জ্বলদর্চি

আফসার আমেদ /বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

(বাংলা ছোটোগল্পের ইতিহাসের দিকে তাকালে দ্যাখা যাবে, মাঝে মাঝেই বাঁক বদল হয়েছে তার। বিষয়— আঙ্গিক সমস্ত দিক থেকেই বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে। আর এই বদলের সঙ্গে গভীরভাবে সংযোগ রয়েছে সময়ের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে বিশ শতকের পঞ্চাশের বছরগুলিতে লিখতে আসা গল্পকারদের নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু পঞ্চাশ-পরবর্তী ছোটোগল্প ও গল্পকারদের নিয়ে তেমন আলোচনা আমাদের নজরে আসেনি। কিন্তু এই সময়ে বাংলা ছোটোগল্প বৈভব ও ঐশ্বর্যে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে। এই সময়-পর্বে লিখতে আসা নির্বাচিত লেখকদের চারটি করে গল্প নিয়ে বিন্যস্ত হবে এই আলোচনা। কিন্তু ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় আলোচনা সম্ভব হবে না। বিভিন্ন সংখ্যায় বিভিন্ন সময়ের গল্পকার উঠে আসবেন। এভাবেই বাংলা গল্পের অভিমুখকে চিহ্নিত করবার চেষ্টা করা হবে।)

বাংলা গল্পের পালাবদল— ১৪   


আফসার আমেদ 

বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

সত্তরের বছরগুলিতে লিখতে আসা সাহিত্যিকদের মধ্যে বয়সের দিক থেকে সবচেয়ে কনিষ্ঠ সম্ভবত আফসার আমেদ (১৯৫৯-২০১৮)। পশ্চিমবঙ্গের যে অল্প কয়েকজন লেখকের লেখার প্রধান উপজীব্য মুসলিম সমাজ ও মুসলিম মানস তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন আফসার আমেদ। তাঁর ছোটোগল্পগুলিতে নিখুঁতভাবে ধরা আছে এ বঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায়ের যাপনচিত্র। অমুসলিম চরিত্র, জীবন নিয়ে যে তিনি গল্প লেখেননি তা নয়, কিন্তু তার পরিমাণ তুলনায় কম। মুসলমান সমাজের এমন কিছু সমস্যা আছে যা বিশেষভাবে চিনিয়ে দেয় তাদের ধর্মচেতনাকে। এই সমস্যাগুলিকে আফসার তাঁর গল্পের বিষয় করে তুলেছেন।  

উল্লেখ করা যেতে পারে ‘আদিম’ (‘পরিচয়’, শারদীয় ১৯৮১, ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’, আফসার আমেদ, দে’জ পাবলিশিং, ১৯৯৯) গল্পটি। বাপ ইজ্জত আলি আর ছেলে কায়েম আলি— দুজনের দুটি ঘর পাশাপাশি। ইজ্জত স্ত্রীর মৃত্যুর তিনমাসের মধ্যে আজনগাছির খবির মল্লিকের সেজ বেটি সাবেরাকে বিয়ে করে আনে। ছেলেকে জিজ্ঞেস করেনি। কায়েমও এ নিয়ে কোনও কথা বলেনি। বিয়ের পরদিন ইজ্জত মাঠে কাজের ফাঁকে মুড়ি খেতে খেতে ছেলেকে জানিয়েছে, “তোর মা এল”। বিরক্ত হয়নি কায়েম, বরং বাড়িতে কুটুম এসেছে বলে বাপের নির্দেশে তাড়াতাড়ি মাঠ থেকে এসেছে মাছ ধরবে বলে।  

কায়েমের শ্বশুরবাড়িও সেই আজনগাছি। কায়েমের বউ হাফেজার সঙ্গে সাবেরার বাপেরবাড়ি থাকতে ভাব ছিল খুব। সাবেরা এখানে এসে পুরনো সঙ্গীকে পেয়েছে। শাশুড়ী বউয়ে খুব ভাব। দুজনে বেশ হাসিখুশিতে থাকে। “আসলে সাবেরা মা নয় শাশুড়ী নয় সে একজন বউ। হাফেজা ছিল বলে যেন বেঁচে গেল। দুজনের অনেক হাসাহাসির কথা হয়। কখনো হাফেজা কিল মারে তো নতুন বউ আঁচলের ফাঁকে এদিক-ওদিক তাকিয়ে খামচে দেয় যেখানে-সেখানে। আসলে দুটিতে আগে এরকমই ছিল। আজ রঙিনতায় উদ্ভটভাবে মুখোমুখির ফলে পিরিত আরো জমে উঠেছে।”

কায়েমের মুখোমুখি হলে সাবেরা লজ্জায় সেঁধিয়ে যায়। তারই মধ্যে আম গাছের উপর থেকে কায়েম দেখতে পায় সাবেরার ঠোঁটের কোনায় মাছির মতো তিল অসম্ভব তেলালো। কারো কারো খয়েরি হয়, এটা একেবারে মিশকালো। গাছ থেকে নেমে আসা কায়েম বউ হাফেজার ঠোঁটে তিল খোঁজে। কিন্তু ঠোঁটে নয়, কায়েম তার বউয়ের থুতনিতে তিল আবিষ্কার করে— “ও বউ তোর থুতনিতে তিল কোথা থেকে এল?” এতদিন হাফেজার আস্ত শরীরটাকে নিবিড়ভাবে অনুভব করেও এই নিখুঁত কারুকাজ চোখে পড়েনি তার। হাফেজা তাকে জানায়—“তুমার মায়ের ঠোঁটে আছে। তিল নয় জরুল, কালো চিংড়িমাছের চোখের মত।”
রাতে মিলনের সময় কায়েম হাফেজার থুতনিতে হাত দেয়। তিলের কোনও অবয়ব খুঁজে পায় কিনা স্পর্শ করে। হাফিজা ফিসফিসায়— “আঁধারে কি তিল খুঁজে পাবে নাকি?” তিল ঠাওর করা যায় না, কিন্তু অন্ধকারে জড়ুল বোঝা যায়। কে জানে সে সাবেরার জড়ুলই হয়তো খুঁজছিল। বাড়ির ছিটেবাড়ার দেওয়ালে কাদা ধরাতে গিয়ে, কাদা ছানতে গিয়ে কায়েমের চোখে পড়ে তার একফোঁটা মাকে। পেছন থেকে বাঁপাশের ঠোঁটদুটো দ্যাখা যায়। জড়ুলটা দেখতে পায় না। ডানপাশে আছে নিশ্চয়ই। 

বউকে জিজ্ঞেস করে— “কুন দিকের ঠোঁটে জরুলটা আছে গো, বউ, নীচের ঠোঁটে না ওপরে ? বাঁইয়ে না ডাইনে ?” হাফেজা জানায় ডানদিকের ঠোঁটে। এরপর অন্ধকারেও বুঝি চোখ জ্বল জ্বল করে তার। হাফেজার বুকে মুখ গুঁজে ধীরে ধীরে তর্জনীটা চিবুকের কাছে নিয়ে যায়, তিলটার অবয়ব স্পর্শ করার নেশায় পায় যেন। আলো থাকলে অন্তত দেখতে পেত।   

বাজারে কেরোসিন পাওয়া যাচ্ছে না। বাপ-ব্যাটা দুজনেই পরেরদিন বিকেলে পাশের গাঁয়ে কেরোসিন আনতে যায়। দুজনেরই শ্বশুরবাড়ি ওখানে। সেখান থেকেও ঘুরে আসবে। কে জানে রাতে সেখানে থেকে যাবে কিনা।  

আর এদিকে দুই বউ উঠোনে মেতে ওঠে পুরনোদিনের রঙিন গল্পে। তারপর আকাশের তলায় শুয়ে থাকে চুপচাপ। দুজনে গা ছুঁয়ে থাকে দুজনে। শুয়ে পড়লে দিক নির্নয় করতে বিভ্রম লাগে। তন্দ্রায় আরও কত ভুল হয় মানুষের। হাফেজা সাবেরাকে ঘুম থেকে তুলে দাঁড় করায়। 

“সাবেরা ঘুম থেকে উঠে নিশি পাওয়া মেয়েমানুষের মত তড়বড় পা ফেলে চলেছে। ঘুম পেয়েছে খুব তাই তড়বড়িয়ে চলে গেল হাফেজাকেই ফেলে। হাফেজার অন্ধকারে চোখ জ্বলে না। এদিক না ওদিক ? এদিকেই। ঘরে ঢুকে ভুল হয়, সাবেরা সে বিছানায় শুয়ে আছে। তারই ভুল। ঢুলতে ঢুলতে পাশের ঘরে বিছানা হাতড়ে শুয়ে পড়ে হাফেজা। শুলে কি আর জ্ঞান থাকে নাকি, নিঃসাড় অতল ঘুম।”

শ্বশুরবাড়িতে খেয়েদেয়ে অনেক রাতে কেরোসিনের টিন হাতে অন্ধকারে বাড়ি ফেরে বাপ-ব্যাটা। কোনোদিকে না তাকিয়ে যে যার ঘরে চলে যায়। হাফেজা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। কায়েম শুয়ে পড়ে পাশে। তার তন্দ্রায় বরফ জমে।

“হাফেজার হাত এসে পড়েছে কায়েমের বুকে। ধীরে ধীরে সে শিহরণ নিঃশব্দে রসায়ন বিক্রিয়ার মত দানা বাঁধে। কায়েম আবেশে হাফেজার বুকে মুখ লুকোয়। হাফেজা ঘুমোয় অথচ সাড়া দেয়। কায়েম কি ঘুমোয় না! ঘুম নয় ঠিক, ঘুমের আমেজ। অথচ তৃপ্ততার পূর্ণতায় এগিয়ে যাচ্ছে। অপেক্ষায় সাড়া পেয়ে এমন যত্নে এগিয়ে যায় যার বিকল্প নেই। অথচ হাফেজা ঘুমোয়। হাফেজা ঘুমোয় তো কিছু এসে যায় না। কায়েমের তন্দ্রায় উজ্জ্বল রং-বে-রং স্ফটিক ঠুং ঠাং বেজে চলুক। শূন্যতায় আঁধারে সেই হাফেজার তিলের স্পর্শ পেতে চায়। কোনও অবয়ব নেই অথচ স্পর্শ পাবার তর্জনী, ইচ্ছায় ঘোরাফেরা করে। এই চোখ। মুখ কপাল। চিবুক। ঠোঁট। ঠোঁট। ঠোঁট। হাত অসাড় হয়ে যায়। ঠোঁটে কি না থুতনিতে ? স্পর্শ পাওয়া যায় না। হয়ত ঠোঁটেই। তাই কি। মাথায় সব গোলমাল ঠেকে। ঠোঁটে তো নয়, থুতনিতে। তবে ঠোঁটে কেন ? ভাল করে পরখ করে। ঠোঁটের উপকণ্ঠে কোনো অবয়ব তর্জনীতে ঠেকেছে। জরুল। আশ্চর্য! ঠোঁটের ডান দিকের জরুলটা সাপ ছোঁয়ার মত ছুঁয়ে দেয়। এক্কেবারে নিঃসাড় হয়ে যায়।”

মেঝেতে বসে অনেকক্ষণ ঝিম মেরে থাকে কায়েম। ধীরে ধীরে মাথাটা হাল্কা হয়। বিছানার রমণীও বুঝি চিনতে পারে তাকে। কারো কোনও দোষ নেই। “আসলে বসবাসই আদিম গুহা। আকঙ্খা এখানে বদ্ধ হয়ে আছে।”

তিলের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করত কায়েম। তিলের জন্য এই আকর্ষণ, নাকি জড়ুলের জন্য! অবচেতনে হয়তো তিলের মাধ্যমে সে পৌঁছোতে চাইত জড়ুলের কাছে। সচেতনভাবে সেখানে যাওয়া যায় না। তাই অবচেতনে যাত্রা। আদিমতা আকাঙ্ক্ষা সবই তো অবচেতনে থাকে। সময়-সুযোগ মতো বেরিয়ে আসে গুহা থেকে। অবচেতনের সুপ্ত বাসনা এভাবে পূর্ণতা পাবে তা জানা ছিল না। তাই তো বোঝার পরে এভাবে নিঃসাড় হয়েছিল কায়েম। হতচকিতও। এরমধ্যে কোনও পাপবোধ নেই। থাকতে পারে না। বরং এক অনাস্বাদিত অনুভবে পূর্ণতা পেয়েছে কায়েম। কে জানে তার শয্যাসঙ্গিনী ‘মা’ও হয়তো একইভাবে পুলকিত। পাশের ঘরের কথা কায়েমের মনে না পড়লেও পাঠকের মনে পড়ে। সেঘরেও একইভাবে কায়েমের যুবতী বউ তার বৃদ্ধ বাপের শয্যাসঙ্গিনী হয়েছে আজ। যদিও-বা এসব ঘটেছে অজান্তে। ঘুমে— তন্দ্রায়— অচেতনে— ঘটনা পরম্পরায়— অনিবার্যভাবে।   

যৌনতা বারবার বিষয় হয়ে উঠেছে তাঁর গল্পে। গ্রামীণ দরিদ্র মুসলিম মানসের প্রেম-যৌনতার বিচিত্র বর্ণিল স্তরগুলিকে আলোকিত করেছেন তিনি। একটু সচেতন থাকলে বোঝা যাবে যৌনতা তাঁর চরিত্রগুলিকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে। চরিত্রদের প্রাত্যহিকতায় লগ্ন হয়ে রয়েছে তাদের যৌনবোধ। বহু চরিত্রের ব্যক্তিত্বও যৌন-নিরপেক্ষ নয়।    

‘সমুদ্রের নিলয়’ (‘পরিচয়’, শারদীয় ১৯৮৮) গল্পেও স্বামী-স্ত্রীর বয়েসের ব্যবধান। পঞ্চাশ পেরোনো গহর আলি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে আঠারো বছরের আলেয়াকে। প্রথম পক্ষের বিবি লালমনের চোদ্দটা ছেলেমেয়ে। আলেয়া লালমনকে বড়বুবু বলে।

গহর একজন প্রবীন পুরুষ। আলেয়া ভাবে তার বাবা বেঁচে থাকলে তার বয়স গহরের থেকেও কম হত। গহরের বড়ো ছেলে সাজু তারও ছেলে। সেই ছেলে আলেয়ার থেকেও বড়ো। সে ‘ছোটমা’ বলে ডাকলে তার ভেতরটা কেঁপে ওঠে। নিপাট এক জননীভাব ফুটিয়ে তুলতে হয় গম্ভীরভাব। পরিণত বয়স্কা হয়ে ওঠে সে। সাজুর সে মা— এটা প্রকাশ করতে হয়। এভাবে কচি মেয়েরা অকালে মনেপ্রাণে প্রবীণ হয়ে ওঠে। উঠতে হয়। 

সমুদ্র-উপকূলবর্তী সুন্দরবন অঞ্চলের পটভূমিতে লেখা এই গল্পে যে সমস্যা উঠে এসেছে তার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এই বয়স, অকাল প্রবীণতা এবং সম্পর্কের বিষয়টি। গহরের সংসারে আলেয়া সুন্দরভাবে জড়িয়ে আছে। দুটি সন্তানও হয়েছে তার। এরমধ্যে সেই দ্বীপে এসে হাজির হয়েছে আলেয়ার পূর্ব প্রেমিক গাজি। খালাতো ভাই গাজির সঙ্গে তার ভাব ছিল। মেটেবরোজের মুদির দোকানে কাজ করে গাজি। মাঝে মাঝে আসত। এলেই হয়তো মনে পড়ত আলেয়াকে। আবার যখন কলকাতা চলে যেত তখন বুঝি মনেও পড়ত না। এই ফাঁকে গহরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তার। এতে আলেয়া ভেবেছে গাজির প্রতি প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে। এখন গাজি এসে রেডিও বাজাতে বাজাতে গেলে তার ইচ্ছে করে দ্যাখা করতে। কিন্তু ঘর থেকে বেরোয় না। গহরের বিরাটত্বের মধ্যে স্বেচ্ছা-সমর্পিত সে। এই সংসারে তার কোনও কষ্ট নেই। “গহর তাকে বিয়ে করে তার মধ্যে যে প্রবীণতা জুড়ে দিয়েছে, সেই অবস্থার মধ্যে আলেয়া সমর্পিত থাকতে চেয়েছে।” গাজিকে তাই এড়াতে চায়। 

তাদের বড়ো ছেলে সাজু পৃথক থাকে। সাজুর বাড়িতে যাতায়াত করতে দ্যাখে গাজিকে। সাজুর বাড়িতে বসে তাকিয়ে থাকে তাদের বাড়ির দিকে। আলেয়াকেই দেখতে চায় গাজি। তাই ধারণা ছিল আলেয়ার। কিন্তু একদিন সে আবিষ্কার করে, তাকে নয়, তাদের বড়ো মেয়ে মাসুরাকে দেখছে গাজি। মাসুরাও দ্যাখে তাকে। সম্পর্কে আলেয়া মাসুরার মা। তার ভেতরটা কেঁপে ওঠে। ছটফট করে ওঠে সে। মাসুরাকে গাজির কবল থেকে রক্ষা করতে চায়। কিন্তু তার উপায়ও থাকে না কিছু। পূর্ব-প্রেমিকের প্রতি এখনও যে টানটুকু ছিল তার মধ্যে ঢুকে পড়েছে মাসুরা। বিপন্ন অসহায় আলেয়া ঘাটে এসে কাঁদতে বসে।  

“সমুদ্রের জলের মত, চোখের জল তার ঠোঁটে পড়ে, লবনাক্ত স্বাদ পায়। সমুদ্রের নোনতা স্বাদ শুধু নয় সমুদ্রের মত বিশাল আকাঙ্ক্ষা বোধ করে আলেয়া। ধীরে ধীরে কেঁপে উঠছে তার শরীর। ঠোঁট নড়ে। বুকে ভার লাগে। থেকে থেকে ধাকাচ্ছে বুক। নরম জ্যোৎস্না। চারদিক হিমেল হাওয়া। জোনাকি, কুয়াশা—দূরে সমুদ্রের নিলয়। সেদিকে তাকিয়ে থাকে সে।”

পূর্ব-প্রেমিক তো স্বামীরতুল্য। সেদিক থেকে দেখলে মাসুরা গাজিরও কন্যাতুল্য। আলেয়া মনে করে এক অসম বিয়ে— অসম সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে মাসুরা ও গাজি— তার মেয়ে ও প্রেমিক। অথচ তার কিছু করার থাকছে না। সে বাধা দিতেও পারে না। কারও কাছে প্রকাশ করারও সাধ্য নেই তার। প্রকাশ করলে স্বামীর কাছে, পরিবারের কাছে ধরা পড়ে যাবে। এদিকে যে গাজিকে, প্রেমিককে সে পেল না, তাকে তার মেয়ে মাসুরা জয় করে নিতে পারল। গাজির প্রতি এখনও যে তার মধ্যে একটা তীব্র আকর্ষণ আছে এই ঘটনায় সেই সুপ্ত আকর্ষণ স্পষ্ট হয়েছে। সেই আকর্ষণও সমুদ্রের মতো অবাধ। এই যন্ত্রণাও কম নয়। অব্যক্ত যন্ত্রণা অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে। সেই অশ্রুও সমুদ্রের মতো ব্যাপ্ত।   

‘জিন্নত বেগমের বিরহমিলন’ (‘পরিচয়’, গল্পসংখ্যা ১৯৮১) গল্পে দরিদ্র মুসলিম বধূদের বিরহযন্ত্রণার ছবি তুলে ধরেছেন আফসার। দারিদ্র্যের কারণে এ গাঁয়ের পুরুষরা সব শহরে চলে যায় কাজ করতে। মাসে-মাসে হপ্তায়-হপ্তায় আসে না। বছরে এক-দুবার আসে। আর বছর-বিয়োনি বউদের পেটে বাচ্চা দিয়ে চলে যায়। নিয়মিত টাকাও পাঠায় না। শহর তাদের যাদু করে রাখে। বড় কষ্টে দিন কাটে যুবতী বধূদের। শুধু তো পেটের খিদে নয়। যৌনতার জ্বালায় ছটফট করে তারা। দিনটা যদিও-বা কেটে যায় কোনোক্রমে, রাত কাটানো দুষ্কর হয়ে ওঠে— “হা সন্ধে হা রাত্তির, বোঝা বুক লিয়ে কাটাই।” 

জিন্নত বেগমও এই গাঁয়েরই বউ। ভরা যৌবন তার। মাত্র ছ-মাস হল বিয়ে হয়েছে। প্রথম দুমাস তার বর ফি-শনিবার বাড়ি আসত। চারমাস আর আসে না। চিঠিও না। সদ্য বিবাহিতা যুবতী জিন্নত স্বামী-সান্নিধ্যের জন্য হা পিত্যেশ করে। ভরভরন্ত শরীর নিয়ে ‘ছেনালিপনা’ও করে কত রকম। খেজুর গাছে জিরেন দেওয়া আসাদ বক্সকে বলে— “হুই গো রস খাওয়াবে ?” সে বলে রসের সময় গাছের নীচে এলে রস পাওয়া যাবে। জিন্নত-এর উত্তর—“সারাবছর রস দিতে পারে নাই কেনে ?” বা “জিরেন, না ক্ষেমতা নাই ?” আবার, গ্রামের জোতদার জিয়াদ শুকটি তাকে ধান চালের কাম দিতে চাইলে বলে, শুধু চাল-কলাই-গেঁহু নয়, “আমারে আরো দিতে হইব।” জিয়াদ আর কি জানতে চাইলে বলে, “খুশ হইয়ে যা দিবা।”


কিন্তু এই ছেনালি করে তো যৌনতা মেটানো যায় না। অন্য মেয়ে বউকে পুরুষদের আদর করতে দেখলে তার বিরহ যন্ত্রণা আরও বাড়ে— “সোহাগ করতি দেখলে সোহাগ খায়তে মন যায়রে। জান হু হু কইরবে। পায়ে হাতের দড়ি যেন ছিঁড়িছিঁড়ি কইরব। কেঁদে ফেলব। কান্না যেন সব কষ্টের সাঙাত-সই।”  

আর এই জিন্নতের চোখে পড়ে নানান নারী-পুরুষের সোহাগের দৃশ্য। জিয়াদ শুকটির কলকাতাইয়া সেজ বউকে ছোটো বিবি ধরে মারার পর একান্তে ক্রন্দনরত সেজ বউকে জিয়াদের জোয়ান লেড়কাটা আদর করে, বুকে বুক মিশিয়ে দাঁড়ায়, মাকে চুমু খায় ছেলে। এই দৃশ্য দেখে জিন্নত হাসি সামলাতে পারে না। জিয়াদের বড়ো খোকা তার কাছে এলে সে বলে— “তর সৎ মায়ের মুয়ে চুমু খাস, শরীল ডইলে দিস, তবে মোকে কেনে ক্ষ্যাপাস। মোর শরীল, শরীল লয় ?” জিন্নতের সই কুলশনের ছেলে হবার পর তার মরদ এসে আদর করলে তাও চোখে পড়ে তার। কান্না বেরিয়ে আসতে চায়। 

জিয়াদের খোকার সঙ্গে তার সৎ মায়ের প্রেম-সম্পর্ক, যৌন-সম্পর্কের মূলেও মুসলমান সমাজের একাধিক বিয়ে এবং তার ফল হিসেবে স্বামীর সন্তানের সঙ্গে বধূর বয়সের ঘনিষ্টতা ক্রিয়াশীল। 

স্বামীর জন্য নিজেকে সাজিয়ে রাখে। চুড়িওয়ালির কাছ থেকে ‘সোয়ামি-জাগানো চুড়ি’ পরে দুহাত ভরে। তারপর শনিবার অনেক রাত পর্যন্ত শিমুলতলার ঘাটে নদীর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কারো কারো স্বামী আসে নৌকোয়। তার আসে না। সে একা দাঁড়িয়ে থাকে বৃথা আশা নিয়ে। অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মাথা ঘোরে তার। আর তখনই বাঘের মতো জিয়াদ চাচা তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় কাঁটা ঝোপে। জিয়াদের বোবাকালা বোঙা চাকরটাই ঘরে এনে তোলে তাকে। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় সে দ্যাখে তার পাশে এসে শুয়েছে তার বর।

আফসারের গল্পে একটা বড়ো যায়গা জুড়ে আছে দারিদ্র্য। দারিদ্র্যের কারণেই তো গ্রামের পুরুষদের বউ ছেড়ে শহরে যেতে হয়েছে। নিয়মিত আসতেও পারে না রোজগারে ঘাটতি পড়বে বলে। কুলশন পেটে বাচ্চা নিয়েও দিনের পর দিন না খেয়ে কাটিয়েছে। পর পর দুটো মেয়ে বিইয়েছে বলে শাশুড়িও দ্যাখে না। শাশুড়ির ধারণা এই কারণেই তার ছেলে বাড়ি আসে না। প্রসবের পরে সদ্যজাত শিশুর মুখে মধু দিতে বললে তার শাশুড়ি নুন দিতে চায়। আবার ছেলে হয়েছে শুনে পড়িমরি করে দৌড়ে যায় মধু আনতে। কুলশনের বর বহুদিন পরে বাড়ি আসে পুত্র সন্তান হওয়ার পর। পুত্র-সন্তানের প্রতি আকর্ষণ এখনও আছে গাঁ-ঘরে। আর ছেলে না হলে অদ্ভুত এক অপরাধ নিয়ে সর্বদা থাকতে হয় মায়েদের। এই গল্পের প্রধান সমস্যা দারিদ্র্যের সঙ্গে লগ্ন হয়ে আছে। আর দ্যাখা যাচ্ছে, এই দারিদ্র্যের বলি হচ্ছে প্রধানত মুসলিম মেয়েরা। পুরুষরা দারিদ্র্যের আঁচ থেকে নানাভাবে নিজেকে অনেকটা মুক্ত করতে পেরেছে। নারীরা পারেনি। অনবরত দগ্ধ হচ্ছে সেই আগুনে।   

আফসারের বহু গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষের ধর্মবোধ ও ধর্মচেতনা। মুসলমান সমাজে কোরানের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারও কারও দৈনন্দিন জীবনচর্যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে থাকে কোরান সচেতনতা। শুধু মৌলানাদের মধ্যে কোরান-বিশ্বাস গভীরভাবে থাকে তা নয়। সেভাবে ধর্ম-নির্ভর জীবন যাপন করেন না এরকম বহু মুসলমানের বোধেও উদগ্র হয়ে থাকে কোরান-বিশ্বাস। ‘রক্তলজ্জা’ (‘প্রতিক্ষণ’, আগষ্ট ১৯৯১) গল্পের কেন্দ্রে আছে কোরানের প্রতি অটুট বিশ্বাস।  

বরের অনুপস্থিতিতে ফতিমা তার চাচাতো দেওর হাসানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে প্রেম সম্পর্কে। হাসানের প্রতি অসম্ভব মুগ্ধতা তার। প্রতি মুহূর্তে হাসানের প্রতি নতুন আকাঙ্ক্ষা আলোড়িত করে তাকে। ভুল-নির্ভুল পাপ-পুণ্য এই ভেদরেখাটা মুছে দিয়েছে ফতিমা। হাসানকে সে শুধু ভালোবাসার বিনিময়ে শরীর দিতে চায়। আর কোনও কিছুর বিনিময়ে নয়। হাসানের সঙ্গে ফতিমার সম্পর্কের মধ্যে অদ্ভুত এক গোপনীয়তা থাকে। তাই শাকিল তার স্বামী। আর সেলিনা হাসানের বউ।  

হাসানের প্রতি প্রেম শুধু চোখের দ্যাখায় থাকে না। শরীরের ভেতরও ফতিমা নতুন করে খুঁজে পায় প্রেমকে— “স্তনাগ্রের ওপর স্পর্শের উত্তেজনা স্তন জুড়ে সারা বুকে ছড়িয়ে পড়ে, জননে স্পর্শ জনন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, সারা শরীরে। আশরীর প্রেম।”  

তবু শাকিল তার স্বামী। শাকিলকে সে যত্ন করে খেতে দেয়। তার জন্য রান্না করে তৃপ্ত হয়। গায়ে জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরলে ফতিমার মনটা হাহাকার করে ওঠে। শাকিলের বুকে ধরা দিতে চায়। আবার পাশের বাড়ির হাসানের গলাঝাড়ার শব্দ ফতিমাকে কত যে কাঁপায় তা শাকিল জানে না। 

ফতিমাকে অধিকার করে হাসান জয়ের আনন্দ অনুভব করে। সে চেয়েছিল ফতিমার আত্মসমর্পন। কিন্তু তার মধ্যে এতটা ব্যাকুলতা আসবে আগে ভাবেনি। হাসানের প্রেম দেহসর্বস্ব। প্রথম থেকেই বাহুপাশে বেঁধে ফেলতে চায় হাসান ফতিমাকে। ফতিমার সঙ্গে প্রেম সম্ভাষণ অসহ্য লাগে তার। তবু ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলতে হয়। আল্লার কসম খেয়ে বলে ফতিমার প্রতি তার ভালোবাসার কথা। ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে মেরে ফেলতেও চায় সে ফতিমাকে। আর ফতিমা প্রেমালাপে ভরে উঠতে চায়। শরীর নিয়ে ফুরিয়ে যাক, চুকেবুকে যাক চায় না। এদিকে হাসান ফতিমার সঙ্গে প্রেমে জাগতে পারে না। শরীর শরীরই। যে সময় শরীর পায়, সেখানেই শুরু সমাপ্তি হয়। 

তাদের গোপন মিলন একদিন ধরা পড়ে যায়। রাত্রিবেলা হাসানকে ফতিমার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে হাসানের মেজভাবি সখিনা। হাসান অস্বীকার করতে চায়। সে আল্লার কসম খেয়ে বলে ফতিমার ঘরে যায়নি। শুধু তাই নয় কোরান স্পর্শ করে বলে, “তোমরা ভেবেছ ফতিমার সঙ্গে আমার খারাপ সম্পর্ক আছে— নেই। আমি রাতে ওর কাছে যাই নি। এই কোরান ছুঁয়ে বলছি, যাই নি, যাই নি, যাই নি— তিন সত্যি।”

ফতিমার কানে যায় কথাটা। তাকে ভালোবাসার কথা এতদিন বলেছে আল্লার কসম খেয়ে। সেই লোকটা আল্লাকে নিয়ে ছেলেখেলা করে, কোরান নিয়ে শয়তানি করে! কোরান বিশ্বাসী ফতিমা যন্ত্রণায় দীর্ণ হয়। বালিশের ভিতর একরাশ কান্না গুঁজে দেয়। কোরান ছোঁয়া আর হাসানকে ভালোবাসা এই দুয়ের দ্বন্দ্বের গোলমালে পড়ে যায় ফতিমা। সেও চায়নি তাদের গোপন প্রেমের প্রকাশ ঘটুক। হাসান যদি গলা ফাটিয়ে অস্বীকার করত তাতেও প্রেম থাকত ফতিমার মধ্যে। কিন্তু সে যে কোরানের অপমান করেছে!  

কত রাত হল খেয়াল থাকে না ফতিমার। তার চোখের উপর উঠে আসে কোরানের বর্ণমালা, পৃষ্ঠা, বাক্য, অনুচ্ছেদ। বাইরের ঝড়ো বাতাসে ঘরের জানলা খুলে যাওয়ার আতঙ্কে পাল্লা দুটো জোরে বন্ধ করে। দুই পাল্লার ফাঁকে চেপে যায় ডান তর্জনী। তর্জনী রক্তাক্ত হওয়ার আঘাত তার কাছে ম্লান হয়ে গেছে এখন। রক্তাক্ত হাতে কোরান পাঠ করতে বসে সে। “কোরানের পৃষ্ঠায় ডানদিক থেকে বাঁদিকে বর্ণমালার নীচে ডান তর্জনী বুলোয় ফতিমা।” 

এতদিনের সযত্ন লালিত প্রেম মুহূর্তে ছারখার হয়ে যায়। কোরানের প্রতি প্রিয় পুরুষের অপমানে সেও অপমানিত বোধ করে। কোরানকে বেশিবেশি করে আদর করে। ডুবে থাকতে চায় এই মহার্ঘ গ্রন্থটির মধ্যে। নিজেকে লীন করে দিতে চায় কোরানের মধ্যে। কোরান-বিশ্বাস তার জীবনবোধটাকেই বদলে দিল। মুহূর্তে ছারখার হয়ে গেল এতদিনের সযত্ন-লালিত প্রেম। এই গল্প বিশেষভাবে মুসলিম জীবনেরই গল্প। 

আফসার আমেদের অধিকাংশ গল্পই লেখা হয়েছে গ্রামীণ পটভূমিতে। গ্রামীণ চরিত্রদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত-দরিদ্র। তবে শুধু দারিদ্র্য নয়, তাদের প্রাত্যহিকতার নানা প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন আফসার। রক্ষণশীলতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, স্বার্থের প্রয়োজনে ধর্মের অপব্যবহার, মৌলানাদের ব্যক্তিজীবনের কলুষতা, যৌনতা, অসম প্রেম ইত্যাদিও উঠে আসে তাঁর গল্পে। মুসলিম গৃহবধূরা তাঁর গল্পে স্বতন্ত্র জায়গা করে নিতে পেরেছেন। নারীর ব্যক্তিসত্তার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাস করেন আফসার। সেই বিশ্বাসবোধ থেকেই মুসলিম সমাজের নারীদের স্বতন্ত্র সত্তার স্বীকৃতি জানিয়েছেন তাঁর গল্পে। ধর্মের যে একটা সামাজিক প্রভাব থাকে মানুষের প্রাত্যহিকতায়, সেই সমাজ বাস্তবতাকে তুলে ধরেন তিনি তাঁর লেখায়। আর তুলে ধরতে গিয়ে শিল্পের ক্ষেত্রে কোনও রকম আপোষ করেন না। তাই শেষ পর্যন্ত সেগুলি শিল্প হয়ে উঠেছে। গল্প হয়ে উঠেছে। আফসার আমেদের গল্পের সার্থকতা এখানেই।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments