জ্বলদর্চি

বনমহোৎসব /অমিতরূপ চক্রবর্তী

বনমহোৎসব

অমিতরূপ চক্রবর্তী

ভোরের দিকে ঘুম ভাঙল আমার। চোখ খুলে তাকাতেই টের পেলাম মস্তিষ্ককে পেঁচিয়ে ধরা নেশার চাপটা এখনো আছে। ঘরের আলো নেভানো হয়নি। ঠা ঠা করে আলোটা জ্বলছে। ক’টা বাজতে পারে আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম। এখন কি রাত না কি ভোর-ভোর? সময় দেখার জন্য কোনো ঘড়ি কোথাও খুঁজে পেলাম না। রান্নাঘরের দিকে দরজার ওপরে একটা ছিল, এখন সেটা নেই। কেউ সরিয়ে নিয়েছে হয়তো। 

গলা অবধি চাদর টেনে শুয়েছিলাম। এখন টের পেলাম গায়ে, গলায় ঘাম এসেছে। ফেলে দিলাম চাদরটা। উঠে বসতে গিয়ে দেখলাম নেশাটা এখনো বেশ শক্তভাবে চেপে বসে আছে আমার ওপর। খাট থেকে মেঝেয় পা রেখে দাঁড়াতেই খানিকটা টলে গেলাম। তারপর খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে রান্নাঘরে গিয়ে দেওয়াল হাতড়ে আলো জ্বাললাম। জল তেষ্টা পেয়েছে। সিংকের সামনে খুচরো কিছু বাসন। দেখে বুঝলাম রাতে কারও খাওয়া হয়নি। কোনো বাসনে নতুন এঁটোর দাগ নেই। কয়েকটা প্লেটে কিছু টোমাটো সস আর কাঁটাচামচ রাখা। এলোমেলো কয়েকটি গেলাস। একটা পলিথিনের ক্যারি, তার মধ্যে ভিজে নেতিয়ে থাকা খবরের কাগজ। কেমন একটা গন্ধ আসছে তা থেকে। 

এলোমেলো গেলাসের একটি সিংকে ধুয়ে জল খেলাম। জলটা মুখে টানতেই গা-টা ঘুলিয়ে উঠল। মনে হল, জলে মদ মেশানো আছে। এখন মুখে সেই স্বাদটা বিশ্রী লাগছে। ফ্রিজার খুললাম। রাতে খাইনি কিছুই। সুলতামাসী শুধু এককাপ লাল চা করে দিয়েছিল। সঙ্গে খাবার মতো মুড়ি বা বিস্কুট কিছুই ছিল না ঘরে। শুয়ে পড়ার আগে ওই এককাপমাত্র চা-ই খেয়েছিলাম। তখন ঘামে, উত্তেজনায় দপদপ করছিল শরীরটা। মাথার ওপরে সোঁ সোঁ করে ফ্যান চলছিল। মনে হচ্ছিল অবরুদ্ধ একটা চিৎকার যেন আমাকে চিরে-খুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায় বা বেরিয়ে এলেই যেন ভাল হত। সুলতামাসীর কণ্ঠ বলছিল ‘শুয়ে পড়, শুয়ে ঘুমিয়ে পড়। আর টেনশন করিস না বাবা!’
শুয়ে থাকা ছাড়া এখন কিছু করার নেই। তবে ঘুম হয়তো আর আসবে না। নেশায়, উত্তেজনায় প্রতিদিন রাতের ওষুধটাও খেতে ভুলে গেছি। এখন আর খাওয়া যাবে না। খেতে পারলে হয়তো ঘুম আসত। ডাইনিংয়ের ওপরে দেখলাম সিগারেটের প্যাকেট রাখা। একটা সিগারেট নিয়ে ওয়াশ বেসিনের আয়নায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সিগারেট ধরালাম। অভূক্ত শরীর, তার ওপরে নেশা। প্রথম টানেই অনেকটা ধোঁয়া ভেতরে গিয়ে পাঁজরটা শুকিয়ে ফেলল যেন। আয়নায় নিজের দিকে তাকালাম। মাথায় আলতো টাঁক আলোয় চকচক করছে। গালে বেশ ক’দিনের দাড়ি। চোখের নাবালে ক্লান্তি আর স্বেচ্ছাচারের ছাপ। নিজের দিকে তাকিয়ে থেকেই সিগারেটে আরেকটা টান দিলাম। পাঁজর নিঃসৃত ধোঁয়াগুলো যখন আমার মুখকে আরতি করে করে বাতাসে মিলিয়ে যেতে থাকল, তখন যেন নিজেকে নিজের কাছে কিছুটা চেনা মনে হল। সেই পুরনো অবোধ্য দৃষ্টি, কালো দু’পাটি ঠোঁট, কপালের নীচে নানা ভাবনায় কিলবিল। 

মেজোপিসির ফোনের কথাটা মনে পড়ল। ওটাই ছিল গতরাতের শেষ ফোন। মেজোপিসি বলছিল ‘কাজটা তোর ভাল হয়নি অমি। ওভাবে আঙুল নাচিয়ে কথা বলায় মেজোপিসে প্রচণ্ড অসম্মান বোধ করেছে। তুই কিন্তু আজ আমাদের বাড়ি আসবি না, কিছুতেই না। মেজোপিসেমশাই সোজা বলে দিয়েছে তুই যেন আর আমাদের বাড়ি না আসিস।‘
হ্যাঁ, কাজটা সত্যিই ভাল হয়নি। উত্তেজনায় ওভাবে আঙুল উঁচিয়ে কথা না বলে, ঠাণ্ডাভাবেই বলতে পারতাম। কিন্তু এটা এখন সবকিছু নীরব হয়ে যাওয়ায় মনে হচ্ছে। তখন অমন আগুন-লাগা অবস্থায় এই ভাবনা মনে আসার কথা নয় এবং আসেওনি। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমাদের বেডরুমে বিছানার পাশে চেয়ারে মেজোপিসেমশাই বসা। ভেতরে যাবার দরজায় সুলতামাসী। দেওয়ালের দিকে সোফায় বড়দা, বড়বৌদি। আমি তখন বাথরুমে মুখ-হাত ধুয়ে ঘুরে বারান্দায় এসে মুখ মুছছি। বড়বৌদিই বলল ‘অমি এভাবে চলতে পারে না, নিজে ঠিক হও এবার।‘
ওই যে বললাম আগুন-লাগা অবস্থা তখন। বড়বৌদির কথায় দপ করে আমার মাথায় আগুন লেগে খুলিটা জ্বলতে থাকল। আমি খেই হারিয়ে আঙুল নাড়িয়ে বলেছিলাম, ‘আমার ঠিক হওয়া নিয়ে কারও চিন্তা করতে হবে না। আমি একদম ঠিক আছি। যাকে ঠিক করার, তাকে ঠিক হতে বলো।‘
এইকথা যখন আঙুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলছি, তার ফাঁক দিয়ে দেখেছিলাম চেয়ারে মেজোপিসেমশাই পাথরের মূর্তি হয়ে বসে আছেন। 
ব্যাকপ্যাকটা পিঠে নিয়ে যখন স্টেশনে বসেছিলাম, তখন অন্ধকার চুঁইয়ে ধীরে একটা হাওয়া হচ্ছিল। শান্তি পাচ্ছিলাম তাতে। ট্রেনে উঠে কোথাও রওনা দেব কি না, সে সিদ্ধান্ত তখনও অবধি নিতে পারিনি। বারবার মন দুর্বল হয়ে পড়ছিল। স্টেশন শুনশান। কোথাও কেউ নেই। প্ল্যাটফর্মের একটা অংশে চড়া আলো জ্বলছে। দূরের অংশগুলোয় আলো-আঁধারি। বাঁধানো বসার জায়গা আছে সেখানে। সেখানে বসে বা দ হয়ে শুয়ে তো কাটিয়েই দেওয়া যায় একটি রাত। তারপর সকাল হলে কাছে-পিঠে কারও বাড়িতে চলে যাওয়া যায়। ফোন করে নিজের অস্তিত্বটা বাড়িতে জানিয়ে দিলেই হল। ব্যাকপ্যাকের মধ্যে আস্ত একটা মদের বোতল ছিল। জলও ছিল। তা দিয়েই বানিয়ে খেয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়া যেত। মশার কামড় কিছু মালুম হত না। 
হয়তো তাই-ই করতাম বা হয়তো করতামও না, ট্রেনেও উঠে পড়তে পারতাম। পকেটে মোবাইল ফোনটা ঘনঘন বেজে উঠছিল। একবার কভার সরিয়ে দেখি ছোটকাকা। আমি হ্যালো বলতেই ছোটকাকা বলল ‘কোথায় আছিস? এখুনি বাড়ি ফিরে আয়। আমাদের ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়।‘
আমি হড়হড়ে গলায় বললাম ‘আসছি।‘ বলে আবার বসে থাকলাম। কেন যেন ইচ্ছেই করছিল না ওই অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে ফিরে যেতে। তার থেকে এখানে বসে থাকা শান্তির। বসেও ছিলাম। আবারও ফোন বাজল। এবার কভার সরিয়ে দেখি ছোটোবৌদি। আমি সাড়া দিতেই ছোটোবৌদি বলল ‘এখুনি ফিরে এসো! আমাদের ঘরে এসে সুলতামাসী কান্নাকাটি করছে।‘ আমি কিছু না বলে ফোনটা রাখতে যাব, শুনলাম সুলতামাসী কেঁদে কেঁদে কী যেন বলছে। ওর অনেক কথার মধ্যে আমি বুঝতে পারলাম শুধু ‘ফিরে আয় বাবা ফিরে আয়।‘
আশ্চর্য গতরাতে কীরকম যেন নিরেট হয়ে গিয়েছিলাম আমি। প্রাণহীন, অনুভূতিহীন একটা মানুষ। সুলতামাসীর কান্না আর ওরকম বুক খালি-করা ডাক শুনে আমার স্থির থাকার কথা নয়। তবুও স্থির অকম্পিত ছিলাম। ফোনটা পকেটে রেখে বাতাসের ঝাপট বাঁচিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালাম। প্ল্যাটফর্মের হালকা আলো চুঁইয়ে আসছিল আমি যেখানে বসেছিলাম, সেখানে। সিগারেট টানতে টানতে দেখলাম বেশ ঢলঢলে প্যান্ট পরা একটা দোহারা চেহারার লোক পাশের সরু রাস্তাটা দিয়ে প্ল্যাটফর্মে উঠে এল। কয়েকবার চড়া আলো জ্বলা প্ল্যাটফর্ম দেখল, তারপর আমাকে জরিপ করল তারপর সামনের দিকে ঢিলে পায়ে হাঁটতে থাকল। স্টেশনের আশেপাশের বাড়িগুলোরই কেউ হবে। হয়তো খাবার পর জিরোতে বেরিয়েছে। নয়তো গাঁজার খোঁজে এসেছে। হয়তো এখন ওর সঙ্গীসাথিদের আসার কথা। 

লোকটি এগিয়ে যেতেই আমি উঠে বাড়ির উদ্দেশে হাঁটা দিয়েছিলাম। মাথা কাজ করছিল না। শুধু ক্ষণিকের, চকিতের চিন্তা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। 
সিগারেটের শেষটা ওয়াশ বেসিনে ফেলে জল চালিয়ে আবার বিছানায় ফিরে এলাম। জানালার কাচ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মনে পড়ল ওহো, আসছে দিনটা তো দোলের দিন। ইয়েস, গতকাল আমি ফেরার সময় মেয়েটার জন্য রঙ, আবির পিচিকিরি এসব কিনে ফিরেছিলাম। মেজোপিসেমশাই এসেছে বলে গরম মোগলাইও নিয়ে এসেছিলাম। মেয়েটা কি আমার হাত থেকে রঙ, পিচকিরির থলিটা নিয়েছিল? বাড়ি ঢোকার আগে আমি প্রতি মিনিটে নার্ভাস হয়ে পড়ছিলাম। আবার ওই একই জলঘোলায় আর জড়িয়ে পড়তে চাইছিলাম না। ইস, ঠাকুর সবকিছু যদি শান্ত থাকে! কোনোরকম অশান্তি যদি নতুন করে আর না তৈরি হয়? এসব ভাবছিলাম আর নার্ভাস হয়ে পড়ছিলাম। পায়ে মৃদু উত্তেজনার ঠকঠকও টের পাচ্ছিলাম আমি। হয়তো আগাম সতর্কতা হিসেবেই গেট খুলে আমি মেয়েকে সাড়া দিয়েছিলাম।
-‘পো পো!’ 
মেয়েটা কয়েকবার ডাকার পর সাড়া দিল ‘বাবা!’ তারপর ছুটে বারান্দায় বেরিয়ে এলো। আমিও গ্রিল সরিয়ে জুতো খুলতে খুলতে বলেছিলাম ‘এই দ্যাখো, তোমার জন্য কীসব এনেছি।‘
-‘কী বাবা?’
-‘রঙ, পিচকিরি আর মাথার টুপি। কাল দোল না? তুমি রঙ খেলবে না?
-‘ইয়ে-য়ে! বাবা তুমি খুব ভাল! মাম্মাম দ্যাখো কত রঙ, পিচকিরি!’ বলতে বলতে মেয়েটা ঘরের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গ্যালো। 
আমি বাইরের ঘরে ঢুকে পিঠের ব্যাগ নামালাম। এই ঘরের ফ্যানটা খারাপ হয়েছে বলে সেটা খুলে সারাতে দেওয়া হয়েছে। ঘরে গুমোট ভাপ। হালকা হয়ে বসেছিলাম ঠিকই কিন্তু প্রতি মুহূর্তে আমার ভেতরে একটা সাইরেন বেজে চলছিল যেন। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এইবার গোটা সময়টা একটা সুবিশাল ঢেউ হয়ে আমার দিকে তেড়ে আসবে। আমার অবচেতন সেই আঘাতের জন্যেই অপেক্ষায় ছিল হয়তো। 
ঘরে ঢুকল একটা মানুষের দল। মেজোপিসেমশাই, বড়োবৌদি, ছোটবৌদি আর সুলতামাসী। নাইটি পরা সুলতামাসীকে একটা পুতুলের মতো দেখতে লাগছিল। আমি মনে মনে ভাবছিলাম হে ঠাকুর ওরা যেন আমার বেশি কাছাকাছি না আসে। কাছে এলেই মদের গন্ধটা পাবে। এই মুহূর্তে সেটা ভীষণ, ভীষণই বেমানান হবে। 
সোফায় আমার ব্যাকপ্যাকটা। সেটার মধ্যে আস্ত মদের বোতলটা। আজ একটা পেমেন্ট করেছি। দীপক নামে একটি ছোকরা ঠিকাদার এসে ওটা আমাকে দিয়ে গেল। 
আমি তখন বেরোচ্ছি। অফিসের কোলাপসিবল গেটের কাছে ছোকরাটির সঙ্গে দেখা। 
-‘স্যার।‘
-‘হ্যাঁ, বলো।‘
-‘আপনার জন্য একটা জিনিস ছিল স্যার।‘
আমি ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে বললাম ‘কোথায় সেটা?’
-‘আমার ব্যাগে স্যার।‘
-‘ঠিক আছে, ভেতরে এসো।‘ বলে আমি বাঁ- হাতের বারান্দাটায় সরে এলাম। মার্চের সাড়ে পাঁচটা, পৌনে ছ’টায় চারপাশে একটু ছায়া-ছায়া। ঘুপচিতে অন্ধকার। আমি ছোকরাটিকে আমার পিঠের ব্যাগটা দেখিয়ে বললাম ‘এতে ঢুকিয়ে দাও।‘
ছোকরাটা চটপট বোতলটা ব্যাগে ঢুকিয়ে দিল। হেসে বলল ‘হ্যাপি হোলি স্যার।‘
আমি সোজা ছেলেটার চোখে চোখ বিঁধিয়ে বললাম ‘শুধু এটাই?’
ছোকরাটি আমতা আমতা করে বলল ‘টু পার্সেন্ট অনেকটা বেশি হয়ে যায় স্যার।‘
-‘আমি ওসব বুঝব না। পেমেন্টের আগে টু পার্সেন্টই ঠিক হয়েছিল। আমি একটাকাও কম নেব না।‘
-‘এবার হোলিতে আমার অনেক খরচ স্যার। নতুন বোন-জামাই, বোন।‘
-‘আমার তো আরো বেশি। হরেক বন্ধুবান্ধবদের আবদার। আমার দেরি করিও না। কাল দোল, ফেরার বাস পাব না।‘
ম্লান হেসে ছোকরাটি পুরো টু পার্সেন্ট বের করে আনল। আমি চটপট সেটা পার্সে পুরে রাস্তায় উঠে এলাম। ইচ্ছে করেই পেছনে তাকালাম না। এসব ব্যাপারে পেছনে তাকাতে নেই। 
ঠিক তখনই বরুণদা ফোন করল। ‘বেরোলি?’
-‘হ্যাঁ, এইতো রাস্তায়।‘
-‘গুড একটা অটো ধরে পাহাড়ি ক্যাফেতে চলে আয়। আমি ওয়েট করছি।‘
-‘ওকে।‘
বরুণদা ছোটোখাটো ক্যাফেটার সামনেই দাঁড়িয়েছিল। বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি সীমানা, মাথার চালাও বাঁশের তৈরি। কেবিনগুলোও বাঁশের। বাইরে ছোটো ছোটো আলো ঝোলানো। বরুণদা একটা কেবিনের পর্দা সরিয়ে বলল ‘চল এটাতেই বসি।‘ তারপর কারও উদ্দ্যেশ্যে বলল ‘বাবু, বাবু সার্ভ কর। তারপর বলল আজ একটু সস্তাই খাব।‘ পরিচিত একটা নাম শুনিয়ে বরুণদা বলল ‘চলবে তো?’
সব চলবে। এখন আমার কোনো চয়েস নেই। পানের যোগ্য হলে সবই চলবে আমার। প্রতিদিনের এই নখরে নখরে যুদ্ধ, বিষাক্ত দংশন আর উগ্র অগ্নিকাণ্ড থেকে পরিত্রাণ পেতে আমি মরিয়া। যা পাচ্ছি তাকেই আঁকড়ে ধরছি। ঠিক না ভুল- জানি না। শুধু জানি আমাকে পরিত্রাণ পেতে হবে। বাঁচার শক্তি পেতে হবে। পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য মানসিক সাহস সংগ্রহ করতে হবে। 
সুলতামাসীকে পেছনে ফেলে মেজোপিসেমশাই এগিয়ে এলেন। ‘দিনের পর দিন এভাবে চললে তোরা সংসার করবি কী করে?’
আমি সোফা থেকে উঠে দেওয়ালের দিকে সরে গেলাম। তখন আমাকে দেখে সাঁওতালদের খপ্পরে পড়া একটা শজারুর মতো লাগছিল হয়তো। 
আমি কিছু বলার আগেই সেই গগনভেদী কণ্ঠস্বর বলে উঠল ‘দ্যাখো, দ্যাখো তোমরা ড্রিংক করে এসেছে। বেহেড মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরেছে। এর সঙ্গে কথা বলবে তোমরা? একটা নোংরা, কদর্য মানুষ! ছি!’
-‘অ্যাই, সাট আপ!’
-‘অমি, এক চড় মারব বলে দিচ্ছি! এভাবে কথা বলছ? ড্রিংক করে বাড়ি ফিরতে লজ্জা করল না? বড়দা, মেজোপিসেমশাই যেখানে উপস্থিত আছেন।‘
-‘না, লজ্জা করল না। ড্রিংক করলে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়? আমি একটা অফিসে কাজ করি। অনেকরকম লোকের সঙ্গে মিলিয়ে চলতে হয় আমায়। আর দিনের পর দিন এই অশান্তি আমি আর নিতে পারছি না! শুনছ তোমরা? জাস্ট নিতে পারছি না! সাইকো-ডিসঅর্ডার শুরু হয়ে গ্যাছে আমার।‘
-‘এই শোন, বেশি কথা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!’ মাস্তানদের মতো গলায় কথাটা বলে আমার দিকে এগিয়ে এলো মেজোপিসেমশাই। ‘সবার সামনে নিজের অন্যায়টা স্বীকার করছিস না কেন?’
‘কী অন্যায় আমি করেছি? আমার কোনো বন্ধুবান্ধব আমাকে ফোন করতে পারে না?’
‘পারে, তাহলে তুই করবীর কাছ থেকে সেটা লুকোচ্ছিলি কেন?’
‘ও একটা পাগল, ও কিছুতেই বিশ্বাস করত না।‘
-‘দ্যাখো, দেখলে কী বলছে? আমি পাগল? তাহলে তুমি কী? মোবাইলে অত রাতে মহিলাদের সঙ্গে কীসের অত কথা? ওইসব নোংরা ছবিগুলো কে পাঠায়? আবার সেই গগনভেদী কণ্ঠস্বরটা বলে উঠল।
-‘হোয়াট ননসেন্স! কীসের নোংরা ছবি? আমার ফোনে কোন ছবি নোংরা?’
এবার প্রেতের মতো নাকি নাকি সুরে গগনভেদী কণ্ঠস্বরটা বলে উঠল ‘কোনো নোংরা ছবি নেই না? আমি দেখিনি সেসব ছবি? স্নান করে গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে ছবি তুলে পাঠিয়েছে, সেটা নোংরা ছবি নয়? সেই ছবি সামনে রেখে তুমি মাস্টারবেট করোনি?’
আমার সহ্যের যেন সীমা-পরিসীমা রইল না আর। আমি সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে বললাম ‘তুমি একটা বদ্ধ পাগল। ওটা একটা স্টুডিওয় ফটোশুট। আর আমি মাস্টারবেট..তুমি একটা উন্মাদ, পারভার্টেড মেয়ে!’
-‘আর তুমি তুলসীপাতা, তাইতো?’
ছোটবৌদি এগিয়ে এল। ‘না অমি, এটা খুব খুবই জঘন্য একটা কাজ। তোমার কাছ থেকে এ আসা করা যায় না। ছিঃ, ছি ছি ছি!’
-‘ছোটবৌদি, তোমাদের মেয়ের স্বামীরা যদি এসব কাজ করে, তোমাদের মেয়েরা মেনে নিতে পারবে? ও-ও কি পারবে যদি ওর বোনের স্বামীরা এসব করে?’
-‘এই তুই চুপ করবি? চুপ করবি তুই? থাবড়া মেরে মুখ ভেঙে দেব শালা!’ আমার চোখের চশমাটা দেওয়ালের দিকে উড়ে গিয়ে ঠোক্কর খেয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। 
-‘এই তোর মুখের ভাষা? সুলতামাসীর ঠাস করে চড়টা আমার গালে আছড়ে পড়ল কিন্তু কোনো ব্যথাবোধ হল না আমার। 
-‘জুতিয়ে তোকে আমি সিধে করে দেব!’ ভয়ংকর একটা খুনির মতো মেজোপিসেমশাই বলল। আলোর থেকেও দ্রুতগতিতৈ ছুটছে তখন আমার মন। সত্যিই কি মন? জানি না। চিৎকার করে বললাম ‘যা করেছি, বেশ করেছি। আরও করব। এই সংসার এমনিতেও হবে না। আমি আমার মতো করে বাঁচতে চাই। তোমরা শুনলে? আমি আমার মতো করে বাঁচতে চাই। এইভাবে আমি আর পারছি না, আমি পারছি না!’ বলতে বলতে আমি টের পেলাম কাছের দেওয়ালটায় আমি ক্রমাগত মাথা ঠুকছি। বড়বৌদি বোধহয় ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছিল আমায়। 
-‘এই রাস্কেল চেঁচাচ্ছিস কেন?’ মেজোপিসেমশাইয়ের চড়টাও গালে আছড়ে পড়ল অথচ কোনো ব্যথাবোধ হল না আমার। আমার তখন এই মানুষগুলো থেকে, এই অগ্নিকুণ্ড থেকে একছুটে বেরিয়ে যেতে চাইছিলাম। যে কোনো জায়গায়, যে কোনো কোথাও। 


২.
জানালার ওপারে দেখলাম দূরের আকাশ একটু একটু ফর্সা হয়ে আসছে। এখন একটু কড়া চায়ের জন্য মনটা ছটফট করে উঠল আমার। কিন্তু বাসনপত্র ধুয়ে নিজে চা বানিয়ে খেতে একটুও ইচ্ছে করছিল না। আমি এখন সুলতামাসীর বিছানায় বসে আছি। সুলতামাসী ঘুমোচ্ছে বাইরের ঘরটায়। ওই ঘরে মশারি খাটানোরও ব্যবস্থা নেই। মশারা বোধহয় ওকে ঘিরে ধরে মহোল্লাসে রক্ত খাচ্ছে। ডাকব না কি সুলতামাসীকে? কিন্তু ও ঘরের অন্ধকারটার দিকে পা বাড়াতে কেমন যেন সাহস হল না আমার। 
কোনো শব্দ নেই কোথাও। শুধু অন্য ঘরে সোঁ সোঁ করে ঘোরা সিলিংফ্যানের শব্দ ছাড়া। মানুষের ভাবনারও কোনো শব্দ নেই অথবা মানুষ যখন ঘুমোয়, তখন হয়তো তার ভাবনাও ঘুমোয়। এখন বসন্ত। দিনের এইসময়ে হয়তো গাছে গাছে রকমারি ফুলেরা ফোটে। খুব কাছে গেলে ফুলফোটার শব্দ শোনা যাবে? না কি তারাও নিঃশব্দ?
হঠাৎ এইসময়টাকে আমার কেমন যেন মনে হল প্রচণ্ড ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলভূমির মতো। তাণ্ডব চালিয়ে ঝড় ফিরে গেছে। ভগ্নস্তুপ হয়ে পড়ে আছে উপকূল। এই নির্জন উপকূলে একটি সিড়িঙ্গে চেহারার কিশোর কাজে লাগার মতো কিছু জিনিস খুঁজে বেড়াচ্ছে। 
কাল যখন বাড়ি ফিরি, তখন ঘামে জবজব করছে আমার পোশাকআসাক। দরদরিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে গলা দিয়ে, চুলের গোড়া দিয়ে। সুলতামাসীই আমার জামা খুলে ভেজা গামছা দিয়ে ঘাড়-মুখ মুছিয়ে দিয়েছিল। ওর তৎপরাতেই আমি ট্রাউজার খুলে একটা বারমুডা পরে এই বিছানায় এসে বসেছিলাম, একসময় শুয়েও পড়েছিলাম।  
নেশার জন্যেই হয়তো-বা হবে আমি সুলতামাসীকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে পারিনি। অন্য সময় হলে হয়তো তাই করতাম। পাহাড়ি ক্যাফেতে বসে বরুণদার সঙ্গে যখন একটানা মদ খেয়ে যাচ্ছি, তখন নিজেকে হিংস্র করে তোলার কেমন একটা রোখ আমাকে পেয়ে বসেছিল। এমন একটা রোখ, যেন বুলেটও ফুঁড়তে পারবে না আমায়। চেরাইকলের মেশিনও কাটতে পারবে না আমায়। 
বরুণদা বলছিল ‘অমি, বেশি খেয়ে ফেলছিস কিন্তু!’
-‘চিন্তা কোরো না, আমি একদম ঠিক আছি।‘
-‘কী হয়েছে বল তো তোর?’
-‘নো, নাথিং। সবকিছু ওকে।‘
-‘তোরা দু’টিতে ঠিক আছিস তো?’
আমি একচুমুক মদ পেটে পাঠিয়ে হিসহিস করে বললাম ‘মাদারফাকার!’
-‘এই কাকে গালাগালি করছিস তুই?’
-‘কাকে আবার? নিজেকে! এই বুলহেডেড নিজেকে!’
-‘করবী আর তোর মধ্যে সমস্যাটা কী বলতো?’
এই চুমুকে মদের স্বাদটা আমার বিশ্রী লাগল। পকেট থেকে টু পার্সেন্টের নোটের গোছাটা বের করে এনে বললাম ‘আজ একটা পেমেন্ট করলাম। টু পার্সেন্ট। এমন অনেক টু পার্সেন্ট আসে আমার। কোনো কোনো সময় থ্রি পার্সেন্ট, ফোর পার্সেন্টও হয়। আর মাসে যা বেতন পাই তার ওপর টিকে থাকে আমার সংসার। স্বাচ্ছন্দ্য, বিলাসিতা যা কিছু- সবই এই আমার টাকায়। আর ওই মেয়েমানুষটা সব নিয়ে আমাকেই ন্যাংটো করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। কী? ভাবতে পার তুমি? আমাকে কেউ ফোন করতে পারবে না, আমি কারও সঙ্গে কথা বলতে পারব না। ওই মেয়েমানুষটার কথায় ও ছাড়া দুনিয়ার সব মহিলা হোর আর আমি বাদে দুনিয়ার সব পুরুষ সজ্জন। ভাবতে পার কী নিয়ে চলছি আমি? কেমন একটা লাইফ লিড করছি? জাস্ট ভাবতে পার?’ শেষ কথাটা বলার সময় আমি সেই ক্রমশ ঘনিয়ে ওঠা হিংস্রতাবশত টেবিলে থাবড়া মেরেছিলাম দু’হাতে। পলকা আয়রন পায়ার টেবিলটা ওতে থরথরিয়ে কেঁপে উঠেছিল। 
-‘দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এই মেন্টাল টর্চারে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি বরুণদা। আমার কোনো পার্সোনাল লাইফ নেই, প্রাইভেসি নেই, কোনো আনন্দ নেই, ফিলিংস নেই! আমার মেয়েটাও  (জানি না কোথা থেকে দুর্বল একটা কান্না গলা পেঁচিয়ে ধরল আমার) আমাকে বলে তুমি একটা নোংরা মানুষ! আমার মেয়েটা বরুণদা, আমার পাঁচ বছরের ফুটফুটে মেয়েটা! আমি কীসের, কীসের অভাব রেখেছি ওদের?’ 
কতগুলো মঙ্গোলিয়ান নৃ-গোষ্ঠীর ছেলে আমাদের কেবিনের বাইরে টেবিলে বসে মাটির খুঁড়িতে চা খাচ্ছিল। আমার আর্তরবে ওরা চা খাওয়া কিছুক্ষণের জন্য থামিয়ে রেখে কেবিনের দিকে চেয়ে রইল। 
টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমি রাজার মতো হাতের ইশারা করে ব্যাপারটাকে সামাল দিলাম। ‘সরি, এক্সট্রিমলি সরি। এভরিথিং নর্মাল। আপলোগ চায়ে পিজিয়ে।‘
আমার মেয়ের নাম নন্দা। আমাদের গুরুপরিবারের দেওয়া। আসছে জুনে পাঁচে পড়বে। ইস্কুলে কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে ভর্তি করিয়েও মহামারির কারণে একদিনও ইস্কুল কী, তা বোঝেনি। প্রতিদিন আধঘণ্টার জন্য মোবাইলে কীসব ভাটের ক্লাস হয়, তার জন্যে মাসে মাসে একগাদা টাকা টিউশানি ফি। 
বাড়িতে বিচারসভা বসিয়েছে করবী। বড়দা, বড়বৌদি, মেজোপিসেমশাই এরা সবাই জুরি। আর আমার এসব ফেস করতে ইচ্ছে করে না। আগে বুক ঠুকে ঝগড়া করেছি। এখন আর সেসবের কোনো অর্থ দেখি না। 
বরুণদার গাড়ি বাইরে দাঁড়িয়েছিল। বরুণদা বলল ‘তোকে কোথায় ছাড়ব?’
-‘সার্কাস মাঠের কাছাকাছি নামিয়ে দাও।‘
-‘অনেকটা দূর হাঁটতে হবে তো?’
-‘হোক, টাইমটা কিল করতে হবে বরুণদা। ওই ননসেন্স অবস্থাটা ফেস করতে চাই না।‘
-‘ওভার ড্রাঙ্ক হয়ে আছিস। সামলাতে পারবি তো?’
আমি কেমন বিধুর হেসে বলেছিলাম ‘সামলেই তো আসছি। এখন এটাই তো আমার কাজ।‘
-‘ওকে। তবে ইদানিং তুই মদ খেলে কিন্তু খুব অ্যাগ্রেসিভ হয়ে যাস।‘
-‘ইয়েস। আমি এটা এক্সারসাইজ করেছি। অ্যাটাক ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স।‘
বলেছিলাম ঠিকই, তবে পারলাম কই। দু- একটা চিৎকার, ধমক বা গজরানির পর আর তো পারিনি। আমি সার্কাস মাঠে নেমে উদ্দ্যেশ্যহীনভাবে হাঁটছিলাম। দমকল মোড়ের মাথায় নির্মল ফলের পসরা ও রঙের পসরা সাজিয়ে বসেছে। মহামারির পর এবার খোলা দোল। রঙের বাজারে তাই বেশ ভীড় চোখে পড়ল। নির্মল ওর দোকান থেকে বলল ‘হ্যাপি হোলি ভাই।‘
নির্মল আমার বাল্যবন্ধু। প্রাইমারিতে একইসঙ্গে পড়েছি। আমি ওর দোকানের দিকে এগিয়ে গেলাম। ‘মেয়ের জন্য রঙ দে।‘
নানারকম মুখোস ঝুলছে। নির্মল বলল ‘এটা একটা মেয়েকে কিনে দে।‘
জানি না কেন ওর এই কথায় আমি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে মুখোসগুলোর দিকে চেয়েছিলাম। পরে বললাম ‘এতে ও ভয় পাবে। তুই একটা টুপি দে বরং।‘
চট করে ওকে বললাম ‘কাল মাল খাবি?’
নির্মল কেমন বোকার মতো ঘাড় হেলাল শুধু। 
-‘শুধু আমি আর তুই, আর কেউ না। দূরে কোথাও যাব। জিনিস নিয়ে চিন্তা নেই। এই আমার ব্যাগ, এর মধ্যেই আছে। একটা ফুল বোতল।‘
এই কথা নির্মলকে বলার সময় কেন যে আমি ওরকম হিংস্রভাবে বলেছিলাম, জানি না। বিশেষত কথার ফাঁকে পিঠের ব্যাকপ্যাকটা দেখানোর সময়। নির্মল কোনো উত্তর দেয়নি। গবেটের মতো তাকিয়েছিল শুধু।
৩.
কোনো কোনো দিন রাতে ঘুম ভেঙে উঠে ভেবেছি ঘুমন্ত মেয়েটাকে দু’হাতে আগলে ও পাশের নির্বোধ মাংসের তালটাকে লাথি মেরে বিছানা থেকে ফেলে দিই। গোটা ঘরে উড়ে বেড়াচ্ছে ফিকে সাদা আলো। কারণ পরের সুলতামাসীর ঘরে আলো জ্বলছে। দুই ঘরের দরজায় কোনো পাল্লা নেই। পাল্লা রাখা হয়নি। সুলতামাসীর শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে। সারা ঘরে ওই ফিকে সাদা আলো। মাংসের তাল ঘুমে নাক ডাকাচ্ছে। মেয়েটার চুল এলোমেলো। ঘাড় গুঁজে কাদা হয়ে ঘুমোচ্ছে।
হ্যাঁ, এ কথা সত্যি যে আমি মাস্টারবেশন করেছিলাম। তবে মাংসের তালটা যেমন বলছে, তেমন ফোনে ওই বান্ধবীর ছবি সামনে রেখে নয়। এমনিই। কী একটা তিক্ততা, হতাশার আর না- পারার বোধ থেকে যেন। বাইরের ঘরটায় উঠে এসেছিলাম। চারপাশে তখন গাঢ় ঘুম। মাংসের তাল নাক ডাকাচ্ছে। বাইরে মধ্যরাতের অবাধ বাতাস। আকাশ থেকে নক্ষত্র ঝরে পড়ছে গাছপালার মাথায়। বাইরের ঘরে বসে কাজটা শেষ করেছি মাত্র, দেখলাম ভেজানো দরজার ফাঁকে একটা নিঃশব্দ প্রেতের মতো আভাস।
যা বলছিলাম, কতদিন ঘুম ভেঙে উঠে ভেবেছি লাথি মেরে মাংসের তালটাকে বিছানা থেকে ফেলে দিই কিন্তু শেষমেশ সত্যিই আর পারিনি। কোনো মমত্তবোধ থেকে নাকি? তাই যদি হয়, তবে তার মতো অদ্ভুত আর হাস্যকর কিছু হয় না। আমার অবচেতনে এই মাংসের তালটার প্রতি তীব্র ঘৃণা আর বিদ্বেষ থাকাই উচিত। 
আহ! কথাটা মনে মনে ভেবে কী খেয়ালে দু’ হাত মাথায় বোলালাম। তখন মনে হল আমার মাথায় বড়ো বড়ো লম্বা চুল থাকলে ভাল হতো। দু’হাতে সাপটে সেগুলোকে পেছনে নিয়ে যেতে পারলে আরাম লাগত। 
ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল সুলতামাসী। আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঘরঘরে গলায় বলছিল ‘এমনভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে যাস না বাবা। আমার যে তাহলে আর কেউ থাকবে না। আমি এক বুক হাহাকার নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকব।‘
আমি একটা পাথরের মূর্তি হয়ে বসেছিলাম। সুলতামাসী অবিরল বলে চলেছে ‘তোর বাবার পথে যাস না গোপাল। দেখলি তো তোর বাবার জীবনটা কী হল!’
আমার মা-বাবা নেই। জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতে আমি সুলতামাসীর হাতে বড়ো হয়েছি। আমার বাবা ওর অফিসের কী একটা তছরুপিতে জড়িয়ে পড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। মা মারা যায় কোলন ক্যানসারে। প্রচণ্ড তাণ্ডবের পর গোটা বাড়িটা থমথম করছে তখন। রাস্তা দিয়ে তীব্র হর্ন দিয়ে কখনো কখনো বাইক ছুটে যাচ্ছে। কাল ধনেখালি রোদে এই বাইকগুলোই অলিতে গলিতে দাপিয়ে বেড়াবে। চালকের পেছনে তাদের স্ত্রী অথবা প্রেমিকা। সবারই পরনে হলুদ শাড়ি। গালে রঙ, চোখে মোটা ফ্রেমের রঙিন চশমা। হাতে আইসক্রিম অথবা ঠাণ্ডা পানীয়র বোতল। মেয়েটার কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না। সুলতামাসীকে জিজ্ঞেস করলাম ‘পুচকি কোথায়?’
-‘সে বেচারি তো ভয়ে কাঠ হয়ে বিছানার এককোণে মোবাইল নিয়ে শুয়েছিল। এখন খেয়েদেয়ে মা’র সঙ্গে ঘুমোচ্ছে।‘
কোথাও বুকের ভেতরে একটা হু হু করা ধুলোঝড় উঠল যেন। শেষ চৈত্রে এমন ধুলোঝড় ওঠে। দিগন্ত থেকে অসংখ্য ঘুর্ণি নিয়ে ছুটে এসে চারপাশ কেমন অন্ধকার করে দেয়, দেখেছি। সেইরকম একটা ধুলোঝড়। আমি জানতামও না যে এমন হবে। হঠাৎ আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। 
সুলতামাসী তখন আমাকে শুইয়ে দিয়েছিল। 
নির্মলের দোকান থেকে বেরিয়ে অযথাই এ রাস্তা ও রাস্তায় হাঁটছিলাম। সময়টাকে খরচ করে ফেলতে চাইছিলাম আমি। এই বিচারসভার ঘোষণা আগেই করবী দিয়ে রেখেছিল। অনুর ফোনকলটা নিয়ে তখন ওর সঙ্গে আমার অশান্তি বারো ঘণ্টা পেরিয়েছে। সামান্য একটা ফোন। হয়তো দোলের শুভেচ্ছা জানাতো। সকালে অফিসে গিয়ে আমিই বরুণদাকে ফোন করে সজ্ঞানে মদের বৈঠকটা ঠিক করি। 
এবার খুব গরম। এইসময় শীত শীত করার কথা। কিন্তু এমন ভোরের দিকে ফ্যানের হাওয়া সত্ত্বেও গরম লাগছে। অথবা হয়তো সত্যিই তেমন গরম নেই। এই গরমবোধ আমারই একার, আমার অন্তর্জাত। 
নিঃশব্দে অন্য ঘরটার অন্ধকারে প্রবেশ করলাম। কোথাও কোনো শব্দ নেই। কেবল পাখা ঘোরার শব্দ। হাওয়ার ঝাপটায় নেটের মশারির দেওয়াল উড়ছে। মায়ের বুকের কাছে মেয়েটা তালগোল মেরে ঘুমিয়ে আছে। 

কী মনে করে আমি মশারির এ দিকটার বাঁধন খুলে ফেললাম। মশারিটা ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গিয়ে ঘুমন্ত দু’জনের গায়ে পড়ল। আমি অন্য ধার থেকে মশারিটা ওদের ওপর থেকে টেনে সরিয়ে নিলাম। হাতকাটা নাইটি পরে করবী মেয়েকে আঁকড়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। নাক ডাকছে ওর। নিথর হয়ে আছে করবীর নগ্ন বাহু। আমি সেই বাহু ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়িয়েও কেন জানি গুটিয়ে নিলাম। 
ওয়াশ বেসিনে এসে আরেকটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেট খেতে খেতে আয়নার মানুষটাকে লক্ষ্য করতে থাকলাম। বোঝার চেষ্টা করতে থাকলাম আয়নায় আমারই মতো দেখতে মানুষটা আসলে কে? 
বাইরে সমানে তখন আকাশ ফরসা হয়ে আসছে। 

পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments