জ্বলদর্চি

দিলীপ কুমার পাত্র (বৃক্ষপ্রেমী, শিক্ষক, সমাজসেবী, ময়না)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন পর্ব -- ২১

দিলীপ কুমার পাত্র (বৃক্ষপ্রেমী, শিক্ষক, সমাজসেবী, ময়না)

ভাস্করব্রত পতি

বেতনের টাকা দিয়ে তিনি কাপড় জামা কিনতে পছন্দ করেননা। যেটুকু প্রয়োজন, তার বাইরে বিলাসিতা পছন্দ নয় তাঁর। বরং সেই টাকায় গাছ কিনে বিলি করেন পাড়ায় পাড়ায়, স্কুলে স্কুলে, ক্লাবে ক্লাবে। কুড়ি হাজারের বেশি চারা গাছ বিতরণ করেছেন বিভিন্ন স্থানে। প্রতি বছর হাজারের বেশি বিভিন্ন ধরনের লুপ্তপ্রায় গাছের বীজ সংগ্রহ করে দান করেন লাগানোর জন্য। এহেন মানুষটিকে মেদিনীপুরের মানুষ চেনে "বৃক্ষপ্রেমী" হিসেবেই। ছাত্র ছাত্রীদের কাছে তিনি "সবুজ দাদা"! তাঁর মতে 'গাছ' হলো মানুষের একমাত্র সখা, যারা কিনা সহজ সরলভাবে বেঁচে থাকতে সর্বদা পাশে থাকে।

তিনি দিলীপ কুমার পাত্র। দিলীপ স্যার। ময়নার বাসিন্দা। পেশায় শিক্ষক। শুধু এইটুকু পরিচয় দিলে অন্যায় করা হবে। তাঁর কাজের নিরিখে তিনি অনন্য। অজস্র কাজে তিনি নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন স্রেফ পরিবেশকে ভালোবেসে। পরিবেশের সুস্থতা কামনায়। নিজে ভূগোল পড়ান। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে পৃথিবীর ভৌগলিক অবস্থান তিনি বুঝতে পেরেছেন। বিশ্ব উষ্ণায়ন গ্রাস করছে পৃথিবীর জল হাওয়া মাটি। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে ক্রমশঃ যন্ত্রনাময় হয়ে উঠছে ধরিত্রী। এমতবস্থায় তিনি ভেবেছেন সামান্য কিছু হলেও পৃথিবীকে রক্ষা করবার গুরু দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে। আর এজন্য সাথী করেছেন "গাছ"কে। তাঁর চিন্তায় প্রতিফলিত হয় -- " বিশ্ব জুড়ে হচ্ছে কি / ভুগছে লোকে বহু / মরবে মানুষ লাখে লাখে / রিপোর্ট দিচ্ছে হু"।

ভূগোল নিয়ে পড়ার সুবাদে ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা তৈরি হয়েছে। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন, পৃথিবীর জলবায়ু ঘোর বিপদের মধ্যে। ২৩ শে সেপ্টেম্বর সুইডেনের গ্রেটা থুনবার্গের আন্দোলনে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় জলবায়ু ধর্মঘট। সেই গ্রেটা আজ দিলীপ কুমার পাত্রের আদর্শ। জলবায়ু ধর্মঘটের মূল কারিগর গ্রেটা থুনবার্গকে নিয়ে তাঁর লেখা -- "বিশ্বজুড়ে তোমার নাম সবার মুখে মুখে / পরিবেশকে রাখলে ভালো থাকবো মোরা সুখে / মহাপ্রলয়ে গোটা বিশ্ব ভাবে গ্রেটার মতো / পরিবেশ রক্ষায় করব কাজ আসুক বাধা যত"। 
পেশায় শিক্ষক এই মানুষটি শিক্ষাগত যোগ্যতার তালিকায় এম.এ, বি.এড. (প্রথম শ্রেণি), আই.টি.আই. (ফিটার) ছাড়াও রয়েছে সিভিল ডিফেন্স (ইনস্ট্রাক্টর), রেডক্রশ (ইনস্ট্রাক্টর), সেন্ট জন অ্যাম্বুল্যান্স, ডিজাস্টার ম্যানেজম্যান্ট (এ.টি.আই), ব্রতচারী, পপুলেশন এডুকেশন এণ্ড এক্সটেনশন প্রশিক্ষণ। যা এককথায় অভিনব। চাকরি করতে হয় পেশার তাগিদে। আর নেশায় তিনি পরিবেশ রক্ষার সৈনিক। ২০০১ সালে উত্তর ২৪ পরগণার শ্যাম নগর মন্ডলপাড়া বিদ্যা নিকেতনে সহ শিক্ষক পদে যোগদান করেন। এরপর ২০১২ সাল থেকে ময়না রাধাবল্লভচক্ সারদাময়ী বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতা করে চলেছেন এখনও।

পরিবেশ ও সমাজ সচেতনতাই তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য। পরিবেশ দূষণরোধে তাঁর নিরলস প্রয়াস প্রশংসার দাবি রাখে। সারা মেদিনীপুর জেলা জুড়ে নীরবে নিভৃতে নিরলস কর্মকাণ্ড তাঁকে বানিয়েছে 'মানুষ রতন'। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় পাঠকের চিঠি, পরিবেশ বিষয়ে অনুচ্ছেদ এবং ছড়া দেশ বিদেশের একশ টির বেশি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। আনন্দবাজার পত্রিকা, বর্তমান, আজকাল, প্রতিদিন, সুস্বাস্থ্য, এযুগের কিশোর বিজ্ঞানী, মুক্ত বাংলা, গণশক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবেশ বিষয়ক নানা ধরনের লেখা লিখে পৌঁছে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষের কাছে। লক্ষ্য পরিবেশের প্রতি ভালোবাসার জন্ম দেওয়া। আর এই অসম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন মেদিনীপুরের বুকে বসেই।

অসংখ্য বই লিখেছেন পরিবেশকে কেন্দ্র করেই। পরিবেশ ও সমাজ সচেতনতার বিষয়ে দুই হাজারের বেশী স্লোগানের উপর একটি বই প্রকাশের পথে। তাঁর মতে খুব সহজে সাধারণ মানুষের মনে পরিবেশ বাঁচানোর মন্ত্র পৌঁছে দিতে এরকম স্লোগানগুলির কার্যকারিতা মারাত্মক। ইতিমধ্যে পরিবেশ ও সমাজের উপর পাঁচশোর বেশী ছড়া লিখেছেন। সাধারণ জ্ঞান, পরিবেশ দর্পণ, পরিবেশ ভাবনা, পরিবেশ গড়ি বেশ, সমাজ দর্পণ, স্মরণীয় যাঁরা, ভেষজের গুণাগুণ, পরিবেশ পড়ি বেশ, পড়ি মজা করে, ছড়ায় ছড়াছড়ি, মুখে মুখে স্লোগান, পড়বো ছড়া করবো মজা ইত্যাদি বইতে  প্রতিটি বইয়ের ছত্রে ছত্রে রয়েছে পরিবেশ ভাবনা। ছোট থেকে বড় -- সকলকে অতি সহজভাবে পরিবেশ সচেতন করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন বছরভর। সহজ বাংলাতে তিনি তুলে ধরেন -- "গাড়ির ধোঁয়া কলের ধোঁয়া / আবর্জনার গন্ধ / বিষে ভরা বায়ুতে / হবে দম বন্ধ"।

ইতিমধ্যে পরিবেশ বিষয়ে দু'শটির বেশি স্লোগান সরকারি দপ্তরে পাঠিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে কুড়ি হাজারের বেশি চারাগাছ স্কুল, কলেজ, অফিস, ক্লাব, থানা, এনজিও ও সাধারণ মানুষকে দান করার পাশাপাশি এবং বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে পাঁচ হাজারের বেশি চারাগাছ লাগিয়েছেন পরিবেশ দূষণরোধে ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার জন্য। এহেন পরিবেশপ্রেমী মানুষ বিরল এই জমানায়। নিজের গাঁটের কড়ি খসিয়ে 'ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো' সুলভ কাজকর্মে জড়িয়ে থাকতে ভালোবাসেন তিনি। আসলে তিনি বিশ্বাস করেন, পরিবেশ বাঁচলে পৃথিবী বাঁচবে। আর পৃথিবী বাঁচলে জীবজগৎ বাঁচবে।

প্রতি বছর এক হাজারে বেশী বিভিন্ন ধরনের লুপ্তপ্রায় গাছের বীজ সংগ্রহ করেন। সেগুলো বিলি করেন লোকজনকে। তাঁর এই কাজের জন্য তিনি স্থানীয় মানুষের কাছে ‘বৃক্ষপ্রেমী’ও ‘সবুজ দাদা' নামে পরিচিতি পেয়েছেন। একাধারে তিনি 'ময়না সবুজ বাঁচাও মঞ্চ' ও 'ময়না পরিবেশ মঞ্চে'র কর্ণধার, ভারতীয় রেডক্রস সোসাইটি, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের আজীবন সদস্য। অন্যদিকে 'বেঙ্গল প্রোগ্রেসিভ ফার্মার্স এ্যাণ্ড এগ্রিকালচার সায়েনটিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের' সদস্য। তমলুক ফ্লাওয়ার লাভার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ময়না ব্লক জীব বৈচিত্র্য ব্যবস্থাপন সমিতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রেখেছেন নিজেকে। অন্যদিকে তিনি ভারতীয় রেডক্রস সোসাইটির জেলা ইনস্ট্রাক্টর এবং পল্লী বাংলা এফ. এম. রেডিও - ৯১.২ তে পরিবেশ কেন্দ্রিক জনসচেতনতা মূলক অনুষ্ঠানে অংশ নেন নিয়মিত। 

গাছ বাঁচাতে জলের অপচয় রোধে, ক্যারিব্যাগ বন্ধ ও পরিবেশ দূষণ রোধে জন সাধারণকে সচেতন করতে সাইকেল র‍্যালি ও বাইক র‍্যালিতে বহুবার অংশগ্রহণ করেছেন। লিখে ফেলেছেন ৩০ টির বেশি গান। যে গানে রয়েছে সুস্থ পৃথিবী গড়ার আহ্বান। যে গানে রয়েছে নিজেকে ও নিজের চারপাশের ফুল ফল লতা পাতাকে মনোরম করে রাখার আবেদন। যে গানে রয়েছে বাঁচবার পথ। ভবিষ্যতের পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখার শপথবাক্য।

পরিবেশ বিষয়ে কাজের জন্য বহু প্রশংসা ও সংবর্ধনা জুটেছে। প্রাথমিক চিকিৎসা ও বিপর্যয় বিষয়ে কুড়িটির বেশি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন রেডক্রস ও সিভিল ডিফেন্সের হয়ে। এছাড়া মকড্রিল, রক্তদান শিবির, পথ নিরাপত্তা, পদযাত্রা ইত্যাদি নানা অনুষ্ঠানে তাঁকে পাওয়া যায় সবসময়ই। বহু ক্লাব ও প্রতিষ্ঠানকে চারাগাছ লাগাতে উৎসাহিত করে চলেছেন নিজের উদ্যোগে। প্রতি বছর নিয়ম করে পরিবেশ দিবস এবং অরণ্য সপ্তাহে ১০০ টি করে সবুজ টুপি ও ব্যাগ বিতরণ করেন। ইংরাজী নববর্ষে স্কুল, কলেজ, ব্যাঙ্ক, অফিস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানকে ১০০ ক্যালেন্ডার বিতরণ করেন। যাতে থাকে পৃথিবী রক্ষার আহ্বান। এছাড়াও স্কুলে স্কুলে গিয়ে পরিবেশ বিষয়ে বসে আঁকো প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন সম্পূর্ণ নিজ ব্যয়ে। এসবই পরিবেশকে নির্মল রাখার পাশাপাশি নিজেদের সতেজ রাখার কৌশল।

পরিবেশ বিষয়ে কাজের জন্য এবং ছড়া লেখার জন্য বহু প্রতিষ্ঠানের সম্বর্ধনা ও পুরস্কার পেলেও তিনি অবশ্য থামতে চাননা। উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে ‘রক্ত করবী’, ‘বৃক্ষপ্রেমী’, ‘আর.সি.বি.এস. বাংলা’, ‘বিদ্যাসাগর’, ‘শিল্পমনন, ‘আয়না’, ‘দি তদন্ত নিউজ’, ‘জে.এন.ইউ' স্মারক ইত্যাদি রয়েছে। বাড়িতে কোনো অতিথির আগমন হলে চারাগাছ দিয়ে অভ্যর্থনা করেন। এছাড়া যে কোন অনুষ্ঠানে গেলে উপহার হিসেবে একটি করে ফুল অথবা ফলের চারাগাছ তুলে দেন। এটা তাঁর জীবনের ব্রত হিসেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর এভাবেই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পৃথিবীর জঞ্জাল সরানো ব্রত নিয়েছেন 'বৃক্ষপ্রেমী' দিলীপকুমার পাত্র।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments