জ্বলদর্চি

ড.কমল কুমার কুণ্ডু (ইতিহাস গবেষক, প্রবন্ধকার, তমলুক)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ২২

ড.কমল কুমার কুণ্ডু (ইতিহাস গবেষক, প্রবন্ধকার, তমলুক)

ভাস্করব্রত পতি

একসময় ছিলেন ব্যাঙ্কের অফিসার। কিন্তু আদপে তিনি লোক গবেষক। এখন চাকরি জীবন থেকে অবসর নিয়েছেন। কোনো দিনই অর্থের অভাব হয়নি। সমাজের উচ্চপদস্থ লোকজনের সাথে সম্পর্ক এবং ওঠাবসা। কিন্তু আয়েসী জীবন তাঁর ধাতে নেই। সারাজীবন পড়াশুনো এবং সেই সংক্রান্ত বিষয়ে ডুবে থাকার পাশাপাশি নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন এই সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, মানবজীবন সহ চলমান দুনিয়াটাকে ভিন্নতর চোখ দিয়ে পরখ করার কাজে।

ড. কমল কুমার কুণ্ডু। অবিভক্ত মেদিনীপুরের তথা রাজ্যের অন্যতম জনপ্রিয় লোক গবেষক এবং ক্ষেত্র সমীক্ষক। এরকম মানুষ বিরলতম। চেন্নাইতে চিকিৎসারত অবস্থাতেও বই পড়ার মানসিকতা তাঁর। সঙ্গে করে বই নিয়ে যেতে ভোলেননা। এটা বইয়ের প্রতি ভালোবাসার চূড়ান্ত মিশেল। এনাকে দেখে শেখা যায় গবেষণার নিয়মকানুন এবং গভীর ঈপ্সা। শিক্ষা জীবনে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে এম. এ. এবং পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। কিন্তু পুঁথিগত ঘেরাটোপে তিনি নিজেকে বন্দী রাখেননি কখনো।

ড. কমল কুমার কুণ্ডু সেরকমই এক নাম। তমলুক শহরের সংস্কৃতিবান এবং ইতিহাস সচেতন মানুষ হিসেবে জনগণ একডাকে চেনে। তমলুকের মতো ইতিহাস বিধৌত শহরে তিনি তাঁর 'কাজ' দিয়েই নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন অদ্ভুতভাবে। তমলুক শহরের নতুন করে পরিচয় দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু তিনি তমলুকে বসেই তমলুকের বুকে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য 'মণিমুক্তা'কে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তুলেছেন নিজের লেখনীর গুণে।
তিনি লিখেছেন এস বি আই অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের ইতিহাস। ২০০২ তে দিল্লীর 'হারমান পাবলিকেশান' থেকে প্রকাশিত হয়েছে 'সূত্রধরস অব বেঙ্গল' নামক ইংরাজী বই। মন্দির নির্মাণকারীদের নিয়ে এ ধরনের কাজ অনন্য। স্বাধীনতা সংগ্রামে অনন্য জেলা মেদিনীপুরের বুকে ঘটে যাওয়া ব্রিটিশ যুগের নানা কাহিনী নিয়ে তিনি লিখেছেন 'জিলা মেদিনীপুর : স্বাধীনতা আন্দোলন'। তমলুক মিউজিয়াম নিয়ে তাঁর লেখা বই 'তাম্রলিপ্ত সংগ্রহশালা ও গবেষণাকেন্দ্র : উত্তরণের চড়াই উৎরাই' এক আলাদা মাত্রা দিয়েছে পাঠকদের মনে। তাঁর লেখা বইগুলির মধ্যে  ‘A Study in Retrospect' (১৯৯০), ‘জিলা মেদিনীপুর : স্বাধীনতার আন্দোলন' (২০০১), “Sutradhars of Bengal' (২০০২) এবং 'বিপ্লবতীর্থ মেদিনীপুর -- ফিরে দেখা আন্দোলন' (২০২১) উল্লেখযোগ্য। এই 'বিপ্লবতীর্থ মেদিনীপুর' বই সম্পর্কে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, "কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের স্নাতকোত্তরশ্রেণীতে সুদীর্ঘ চার দশকের আমার শিক্ষকজীবনের যে সমস্ত ছাত্র স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকাকালীন ও অবসরপ্রাপ্তির পরেও লিখন-পঠনে নিষ্ঠাসহ ব্যাপৃত, তাঁদের অন্যতম পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক নিবাসী ড. কমলকুমার কুণ্ডু। তমলুকের ‘তমলুক মিউজিয়াম’-এর প্রতিষ্ঠায় ড. কুণ্ডুর সর্বাঙ্গীণ প্রয়াস এবং অবদান সুবিদিত। ইতিহাস বিষয়ে প্রকাশিত বহু প্রবন্ধ, পুস্তক এবং সম্পাদিত পুস্তকের জন্য ড. কুণ্ডু সুপরিচিত। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে মেদিনীপুর জেলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অসামান্য অবদান বিষয়ে নানা সময়ে ড. কুণ্ডু লিখিত ও বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যনির্ভর প্রবন্ধাবলী ও নতুন কয়েকটি প্রবন্ধের সংকলন বর্তমান ‘বিপ্লবতীর্থ মেদিনীপুর : ফিরে দেখা আন্দোলন' গ্রন্থের সমাদরলাভে আমি নিঃসন্দেহ"।

এছাড়া তাঁর সম্পাদিত বই ‘প্রসঙ্গ তাম্রলিপ্ত' (১৯৮৩), ‘উমাচরণ অধিকারীর (১৮৮৩) তমলুকের প্রাচীন ও আধুনিক বিবরণ' (১৯৯৫  ও 2020) এবং J C PRICE (১৮৭৬) এর লেখা Notes on THE HISTORY OF MIDNAPORE VOL -1(২০১৯) এর নাম উল্লেখ করা যায়। এই J C Price এর বইটির বিষয়ে তিনি জানিয়েছেন, "This book Notes on the History of Midnapore Vol. I. written lucidly by J. C. Price, former Assistant Settlement Officer Midnapore, was published in 1876 wo years after of his another book The Chuar Rebellion, 1799', which was published in 1874. This book is basically based on the correspondences between the offices of Midnapore and Calcutta of the British East India Company Although the book is framed between the years 1764 and 1774, it goes beyond that period and sometimes upto 1793. All the incidents during that period immediately after getting the nights of the Revenue Administration of the Company on this district were included their struggle for extension of dominion, the description of boundaries of Company's jurisdiction, supervisions of Revenue Administration of the district, commercial activities of the Company including salt production and its trade, general history includes Company's expedition to Jungle Mahals, Company's relationship with the French Company and the rebellion of the Chuar's, the Sannyasi's and Fakir's and even on the banking activities including affairs of Exchanges, Currency and Mint during this period. The scholars would feel happy and will find unknown sources on Midnapore from this book"। এছাড়া আরও অসংখ্য নামী দামী বই প্রকাশের সাথে তিনি জড়িত প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে।

পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের ক্ষেপুতের গোপালগঞ্জ গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫০ এর ৩১ মার্চ। বাবা ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় কুণ্ডু এবং মা পারুল কুণ্ডু। বেশ কয়েক বছর হোলো অবসর নিয়েছেন স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইণ্ডিয়ার অফিসার পদ থেকে। স্কুল জীবনের শিক্ষক গৌরীশঙ্কর বসুর অনুপ্রেরণায় আজ তিনি ইতিহাসমুখী মানুষ হতে পেরেছেন। আজও সেই ইতিহাস অন্বেষণে বুঁদ হয়ে থাকতে পছন্দ করেন।

কেবল ব্যাঙ্কের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকাতেই আবদ্ধ থাকেনি কমল কুমার কুণ্ডুর জীবন। তাঁর লিখিত বইগুলি সেই প্রমাণই দেয়। তিনি ইতিহাস ভালোবাসেন। সংস্কৃতি ভালোবাসেন। মানুষের জীবন ভালোবাসেন। তাই পিছলে যাওয়া ইতিহাসকে বাঁচাতে কলম ধরেন তিনি। বলীষ্ঠ সেইসব লেখা যে কোনো সাহিত্যরসিক এবং ইতিহাসপ্রেমী মানুষের হৃদয়কে সুরভিত করবেই। আনন্দবাজার পত্রিকা, দি টেলিগ্রাফ, দৈনিক বসুমতি, আনন্দমেলা, আপনজন, জন্মভূমি, তাম্রলিপ্ত, ব্রতীসংহতি, দৃষ্টি, কলমচি, পূর্বাচল সহ অসংখ্য পত্রপত্রিকা ও লিটিল ম্যাগাজিনে প্রকাশ করেছেন বহু লেখা। প্রতিটি লেখাই মূল্যবান এবং গবেষণা ঋদ্ধ ফসল।

তাম্রলিপ্ত সংগ্রহশালার গঠনের পিছনে ড. কমল কুমার কুণ্ডুর অবদান অনস্বীকার্য। এই সংগ্রহশালা আজ তমলুকের গর্ব। ১৯৬৯ সালে এই মিউজিয়ামের পথচলা শুরু। সেসময় শ্রুতিনাথ চক্রবর্তী মিউজিয়াম শুরু করার কথা বললেও ১৯৭৩ সালে তমলুক কলেজে মিউজিয়ামের উদ্বোধন করেন তৎকালীন সাংসদ সতীশচন্দ্র সামন্ত। তারপর থেকে আলাদা ভাবে মিউজিয়াম তৈরির যে পদচারণা শুরু হয়, তাতে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন ড. কমলকুমার কুণ্ডু। পাশে ছিলেন লক্ষ্মনচন্দ্র প্রধান, আশুতোষ মাইতি, প্রদ্যোৎ কুমার দে, প্রশান্তকুমার মণ্ডল, কান্তিপ্রসন্ন সেনগুপ্ত প্রমুখ। ১৯৭৫ এর ১ লা ডিসেম্বর তাম্রলিপ্ত পৌরসভার ভবনে উঠে আসে। উদ্বোধন করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। এই মিউজিয়ামের অসংখ্য উপাদান তিনি সংগ্রহ করে জমা দিয়েছেন। বলতে গেলে মিউজিয়াম অন্ত প্রাণ তিনি। তাম্রলিপ্ত সংগ্রহশালা ও গবেষণাকেন্দ্রর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ১৯৮৬ সাল থেকে সম্পাদকের পদে থেকে সংগ্রহশালাটিকে ২০০১ সালে হস্তান্তর করেছেন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়াকে।

তাঁর কলমের ডোগাতেই নতুন রূপে আমরা পেয়েছি মোতিলাল শীল, বীরজা শংকর, সত্যেন্দ্রনাথ জানা, তারাশিষ মুখোপাধ্যায়, বিজ্ঞান সাধক পুলিনবিহারী সরকার, কর্মযোগী সতীশচন্দ্র সামন্ত, বিপ্লবী সুশীলকুমার ধাড়া, জলধর সেন, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়দের। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ এবং অসংখ্য অজানা তথ্যে সমৃদ্ধ ছিল সেসব রচনা। যা অন্যত্র মেলেনি এরকমভাবে। তাম্রলিপ্তে বৌদ্ধধর্মের কিরকম প্রসার ও প্রচার ছিল সে বিষয়ে বক্তব্য রাখতে ২০১৬ তে যেতে হয়েছিল থাইল্যান্ডের নান প্রভিন্সের বিশ্ববিদ্যালয়ে।

পূর্ব মেদিনীপুরের নামকরণ কিভাবে হল, তাম্রলিপ্তের সমাজ ও সংস্কৃতি, মেদিনীপুরের সঙ্গীত চর্চার পরিক্রমা, বুদ্ধ নগরী তাম্রলিপ্ত, হিজলী টাইডাল ক্যানেল, নাটশালের প্রত্নবস্তু, খড়ুই গ্রামের গালা পুতুল, দেশলাই কথা, তমলুকের মন্দির মসজিদ ও ধর্মীয় স্থান, লবণ অন্দোলন, নেতাজীর একদিনের তমলুক সফর, গান্ধীজীর দশ দিন ইত্যাদি অসংখ্য বিষয়ে লেখা পাঠক সমাজে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে।
অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন বহু সাহিত্য সংস্থা ও পত্রপত্রিকা থেকে। ১৯৯৫ এর ১ লা জুলাই স্টেট ব্যাঙ্কের জন্মদিন অনুষ্ঠানে 'কৃতি অফিসার' হিসেবে বিরল সম্মাননা পেয়েছেন। কলকাতা গৌড়ীয় মিশনের মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার অ্যাডভাইসরি বোর্ডের সদস্য। 'পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রহশালা সমিতি'র ভাইস প্রেসিডেন্ট সহ এশিয়াটিক সোসাইটি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের আজীবন সদস্য হয়ে রয়েছেন। ICOM-এর ভারতীয় কমিটির প্রাক্তন এক্সিকিউটিভ বোর্ড মেম্বার ড. কমল কুমার কুন্ডু।

তিনি লেখেন। লিখতে ভালোবাসেন। গতানুগতিক জীবনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে চলতে চান তিনি। এই চলার পথে বাধা পেয়েছেন। কিন্তু সে সব গায়ে মাখেননি। সোজা পথে চলতে চলতেই 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন' হয়ে উঠেছেন। তাঁর কর্মনিশান উড়ছে তমলুকের বুকে। তমলুক ছাড়িয়ে সেই নিশান চলছে রাজ্যের অন্য প্রান্তেও।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments