জ্বলদর্চি

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী/একাদশ পর্ব /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী               
একাদশ পর্ব         
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী


ষড়যন্ত্র

এদিকে এই সময়ে সম্রাটের দরবারের অন্যতম গায়ক মিঞা খোদাবক্সের হাভেলিতে মৃদু প্রদীপের আলোয় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে এক গোপন আলোচনা করছিলেন মিঞা খোদাবক্সের অনুগামী কয়েকজন সভাগায়ক। এরা হলেন দরিয়া খাঁ, নবাব খাঁ, মসনদ আলী ও বৈকুণ্ঠ দাস। এই বৈকুণ্ঠ দাস স্বামী হরিদাসের শিষ্য ছিলেন এক সময়। তানসেন গুরুভাইয়ের প্রতি অনুকম্পাবশত সম্রাটকে অনুরোধ করার পরে সম্রাট বৈকুণ্ঠনাথকে সভাগায়কের পদে নিয়োগ করেন। কিন্তু সে ছিল তানসেনের প্রতি ঈর্ষাপরায়ন এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সব সময় ভিতরে ভিতরে চেষ্টা করত কিভাবে তানসেনকে সভাগায়কের পদ থেকে বিচ্যুত করে তার জায়গায় সে নিজেই অভিষিক্ত হতে পারে যার জন্য সে মিয়া খোদাবক্সের একান্ত অনুগামী। এছাড়াও তাঁর ধারণা ছিল তানসেন ইচ্ছে করলেই তাঁর জন্য সম্রাটকে বলে বিভিন্ন পারিতোষিকের ব্যবস্থা বা একটা জায়গীরের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। আলোচনার শুরুতেই নবাব খাঁ বললেন "আমাদের এমন একটি পন্থা বের করতে হবে যাতে সম্রাটের মনে হয় যে তানসেন দরবারের প্রধান গায়ক বা নবরত্ন সভার সদস্য হিসেবে উপযুক্ত নয়। এছাড়াও বিভিন্নভাবে সুযোগ খুঁজতে হবে যে তানসেন নবাবের প্রতি বিশ্বস্ত নয় তাহলেই কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে"।

তার কথা শুনে মসনদ আলী বললেন "আপনার এই বক্তব্য কোনমতেই সমর্থনযোগ্য নয় কারণ তানসেনকে অযোগ্য প্রমান করার কোনো রাস্তা নেই। সমস্ত রাগ রাগিনী তার কণ্ঠস্থ। এছাড়াও তিনি এমন কোন কাজ করেননি যে সম্রাটের কাছে প্রমাণ দেওয়া যাবে যে তিনি সম্রাটের প্রতি বিশ্বস্ত নন"। মসনদ আলী বলার পরে দরিয়া খাঁ বললেন "তানসেনের কাছে সঙ্গীত ছাড়া আর কোন আকর্ষনীয় বস্তু নেই। তিনি যদি আমাদের মত কোনভাবে নারী বা সুরাতে আসক্ত থাকতেন তাহলে আমাদের সুযোগ ছিল যে তাকে কোনোভাবে ফাঁদে ফেলা যাবে। কিন্তু সে রাস্তাও বন্ধ, তিনি তো এ পথ মাড়ান না"। সবাই যখন চুপচাপ হলেন মিয়া খোদাবক্স তখন বৈকুণ্ঠনাথকে বললেন "বৈকুণ্ঠনাথ আপনার কোনো বক্তব্য এখানে কি আছে"? বৈকুণ্ঠনাথ মাথা চুলকিয়ে বললেন "একটা পথ আমি দেখতে পাচ্ছি। আপনারা জানেন যে সঙ্গীতে 'দীপক'রাগ নামের একটি রাগ আছে যে রাগ গাইলে বাতাস এত উত্তপ্ত হয় যে দীপ জ্বলে ওঠে এবং গায়কের শরীর সেই রাগের উত্তাপে পুড়ে যায় এমনকি মৃত্যুমুখে পতিত হতে পারেন। স্বামী হরিদাসের কাছে তানসেন থাকাকালীন আমি দেখেছি গুরুজী তানসেন এবং বৈজু বাওরাকে কেবলমাত্র দীপক রাগ রাগের তালিম গিয়েছিলেন। আমরা যদি সম্রাটকে দরবারে অনুরোধ করি তানসেনকে সেই রাগ গাইবার কথা বলতে তাহলে কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে"। মিঞা খোদাবক্স এই কথা শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললেন "আপনি সঠিক কথাই বলেছেন বৈকুণ্ঠ দাস। সম্রাট অনুরোধ করলে তানসেন দীপক রাগ গাইতে না করবেন না এবং দীপক রাগ গাইলে তিনি হয়তোবা মৃত্যুমুখে পতিত হতে পারেন। আর যদি তিনি দীপক রাগ যদি গাইতে রাজী না হন তখন সম্রাট ধরে নেবেন যে তানসেন তাঁর কথাকে উপেক্ষা করলেন এবং সে ক্ষেত্রে তিনি তানসেনের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন"। সেদিনের আলোচনার শেষে সবাই সেই প্রস্তাবে সম্মত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যে পরের দিনে দরবারে তাদের পক্ষ থেকে সম্রাটকে এই অনুরোধ জানানো হবে। এই বলে তারা কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যে যার হাভেলির অভিমুখে গমন করলেন।

প্রতি দিনের দিনলিপি একইভাবে লেখা হচ্ছে। আজও যথারীতি প্রাতঃস্নান ও নিজের রেওয়াজের পরে কন্যা সরস্বতী সংগীত কক্ষে এসে পিতার কাছে তালিম নিতে বসল। বেশ কিছুক্ষণ তাকে তালিম দেওয়ার পরে তানসেন জলযোগ পর্ব শেষ করলেন। এর পরে তাঁর দরবারে যাওয়ার কথা। এমন সময় দরবারের একজন কর্মচারী এসে জানালো যে সম্রাটের নির্দেশে আজ দুপুরের পরিবর্তে সান্ধ্যকালীন দরবার হবে। এই সংবাদে তানসেন কিছুটা বিস্মিত হলেন কারন আজ এমন কি ঘটনা ঘটলো যে দুপুরের দরবার স্থগিত রেখে সান্ধ্যকালীন দরবার হবে। যাই হোক এই সংবাদ শুনে তানসেন নিজের সংগীত কক্ষে প্রবেশ করে রেওয়াজ করতে বসলেন। বিলম্বিত সকালের রাগ আশাবরী দিয়ে শুরু করে জৌনপুরী রাগ গেয়ে যখন উঠলেন তখন সূর্যদেব মধ্যগগনে। ইতিমধ্যে দাসীরা একবার তাঁকে জানিয়ে গেছে মধ্যাহ্নভোজের সময় পেরিয়ে গেছে। অগত্যা রেওয়াজ ছেড়ে উঠে মধ্যাহ্নভোজ শেষ করে পুনরায় কক্ষে প্রবেশ করে গ্রন্থ রচনায় মগ্ন হলেন। সন্ধের পূর্বে দরবারে যাবার পোশাক পরলেন। হাঁটু পর্যন্ত নেমে যাওয়া শুভ্র হাতায়ালা পোশাক, মাথায় আতাপটি পাগড়ি, রেশমের দোপাট্টা বুকের উপরে আড়াআড়িভাবে রাখা, কোমরে চওড়া কোমরবন্ধে গুঁজে রাখা আছে একটি ছোরা। দরবারে যাবার সময় যদিও এই ছোরার কোন প্রয়োজন হয় না তথাপি এই ছোরা কোমরবন্ধে গুঁজে রাখা মোগল দরবারের কেতা। সবাইকেই এই নিয়ম মেনে চলতে হয়।                                      

দরবারে তানসেন যখন পৌছলেন তখনও দিনের আলো আছে অর্থাৎ গোধূলি বেলা। দরবারে প্রায় সকলেই এসে গেছেন কিন্তু সম্রাট তখন এসে পৌঁছাননি। তানসেন নিজের আসনে উপবেশন করার পরে পাশের আসনে উপবিষ্ট বীরবলের কাছে জানতে পারলেন আজকের দরবারের সময় পরিবর্তনের কারণ। মুঘল সেনারা ঝালোয়ার দুর্গে পৌঁছানোর পূর্বেই চিতোরের ভূতপূর্ব মহারানা প্রতাপ সিংহের অতর্কিত আক্রমণে ঝালোয়ার দুর্গ সম্রাট আকবরের হাতছাড়া হয়ে গেছে। যে সামন্ত রাজা ঝালোয়ার দুর্গের দায়িত্বে ছিলেন তিনি প্রানভয়ে পালিয়ে গেছেন। যার জন্য আজ সারাদিন ধরে সম্রাট রাজা মানসিংহ ও অন্যান্য সমরবিশারদদের সাথে পরামর্শ করেছেন কিভাবে ঝালোয়ার দুর্গ পুনরুদ্ধার করা যায়। দুজনের কথাবার্তার মাঝখানে ঘোষণা হল সম্রাট দরবারে আসছেন। অল্প সময় পরে সম্রাট এসে মসনদে আসীন হওয়ার পরে বীরবল প্রস্তাব করলেন "জাহাঁপনা, আজ অন্যদিনের তুলনায় আপনাকে অধিক ক্লান্ত মনে হচ্ছে। এই সময় যেহেতু বহিরাগত দর্শনার্থী কেউ নেই এবং দরবারে যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা না থাকে তাহলে আজকের এই সান্ধ্য দরবারে আপনার হুকুম হলে আমরা সংগীত শ্রবণ করতে পারি। তাতে সারাদিনে আপনার দেহমনে যে ক্লান্তি এসেছে তা দূর হবে"। বীরবলের প্রস্তাব শুনে আকবর বললেন "হ্যাঁ কবিবর, আপনি সঠিক কথাই ব্যক্ত করেছেন"। এই বলে আকবর বাদশা দরিয়া খাঁকে বললেন "আজ আপনার সংগীত শোনানোর পালা, আপনি সংগীত পরিবেশন করা শুরু করুন"। সম্রাটের কথা শুনে দরিয়া খাঁ বললেন "হুজুর যদিও আজ আমার সংগীত শোনানোর পালা তবুও আমার প্রস্তাব আমাদের এই সাতজন সভাগায়কের উর্দ্ধে সংগীত সম্রাট তানসেন। তাঁর কণ্ঠে যে সুরের জাদু আছে আমাদের কারো কন্ঠে তা' নেই। আজ আপনি যখন ক্লান্তি অনুভব করছেন সে ক্ষেত্রে মিঞা তানসেনের কন্ঠের সুর এই দরবারে পরিবেশিত হলে আপনার ক্লান্তি অচিরেই দূর হবে"। দরিয়া খাঁয়ের কথা শুনে সম্রাট তানসেনকে বললেন "সভাগায়কেরা যখন আপনার গান শুনতে আবেদন রাখছেন তাহলে আপনিই আজ আমাদের গান শোনান"। অগত্যা তানসেন বীণাযন্ত্র নিয়ে রাগ 'শুদ্ধ কল্যাণ' গাইতে শুরু করলেন। তানসেনের কন্ঠে আজ যেন রাগ শুদ্ধ কল্যাণ নূতন রূপ পেয়েছে। সুরের মাধুর্যে সবাই বাক্যহারা। দরবারের প্রদীপ্ত প্রদীপের শিখা গুলি কেঁপে কেঁপে উঠছে। তাঁর গান শেষ হতে দরবারে করতালির ঝড় বয়ে গেল। সকলেই ধন্য ধন্য করতে লাগলেন। মিঞা খোদাবক্স আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে সম্রাটকে আদাব জানিয়ে বললেন "হুজুর আজ তানসেনের গান শুনে আমরা প্রত্যেকেই পরিতৃপ্ত। ওঁর কন্ঠের সুরের যাদু যে আমাদের কারও নেই তা আরো একবার প্রমাণ হয়ে গেল"। সম্রাট বললেন "মিঞা খোদাবক্স, আপনি সঠিক মূল্যায়ন করলেন তানসেনকে। সত্যি আমার দেহমনে সারাদিন যে ক্লান্তি পাথরের মত চাপ সৃষ্টি করেছিল তা দূর হয়ে গেল"। মিঞা খোলাবক্স আরো বললেন "হুজুর আমরা শুনেছি সংগীতে দীপক রাগ নামের একটি রাগ আছে। সেই রাগের প্রকৃতি কি আমরা কেউই জানিনা। শুধু তাই নয় সেই রাগ গাওয়ার গায়কি রীতিও আমরা কেউ জানিনা। বহুদিনের ইচ্ছা আপনাকে মুখ ফুটে বলতে পারি নি যে সেই রাগটি আমরা শুনেছি সংগীত সম্রাট তানসেনের আয়ত্তে। আপনার যদি অনুমতি হয় তাহলে মিঞা তানসেন সেই রাগ যদি আমাদের গেয়ে শোনান তাহলে পুনরায় নিজেদের ধন্য মনে করব"।         

মিঞা খোদাবক্সের এই কথা শুনে সম্রাট তানসেনকে জিজ্ঞেস করলেন "সংগীত সম্রাট এ কথা কি সত্য যে আপনি এই রাগ গাইতে জানেন? যদি সত্য হয় তাহলে আপনি এই রাগের বৈশিষ্ট্য কি যদি আমাদের জানান"। সম্রাটের প্রশ্নের উত্তরে তানসেন মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে বললেন "জাহাঁপনা এই রাগের বৈশিষ্ট্য হলো এই রাগ যেস্থানে গাওয়া হবে সেই স্থানের শ্রোতা এবং গায়কের জীবন বিপন্ন হতে পারে"। " কিভাবে"?  প্রশ্ন করলেন সম্রাট। তানসেন উত্তরে বললেন যেখানে এই রাগ গাওয়া হয় সেখানে বাতাস ধীরেধীরে উত্তপ্ত হয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হয়ে অগ্নির প্রদাহে অগ্নি প্রজ্বলিত হয়"। তানসেনের এই কথা শুনে মিঞা খোদাবক্স বললেন "জাহাঁপনা আমার এই কথা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। কারণ এমন কোন রাগের কথা আমাদের জানা নেই যে রাগ গাইলে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হবার সম্ভাবনা থাকে। আমার মনে হয় সংগীত সম্রাট আপনাকে হয়তো এই রাগ শোনাতে অনিচ্ছুক"। মিঞা খোদাবক্সের এই কথা শুনে সম্রাটের অহমিকায় আঘাত লাগলো। তিনি বললেন "উত্তম, সংগীত সম্রাট আমাদের অবশ্যই আগামীকাল এই রাগ গেয়ে শোনাবেন এবং সেক্ষেত্রে দরবারের আধিকারিককে নির্দেশ দেওয়া থাকবে যাতে অগ্নি নির্বাপনের সমস্ত ব্যবস্থা তিনি মজুদ করে রাখেন"। সম্রাটের আদেশ শুনে মিঞা খোদাবক্স মনে মনে অত্যন্ত উৎফুল্ল হলেন, কারণ তাদের গতরাত্রির মন্ত্রণা অনুযায়ী সম্রাট তাদের পরিকল্পনায় সায় দিয়েছেন। এর পরে দেখা যাক তানসেন কিভাবে নিজেকে রক্ষা করেন। তানসেন সম্রাটের আদেশ শুনে বললেন "জাহাঁপনা এই রাগ গাইতে রেওয়াজের প্রয়োজন। সেজন্য আমাকে অন্ততপক্ষে পনের দিন সময় দিতে হবে। তারপরে আপনাকে এই রাগ শোনাবো এবং এই পনের দিন আমাকে দরবারে উপস্থিত থাকতে যেন আদেশ না দেওয়া হয়"। তানসেনের বলার পরে মহেশদাস আসন ছেড়ে উঠে বললেন "সম্রাট তানসেনের কথামতো তাঁকে দীপক রাগের রেওয়াজের জন্য তিনি যে সময় চেয়েছেন তা' যুক্তিসঙ্গত কারণ এটি একটি বিস্মৃতপ্রায় রাগ। রাগটি নিবিড়ভাবে অনুশীলনের জন্য এই সময় তাঁকে দরবারে উপস্থিত থাকার আদেশদানে বিরত থাকা উচিত”। বীরবলের কথা শেষ হতে সম্রাট ঘোষণা করলেন "সঙ্গীতসম্রাট তানসেন ও বীরবল যে কথা বলছেন তা অত্যন্ত ন্যায় সঙ্গত মনে করছি। সেক্ষেত্রে আমরা পনের দিন পরেই তানসেনের কন্ঠে দীপক রাগ শুনবো" - এই বলে সেই দিনের মতো তিনি দরবারের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।       

দরবার শেষ হওয়ার পরে মিঞা খোদাবক্স ও তাঁর সঙ্গীরা দরবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এক নির্জন রাস্তায় নিজেরা তাদের পরিকল্পনা সফল হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠলেন। নিজের হাভেলীতে ফিরে এসে তানসেন চিন্তা করলেন সম্রাটের নির্দেশমতো দীপক রাগ গাইতে গেলে মেঘমাল্লার রাগের গায়কী রীতিতে কাউকে তালিম দিতে হবে এবং সেক্ষেত্রে একমাত্র উপায় ও অবলম্বন কন্যা সরস্বতী।                    
                                                                   ক্রমশঃ
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments