আষাঢ়ে গল্পের আল ধরে --১৩
তন্দ্রা ভট্টাচার্য্য
পুরাতন প্রেম নতুন ফ্রেমে
"পুরাতনকে বিদায় দিলে না যে
ওগো নবীন রাজা"
রবীন্দ্রনাথের গানই একমাত্র চির প্রাসঙ্গিক ।
যা নবীন যা নূতন তা পুরনো ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রাচীন যা কিছু সম্পদ সেই ঐতিহ্যই বর্তমান ধরে রাখে। আধুনিক কালের সাজে নতুন ঝলমলিয়ে ওঠে এবং প্রাচীন ফিরে আসে নব রূপে । এই যে ডাকবাক্সটা পড়ে আছে সেই প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে। এককালে কত মুখর থাকত ডাকবিভাগ পরিসেবা। কত মানুষের কত সুখ দুঃখের সাথী হল এই চিঠি। সুকান্ত ভট্টাচার্য এর লেখা আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া সেই কালজয়ী গান " রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে" আমাদের মনে এখনো আনন্দের প্লাবন আনে।
এখন অফিশিয়াল চিঠি ছাড়া আর কোনো চিঠি খুব একটা আসে বলে মনে হয় না।
চিঠি লেখা কিন্তু একটা শিল্প তবে কী মানুষ চিঠি লিখতে ভুলে গেল ? চিঠি নিয়ে কত গান মনে পড়ছে বনশ্রী সেনগুপ্তর " আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম " প্রেমিকের চিঠির কত গোপনীয়তা ভাবা যায়! প্রিয়র চিঠির জন্য ঘর বাহির করতে করতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি মনে আশঙ্কা জাগে। মন কেমন করা জগন্ময় মিত্রের গান মনে পড়ে? " যত চিঠি লিখে যাই তবুনা ফুরায় চিঠি তো হয়না শেষ " এই গান শুনলেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। । এখন চিঠির জায়গা মোবাইল ফোন নিয়েছে এছাড়া ইন্টারনেটে মেইল ব্যবস্থা রয়েছে। এখন সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ মেইল এ হয়। মেইল সেই চিঠির সতীন। আধুনিক সমাজকাঠামোয় হয়তো যে বদল এসেছে তার অবশ্য খুব ভালো দিকও আছে। চিঠির জন্য অপেক্ষা নেই তাড়াতাড়ি উত্তর পেয়ে যাবেন। সারা পৃথিবী যেন অন্তর্জালে গাঁথা।
কত পরিবর্তন যে এসেছে তাই ভাবি! এখন গ্লাসে কজন জল খায় বলুন তো? পরিবর্তে সকলে বোতলে জল খায়। এভাবে জল খাওয়া কিন্তু বিজ্ঞান সম্মত নয়। আমার বেশ মনে আছে ছোটবেলায় গ্লাস ধরতাম ডানহাতে এবং ঐ গ্লাস ডাল তরকারি মাখা গয়না পরে যেত।
গ্রিটিংস কার্ড পেতে কার না ভালো লাগে বলুন?
এই রঙবেরঙের কার্ড গুলো হারিয়েই গেল।
কত মানুষ এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাই না?
আজকাল কারোর ঘরেই সচল হাতঘড়ি খুঁজে পাওয়া যাবেনা।আগে রিস্টওয়াচ ব্যাপারটার ভেতর একটা সুপ্ত অহংকার ছিল। আমাদের ঠাকুরদার আমলে বোধহয় ঘড়ি পকেটে ঝোলানোর চল ছিল। আগের দিনে লোক তো ছায়া দেখে রোদ্দুর দেখে সময় বুঝত। আমি 1990 সালে মাধ্যমিক পাশ করি, তখন বাবা আমাকে একটি Hmt ঘড়ি দিয়েছিলেন। সবাই Hmt ফুল ফর্ম জিজ্ঞাসা করত। দেওয়াল ঘড়ি, টেবিল ঘড়ি এখনো সবার বাড়িতে আছে।
"বেলঘড়িয়া" জায়গাটির নাম বড় বেল দেওয়া ঘড়ির জন্যই খুব সম্ভবত এই নাম হয়েছে।
এখনো আছে হুগলী জেলার চুঁচুড়া তে ঘড়ির মোড় বলে একটি জায়গা কারণ সেখানে একটি বড় ঘড়ি টাঙানো আছে।
আগে তো মোবাইল ছিলনা, যেখানেই ভ্রমণে যাও অবশ্যই ক্যামেরাতে রিল ভরে নিয়ে যেতে হবে।
তারপর বাড়ি ফিরে স্টুডিওতে দিয়ে আসতে হবে।
অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সবাই মিলে কাড়াকাড়ি করে ছবি দেখা। অন্য সদস্যরা ঐ নেগেটিভ থেকে ছবি করে নেবেন। কত রকমের অ্যালবাম
স্মৃতিচারণ নিয়ে সেজে উঠত। আরেকটা জিনিস মনে পড়ছে দু এক টাকার আচার কিনলে তার সঙ্গে একটা নেগেটিভ ফ্রি পেতাম এবং ঐ নেগেটিভ রোদে ধরলে নায়ক নায়িকার ছবি দেখা যেত আমরা বাচ্চাবেলায় খুব আনন্দ পেতাম।
পুজোর সময় পুজোর গান একটা বড় জাগয়া দখল করে ছিল ছোট বড় সবার মনে। পুজোর গানের ক্যাসেট কিনতে হবে। কত ক্যাসেট ও রেকর্ড প্লেয়ার এখনো সিঁড়ি ঘরে ধুলোয় ধূসর হয়ে আছে।
আপনারা কেউ মাটিতে আসন পেতে বসে ভাত খেয়েছেন? তখন মেয়ে বউরা ঘরে ঘরে সোয়েটার বুনতো সেইসঙ্গে অসাধারণ সুন্দর ডিজাইনের নক্সা করা আসন বানাতো। হালকা শীতে কাঁথা গায়ে দেওয়ার জন্য সবাই অল্প বিস্তর পুরনো শাড়ি দিয়ে নক্সীকাঁথা বুনত, অসাধারণ সব হাতের কাজ। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন এর "নক্সীকাঁথার মাঠ" কবিতা টি একটি মাইলস্টোন এক অবিনশ্বর প্রেমের আখ্যান কাব্য। এখন কাঁথা কেউ ব্যবহার করে না তবে সেই শিল্প শাড়িতে বিরাট বাজার দখল করেছে, সেইসব কাঁথাস্টিচ দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এখন তো পুজো এসেই গেল মনে পড়ে নানা রঙের মাথার ফিতের কথা, নানা রঙের চুড়ি আর মায়েদের আলতা পরা লাল টুকটুকে পা দুটির কথা। মায়েদের ক্রিম বলতে স্নো ছিল। উৎসবের দিনে গ্রামে গঞ্জে যাত্রাপালা, পুতুলনাচের আসর দেখতে লোকে দলে ভিড় করত। হাফটাইমে খোসা ছাড়িয়ে বাদামভাজা খাওয়া, মাছ লজেন্স, জেলি লজেন্স,
পাঁচ টাকার কাঠি আইসক্রিম এসব স্বাদের সত্যিই ভাগ হয়না। আর যে রথের মেলায় জিলাপি পাঁপড় ভাজা খাননি তার যেন জীবন অসম্পূর্ণ থেকে গেল। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে রামযাত্রা শোনার কথা মনে আছে? মনে পড়ে সকালে উঠে রোলকরা বাসি রুটি গরম চায়ে ডুবিয়ে খাওয়ার অমৃত স্বাদ। মুড়ি ঘুঘনি চানাচুর পেয়াজ দিয়ে মেখে শীতের রোদে পিঠ দিয়ে স্টিলের গ্লাসে চা খেয়েছেন কখনো? পুজোর একমাস আগে থেকে ধানভানা মুড়ি, মুড়কি, মোওয়া কত ধরনের নাড়ু সব আয়োজন চলত জোর কদমে। আজকাল ঢেঁকি দেখাই যায়না। কিনে খাবার মতো তখন অত পয়সা কোথায় পাবে মানুষ? নিজের হাতে আদর মিশিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করতে হবে। আজকালকার বাচ্চারা মালা গাঁথতে জানে? আমার একটা দায়িত্ব ছিল বৃহস্পতিবার মায়ের লক্ষ্মীপুজোর মালা গেঁথে দিতে হবে। ভয় ড়র তো কিছুই ছিলনা খুব সকালে নিজেদের বাগানে বা অন্য কারোর বাগানে সাজি ভরে ফুল তুলতে হবে ঘরের নিত্য পুজোর জন্যে । আচ্ছা আগের দিনে খুব বিরক্তিকর জিনিস ছিল জ্বর এলেই জোর করে বার্লি খাওয়াবে রবিনসন বার্লি। নামটাই ভালো খেতে খুব বাজে। তখনকার দিনে জ্বর হলে ভাত দিত না। রুটি ফল দুধ এসব খেতে হবে।
এখন এসব নেই বরং স্নান করবে ভাত খাবে আর প্রোটিন তো খেতেই হবে।
রবীন্দ্রনাথের একটা গান মনে পড়ল " পুরানো জানিয়া চেয়োনা আমারে আধেক আঁখির কোণে অলস অন্য মনে"
সম্পর্ক পুরনো হয়ে যায় । থাকতে থাকতে সম্পর্কের উপর ঘন হয়ে আসে সর। কোথাও ভরা নদীর মাঝখানে দ্বীপ সৃষ্টি হয়। শুরুহয় কত নতুন বসবাস, বাড়তে থাকে আত্মীয়তা। স্বামী স্ত্রীর
সম্পর্কের ভেতর একঘেয়েমি চলে আসে। তাই জীবন বারবার ঝালিয়ে নিতে ভ্রমণ করতে হয়। ফ্যামিলি গেটটুগেদার করার খুব প্রয়োজন।
একে অন্যকে স্পেস দিতে হয় যে যার বন্ধু বৃত্তে দু চারদিন প্রাণখুলে আনন্দ হাসিতে মেতে উঠতে হয়। একটা কথা আছে "পুরনো চাল ভাতে বাড়ে" বাড়ির প্রবীণদের কাছ অনেক কিছু শেখার আছে শোনার আছে। আমাদের বিশ্বসাহিত্য থেকে ভারতীয় সাহিত্য যে স্তম্ভের উপর চিরকাল থাকবে " শেক্সসপিয়র , দস্তয়েভ্স্কি, তলস্টয়, গ্রাব্রিয়েল গাসির্য়া মার্কেস, কাম্যু, কাফকা, রিলকে, পাবলো নেরুদা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সতীনাথ ভাদুড়ী, বঙ্কিম, শরৎ, জীবনানন্দ, বলে শেষ হবেনা। পুরনো এবং নতুন দুই মেরুই জীবন কে সম্পদে সমৃদ্ধিতে ভরে রাখে। আজকের আমি কালকে পুরনো কিন্তু আমার অনুভব,ভাবনা এবং সম্পূর্ণ আমি মানুষটার মন সেই নবীনই আছে। আমাদের মা ঠাকুমারা ঘটিহাতা ব্লাউজ, থ্রিকোয়াটার হাতা ব্লাউজ পরতেন সেই সব ফ্যাশন আবার নতুন ভাবে ফিরে এসেছে। আমার মায়ের দিদারা আবার সেমিজ পরতেন তারই মর্ডান রূপ ম্যাক্সি বা নাইটি এটি তো আমাদের জাতীয় পোশাক এছাড়া আমাদের চলে বলুন?
অতীত কে ধরে রাখার ভেতরে ঐতিহ্য আছে। বয়স যত বাড়ে সম্পর্ক তত গভীর হয়। তখন শরীরের থেকে মন বেশি প্রাধান্য পায়। শারীরকে ব্যায়াম এবং সুন্দর চিন্তার ভাবনার মাধ্যমে সতেজ ও স্বতঃস্ফূর্ত রাখা যায়। বিভিন্ন রকম মানসিক স্তরের মাধ্যমে যৌবন কে সতেজ রাখা যায়। মনের গভীরে যে মানুষটি বাস করে সবার আগে তাকে শ্রদ্ধা এবং পুজো করার প্রয়োজন । এই সুন্দর পৃথিবীতে একমাত্র প্রেমই পারে নবজীবন দান করতে।
ভরপুর প্রেমে বারবার ডুব দিন। প্রিয় চোখে চোখ রেখে বলুন "হৃদয় বসন্ত বনে যে মাধুরী বিকাশিল"
0 Comments