ নিয়ে যেতে পারে বাবা? নিয়ে যায় তো এক শরৎ। আমার ভার শরৎ-ই নিতে পারে, আর কেউ পারে না।’ বস্তুতঃ ‘উদ্বোধন’ বাটী শ্রীশ্রী সারদানন্দের মাতৃভক্তির অপূর্ব নিদর্শন।”

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments