জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে -৩৯/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৩৯

বাড়ির জন্য মন অস্থির হয়ে উঠেছে। বকুল ফোন করে জানিয়েছে, সামনের সপ্তাহে বাড়ি আসতে পারে । বাড়ি মানে মামাবাড়ি। এদিকে ভাড়াটিয়ারা নেই, ট্যাঙ্কে জল ভরে যায়নি। কাজের মেয়ে গাছে জল দিতে পারছে না। এদের কমন সেন্স বলে কিছু নেই। যাই হোক লন্ডন থেকে ফিরেছি গতকাল। আজ (২৭ মে) নতিংহামে আজ দলাইলামা আসেছেন, তাই এখানে বসবাস করা চিনারা প্ল্যাকেট হাতে নিয়ে সিটিসেন্টারে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
    আজ বারমিংহাম থেকে দীপের এক সিনিয়র দিদি রিমা, দাদা নীলাদ্রি আর  তাদের ছেলে আসবে জারাকে দেখতে। ওদের জন্য সকালে ডালপুরি আর আলুরদম বানালাম। দুপুরের রান্না আমি আর দীপ দুজনে মিলে করলাম। ও সরষে ইলিশ করল।  আমি মাটন ,আলুভাজা, আনারসের চাটনি, মুগেরডাল, বাঁধাকপির ঘণ্ট বানালাম। এখানকার বাঁধাকপি কলার মোচার মত লম্বাটে ও সূচলো, পাতাগুলো কোঁকড়ানো। আর একটা জিনিসেরও বাঁধাকপির মত স্বাদ, ভিতরটাও তাই, সাইজ  আমড়ার মত। একটা মোটা দণ্ডের গায়ে অনেকগুলো করে ফলে থাকে। এই সবজিটিকে ‘স্প্রউটি’ বলা হয়। ‘স্প্রাউট’ থেকে ‘স্প্রাউটি’। আমার এই এক দোষ, আবার ‘ধান ভাঙ্গতে শিবের গান’ শুরু করে দিয়েছি। 

    যাই হোক, ডালপুরি আলুরদম খেয়ে ওরা যাকে বলে একেবারে ফিদা। শুনলাম রান্না পছন্দ না হলে নীলাদ্রি মুখের ওপর বলে দেয়। এটা ছিল সকালের খাওয়া, মানে ব্রেকফাস্ট। খাওয়ার পর আর একটা গাড়ি ভাড়া করে ওয়ালাটন  বেড়াতে গেলাম। ক্যাসেলটির ভিতরে একটি মিউজিয়াম রয়েছে, যা দেখে অনেক অনেক অচেনা, আজানা জিনিসের বিষয়ে জানলাম। ক্যাসেলের বাইরে কি নেই? দূরে একটা ঝিল দেখা যাচ্ছে, রয়েছে ডিয়ার পার্ক, কত্কমের গাছ, মস্ত বড় বড় সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ। এখানে নানারকম খেলাধুলাও হয়। আরও কী ছিল, দেখা হয়ে ওঠেনি ফেরার তাড়া ছিল বলে। আসলে লাঞ্চ করা হয়নি। 
    ফিরে এসে লাঞ্চের পর ওরা ঘুমিয়ে পড়ল। ওরা উঠল আটটার সময়। নিলাদ্রি তখনো ঘুমাচ্ছে। আমি ওদের রাতের খাবার খেয়ে যেতে বললাম। ডাল,  আলুসেদ্ধ মাখা, মাখন আর ডিমের অমলেট দিয়েই ওরা খাওয়া সারল। মাছমাংস  খেতে চাইল না। এখন নটার সময় সন্ধ্যা নামে। ওরা দশটার সময় রওনা দিল। নটিংহাম থেকে বারমিংহাম যেতে এক ঘণ্টার মত সময় লাগে। রিমা ড্রাইভ করে গেল। নীলাদ্রির ড্রাইভিং লাইসেন্স এখনো হয় নি। নীলাদ্রির মত দীপের আর এক  সিনিয়র দাদা আছে, নাম অনুপম। ওরা নরউইচে থাকে, নটিংহাম থেকে অনেকটাই দূর। তাছাড়া ওদের হাতে সময়ও কম। ওরা নিউজিল্যান্ড চলে যাচ্ছে, কয়েকদিনের মধ্যে রওনা হবে। তাই জারাকে দেখতে আসতে পারছে না। জারার জন্য খুব সুন্দর একটা ড্রেস পাঠিয়েছে। দীপ বলছিল, অনুপমদা, ফুলদি এদেশ থেকে চলে যাওয়া মানে এই দূরদেশে মাথার ওপর থেকে একটা ভরসার হাত উঠে যাওয়া।
    তমাল দত্ত নামে আর একজন বাঙালি ডাক্তার নটিংহামে এসেছে। ও একা এদেশে থাকত, সম্প্রতি ওর বউ দেবযানী(বনি) এসেছে ছেলে সানকে সঙ্গে নিয়ে। বাবলিরা প্রথমে যে কোয়ার্টারে উঠেছিল, তমালরা সেটাতে থাকছে। একদিন দীপ  বলল, লন্ডন থেকে স্টার টুরের বাস স্কটল্যান্ড যাচ্ছে। তমালরাও যাবে। আপনারাও বেড়িয়ে আসুন। লন্ডন যেতে হবে না। বাস বারমিংহাম হয়ে যাবে। সেইমত অনলাইনে একসঙ্গে তমালদের ও আমাদের দুজনের টিকিট কাটা হল। বনি ভাল গান করে। গোটা দুই বাংলাছবিতে প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে কাজ করেছে। তাই ও এদেশে থাকতে চায় না, ছেলেকে রেখে যাবে, সানের বয়স ৬/৭ হবে। ৭ জুন কস্টল্যান্ড রওনার দিন ভোরবেলা উঠে তৈরি হলাম দুজনে। একটা ট্রলি সুটকেসে শীতের পোশাকসহ সাড়ি জামাকাপড় নিয়েছি। ওখানে ঠাণ্ডা বেশি। আর  একটা ব্যাগে কিছু শুকনো খাবার আর ফল নিয়েছি। খাবার নেওয়ার প্রয়োজন হত না,আসলে স্টারটুর লাঞ্চ দেবেনা। যে হোটেলে থাকা হবে, তারা ব্রেকফাস্ট দেবে। এরা ডিনার দেবে।খান সাহেব এখানের খাবার খেতে পারবে না। তাই বাধ্য হয়ে চিড়ে, চিনি,দুধ নিতে হয়েছে। যে গাড়ি বুক করা হয়েছে তার ড্রাইভার জাবেদ গতরাতে ফোন করে জানিয়েছে, স্টারটুরের বাস যেখান থেকে আমাদের তুলবে, সেটা বারমিংহামের একটা হাইওয়ে। ওখানে পৌঁছাতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে। আমাদের সময় নিয়ে বের হতে হবে। এই কোম্পানি থেকে আমাদের সকাল ৮ টাতে হাইওয়ের পাশের রেস্টুরেন্টে পৌঁছাতে বলেছে। জাবেদ ৫টা ৩০ শে এসে গেছে। আমরা রেডি ছিলাম। প্রথম দিনের জার্নি কেমন হবে জানিনা, তাই সালোয়ার কামিজের অপর একটা হাল্কা সোয়েটার নিলাম। শালটা ব্যাগে রাখলাম।  তমালরা তখনও রেডি হয়নি বলে আধ ঘণ্টা মত অপেক্ষা করতে হল। ৬টার সময় গাড়ি রওনা দিল। এটা ৪ সিটের গাড়ি। তমালের ছেলে সানকে নিয়ে আমরা পাঁচজন। এ দেশে বাচ্চা কোলে নিয়ে বসা আইনত অপরাধ। বড় গাড়ি নিলে ভাড়া বেশি লাগবে। তাই সানকে কোলে নিয়ে বসলেও মাঝে মাঝে ওকে মাথা ঝুঁকিয়ে বসতে হচ্ছে।
    আমরা সময়ের অনেক আগেই পৌঁছে গেলাম। রেস্টুরেন্টে বসে কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে গল্প করতে লাগলাম। শুনেছি বারমিংহামে প্রচুর বাংলাদেশি বাঙ্গালিদের বাস। মাঝে মাঝেই একদল করে বিভিন্ন ধরণের মানুষ রেস্টুরেন্টে আসচ্ছে, বেরচ্ছে। এদের মধ্যে ভারতীয় বাংলাদেশী, পাকিস্তানিরাও রয়েছেন। একটা  অবাঙালি ভারতীয় পার্টি ঢুকল, মহিলাদের ঝলমলে সাড়ি দেখে মনে হচ্ছে এরা হয় কোন বিশেষ অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন, নয় অনুষ্ঠান থেকে ফিরছেন। এরমধ্যে আমাদের বাস এসে গেল এবং গাইড আমাদের চিনেও নিলেন। গাইড আমার হাত থেকে সুটকেসটা নিয়ে হাঁটা দিলেন। আমরা তাঁর পেছন পেছন গিয়ে বাসে উঠলাম। বাসের একেবারে পেছনের ৫ টি সিট আমাদের ৫ জনের। যেহেতু আমরা শেষে টিকিট কেটেছি, আবার বাসে উঠেছিও শেষে, তাই আমদের সিটও শেষে। আমরা গাঁইগুই করছিলাম। গাইড আশ্বস্ত করে বললেন, কোনও অসুবিধা হবে না। এসব বাস ঝাঁকুনি দেয় না। বাসের যাত্রীরা বললেন, অসুবিধা হলে আমরা সিট পাল্টা  পালটি করে বসব। কিন্তু তার প্রয়োজন হয়নি। বাসে ওঠার পর পরিচয় পর্ব শুরু হল। প্রত্যেক পরিবার থেকে একজন করে দাঁড়িয়ে নিজেদের সবার পরিচয়  জানালেন। সিট খুবই আরামদায়ক। কোন ঝাকুনি নেই। বরং ভালই হয়েছে, ৫জনে  একসঙ্গে বসে গল্প করছি, এটা সেটা খাচ্ছি।
  ইউকের ব্রিটেন, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও আয়ারল্যান্ডের মধ্যে স্কটল্যান্ড সবচেয়ে সুন্দর বলে শুনেছি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। লেক,পাহাড় আর জঙ্গল। চারিদিকে মনভোলানো দৃশ্যে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। নালার মত জলস্রোত গাছের ফাঁক দিয়ে বয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে লোকালয় পড়ছে। রাস্তার দুধারে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠগুলি দেখে বুঝতে পারছি না, কোনটা শস্যখেত আর কোনটা পশুচারণ ভুমি। শস্য কেটে নেওয়া নেড়া জমিতে পলিথিনে বাঁধা বড় বড় বান্ডিল পড়ে রয়েছে, এগুলো গম না রেপসীড, বুঝতে পারছিনা। ঘণ্টাদুই পরে একটি রেস্টুরেন্টের সামনে বাস দাঁড়াল। সবাই নেমে কেউ ওয়াসরুম গেলেন, কেউ খাবার অর্ডার দিলেন। ৩০ মিনিট পর আবার বাস ছুটতে শুরু করল। শুনেছিলাম স্কটল্যান্ডের এনভারনেস ইউরপের সবচেয়ে উচু স্থান। পাহাড়ি পথবেয়ে বাস ওপরে ওঠে। শুনে ভয় পেয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম দার্জিলিং, উটি বা তিরুমালার মত পাহাড়ের গা’বেয়ে বাস ওপরে উঠবে। আমার বোঝায় ভুল ছিল। আসলে স্কটল্যান্ডের  সম্পূর্ণ ভুমিই ধিরে ধিরে উচু হয়েছে। দুপুর ১টা নাগাদ বাস এসে পৌঁছাল ব্ল্যাকপুলের প্লেজার বিচে। গাইড বললেন, বাস আমাদের শীবিচ ঘুরিয়ে এনে কারপার্কে নামিয়ে দেবে। এখানে বিকেল সাড়ে ছটা পর্যন্ত থাকা হবে। বাসে ওঠার আগে এখানেই ডিনার করানো হবে।
                 
                                ক্রমশ

 পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments